ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে, ভাষার বৈচিত্র্য আল্লাহর নিদর্শন। পবিত্র কুরআনে ভাষার বৈচিত্র্যকে সৃষ্টির একটি আয়াত হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। সূরা আর-রুমের ২২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে:
وَمِنْ آيَاتِهِ خَلْقُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَاخْتِلَافُ أَلْسِنَتِكُمْ وَأَلْوَانِكُمْ ۚ إِنَّ فِي ذَٰلِكَ لَآيَاتٍ لِلْعَالِمِينَ
বঙ্গানুবাদ: "আর তাঁর নিদর্শনাবলীর মধ্যে রয়েছে আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও রঙের বৈচিত্র্য। নিশ্চয়ই এতে জ্ঞানীদের জন্য নিদর্শন রয়েছে।" -সূরা আর-রুম, ৩০:২২
এছাড়া, সূরা ইবরাহীমের ৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে:
وَمَا أَرْسَلْنَا مِنْ رَسُولٍ إِلَّا بِلِسَانِ قَوْمِهِ لِيُبَيِّنَ لَهُمْ
বঙ্গানুবাদ: "আমরা প্রত্যেক রাসূলকে তার নিজ সম্প্রদায়ের ভাষায় পাঠিয়েছি, যাতে তিনি তাদের কাছে ব্যাখ্যা করতে পারেন।" -সূরা ইবরাহীম, ১৪:৪
এই আয়াতগুলো ভাষার বৈচিত্র্যকে ঐশী সৃষ্টির অংশ হিসেবে তুলে ধরে এবং প্রতিটি সম্প্রদায়ের নিজস্ব ভাষায় ঐশী বাণী পৌঁছানোর গুরুত্ব নির্দেশ করে।
হাদিসেও ভাষা শিক্ষার গুরুত্ব উল্লেখ রয়েছে। সাহাবী যায়দ ইবনে সাবিত (রা) থেকে বর্ণিত একটি হাদিসে বলা হয়েছে:
عَنْ زَيْدِ بْنِ ثَابِتٍ قَالَ أَمَرَنِي رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَنْ أَتَعَلَّمَ كِتَابَةَ الْيَهُودِ فَقَالَ إِنِّي وَاللَّهِ مَا آمَنُ الْيَهُودَ عَلَى كِتَابَتِي فَتَعَلَّمْتُهَا فَلَمْ يَمُرَّ بِي إِلَّا نِصْفُ شَهْرٍ حَتَّى حَذَقْتُهَا
বঙ্গানুবাদ: "আল্লাহর রাসূল (সা) আমাকে ইহুদিদের লেখা শিখতে নির্দেশ দিলেন। তিনি বললেন, 'আল্লাহর কসম, আমি ইহুদিদের আমার লেখার ব্যাপারে ভরসা করি না।' তাই আমি তা শিখলাম, এবং অর্ধ মাসের মধ্যেই আমি তা আয়ত্ত করলাম।" -সুনান আবু দাউদ, হাদিস নং: ৩৬৪৫, সহিহ
এছাড়া, সালমান ফারসি (রা) সম্পর্কে বর্ণিত আছে যে তিনি কুরআনের সূরা আল-ফাতিহার পারস্য ভাষায় অনুবাদ করেছিলেন, যা কুরআনের অর্থ অনুবাদের প্রাচীনতম উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত। -বুখারি, বিবরণ অনুযায়ী
এই আয়াত ও হাদিসগুলো ভাষার বৈচিত্র্যকে শুধু সাংস্কৃতিক সম্পদই নয়, বরং ঐশী উদ্দেশ্য ও যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে।
