
সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি খবর ছড়িয়ে পড়েছে, যেখানে বলা হচ্ছে, "নাসা মহাকাশ থেকে ফেরেশতাদের শব্দ রেকর্ড করেছে"। ইসলামি শরিয়াহ অর্থাৎ, কুরআনের হাদিসের আলোকে এই ধরনের খবর বিশ্লেষণ করার প্রয়োজন রয়েছে, কারণ বিষয়টি নিয়ে অনেকেরই কৌতুহল, তা ছাড়া বিষয়টি ঈমান ও আকিদা সংশ্লিষ্ট হওয়ায় এটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ও বটে।
ইসলামে ফেরেশতাদের ভূমিকা ও প্রকৃতিঃ
ইসলামি বিশ্বাস অনুসারে, ফেরেশতারা আল্লাহর বিশেষ সৃষ্টিজীব, যারা কোনো প্রকার খাদ্যগ্রহণ বা সাধারণ মানবিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী নন। তারা কেবল আল্লাহর নির্দেশ পালনে নিয়োজিত থাকেন এবং আল্লাহর অবাধ্য হতে পারেন না। ফেরেশতাদের সম্পর্কে কুরআন ও হাদিসে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে:
১. ফেরেশতাদের সৃষ্টি ও দায়িত্বঃ
ফেরেশতাদের আল্লাহ নূর (আলো) থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং তারা আল্লাহর নির্ধারিত দায়িত্ব পালন করেন। কুরআনে বলা হয়েছে:
"وَيَفْعَلُونَ مَا يُؤْمَرُونَ"
তারা যা আদেশ দেওয়া হয়, তাই পালন করে। — *সুরা আত-তাহরিম: আয়াত ৬
তারা আল্লাহর আদেশ ব্যতীত কোনো কাজ করেন না এবং তাদের কার্যক্রম মানুষের জ্ঞান ও উপলব্ধির বাইরে।
২. ফেরেশতাদের কর্মক্ষেত্র ও দায়িত্বঃ
কুরআনে ফেরেশতাদের কার্যক্রম সম্পর্কে আল্লাহ বলেন:
"إِنَّ الَّذِينَ عِندَ رَبِّكَ لَا يَسْتَكْبِرُونَ عَنْ عِبَادَتِهِ وَيُسَبِّحُونَهُ وَلَهُ يَسْجُدُونَ"
"তোমার প্রভুর কাছে যারা আছে, তারা তাঁর ইবাদতে অহংকার করে না। তারা তাঁর প্রশংসা করে এবং তাঁর কাছে সিজদা করে।"
— সুরা আল-আ'রাফ: আয়াত ২০৬
ফেরেশতারা সর্বদা আল্লাহর প্রশংসা ও তাসবিহ (জিকির) করেন এবং তাদের কাজ আল্লাহর নির্দেশ পালনের মধ্যে সীমাবদ্ধ।
৩. ফেরেশতাদের অদৃশ্য সত্তাঃ
ইসলামে ফেরেশতাদের অদৃশ্য সত্তা হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। তাদের দেখতে পাওয়া বা তাদের কর্মকাণ্ড থেকে শব্দ শোনা মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। আল্লাহ বলেন:
"إِنَّ اللَّهَ يَعْلَمُ غَيْبَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ ۚ إِنَّهُ عَلِيمٌ بِذَاتِ الصُّدُورِ"
"নিশ্চয় আল্লাহ আসমান ও জমিনের অদৃশ্য বিষয় সম্পর্কে সম্যক জ্ঞাত। তিনি অন্তরের কথাও জানেন।" — *সুরা আল-মুলক: আয়াত ১৩
নাসা ও ফেরেশতাদের জিকিরের শব্দ সম্পর্কিত দাবির ভিত্তিঃ
নাসা বা কোনো বৈজ্ঞানিক সংস্থা যদি মহাকাশ থেকে কোনো অজানা শব্দ রেকর্ড করে, তবে তা বিজ্ঞানী বা গবেষকদের কাছে মহাবিশ্বের গঠন, তারকাদের গতিবিধি, কিংবা মহাকর্ষীয় তরঙ্গের (Gravitational Waves) ব্যাখ্যার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে পারে। এই ধরনের কোনো শব্দকে ফেরেশতাদের শব্দ বা জিকির হিসেবে দাবি করা নিছক কল্পনা বা বিভ্রান্তিমূলক গুজব।
ইসলামে ফেরেশতারা মানুষের শ্রবণ বা দর্শনক্ষমতার বাইরে। ফেরেশতাদের কাজ সম্পর্কে আমরা যা জানি, তা কুরআন ও হাদিসে বর্ণিত তথ্যের ভিত্তিতেই সীমাবদ্ধ।
