বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত করেছেন যে মহাবিশ্ব এমন হারে সম্প্রসারিত হচ্ছে যা প্রচলিত পদার্থবিজ্ঞানের ধারণা দিয়ে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। ডার্ক এনার্জি স্পেকট্রোস্কোপিক ইন্সট্রুমেন্টের (DESI) তথ্য বিশ্লেষণ করে ৩০০ মিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরের কোমা গ্যালাক্সি ক্লাস্টারের সুনির্দিষ্ট দূরত্ব নির্ধারণ করা হয়। এটি মহাবিশ্বের সম্প্রসারণের হার (হাবল ধ্রুবক) পরিমাপে সহায়ক হয়েছে।
মাইক ম্যাক্রের ভাষায়- Scientists have confirmed the space around us appears to be growing faster than physics can explain, based off precise measurements of a galaxy cluster over 300 million light-years away. অর্থাৎ, বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত করেছেন যে আমাদের চারপাশের মহাকাশ এমনভাবে সম্প্রসারিত হচ্ছে যা পদার্থবিজ্ঞানের প্রচলিত ধারণায় ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। এই তথ্য পাওয়া গেছে ৩০০ মিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরের একটি গ্যালাক্সি ক্লাস্টারের সঠিক পরিমাপ থেকে।
ডিউক ইউনিভার্সিটির পদার্থবিদ ড্যান স্কলনিকের নেতৃত্বে পরিচালিত গবেষণায় টাইপ আইএ সুপারনোভা বিশ্লেষণ করে নিশ্চিত করা হয় যে, কোমা ক্লাস্টার ৩২১ মিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত। এর মাধ্যমে মহাবিশ্বের সম্প্রসারণের হারের একটি নির্ভরযোগ্য মান নির্ধারণ করা হয় – প্রতি মেগাপারসেকে ৭৬.৫ কিলোমিটার প্রতি সেকেন্ড।
তবে এটি প্রাচীন আলোর প্রসারণ থেকে পাওয়া সংখ্যার তুলনায় ভিন্ন (৬৭.৪ কিমি/সেকেন্ড/মেগাপারসেক), যা মহাকাশবিদ্যার একটি গভীর ধাঁধা। এই পার্থক্য কেন হচ্ছে, তা স্পষ্ট নয়। হয় এটি প্রচলিত মডেলের কোনো ত্রুটি, অথবা নতুন পদার্থবিদ্যার একটি দিক উন্মোচন করছে।
গবেষকরা মনে করছেন, এটি মহাবিশ্ব সম্পর্কে আমাদের ধারণাকে নতুনভাবে ভাবতে বাধ্য করবে এবং আরও বিস্ময়ের দুয়ার খুলে দেবে।
মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ সম্মন্ধে কুরআন কী বলেছে?
মহাবিশ্বের দ্রুত সম্প্রসারণের বিষয়টি আধুনিক বিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার। তবে এটি ইসলামী দর্শন এবং কুরআন-হাদিসের বর্ণনার সঙ্গেও প্রাসঙ্গিক। কুরআন ও হাদিসে মহাবিশ্বের সৃষ্টি ও এর প্রকৃতি নিয়ে যে তথ্যগুলো দেওয়া হয়েছে, তা এই আধুনিক আবিষ্কারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ সম্মন্ধে কুরআনের বাণী:
কুরআনে আল্লাহ মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ সম্পর্কে স্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়েছেন।
আয়াত: سورة الذاريات (সূরা আয-যারিয়াত), আয়াত ৪৭:
وَالسَّمَاءَ بَنَيْنَاهَا بِأَيْيْدٍ وَإِنَّا لَمُوسِعُونَ
"আর আমরাই মহাকাশ (আকাশমণ্ডলী) সৃষ্টি করেছি ক্ষমতা দিয়ে, এবং আমরাই তা সম্প্রসারণ করছি।"
এই আয়াতে "لَمُوسِعُونَ" শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে, যার অর্থ "আমরা সম্প্রসারণ করছি।" এটি সরাসরি ইঙ্গিত করে যে মহাবিশ্বের পরিধি বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা আধুনিক বিজ্ঞানেও নিশ্চিত হয়েছে।
সুরা আল-আম্বিয়া (২১:৩০):
أَوَلَمْ يَرَ ٱلَّذِينَ كَفَرُوٓاْ أَنَّ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلْأَرْضَ كَانَتَا رَتْقًۭا فَفَتَقْنَٰهُمَا ۖ
"অবিশ্বাসীরা কি দেখে না যে আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী একত্র ছিল, এরপর আমরা তাদের পৃথক করেছি?"