বর্তমান বিশ্বে কতটি ভাষা রয়েছে, তা নির্ভুলভাবে নির্ধারণ করা দুরূহ। তবে, Ethnologue-এর ২৬তম সংস্করণ (২০২৩) অনুসারে, পৃথিবীতে বর্তমানে ৭,১৬৮টি জীবন্ত ভাষা রয়েছে। দুঃখজনকভাবে, প্রতিনিয়ত কিছু ভাষা বিলুপ্তির মুখে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে, কারণ অনেক ভাষার শেষ বক্তাও মৃত্যুবরণ করছেন। ভাষাবিদদের আশঙ্কা, আগামী এক শতাব্দীতে প্রায় ৩,৫০০ ভাষা, অর্থাৎ বর্তমান ভাষার প্রায় অর্ধেক, চিরতরে হারিয়ে যেতে পারে। গড়ে প্রতি দুই সপ্তাহে একটি ভাষা পৃথিবীর বুক থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে বলে ধারণা করা হয়। এর মধ্যে মাত্র ৩০০টি ভাষায় পৃথিবীর ৯৬% মানুষ তাদের দৈনন্দিন ভাব বিনিময় করে। অর্থাৎ, বাকি ৬,৮০০টিরও বেশি ভাষা এখন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ, তাদের অস্তিত্ব সংকটের মুখে।
Ethnologue (২০২৩) অনুযায়ী, বিশ্বে এমন অনেক ভাষা রয়েছে যেগুলোর বক্তা সংখ্যা অত্যন্ত কম। ১৮১টি ভাষায় মাত্র ১ থেকে ৯ জন বক্তা রয়েছেন, ৩০২টি ভাষায় ১০ থেকে ৯৯ জন, এবং ১,০৭৫টি ভাষায় ১০০ থেকে ৯৯৯ জন বক্তা রয়েছেন। এসব ভাষার বক্তারা যদি পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তাদের ভাষা হস্তান্তর না করেন, তবে শত শত ভাষার বিলুপ্তি অনিবার্য। ভাষা শুধু যোগাযোগের মাধ্যম নয়; এটি একটি জাতির সাংস্কৃতিক পরিচয়, ইতিহাস ও জীবনদর্শনের ধারক। বিভিন্ন জাতি, জনগোষ্ঠী ও সম্প্রদায় তাদের নিজস্ব ভাষায় জীবনযাপন, জ্ঞান, বিশ্বাস ও ঐতিহ্য লিপিবদ্ধ করে। তাই ভাষাগুলোর অবস্থান কেবল ব্যক্তিগত নয়, বরং জাতিগত ও সমাজভিত্তিক। উদাহরণস্বরূপ, পাপুয়া নিউগিনিতে ৮৪০টি ভাষা, চীনে ২৯৯টি, এবং ভারতে ৪৪৭টি ভাষা প্রচলিত রয়েছে।
বাংলাদেশে Ethnologue-এর তথ্য অনুযায়ী বর্তমানে ৪১টি ভাষা প্রচলিত। এর মধ্যে প্রায় ৩০টি ভাষা দেশের আদিবাসী ও ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে ব্যবহৃত হয়। যেমন: চাকমা, মারমা, ওঁরাওং, ত্রিপুরা, গারো, লুসাই, সাঁওতালি, মণিপুরী, রাখাইন, কুরুক, ককবরক, নাইতুং, উসুই, আচিক, আবেং, দুলিয়্যানটং, মাহলেস, খালাছাই প্রভৃতি। এই ভাষাগুলো বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য ও ভাষাগত ঐতিহ্যের জীবন্ত সাক্ষ্য বহন করে। ভাষার এই অপূর্ব বৈচিত্র্যের পেছনে রয়েছে নানা ব্যাখ্যা। কেউ বলেন, ভৌগোলিক দূরত্ব ও পরিবেশের ভিন্নতা ভাষার বিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। আবার কেউ মনে করেন, সমাজবদ্ধ জীব হিসেবে মানুষের চিন্তাভাবনা, অভিজ্ঞতা ও