তুমি জাগলেই আবার আলোকিত হয়ে উঠবে পৃথিবী
কাফির, মুনাফিক এবং মুশরিক -এইসব শব্দ বলা থেকে সঙ্গত কারণে কিছু কিছু সময় আমাদের বিরত থাকতে হয়। এই শব্দগুলো আরবি ভাষার। পবিত্র কুরআনেও এসেছে আলোচ্য শব্দ তিনটি। এগুলোর অর্থ- যথাক্রমে 'অবিশ্বাসী', 'দ্বি-চারী' এবং 'অংশীবাদী'। এই অর্থগুলো সারা দিন বললেও কাউকে তেমন গা করতে দেখা যায় না। কিন্তু আরবি মূল শব্দটা সারা দিন নয়, মাত্র একবার বলুন, দেখবেন আশপাশের লোকজনের প্রতিক্রিয়া কেমন হয়। এ এক আশ্চর্য্য! আরবি শব্দ বললে কারও কারও কাছে তা হয়ে যায় ধিক্কার বা গালাগাল সমতুল্য। বাংলায় একই শব্দের অর্থ বললে কোনো আপত্তি ওঠে না। আজব বটে! এমনটা শুধুমাত্র আরবি শব্দের অর্থ না বুঝার কারণেই ঘটে বলে মনে হয় না।
যাক, আমরা বাংলাদেশী। বাংলাভাষাভাষী। বাংলা শব্দই ব্যবহার করছি। আমাদের স্বভাবসুলভ দ্বি-চারিতা, ধর্মীয় বিষয়াদিতে চরম নির্লিপ্ততা ও নিষ্কৃয়তা এবং জাগতিক ও পারকালিন অধিকাংশ ব্যাপারে শৈথিল্য আর উদাসীনতার পরিণাম দেখছি আমরা। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁর ইসলাম এবং মুসলিম বিদ্বেষমূলক কথাবার্তা ও কর্মকান্ডের ফলে সৃষ্ট ঘোলাটে পরিস্থিতির সুযোগ বিভিন্নজন বিভিন্নভাবে নিতে চেষ্টা করছেন।
অনেকে আনন্দে আত্মহারা হয়ে বগল বাজাচ্ছেন। বলি, বাবা, বগল আপনি বাজান কিছু সময়। বগল বাজানো খারাপ কিছু নয়। শরীরবৃত্তীয় দারুন একটি কাজ এটি। যাদের নিয়মিত ব্যায়াম করার সুযোগ হয় না, তাদের জন্য বগল বাজানো উত্তম ব্যায়ামও বটে! তাছাড়া এমন সুযোগ হাতছাড়া করা নেহায়েত বোকামি। ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁর মত যোগ্য লোক আবার কবে প্রেসিডেন্ট হয়ে ফ্রান্সের মসনদ আলোকিত করবেন, কে জানে! সুতরাং, বগল বাজানোর সম্ভবতঃ এটাই মোক্ষম সময়। আরে আপনারা তো আপনারা! ক'দিন ধরে স্বচক্ষে দেখে যাচ্ছি, হাত নেই এমন পঙ্গুদেরাও খুশিতে তালি বাজানোর চেষ্টায় লাফালাফি করে যাচ্ছেন। সে এক মজার দৃশ্য বটে। ম্যাক্রোঁকে কেউ কেউ মাথায় তুলতে চান। ভারতকে ম্যাক্রোঁর পথে হাটতে একদম ফ্রিতে উপদেশ দান করে যাচ্ছেন। আহ! কি অসাধারণ উদারতা! বিনা ফি-তে অবাধ উপদেশ বিতরণ! মানুষ যে কতটা উপরে উঠতে পারেন, এসব মহান ব্যক্তিদের এসব আচরণ না দেখলে তা বিশ্বাস করারই সুযোগ হতো না! ধন্য ধন্য! ফ্রান্সের লক্ষ লক্ষ মুসলিমের এই দুঃসময়ে আপনাদের একটু আধটু আনন্দ করার অধিকার থাকাই উচিত।
এক শিক্ষককে গলা কেটে খুন করা হয়েছে। ফ্রান্সে। তার ব্যাপারে জানা যায়, তিনি ইসলামের নবী মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ঘৃণ্য ব্যাঙ্গচিত্র প্রদর্শন করেছেন তার দেশে। তার হত্যাকারী হিসেবে যাকে চিহ্নিত করা হয়েছে তিনি নেই। তাকে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গুলি করে মেরে ফেলেছেন। এই যে অপরাধীকে আইনের সামনে, আদালতের সামনে উপস্থাপন না করে, সাথে সাথে গুলি করে মেরে ফেলে অভিযুক্তের মুখ চির দিনের জন্য বন্ধ করে দেয়া হলো, এই ঘটনাই জন্ম দিয়েছে অনেক প্রশ্নের। আসলেই তিনি কি এই হত্যাকান্ডটি সংঘটনে জড়িত ছিলেন? না কি, একটা নাটক সাজানোর উদ্দেশ্যে স্রেফ বলির পাঠা বানাতেই তাৎক্ষনিকভাবে তাকে গুলি করে খুন করে ঘটনা এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো- এই প্রশ্ন এখন ঘুরেফিরে আসছে বারবার।