এই আয়াতটি মহাবিশ্বের সৃষ্টি এবং সম্প্রসারণের একধরনের বৈজ্ঞানিক ইঙ্গিত দেয়। আধুনিক বিজ্ঞানে "বিগ ব্যাং থিওরি" অনুযায়ী, মহাবিশ্ব একসময় ঘনীভূত অবস্থায় ছিল এবং এটি বিস্ফোরণের মাধ্যমে সম্প্রসারণ শুরু করে।
হাদিসের আলোকে বিশ্লেষণ: রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সরাসরি মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ নিয়ে কোনো আলোচনা করেননি। তবে হাদিসে মহাবিশ্বের স্রষ্টা আল্লাহর অশেষ ক্ষমতা ও সৃষ্টিজগতের বিশালতার কথা বর্ণিত হয়েছে, যা মহাবিশ্বের প্রকৃতি বুঝতে সহায়ক।
উদাহরণ:
১. আল্লাহর ক্ষমতা ও সৃষ্টির বিস্তার:
রাসূল (সা.) বলেছেন: "আল্লাহর আরশ আকাশ ও পৃথিবীর ওপর ছায়ার মতো, এবং তাঁর সৃষ্টির বিশালতা মানুষের কল্পনার বাইরে।" (বুখারি, মুসলিম)
২. আকাশের স্তরসমূহ: রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, "এই পৃথিবীর প্রথম আকাশের ওপর আরও ছয়টি আকাশ রয়েছে, এবং প্রতিটি আকাশের পরিধি ও বিস্তার আমাদের কল্পনার বাইরে।" (তিরমিজি)
বিজ্ঞান ও ইসলাম: সামঞ্জস্যপূর্ণ ব্যাখ্যা: বিজ্ঞান বলছে, মহাবিশ্ব ক্রমাগত সম্প্রসারিত হচ্ছে এবং এটি "বিগ ব্যাং" এর মাধ্যমে শুরু হয়েছিল। ইসলামেও এই ধারণাটি রয়েছে যে মহাবিশ্বের সৃষ্টি হয়েছে এবং এটি আল্লাহর ইচ্ছায় একটি নির্ধারিত পরিধি পর্যন্ত সম্প্রসারিত হচ্ছে।
ইসলামিক দৃষ্টিকোণ থেকে শিক্ষা
১. আল্লাহর কুদরত ও জ্ঞান অনুধাবন: মহাবিশ্বের এই বিশালতা আল্লাহর কুদরতের প্রমাণ। মানুষ যতই গবেষণা করুক, আল্লাহর সৃষ্টির রহস্য পুরোপুরি অনুধাবন করা সম্ভব নয়।
২. তাওহিদের প্রতি বিশ্বাস: কুরআনের আয়াতগুলো মহাবিশ্বের বিস্তার সম্পর্কে আল্লাহর একত্ব ও সৃষ্টির সুনিপুণ পরিকল্পনার প্রমাণ দেয়।
৩. প্রকৃতির পর্যবেক্ষণ: কুরআন বারবার মানুষকে প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ করার আহ্বান জানিয়েছে। এটি জ্ঞান অর্জন এবং আল্লাহর সৃষ্টির কৃতজ্ঞতা প্রকাশের একটি পথ।
উপসংহার: কুরআন ও হাদিসে বর্ণিত মহাবিশ্বের সৃষ্টি ও এর সম্প্রসারণ সম্পর্কে দেওয়া তথ্য আধুনিক বিজ্ঞানকে সমর্থন করে। এটি প্রমাণ করে যে ইসলামের শিক্ষাগুলো শুধু আধ্যাত্মিক নয়, বরং বৈজ্ঞানিক সত্যের সঙ্গেও সামঞ্জস্যপূর্ণ। এই জ্ঞানের আলোকে আমরা আল্লাহর প্রতি আমাদের ঈমান আরও মজবুত করতে পারি।
সায়েন্স এলার্টে প্রকাশিত মাইক ম্যাক্রের লেখা অবলম্বনে
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে জানুয়ারি, ২০২৫ সকাল ৯:৪৮