ঈদে নতুন পোষাক পরিধান সম্মন্ধে ইসলাম কি বলে?
ঈদ মানে আনন্দ। ঈদ মানে উৎসব। বছরশেষে আনন্দময় পরিবেশে পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজন সকলকে নিয়ে ঈদ উদযাপন করা ইসলাম ধর্মের অন্যতম অনুসঙ্গ। বছরের দু'টি ঈদ অর্থাৎ, ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহার সময় পালনীয় কিছু সুন্নাত রয়েছে। অবশ্য দু্ই ঈদের বিধানের ক্ষেত্রে কিছু পার্থক্যও রয়েছে।
ঈদুল আযহা সমাগত; তাই ঈদের দিনের কিছু মাসনূন আমল জেনে নিই-
ইমাম তহাভি (রহ.) লিখেন, ঈদুল ফিতরের সকালে কয়েকটি কাজ করা মুস্তাহাব। গোসল করা, মিসওয়াক করা, সুগন্ধি লাগানো, সদকাতুল ফিতর আদায় করা, ঈদের নামাজ পড়তে বের হবার আগে কিছু খেয়ে নেয়া এবং কাছে থাকা পোষাকসমূহের মাঝে সবচেয়ে সুন্দর পোষাক পরিধান করা। -শারহু মুখতাসারুত তাহাবি ২/১৪৯
শুধু সদকাতুল ফিতর আদায় যেহেতু পবিত্র রমজান শেষে ঈদুল ফিতরের সাথে সম্পর্কিত। তাই এটি ছাড়া বাকি কাজগুলো ঈদুল আযহার দিনের জন্য উত্তম পালনীয়।
ইমাম তহাভি ছাড়া অন্য সব মুহাদ্দিস বা ফকীহও একই কথা বলেছেন। ঈদের দিনে নতুন পোষাক নয়; প্রত্যেকের কাছে যে কাপড়গুলো আছে এর ভেতর সুন্দরটা পরিধান করবে।
ফিকহের ইমামের উদ্ধৃতি উল্লেখ করতে হল, কারণ হাদিসে ঈদের দিনে নতুন কাপড় পরিধানের বিষয়ে তেমন কিছুই বর্ণিত হয়নি। ইমাম বুখারী (রহ.) একটি হাদিস উল্লেখ করেছেন, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু বর্ণনা করেন, একবার হযরত উমর রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু মদীনার বাজার থেকে একটি রেশমের কাপড় আনলেন রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জন্য।
হযরত উমর নবীজীকে বললেন, হে আল্লাহর রাসুল, এ পোষাকটি আপনি ঈদের দিন এবং বাইরে থেকে বিভিন্ন গোত্রের প্রতিনিধি দল আসলে পরিধান করবেন। রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত উমররাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহুকে বললেন, এ পোষাক পরিধান করবে সে ব্যক্তি আখেরাতে যার কোনো অংশ নেই। -সহিহ বুখারী, হাদিস নং ৯৪৮
রেশমের কাপড় হওয়ার কারণে রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পোষাকটি গ্রহণ করেননি। কারণ, ইসলামী শরিয়তে পুরুষের জন্য রেশম পরিধান করা নিষিদ্ধ। নারীরা রেশম ব্যবহার করতে পারে।
হজরত উমরের (রা.) হাদিসে দেখা যাচ্ছে, রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জন্য একটি নতুন পোষাক কিনে আনা হয়েছিল কিন্তু তিনি সে পোষাক পরেননি। অন্য কোনো বর্ণনায়ও রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈদের দিন নতুন পোষাক পরেছেন বলে কোনো বিবরণ পাওয়া যায় না।
