
নতুন করে গৃহকর্মী নেয়ার ঘোষনা সউদির, কিন্তু গৃহকর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে কে?
বাংলাদেশ থেকে নতুন করে গৃহকর্মী নেয়ার সউদি ঘোষনায় আনন্দে আত্মহারা হওয়ার কিছু নেই, সর্বাগ্রে প্রয়োজন গৃহকর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। হ্যাঁ, সউদি আরবের পক্ষ হতে জানানো হয়েছে যে, বাংলাদেশসহ ৮ দেশ থেকে কর্মী নেবে তারা। সৌদি আরবের সংবাদপত্র আল ইকতিসাদিয়াহকে দেশটির মানবসম্পদ ও সামাজিক উন্নয়ন মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র সাদ আল হামিদ বলেছেন, নতুন আট দেশ থেকে গৃহকর্মী নিয়োগের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এর আগে আরও ৮টি দেশের সঙ্গে একই বিষয়ে চুক্তি করেছে সউদি সরকার। সেই ৮টি দেশ থেকেও গৃহকর্মী নেওয়া হবে। মোট ১৬টি দেশ এ সুযোগ পাবে। সৌদি আরবে গৃহকর্মী নিয়োগের অনুমতি পাওয়া দেশগুলো হলো ফিলিপাইন, নাইজার, ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, ভিয়েতনাম, মৌরিতানিয়া, উগান্ডা, ইরিত্রিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, মাদাগাস্কার, উজবেকিস্তান, কম্বোডিয়া, মালি ও কেনিয়া।
উপরের দেশগুলো থেকে গৃহকর্মী নিবে সউদি সরকার। গৃহকর্মীর তালিকায় সাধারণত: বেশিরভাগই থাকেন নারী। এ লক্ষ্যে সউদি সরকার শিগগিরই গৃহকর্মী নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু করার কথাও জানিয়েছে। সে দেশের সরকারি কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে গালফ নিউজ এ তথ্য প্রকাশ করেছে। কথা হচ্ছে, গৃহকর্মী নেয়ার আগ্রহ প্রকাশের এই সংবাদটি নি:সন্দেহে আমাদের জন্য ভালো। কিন্তু গত কয়েক বছরের বাস্তব অভিজ্ঞতায় আমরা যা দেখেছি, বিভিন্ন দেশ হতে আগত সউদিতে অবস্থানরত গৃহকর্মীদের প্রতি যেভাবে অন্যায় অত্যাচার আর অবিচারের স্টিম রোলার চালানো হয়ে থাকে তা এককথায় রোমহর্ষক। বিশেষ করে, অসংখ্য নারী গৃহকর্মীর প্রতি তাদের ঘৃণ্য যৌন অপরাধ বর্ণনা করার মত ছিল না। বাংলাদেশের অনেক নারী গৃহকর্মীর লাশ আমরা পেয়েছি, যাদেরকে নিপীড়ন করে করে, যেীন হেনস্তা করে করে, নির্যাতনে পিষ্ট করে করে তিলে তিলে হত্যা করা হয়েছে। অনেকের লাশও দেশে ফেরত আসেনি। তাদের লাশের অপেক্ষায় হয়তো স্বজনেরা আজও তাকিয়ে আছেন।
বস্ততঃ সউদি সরকার এসব অভিযোগের বিষয়ে তার দেশের নাগরিকদের আইনের আওতায় এনেছেন, এমনটা খুব কম ক্ষেত্রেই শোনা গেছে। আসলে সমস্যা হচ্ছে, অধিকাংশ সউদি নাগরিকই হয়তো ভেবে থাকেন যে, তারা নিজেরা মুনিব আর ভিনদেশ থেকে আগত ভূখাফাঁকা, হা-ভাতে লোকগুলো, যারা তাদের বাসা বাড়িতে কাজ করতে গিয়ে থাকেন, এরা দাস মাত্র। দাস-দাসীদের আবার মানবাধিকার বলে কিছু থাকতে হয় না কি? মুনিবের চিত্তরঞ্জনই তো তাদের কাজ! মুনিবের ইচ্ছাই তো তাদের জীবন! সউদির আদালতগুলোও কি এই মানসিকতা ধারণ করেন কি না, বোধগম্য নয়। কারণ, সেখানকার নাগরিকদের বিরুদ্ধে এই ধরণের বিস্তর অভিযোগ থাকা সত্বেও তারা গৃহকর্মীদের সুরক্ষায় কার্যকর এবং টেকসই ব্যবস্থা নিচ্ছেন না কেন? এটা তো শুধুমাত্র তাদের সদিচ্ছারই বিষয়। তারা ইচ্ছে করলেই এই ব্যাপারে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব। গৃহকমীদের সুরক্ষায় তারা তাদের স্বরাষ্ট্র বা অন্য যে কোনো মন্ত্রণালয়ের আওতায় একটি হেল্প ডেস্ক খুলতে পারে, এক বা একাধিক টোল ফ্রি নাম্বার রাখতে পারে সেখানে, যে নাম্বার প্রতিটি গৃহকর্মীকে সউদিতে প্রবেশের সাথে সাথে দিয়ে দেয়া হবে। তারা যে কোনো বিপদে পতিত হলে বা কোনোভাবে তাদের জীবনের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে মনে করলে, তারা উক্ত নাম্বারে ফোন করে যাতে তাৎক্ষনিকভাবে সহায়তা নিতে পারে।
অথবা, প্রতিটি গৃহকমীর সাথে যোগাযোগের অন্য যে কোনো ব্যবস্থা কার্যকর করতে পারে, যাতে করে তারা নিয়োগকর্তা বা তার নিকটাত্মীয়দের দ্বারা নিগৃহিত ও নির্যাতিত হয়ে থাকেন কি না, তা নিয়মিত পর্যবেক্ষন করা সম্ভব হয়।
কই, এই ধরণের কোনো উদ্যোগ আজ অবদি সউদি সরকার নিয়েছে? এই বিষয়ে তাদের কোনো আন্তরিকতা দেখা গেছে এ পর্যন্ত? লাশ বানিয়ে একেকজন গৃহকর্মীকে যারা বাংলাদেশে ফেরত পাঠিয়েছেন, সেই নির্যাতকদের বিষয়ে সেখানকার আদালত কি রায় দিয়েছে? এসব ঘটনায় তাদের একজনকেও কি কোনো শাস্তি দেয়া গেছে? না কি, স্বাক্ষী প্রমানের অভাবে পার পেয়ে গেছেন প্রত্যেকেই?