যেভাবেই হোক, শিক্ষককে গলা কেটে খুনের ঘটনাটা কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। এটি যে কোনো বিচারে নিন্দনীয়। পুলিশের গুলিতে নিহত ব্যক্তি শিক্ষককে সত্যি সত্যি খুন করে থাকলে তারও বিচার হতে পারতো। অপরাধী ব্যক্তির বিচার আমরাও চাই। কিন্তু একজন অপরাধীর দায় পুরো জাতির উপরে চাপানোর মানে কি? ২০১৯ সালের ১৫ মার্চ নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চের দু'টি মসজিদে বন্দুক হামলা চালায় স্বঘোষিত শ্বেতাঙ্গ চরমপন্থী অস্ট্রেলিয়ান নাগরিক ব্রেন্টন ট্যারেন্ট। ২৮ বছর বয়সী ব্রেন্টনের ওই হামলায় নিহত হন ৫১ জন মুসলিম নিহত হলেও তার একার দায়ভার তো খৃষ্টান জাতির উপরে চাপানোর কথা কোনো মুসলিম একটিবারও বলেছেন বলে শোনা যায়নি।
প্রত্যেক ধর্মের লোকদের অপরাপর ধর্মের প্রতি সাধারণ শ্রদ্ধাবোধ থাকা উচিত। ঘটনা যা-ই হোক, ফ্রান্সের ঘটনার ধারাবাহিকতা লক্ষ্য করলে মুসলিমদের নির্লিপ্ততা চোখে পড়ে। একমাত্র এরদোগান ছাড়া কাউকে তেমন কথা বলতে দেখা যায় না। বাকি দেশগুলোর কি কোনো দায়িত্ব নেই?
অর্থকড়ি যাদের যথেষ্ট রয়েছে- এমন মুসলিম দেশগুলোর কোনো রা নেই। কারণ কি? এর কারণ হচ্ছে- তারা বিলাস ব্যসনে এতটাই মত্ত যে, বাদবাকি বিশ্বের কোথায় কে মরলো আর কে বাঁচলো, এসব খবর নেয়ার ফুরসত তাদের নেই। ঘুমন্ত না হয়েও ঘুমের ভান ধরে থাকা ব্যক্তিকে জাগায় সাধ্য কার?
অতি ক্ষুদ্র স্বার্থের কারণে স্বজাতির প্রতি গাদ্দারির প্রমান আমাদের সামনে বহু বিদ্যমান। সাম্প্রতিককালের সর্বশেষ দৃষ্টান্ত, কিছু আরব রাষ্ট্র অবৈধ দখলদার খুনি ইসরায়েলের সাথে দোস্তি পাতাচ্ছে। এত দিন গোপনে থাকলেও এখন প্রকাশ্যে ফিলিস্তিনের লক্ষ লক্ষ মায়ের বুক খালি করে, তাদের স্বাধীনতার স্বপ্নকে ধুলিস্যাৎ করে তাদেরই মাটিতে জেঁকে বসা এই দৈত্যের সাথে হাত বুক সবই মেলাচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যের বিষফোড়া খ্যাত এই ইসরায়েল নামক অবধৈ অস্ত্রের ভান্ডার এসব দ্বি-চারী স্বভাবের নামকাওয়াস্তে মুসলিমদের পদতলে পিষ্ট করে একদিন কচুকাটা করলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
'দ্বি-চারিতা' পরিহার করে ইসলামের আদর্শে সত্যিকারার্থে আদর্শবান হতে পারলে বগল বাজানো তো পরের কথা, ম্যাক্রোঁ বা অন্য কারও শক্তি নেই, পৃথিবীর এমন কোনো অপশক্তি নেই যে, মুসলিমদের চোখ রাঙিয়ে কথা বলে। দুঃশাসনের যাতাকলে তাদেরকে বন্দি করে। গোলামীর জিঞ্জির পড়ায় তাদের গলায়!