কিন্তু আমাদের বর্তমান মুসলিম সমাজে নতুন পোষাক পরার রেওয়াজ চলে আসছে বহু দিন ধরে। সাহাবিদের যুগের যেসব বর্ণনা পাই সেখানেও দেখা যাচ্ছে তারা ঈদের দিন তাদের কাছে থাকা উৎকৃষ্ট কাপড় পরিধান করতেন। -বাইহাকি দ্রষ্টব্য
নতুন কাপড় কেনার কোনো কথা সাহাবি যুগেও পাওয়া যায় না। তবে অবশ্যই নতুন কাপড় কেনার অনুমতি রয়েছে। ইসলামী শরিয়াতে এতে কোনো বাধাও নেই। যে কেউ যে কোনো সময় কাপড় কিনতে পারে। ঈদের সময় আনন্দ প্রকাশের জন্য নতুন কাপড় কিনতেই পারে। এটাকে সুন্নাত না মনে করলেই হলো। সমাজে কেউ সুন্নাত মনে করে নতুন কাপড় ক্রয় করে বলে মনে হয় না। ঈদ উপলক্ষে মার্কেটে যাওয়া যাবে না- এমন ফতোয়া দেয়া ঠিক হবে না।
শরীয়াতে কেবল একটি নির্দেশনা দেয়া আছে, আর তা হচ্ছে ইসরাফ না করার কথা। অর্থাৎ পোষাক সংগ্রহ করতে খুব বাড়াবাড়ি না করা। অপচয় বা অপব্যয় না করা। কারণ, অপচয় বা অপব্যয় থেকে বেঁচে থাকার নির্দেশ স্বয়ং আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা দিয়েছেন। পবিত্র কুরআনুল হাকিমে ইরশাদ হয়েছে-
وَآتِ ذَا الْقُرْبَى حَقَّهُ وَالْمِسْكِينَ وَابْنَ السَّبِيلِ وَلاَ تُبَذِّرْ تَبْذِيرًا
আত্নীয়-স্বজনকে তার হক দান কর এবং অভাবগ্রস্ত ও মুসাফিরকেও। এবং কিছুতেই অপব্যয় করো না। -সূরা আল ইসরা, আয়াত ২৬
إِنَّ الْمُبَذِّرِينَ كَانُواْ إِخْوَانَ الشَّيَاطِينِ وَكَانَ الشَّيْطَانُ لِرَبِّهِ كَفُورًا
নিশ্চয় অপব্যয়কারীরা শয়তানের ভাই। শয়তান স্বীয় পালনকর্তার প্রতি অতিশয় অকৃতজ্ঞ। -সূরা আল ইসরা, আয়াত ২৭
يَا بَنِي آدَمَ خُذُواْ زِينَتَكُمْ عِندَ كُلِّ مَسْجِدٍ وكُلُواْ وَاشْرَبُواْ وَلاَ تُسْرِفُواْ إِنَّهُ لاَ يُحِبُّ الْمُسْرِفِينَ
হে বনী-আদম! তোমরা প্রত্যেক নামাযের সময় সাজসজ্জা পরিধান করে নাও, খাও ও পান কর এবং অপব্যয় করো না। তিনি অপব্যয়ীদেরকে পছন্দ করেন না। -সূরা আল আ'রাফ, আয়াত ৩১
বর্তমান সময়ের বিত্তশালীগণ যারা মনে করেন বিদেশের নামীদামী মার্কেটে না গেলে ঈদ শপিংয়ের হক আদায় হয় না, ঈদ শপিংয়ের ক্ষেত্রে যে অতিরঞ্জন তারা করে থাকেন তা অনেক ক্ষেত্রে ইসরাফের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায় কি না - ভেবে দেখা উচিত।
বর্তমানে যে কঠিন সময় আমরা অতিবাহিত করছি এ পরিস্থিতিতে অপচয়ের চিন্তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে অন্য আরেকটি বিষয়। আমাদের সবার চোখ এখন করোনার দিকে। করোনাভাইরাসের ভয়ে সবাই আমরা ভীত। তারপরও শপিং করার লোভ সংবরণ করতে পারছি কি? অবশ্য একান্ত প্রয়োজন হলে তো না কিনে উপায় থাকে না। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে করোনা ভীতি নয়, সতর্কতা এবং দায়িত্বশীলতা কাম্য।