সংস্কৃতি সংরক্ষণের প্রয়োজনে ভাষার সৃষ্টি ও বিস্তার ঘটেছে। ইতিহাসের ধারায় ধর্ম, রাজনীতি, উপনিবেশবাদ এবং বাণিজ্যও অনেক ভাষার জন্ম, প্রসার ও বিলুপ্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আধুনিক প্রযুক্তি, বিশ্বায়ন এবং একমুখী শিক্ষাব্যবস্থার প্রভাবে ছোট ও প্রান্তিক ভাষাগুলো আজ অস্তিত্বের সংকটে। তরুণ প্রজন্ম নানা কারণে তাদের মাতৃভাষাকে অবহেলা করে আধিপত্যশীল ভাষার প্রতি ঝুঁকছে, ফলে এই ভাষাগুলো তাদের স্বাভাবিক বিকাশের সুযোগ হারাচ্ছে। কিন্তু ভাষা কেবল যোগাযোগের হাতিয়ার নয়; এটি একটি জাতির আত্মপরিচয়, ইতিহাস, বিশ্বাস, আবেগ ও সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের প্রতীক। একটি ভাষার বিলুপ্তি মানে শুধু শব্দের ক্ষয় নয়, বরং একটি জাতিগোষ্ঠীর শত শত বছরের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সাহিত্য, লোকগান, লোকজ্ঞান এবং চিন্তাধারার চিরনিশ্চিহ্ন।
তাই ভাষা রক্ষা কেবল ভাষাবিদদের দায়িত্ব নয়, এটি আমাদের সকলের সম্মিলিত কর্তব্য। ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ভাষা সংরক্ষণে সচেতনতা বৃদ্ধি, গবেষণা, প্রজন্মান্তরে ভাষা হস্তান্তরের পরিকল্পনা এবং শিক্ষাক্রমে এই ভাষাগুলোর অন্তর্ভুক্তি অত্যন্ত জরুরি। আঞ্চলিক ভাষায় সাহিত্যচর্চা, গণমাধ্যমে ব্যবহারের সুযোগ এবং ভাষাভিত্তিক সাংস্কৃতিক উৎসবের আয়োজন এই ভাষাগুলোর পুনরুজ্জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। পৃথিবীর ভাষাগত বৈচিত্র্য শুধু বৈজ্ঞানিকভাবে মূল্যবান নয়, এটি মানব সভ্যতার এক অপরূপ ধন। ভাষা বাঁচলে জাতি বাঁচবে; ভাষা মরলে হারিয়ে যাবে ইতিহাসের একেকটি অধ্যায়। তাই আমাদের দায়িত্ব ভাষা নিয়ে ভাবা, কাজ করা এবং তাকে ভালোবাসা। এই অমূল্য সাংস্কৃতিক সম্পদকে আগামী প্রজন্মের জন্য রক্ষা করতে আমাদের সকলকে এগিয়ে আসতে হবে।
নীচে Ethnologue (২০২৩) এবং অন্যান্য সাম্প্রতিক সূত্রের ভিত্তিতে মোট বক্তার সংখ্যা (নেটিভ ও নন-নেটিভ বক্তা সহ) অনুযায়ী শীর্ষ ১০টি সর্বাধিক প্রচলিত ভাষার তালিকা দেওয়া হল। পদ্ধতিগত পার্থক্যের কারণে বিভিন্ন সূত্রে সংখ্যা সামান্য ভিন্ন হতে পারে, তবে এই পরিসংখ্যানগুলো ব্যাপকভাবে গৃহীত।
বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ভাষা ইংরেজি, যা ১.৫ বিলিয়ন মানুষ ব্যবহার করে। এটি ব্যবসা, শিক্ষা ও গণমাধ্যমে বৈশ্বিক লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা, যুক্তরাজ্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া এবং ভারতসহ ১০০টির বেশি দেশে প্রচলিত। দ্বিতীয় স্থানে ম্যান্ডারিন চীনা, ১.১ বিলিয়ন বক্তা নিয়ে। চীন, তাইওয়ান এবং সিঙ্গাপুরে প্রধানত ব্যবহৃত, এটি চীনের বিশাল জনসংখ্যার কারণে সর্বাধিক নেটিভ বক্তার ভাষা। তৃতীয় স্থানে হিন্দি, ৬০২ মিলিয়ন বক্তা। ভারতের সরকারি ভাষা, প্রধানত উত্তর ও মধ্য ভারতে প্রচলিত, পারস্পরিক বোধগম্য উপভাষাসহ।
চতুর্থ স্থানে স্প্যানিশ, ৫৫৯ মিলিয়ন বক্তা। স্পেন, মেক্সিকো এবং লাতিন আমেরিকার অধিকাংশ দেশসহ ২১টি দেশে সরকারি ভাষা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত। পঞ্চম স্থানে ফরাসি, ৩১০ মিলিয়ন বক্তা। ফ্রান্স, কানাডা এবং আফ্রিকার বিভিন্ন দেশসহ ২৯টি দেশে সরকারি ভাষা, আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ। ষষ্ঠ স্থানে আরবি (স্ট্যান্ডার্ড), ২৭৪ মিলিয়ন বক্তা। মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকায় প্রচলিত, মডার্ন স্ট্যান্ডার্ড আরবি ও বিভিন্ন উপভাষা অন্তর্ভুক্ত, যা সবসময় বোধগম্য নাও হতে পারে।
সপ্তম স্থানে বাংলা, ২৭৩ মিলিয়ন বক্তা। বাংলাদেশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরা রাজ্যের সরকারি ভাষা, বিশ্বে সপ্তম সর্বাধিক প্রচলিত ভাষা। অষ্টম স্থানে পর্তুগিজ, ২৬৪ মিলিয়ন বক্তা। পর্তুগাল, ব্রাজিল, অ্যাঙ্গোলা এবং মোজাম্বিকের সরকারি ভাষা, ব্রাজিলের জনসংখ্যার কারণে ক্রমবর্ধমান। নবম স্থানে রুশ, ২৫৫ মিলিয়ন বক্তা। রাশিয়া এবং প্রাক্তন সোভিয়েত রাষ্ট্রগুলোতে সরকারি ভাষা, পূর্ব ইউরোপ ও মধ্য এশিয়ায় ব্যাপকভাবে প্রচলিত। দশম স্থানে উর্দু, ২৩২ মিলিয়ন বক্তা। পাকিস্তানের সরকারি ভাষা এবং ভারতে ব্যাপকভাবে প্রচলিত, কথ্য রূপে হিন্দির সাথে পারস্পরিক বোধগম্য (হিন্দুস্তানি)।
এই তালিকার বক্তার সংখ্যায় নেটিভ (L1) এবং নন-নেটিভ (L2) উভয়ই অন্তর্ভুক্ত, যা মোট ব্যবহারের প্রতিফলন করে। শুধু নেটিভ বক্তাদের হিসাবে ক্রম পরিবর্তিত হতে পারে, যেমন ম্যান্ডারিন ইংরেজিকে ছাড়িয়ে যায়। উদাহরণস্বরূপ, বাংলার ২৭৩ মিলিয়ন বক্তার মধ্যে ২৪২ মিলিয়ন নেটিভ বক্তা। বিপন্ন ভাষা এবং দেশভিত্তিক ভাষার সংখ্যা Ethnologue (২০২৩) এর তথ্যের ভিত্তিতে নির্ভুল করা হয়েছে, যা বিশ্বব্যাপী ভাষার পরিসংখ্যানের সবচেয়ে প্রামাণিক উৎস। ভারতে গত ৫০ বছরে ২৩০টি ভাষা বিলুপ্ত হওয়ার দাবি কিছু সূত্রে পাওয়া গেলেও Ethnologue-এর সরাসরি সমর্থন নেই, তাই এটির যাচাই প্রয়োজন।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই জুন, ২০২৫ সকাল ১০:৩৮