অবশ্য গৃহকর্মী নির্যাতন বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গহণের জন্য ইতোপূর্বে আমরা শুনেছিলাম যে, সউদির রাজধানী রিয়াদে বাংলাদেশ ও সউদির কর্মকর্তাদের মধ্যে বেশ কিছু দিন পূর্বে বৈঠক হয়েছিল। বৈঠকে নারী শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে একটি অনলাইন ডেটাবেজ তৈরি করে সেখানে নিয়মিত তথ্য প্রদানের সিদ্ধান্ত হয়েছিল বলেও জানা গিয়েছিল। কিন্তু সেই উদ্যোগ আসলে শেষমেষ কতটুকু আলোর মুখ দেখেছে, তা জানা যায়নি।
আসলে এগুলো এখন ভাবনায় নিতে হবে। আমাদেরকেই এইসব বিষয়ে সোচ্চার হতে হবে। অপরাধ নিয়ে মুখ না খুললে তো অপরাধীদের দন্ত-নখর আঁচড়ে আঁচড়ে, খামচে দিয়ে রক্তাক্ত করে তুলবে বাকিদেরও।
তবে, আমাদের দেশের সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি বিনীতভাবে নিবেদন করতে চাই, সউদি সরকার যদি তার দেশের নাগরিকদের বিরুদ্ধে উত্থিত অভিযোগগুলো তাদের ভাবনায় নিতে না চান, গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের এসব ঘটনাকে তারা যদি গুরুত্ব দিয়ে দেখতে না চান, বরাবরের মত যদি পাশ কাটিয়ে যেতে চান ও উদাসীনতা প্রদর্শন করেই যান, তাহলে স্পষ্ট করে বলি, আল্লাহর কসম, তাদের সীমাহীন নির্লিপ্ততা এবং এই বিষয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত আমাদের মাননীয় কর্তৃপক্ষের গত বেশ কয়েক বছরের অন্তহীন সহ্যশক্তি আর অনি:শেষ নির্লিপ্ততা কোটি প্রাণে নিয়তই রক্তক্ষরণ ঘটাচ্ছে, সউদির কাড়ি কাড়ি রিয়াল, বস্তা বস্তা ডলার কিংবা রাশি রাশি স্বর্ণ - ওগুলো আমাদের জন্য নয়, আমার দেশের সরলা-অবলা নারীদের জন্য ওসব নয়, আপনার পায়ে হাত রেখে অনুরোধ, আপনি পিতা, স্বামী বা অন্য যে পর্যায়ের অভিভাবকই হোন না কেন, নিরাপত্তার গ্যারান্টি না দেয়া পর্যন্তু আপনার মেয়েকে, আপনার স্ত্রীকে, আপনার প্রিয়জনকে সেখানে পাঠাবেন না, আমার দেশের একজন মা-বোনও তাদের দেশে গৃহকর্মী হিসেবে পা দিবে না, আমার দেশের মা-বোনদের ইজ্জতের বিনিময়ে কোনো অর্থ উপার্জন নয়, এমন নিকৃষ্ট অর্থ-বিত্ত দিয়ে কি করবো আমরা? মানবতার মূলে কুঠারাঘাতকারী এমন ধ্বংসাত্মক অর্থ আমরা চাই না। চাই না। চাই না।
সউদি আরব যদি বাংলাদেশ হতে গৃহকর্মী সত্যিই নিতে আগ্রহী হয়ে থাকে, তার সাথে বসুন, কথা বলুন, স্পষ্ট করে তাকে জানিয়ে দেন যে, এরপরে আর একজন নারীর প্রতি অবিচার দেখতে চাই না, কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারলে কথা বলতে এসো, অন্যথায় বিকল্প রাস্তা খুঁজে নাও। একজন নারীর প্রতি অবিচার হলে, সহিংতার ঘটনা সঙ্ঘটিত হলে তোমাদের সাথে চুক্তি বাতিল করা হবে। দেখুন, তারা পথ নিশ্চয়ই বের করে নিয়ে আসবে। কিন্তু সেই সাহস তো আমাদের থাকতে হবে। সেই পাটা তো বুকে ধারণ করতে হবে। বিড়ালের মত হয়ে ৫০০ বছর বেঁচে না থেকে সিংহের মত এক ঘন্টা মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকা গৌরবের। বাঙালীর আজ ভাতের অভাব নেই। অভাবে বাঙালী আজ আর মরছেও না, মরতে চলেছে স্বভাবে.. । স্বভাবের দোষে...।
সংবাদ সূত্র দেখুন: বাংলাদেশসহ ৮ দেশ থেকে কর্মী নেবে সৌদি আরব
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২২ বিকাল ৪:১৮

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



