বিবাহ সহীহ হওয়ার জন্য সর্বনিম্ন মহরের পরিমান এবং মহরে ফাতেমীর পরিচয় ও বর্তমান বাজারে তার মূল্যমান
বিয়েতে অধিকাংশ অভিভাবকই মহরে ফাতেমি নির্ধারণ করতে চান। এটা হয়তো অনেকেই বরকতের জন্য করতে চান। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মহরে ফাতেমির পরিমাণ বা বর্তমান বাজার মূল্য নির্ধারণে দেখা দেয় জটিলতা। ফলে ভোগান্তিতে পড়তে হয় বর এবং কনে উভয় পক্ষকে। আসলে বাজার মূল্য তো একই জায়গায় স্থির থাকে না। ওঠানামা করে। আসলে ভুল বললাম বোধ হয়! বাজার কখনো সম্ভবতঃ নামে না। অন্ততঃ আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে। এখানে শুধু ওঠে। উঠতেই থাকে। উঠতেই থাকে। শুধুই উঠাউঠির খেলা। বাজারের ধাক্কায় আমরা জনগণও কেবল উপরে উঠি। দিনকে দিন উপরে উঠতে থাকি। উঠতেই থাকি। অনেক উপরে। উপরে উঠতে উঠতে আমরা ৩০ টাকার পিয়াজ ৩০০ টাকায় কিনে বসি। ২০০ টাকায় কাঁচা মরিচ কিনে মরিচের ঝাল শুকে দেখতে থাকি কখনো কখনো। আমাদের দেশে উপরে উঠার এই হার জ্যামিতিক আকার ধারণ করে অনেক কিছুর ক্ষেত্রেই।
লক্ষাধিক টাকা দামের মোটাতাজা একটি গরুর চামড়া যে দেশে ২০০ থেকে ২৫০ টাকা বিক্রি করার পরে সেই চামড়াটিতেই নির্মিত প্রতি জোড়া জুতা ৩০০০ থেকে ৫০০০ টাকা দিয়ে যারা কিনে নিতে অভ্যস্ত, আমরা তো সেই দেশেরই ভাগ্যবান মানুষ! তো, আমাদের এখানে কোনো কিছুর বাজার দর নেমে গেছে, আর সাধারণ মানুষ তার সুফল ভোগ করছেন, এমন দৃষ্টান্তের দেখা যে সচরাচর মেলে না- সে কথা আশা করি, কাউকে হলফ করে বুঝানোর প্রয়োজন হবে না। কালে ভদ্রে যদি ব্যতিক্রম কিছু না ঘটে। অর্থাৎ, ইল্লা- মা- শাআল্লাহ!
যাক, বিয়ে নিয়ে এই তল্লাটে গত ক'দিনে রীতিমত যেনতেন একটা ঝড়ের তান্ডব গেছে এমনিতেই। চার বিয়ে জায়েজ কি নাজায়েজ, জায়েজ হলেও তা কখন এবং কোন প্রেক্ষিতে ইত্যাদি নিয়ে বেশ উষ্ণাবস্থা বিরাজ করছিল। বিস্তর কথা হয়েছে এ নিয়ে। তাই ভয়ও আছে, বিয়ে সংক্রান্ত কিছু বলতে গেলে আমাকে আবার কেউ ভুল বুঝে বসেন কি না কে জানে! যাক, বুঝলে বুঝুন। কিন্তু বুঝেই যদি থাকেন, তাহলে শুধু চুপ না থেকে সহায়তার হাত বাড়িয়ে একটু এগিয়েও আসুন না, বেচারা আমার কথা চিন্তা করে! যাক, প্রসঙ্গটি যখন সামনে এসেই গেল, সামান্য একটু ইঙ্গিত দিয়ে যাই। একচুয়ালি, চারটি পর্যন্ত বিয়ে জায়েজ। আল্লাহ তাআ'লা শর্তাধীনে চারটি পর্যন্ত বিয়ের সুযোগ রেখেছেন এটা ঠিক। কিন্তু এর বিপরীতে একটি কথা অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, একাধিক বিয়েকে ইসলাম উৎসাহিত করেনি। ইসলামের প্রাথমিক যুগে প্রয়োজন বিবেচনায় বহুবিবাহ লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু ইনসাফ এবং সমতা রক্ষার মত যেসব কঠিন শর্ত একাধিক বিয়ের সাথে যুক্ত করে দেয়া হয়েছে, একাধিক বিয়ে করে কেউ যদি এসব শর্ত লঙ্ঘন করেন তাদের জন্য আল্লাহ তাআ'লার পক্ষ হতে শাস্তিরও ইঙ্গিত পরিষ্কার। কেননা সূরা নিসার ১২৯ নং আয়াতে বলা হয়েছে -