আজকের মুসলিম বিশ্বের নেতাদের দিকে তাকালে সত্যিই অন্তর ফেটে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। প্রাণের জন্য প্রাণে মায়া নেই তাদের। স্বজাতি বিজাতি কারও জন্যই অন্তর কাঁদে না তাদের। কে বাঁচলো আর কে মরলো - যেন কোনো দায়বোধ তাদের স্পর্শও করে না! সকল অনুভূতি, স্পর্শ আর ভাব অনুভবের উর্ধ্বে ওঠেন যারা তাদের তো মানুষ বলা যায় না। তারা মহামানব কিংবা অতিমানব। আজকের এই মহামানব কিংবা অতিমানবদের দেখলে আফসোসে অন্তর বিদীর্ণ হয়। অস্ফুটে মুখ থেকে বেরিয়ে আসে -
আত্মভোলা মুসলিম! ওঠো তুমি, আর কতকাল ঘুমিয়ে রবে,
বেলা তোমার যায় ফুরিয়ে-মগ্ন তুমি গভীর ঘুমে, জাগবে কবে!
তাই বলি, মুসলিম তুমি জাগো। ঘুমিয়ে থাকার সময় এখন নয়। তুমি জাগো। জেগে ওঠো। কান পেতে শোনো, দিকে দিকে মজলুমানের কান্নার আওয়াজে ভারী হয়ে আসছে আকাশ বাতাস। অবিচার অনাচার অন্যায়ের সয়লাবে ভেসে যাচ্ছে বনি আদমের বেঁচে থাকার নূন্যতম অধিকার। আজ জাতিগত বিভেদের সীমারেখা টেনে পাশ্চাত্বের আধুনিকতার ছদ্মবেশী সত্যিকারের ধর্মান্ধরা গলা ধরাধরি করে একত্রিত হয়েছে। সবাই একই সুরে কলতান তুলছে, মুসলিম হটাও। মুসলিমদের গলা চেপে ধরতে সকলেই মরিয়া।
তুমি ওঠো। ন্যায় ইনসাফের বাণী শোনাও। ঘৃণা নয়, ভালোবাসার বাণী শোনাও বিশ্ববাসীকে। প্রিয় নবীজীর অতুলনীয় ক্ষমা আর জাতিধর্মবর্ণ নির্বিশেষে মানব জাতির প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা, হৃদয়ের মমত্ব; শত্রুর প্রতিও সদয় হওয়ার সেই ঐশী শিক্ষার পয়গাম পৌঁছে দাও দিকে দিকে, ঘরে ঘরে, জনে জনে, দ্বারে দ্বারে।
তুমি জাগলেই, হ্যাঁ, তুমি জাগলেই আবার আলোকিত হয়ে উঠবে পৃথিবী।
উৎসর্গঃ সুলেখক ব্লগার নীল আকাশকে উৎসর্গ করছি ক্ষুদ্র এই লেখাটি। মূলতঃ তার কোনো একটি পোস্টে মন্তব্য করতে গিয়েই এই লেখাটির অবতারণা। তার প্রতি কৃতজ্ঞতাসহ অনেক অনেক দুআ শুভকামনা।
সাথে থাকা এবং পাঠের জন্য কৃতজ্ঞতা জানবেন।
ক্রাইস্টচার্চের আল নূর মসজিদ - নিউজিল্যান্ডের যে দুটো মসজিদে হামলা হয়েছিল তার একটি এই মসজিদ, ছবি কৃতজ্ঞতাঃ অন্তর্জাল।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে অক্টোবর, ২০২০ দুপুর ২:০৯