কুরআন ও হাদিসে ফেরেশতাদের কার্যক্রমের ইঙ্গিতঃ
১. ফেরেশতারা আল্লাহর প্রশংসায় নিয়োজিতঃ
কুরআনে বলা হয়েছে:
"الَّذِينَ يَحْمِلُونَ الْعَرْشَ وَمَنْ حَوْلَهُ يُسَبِّحُونَ بِحَمْدِ رَبِّهِمْ"
"যারা আরশ বহন করে এবং যারা তার চারপাশে রয়েছে, তারা তাদের প্রভুর প্রশংসা করে এবং তাঁর পবিত্রতা ঘোষণা করে।" — সুরা গাফির: আয়াত ৭
২. মানবজাতির প্রতি ফেরেশতাদের দায়িত্বঃ
ফেরেশতারা মানুষের কাজে নজরদারি করেন এবং আল্লাহর আদেশ পালনে নিয়োজিত থাকেন।
"وَإِنَّ عَلَيْكُمْ لَحَافِظِينَ كِرَامًا كَاتِبِينَ"
"আর নিশ্চয়ই তোমাদের ওপর (ফেরেশতাদের) নিয়োজিত করা হয়েছে, যারা সম্মানিত এবং (তোমাদের কাজগুলো) লিপিবদ্ধ করেন।"
—সুরা আল-ইনফিতার: আয়াত ১০-১১
ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকে এই দাবির মূল্যায়নঃ
উপরোল্লিখিত সূরাহ আল গাফির/ আল মুমিন এর ৭ নং আয়াতের মাধ্যমে আমরা জেনেছি যে, ফেরেশতাগণ আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআ'লার তাসবীহ পাঠে রত আছেন। তাদের সেই তাসবীহ পাঠের শব্দ কি মানুষের পক্ষে শ্রবনযোগ্য? বস্তুতঃ ফেরেশতাদের জিকিরের শব্দ মানুষের পক্ষে শ্রবন করা বা রেকর্ড করা সংক্রান্ত কোনো তথ্য বা প্রমান কুরআন এবং হাদিসে নেই। বরং এই ধরনের দাবি মানুষের কল্পনা বা অতিরঞ্জনের ফসল বলেই অনুমেয়। উপরন্তু এ ধরনের ভিত্তিহীন গুজব ছড়ানো ইসলামের দৃষ্টিতে অনুচিত। কুরআনে স্পষ্ট বলা হয়েছে:
"وَلَا تَقْفُ مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ"
"তোমরা এমন বিষয়ের অনুসরণ করো না, যার সম্পর্কে তোমাদের কোনো জ্ঞান নেই।" — সুরা আল-ইসরা: আয়াত ৩৬
উপসংহারঃ
"নাসা ফেরেশতাদের জিকিরের শব্দ রেকর্ড করেছে" কিংবা "পৃথিবীর ভূ-পৃষ্ঠের অনেক গভীরে খননের পরে জাহান্নামীদের কান্নার শব্দ রেকর্ড করা হয়েছে" —এ ধরনের খবর ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে অবাস্তব এবং ভিত্তিহীন। ইউটিউব/ ফেইসবুকে এইজাতীয় ভিডিও অহরহ চোখে পড়ে। এইসব ভুয়া অপতথ্য ছড়িয়ে দিয়ে কিছু মানুষ লাইক, কমেন্টস আর ভিউর ব্যবসা করেন। বস্তুতঃ ইসলামে ফেরেশতারা অদৃশ্য সত্তা এবং তাদের কাজ সম্পূর্ণ আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআ'লার নির্দেশ অনুযায়ী চলেন। সুতরাং, এই ধরনের গুজবে কান দেওয়া বা তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কিংবা অন্য কোনো উপায়ে ছড়িয়ে দেওয়া কোনোভাবেই উচিত নয়। বরং মুসলমানদের উচিত কুরআন ও হাদিসের শিক্ষার প্রতি মনোযোগী হওয়া এবং আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআ'লার নির্ধারিত এবং নির্দেশিত পথে চলা।
আল্লাহই সর্বজ্ঞ ও সর্বশক্তিমান।
পোস্টটি প্রিয় ব্লগার নজসু কে উৎসর্গ করছি। মূলতঃ তার অনুরোধ রক্ষার্থেই এই লেখার অবতারণা। তার জানার আগ্রহ এবং জ্ঞান ও প্রজ্ঞাকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআ'লা বৃদ্ধি করে দিন।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে জানুয়ারি, ২০২৫ সকাল ৭:১৩

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