'তোমরা কখনও নারীদের মাঝে ন্যায় সঙ্গত ও সমতাপূর্ণ আচরণ করতে পারবে না। অতএব,সাধ্যমতো চেষ্টা করো যাতে একবারে একদিকে ঝুঁকে না পড়ো, যাতে আরেকজনকে ফেলে রাখতে হয় দায়িত্বহীনের মতো। জেনে রেখো, যদি সংশোধনের পথ এবং খোদাভীরুতার পথ অবলম্বন করো, তবে আল্লাহ্ ক্ষমাশীল, করুণাময়।' -সূরা নিসা, আয়াত-১২৯
উল্লেখিত আয়াতের মর্ম অনুধাবন করলে সহজেই বুঝা যায় যে, চারটি পর্যন্ত বিয়ে জায়েজ হলেও মুক্তির সহজ পথ হচ্ছে- একটিমাত্র বিয়েতে সন্তুষ্ট থাকার ভেতরে; কারণ, ফিতনা থেকে বেঁচে থাকতে এটা অধিকতর সহজ পথ। আসলে চার বিয়ে করে সকল বিবির প্রতি কোনোভাবেই ন্যয় বিচার ও সমতাপুর্ণ আচরন করা সম্ভব নয় বলেই তাতে রয়েছে অবধারিত শাস্তি। এরপরেও এক বিয়েতে ক্ষান্ত না হয়ে নানাবিধ ঠুনকো অযুহাত দেখিয়ে যারা চার বিয়ের পক্ষপাতি তাদেরকে বাস্তবতার প্রেক্ষিতে বিষয়টি বুঝতে হবে। আল্লাহ তাআ'লা তার কালামের একাংশে থাকা এক বিয়ের যে কথা বলেছেন তাতেই রয়েছে অধিক মঙ্গল। অধিক কল্যান। সুতরাং, সাধারণভাবে থিতু থাকা উচিত তাতেই।
চার চারটি বা একাধিক বিয়ে করে স্ত্রীদের ভেতরে ইনসাফ ও সমতা রক্ষার শর্ত ভঙ্গ করলে আল্লাহ তাআ'লার পক্ষ হতে পরকালিন শাস্তি অপেক্ষা করছে- বিষয়টি শুধুই এমন নয়, বাস্তবিকতার আলোকে এর অনেক কুফল এ দুনিয়াতেই অনেককে পেতে দেখা যায়। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে কিছু পরিবারে এমন দৃশ্য খুবই স্বাভাবিক যেখানে সতীনে সতীনে ঝগড়াঝাটি থেকে শুরু করে নানাবিধ কলহ বিবাদ লেগেই থাকে। অবস্থা ভেদে অনেক ক্ষেত্রে এসব ঝগড়াঝাটি শুধু ঝগড়াঝাটিতেই থেমে থাকে না। মারামারি কিংবা খুনোখুনির ঘটনায় গিয়ে এর পরিসমাপ্তি ঘটে। আর এসবের ফলে ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে নেমে আসে অশান্তির কালো ছায়া। তাই একাধিক বিয়ে জায়েজ বলেই যখন তখন একাধিক বিয়ের চিন্তা মাথায় আনা যাবে না। মনে রাখতে হবে, এই সুযোগটা রাখা হয়েছে বিশেষ প্রয়োজনের ক্ষেত্র বিবেচনা করে। অন্যান্য শর্ত পূরণের পাশাপাশি এর জন্য বিশেষ আর্থিক স্বচ্ছলতারও একটি ব্যাপার রয়েছে। যা লঙ্ঘন করলে তার জীবন দুর্বিসহ নিশ্চিত। দুনিয়া ও আখিরাত সবই তার ধ্বংসের মুখে পড়তে বাধ্য।
বহুবিবাহ যারা করবেন, তাদের আমলের প্রতিদান দেয়া হবে তাদেরকেইঃ