নতুন পোষাক ছাড়া কি ঈদ হয়- মনের ভেতর এই প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে থাকে। অষ্টপ্রহর এই দুশ্চিন্তা মনে বাসা বেধে থাকে। ঈদে নতুন কাপড় কেনা হয়নি বলে পুরো ঈদটাই যেন মাটি হবার যোগার। অথচ বাসায় কাপড় আছে অনেক। দশ সেট হবে কম করে হলেও। তবু নতুন কাপড় কেনা হয়নি বলে চেহারা বিমর্ষ। মন মরা। আসলে এমন একটা ভুল মনোভাব শয়তান আমাদের ভেতর ছড়িয়ে দিচ্ছে, যাতে ঈদের খায়ের, বরকত এবং আনন্দ- সকল কিছু থেকে আমাকে বঞ্চিত করা সম্ভব হয়।
মূলত ঈদের তাৎপর্য বুঝতে অক্ষম আজকের মুসলিম। পবিত্র ঈদের আধ্যাত্মিক, সামাজিক ও মানবিক দিকগুলো আমাদের সমাজ থেকে হারিয়ে গেছে। নতুন কাপড় পরার নামই ঈদ নয়।
ঈদের খুতবায় খতিবরা ঈদের দিন এই লাইনটিও বলেন, লাইসাল ঈদু লুবসুল জাদিদ.. নতুন পোষাক পরার নাম ঈদ নয়। মনকে নতুন করতে হবে। নতুন করে শুরু করতে হবে জীবন। মনকে নতুন করা হচ্ছে ঈদের আধ্যাত্মিক দিক। সব ধরনের পাপ চিন্তা থেকে মনকে পরিচ্ছন্ন করে ফেলতে হবে।
সামাজিক দিক হচ্ছে, আত্মীয়-স্বজন পাড়া-প্রতিবেশী ও বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে সময় কাটানো ও তাদেরকে দাওয়াত করা। সালামি দেয়া, ঈদের শুভেচ্ছা জানানো এবং আরও যেসব সামাজিক বিষয় আছে সেগুলো সম্পন্ন করা। হাদিসেও এর নির্দেশনা রয়েছে।
আর ঈদের মানবিক দিক হচ্ছে- আনন্দটা সুবিধা বঞ্চিত, দুস্থ এবং অসহায় মানুষের ভেতরে ছড়িয়ে দেয়া। একা একা ঈদ করা নয়, অন্য সবাইকে নিয়ে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করার মাঝেই তো ঈদের প্রকৃত ত্যাগ ও বিসর্জনের মাহাত্ম্য। ঈদের আনন্দে সব মানুষকে শরিক করতে না পারলে একাকি আনন্দ করা যায়, কিন্ত সেটাকে ঈদ বলা যায় কি?
আধ্যাত্মিক, সামাজিক ও মানবিক ভাবনাহীন ঈদ মগজহীন খোলসের মত। এই তিনটি হচ্ছে ইদের প্রাণ। মার্কেটে না গেলে ঈদ হবে না- এমন নয়। কিন্তু এই তিনটি বিষয় না হলে ঈদ নয়; আপনার জন্য ওয়াইদ অর্থাৎ আল্লাহর পক্ষ থেকে ধমকি রয়েছে। আত্মকেন্দ্রিক, বখিল এবং স্বার্থপরকে আল্লাহ তাআ'লাও পছন্দ করেন না।
করোনায় পথে বসে গেছে বহু পরিবার। কাজকর্ম হারিয়ে দিশেহারা সেই মানুষদের চোখে ঈদের নতুন কাপড় কেনার স্বপ্ন নেই। নতুন কাপড় কেনা তো দূরের কথা, দু'বেলা খাওয়ার মত চালটাও নেই তাদের অনেকের কাছে।
করোনার পাশাপাশি দেশের বন্যা পরিস্থিতিও ক্রমে খারাপের দিকে যাচ্ছে। বন্যার্ত বানভাষী বিপন্ন মানুষের কষ্টের দিকে তাকিয়ে ঈদ শপিং কিছুটা হলেও রয়েসয়ে করা যায় কি না, ভেবে দেখা উচিত। এই একটা বছর শপিং একটু কম করলে তেমন ক্ষতি কি? এবারের ঈদে আসুন, দরিদ্র ও নিম্ন মধ্যবিত্তের অসহায়, অভূক্ত এবং দুস্থ মানুষের প্রতি সহায়তার হাত প্রসারিত করার চেষ্টা করি। একটু হলেও করি। যতটুকু পারি করি। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআ'লা আমাদের তাওফিক দিন। আমীন।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে জুলাই, ২০২০ সকাল ৯:৪৫