নামাজে উচ্চ এবং নিম্ন স্বরে কিরাআত পাঠের হিকমতঃ
আসিমের খটকা একটার পর একটা লেগেই থাকে। নতুন করে আবার খটকা লেগেছে যুহর ও আসরের নামাজে নিচু আওয়াজে আর মাগরিব, ইশা ও ফজরের নামাজে উঁচু আওয়াজে কিরাত পড়ার বিধান কেন দেয়া হলো- এই নিয়ে। আবার যেতে হবে তারিফের কাছে। তারিফের কাছে জটিল ও কঠিনসব প্রশ্নের চমৎকার যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা পাওয়া যায়, যা অন্য কাউকে সচরাচর বলতে শোনা যায় না।
বিকেল বেলা টিএসসির মোড়ে গেলে তারিফের সাথে দেখা হবে হয়তো। কিন্তু সে পর্যন্ত অপেক্ষা করতে ইচ্ছে হচ্ছিল না আসিমের। তারিফের রুমের দিকে হাটা শুরু করলো সে। রুমের সামনে এসে উঁকি দিয়ে দেখলো, তারিফ এই সাত সকালেই পড়াশোনায় মশগুল। টেবিল ল্যাম্পের এক চিলতে আলোতে কি একটা বই যেন উবু হয়ে গভীর মনযোগ দিয়ে দেখছে তারিফ। সালাম দিয়ে রুমের ভেতরে ঢুকলো আসিম। কি দেখছিস এত মনযোগ দিয়ে? জিজ্ঞেস করলো আসিম।
আরে 'হিসনে হাসিন' বইটা দেখছিলাম একটু। এমন চমৎকার সব দোআর সমাহার যে, পড়লেই ভালো লাগে। যত পড়ি ততই ভাল লাগে। পড়েছিস কখনো? আসিমকে তারিফের প্রশ্ন।
না, পড়িনি। নামই তো শুনিনি। এই প্রথম তোর মুখেই শুনলাম নামটা। কি যেন বললি? 'হাসান হাসান'? আসিমের কথায় জানার আগ্রহ।
আরে বাবা, 'হাসান হাসান' নয়, দ্যাখ। ধর্। বইটা হাতে নিয়ে দ্যাখ। দেখে নামটা পড়। 'হিসনে হাসিন'। বললো তারিফ।
আচ্ছা, দে। নিজের চোখে দেখে নেয়া সবচেয়ে ভালো। সেটাই করি। আচ্ছা, এই 'হিসনে হাসিন' এর অর্থ কি?
দারুন প্রশ্ন করেছিস। নামটা যেমন চমৎকার তেমনি অর্থটাও অসাধারণ 'হিসনে হাসিন' নামটার। সুরক্ষিত দুর্গ।
বাহ! আসলেই চমৎকার! আচ্ছা, সকাল সকাল তোর কাছে এসেছি একটা বিশেষ কাজে। খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়ে জানার প্রয়োজন। গত ক'দিন যাবত মাথার মধ্যে এই একই প্রশ্ন ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমার ধারণা, তুইই পারবি এর সঠিক উত্তর দিতে। প্রশ্নটা হচ্ছে, যুহর ও আসরের নামাজে নিচু আওয়াজে আর মাগরিব, ইশা ও ফজরের নামাজে উঁচু আওয়াজে কিরাত পড়ার বিধান কেন দেয়া হলো? আসিম কথা শেষ করে।
শোন, তোর কাছে বিষয়টা গুরুত্বপূর্ণ এবং খুবই কঠিন মনে হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। তবে, আসলে এটি গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার সাথে সাথে খুবই যুক্তিসংগতও। এই বিধান বরং আল্লাহ তাআলার অসীম কুদরত এবং হিকমতেরও প্রমাণ বহন করে। কেননা, মাগরিব, ইশা ও ফজরের সময় লোকেরা কাজকর্ম, কথাবার্তা ও অন্যান্য শব্দ বা আওয়াজ ইত্যাদি সকল প্রকার কোলাহল এবং শোরগোল থেকে সাধারণতঃ মুক্ত থাকে। পরিবেশও থাকে তখন নিরব এবং শান্ত।
তাছাড়া এ সময় চিন্তা-ফিকিরও থাকে কম, তাই এ সময়ের নামাজগুলোতে পঠিত কিরাআত অন্তরে বেশি প্রভাব সৃষ্টি করে। কেননা, অন্তর চিন্তা-ফিকির থেকে মুক্ত ও পরিচ্ছন্ন হওয়ার কারণে এবং কানে শব্দ না আসার কারণে অনুধাবন ও শ্রবণ করতে আগ্রহী হয়। আর রাতের বেলা কথা কান অতিক্রম করে অন্তরে গিয়ে প্রবেশ করে এবং পূর্ণ প্রভাব সৃষ্টি করে। এ বিষয়ে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
إِنَّ نَاشِئَةَ اللَّيْلِ هِيَ أَشَدُّ وَطْءًا وَأَقْوَمُ قِيلًا
‘নিশ্চয়ই ইবাদতের জন্য রাতে ওঠা প্রবৃত্তি দলনে সহায়ক এবং স্পষ্ট উচ্চারণের অনুকূল।’ -সূরা : মুজ্জাম্মিল, আয়াত : ৬
এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, মানুষের সুমিষ্টকণ্ঠের আওয়াজ এমনকি পাখির কুহূতানও দিনের তুলনায় রাতে আরও অধিক সুন্দর, আকর্ষনীয় এবং প্রভাব সৃষ্টিকারী হয়ে থাকে। এ জন্য এ সময় উঁচু আওয়াজের কিরাআত নির্দিষ্ট হয়েছে।
আর যুহর ও আসরের নামাজে নিচু আওয়াজে কুরআন পড়ার হিকমত হলো, দিনের বেলা হাট-বাজারে ও বাড়ি-ঘরে শোরগোল থাকে, বিভিন্ন আওয়াজ ও চিন্তা-ফিকিরের কারণে অন্তর বেশি ব্যস্ত থাকে এবং কথার প্রতি মনোযোগ কম থাকে, অথবা থাকেই না। তাই এ সময় উঁচু আওয়াজে কিরাআত না পড়ে নিচু স্বরে পাঠের জন্য নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা কুরআনুল কারিমে এদিকে ইঙ্গিত করে ইরশাদ করেন-
إِنَّ لَكَ فِي اَلنَّهَارِ سَبْحًا طَوِيلًا
‘নিশ্চয়ই দিবাভাগে রয়েছে আপনার দীর্ঘ কর্মব্যস্ততা।’ -সূরা : মুজ্জাম্মিল, আয়াত : ৭
কিছুই বলছিস না যে! বুঝতে পেরেছিস কিছু? তারিফের প্রশ্ন।
আরে বলিস কি? বুঝেছি কি না, মানে কি? চমৎকার বুঝেছি। অসাধারণ বুঝিয়েছিস। যুক্তিপূর্ণ। অন্য কারও কাছে গেলে দুনিয়ার শাক মাছ একত্র করে কিচ্ছা কাহিনী শুনিয়ে আমার মাথা নষ্ট করে দিত। তুই তো দু'টো আয়াত দিয়েই সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছিস। আসিমের মুখে আনন্দের ঝিলিক।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই এপ্রিল, ২০২১ বিকাল ৩:১৪