একের বোঝা অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়া হবে না। একের ভুলের কৈফিয়ত অন্যের কাছ থেকে গ্রহন করা হবে না। অতএব, বুঝে শুনে যারা একাধিক বিয়ে যারা করছেন বা করবেন, তাদের পারিবারিক জীবনে তারা ভুলভ্রান্তি করে থাকলে তার দায়ভার কিন্তু আপনার আমার উপরে চাপিয়ে দেয়া হবে না কখনোই। কারণ, এমনটি আল্লাহ তাআ'লা কখনোই করবেন না। তিনি ন্যায় বিচারক। তাঁর কাছে কোনো পক্ষপাতিত্ব থাকবে না। তিনি সর্বজ্ঞাত এবং সূক্ষ্মদর্শী। সুতরাং, যারা একাধিক বিয়ে করেন, আমাদের ধারণা, তারা এটা বুঝে শুনেই করে থাকেন। আর সর্বোপরি, একাধিক বিয়ে করার ফলে তারা নিন্দনীয় নাজায়েজ বা হারাম কোনো কাজও নিশ্চয়ই করেন না। তাই তাদের প্রতি রুষ্ট হওয়া অনভিপ্রেত। বুঝতে হবে, নিতান্ত দায়ে না ঠেকলে এই শাখের করাতে কেউ পা দিতে যাওয়ার কথা নয়।
মূল বিষয়ে ফিরে যাই চলুন। এমনিতেই এক বিয়ে নিয়েই ত্রাহি অবস্থা! তার উপরে বহুবিবাহ! বাবা, মাফও চাই দুআও চাই। তারচেয়ে চলুন, যারা বিয়ে করেনি তাদের কথা ভেবে মহরে ফাতেমির বর্তমান বাজার মূল্যের পরিমাণটা একটু হিসাব করে দেখি-
বিবাহ সহীহ হওয়ার জন্য সর্বনিম্ন মহরের পরিমান
বিবাহের সর্বনিম্ন মহর দশ দিরহাম বা দুই তোলা সাড়ে সাত মাশা অর্থাৎ, ৩০.৬১৮ গ্রাম রূপা। -শরহু মুখতাসারিত তাহাবী ৪/৩৯৮
মহরে ফাতেমীর পরিচয় ও বর্তমান বাজারে তার মূল্যমান
রাসুলুল্লাহ ﷺ -এর মেয়ে ফাতিমা রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহা -এর মহর ছিল পাঁচশো দিরহাম। এটাকেই মহরে ফাতেমী বলা হয়। এক দিরহামের ওজন হল ৩.০৬১৮ গ্রাম। সে হিসেবে ৫০০ দিরহাম এর পরিমান হচ্ছে- ১৩১.২৫ তোলা বা ১.৫৩০৯ কিলোগ্রাম রূপা।
মুহাম্মদ ইবন ইবরাহিম রহ. বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ ﷺ -এর মেয়ে ও স্ত্রীগণের মহর ছিল পাঁচশত দিরহাম অর্থাৎ সাড়ে বার উকিয়া। -তাবাকাতে ইবনে সাদ ৮/২২
ইমাম নববী রহ. মাজমু’ গ্রন্থে বলেন, মহর পাঁচশ দেরহামের বেশি না হওয়া মুস্তাহাব। এটা রাসুলুল্লাহ ﷺ -এর স্ত্রীগণ ও কন্যাদের মহর ছিল।
বর্তমান যুগে প্রচলিত পরিমাপের এককে প্রকাশে সুবিধা বিবেচনায় মুফতি মুহাম্মদ শফী রহ. ৫০০ দিরহাম এর পরিমাণ ১৩১ তোলা ৩ মাশার সমান বলে উল্লেখ করেছেন। যা প্রচলিত গ্রামের ওজন অনুসারে ১ কিলো ৫৩০ গ্রাম ৯০০ মিলিগ্রামের সমান হয়।
উল্লেখ্য, বর্তমানে ১২ গ্রামের তোলা প্রচলিত নয়; বরং ১০ গ্রামের তোলা হিসাবে সোনারূপা বেচাকেনা হয়। সে হিসাবে বর্তমানে মহরে ফাতেমির পরিমান দাঁড়ায় ১ কিলো ৫৩০ গ্রাম ৯০০ মিলিগ্রাম বা প্রায় ১৫৪ তোলা রূপা।
বাংলাদেশে তোলা ও ভরি দিয়ে একই পরিমাপ বোঝানো হয়। বর্তমানে এক তোলা রূপার বাজার মূল্য আনুমানিক (বাজার ওঠানামায় কিছু কম বেশি হতে পারে) ১ হাজার ৫০ টাকা। সে হিসেবে ১৫৪ তোলা রূপার দাম হয় ১,৬১,৭০০/- (এক লক্ষ একষট্টি হাজার সাত শত) টাকা মাত্র।
সকল অবিবাহিতদের জন্য নিবেদিত এই লেখাটি। তাদের যদি সামান্য কাজে আসে সেই আশায়.......
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে আগস্ট, ২০২০ দুপুর ২:১০