বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে ইরানের জন্য পারমাণবিক শক্তি অর্জন ও ঘোষণা কেবল একটি বিকল্প নয়, বরং জাতীয় নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার অপরিহার্য শর্তে পরিণত হয়েছে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, যে জাতি নিজের প্রতিরক্ষা ক্ষমতা শক্তিশালী করতে পারে না, সে জাতি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কখনোই সম্মানজনক অবস্থান ধরে রাখতে পারে না। ইরান আজ যদি দৃঢ়কণ্ঠে ঘোষণা করে যে তারা পারমাণবিক অস্ত্রের অধিকারী, তবে তা হবে মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতিতে এক যুগান্তকারী ঘটনা।
পারমাণবিক শক্তি কেবল একটি সামরিক হাতিয়ার নয়, এটি একটি জাতির আত্মপ্রতিষ্ঠার প্রতীক। বিশ্বের বর্তমান শক্তি কাঠামো পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, যেসব দেশ পারমাণবিক শক্তির অধিকারী, তাদের বিরুদ্ধে কখনোই সরাসরি আক্রমণ চালানো হয় না। ইরানের জন্য এই শক্তি অর্জন তাই জাতীয় নিরাপত্তার গ্যারান্টি। ইরান যদি আনুষ্ঠানিকভাবে নিজেকে পারমাণবিক শক্তিধর হিসেবে ঘোষণা করে, তবে তা ইসরায়েলের আগ্রাসী নীতিকে স্তব্ধ করে দেবে, আমেরিকার একতরফা হুমকিকে অকার্যকর করে তুলবে এবং আঞ্চলিক শক্তি সমীকরণে ইরানকে একটি অনন্য অবস্থানে নিয়ে যাবে।
ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির অগ্রগতি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, তারা ইতিমধ্যেই এই প্রযুক্তির অধিকাংশ উপাদান আয়ত্ত্ব করেছে। ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ প্রক্রিয়া, ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তির উন্নয়ন এবং পারমাণবিক বিজ্ঞানীদের দক্ষতা - সবই ইঙ্গিত দেয় যে ইরান চাইলে অতি অল্প সময়ের মধ্যেই পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করতে সক্ষম। আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার বিভিন্ন প্রতিবেদনও স্বীকার করে যে ইরান পারমাণবিক প্রযুক্তিতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে।
কিন্তু প্রশ্ন জাগে, ইরান কেন এখনো পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে এই ঘোষণা দিচ্ছে না? এর পেছনে রয়েছে বহুমুখী কৌশলগত ও রাজনৈতিক বিবেচনা। প্রথমত, আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার বলয় থেকে মুক্তির জন্য কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালানো। দ্বিতীয়ত, JCPOA চুক্তি পুনরুজ্জীবিত করার মাধ্যমে অর্থনৈতিক চাপ কমানোর চেষ্টা। তৃতীয়ত, সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনেইয়ের পারমাণবিক অস্ত্র সম্পর্কিত ধর্মীয় অবস্থানের কৌশলগত ব্যাখ্যা।
এই ঘোষণার সম্ভাব্য পরিণতি সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তা করা প্রয়োজন। একদিকে যেমন ইসরায়েল ও আমেরিকার তীব্র প্রতিক্রিয়া এবং সম্ভাব্য সামরিক হস্তক্ষেপের ঝুঁকি রয়েছে, অন্যদিকে আরো কঠোর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়া মধ্যপ্রাচ্যে নতুন করে অস্ত্র প্রতিযোগিতা শুরু হওয়ার আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তবে ইরান যদি পরোক্ষভাবে কিন্তু স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয় যে তারা পারমাণবিক সক্ষমতা অর্জন করেছে, তবে তা হবে এক অভিনব কৌশলগত সাফল্য, যা মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধে তাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সুবিধা এনে দেবে।
চূড়ান্ত বিশ্লেষণে বলা যায়, ইরানের জন্য পারমাণবিক শক্তি ঘোষণা একইসাথে সুযোগ ও চ্যালেঞ্জের সমন্বয়। কিন্তু বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে, বিশেষ করে যখন পশ্চিমা শক্তিগুলো তাদের আধিপত্য বজায় রাখতে বদ্ধপরিকর, তখন ইরানের জন্য এই সিদ্ধান্ত নেওয়া সময়ের দাবি। এই ঘোষণা কেবল মধ্যপ্রাচ্যেই নয়, সমগ্র বিশ্ব রাজনীতির গতিধারা পরিবর্তন করে দেবে। একটি পারমাণবিক শক্তিধর ইরানকে আর উপেক্ষা করা সম্ভব হবে না, বরং প্রতিটি আন্তর্জাতিক ফোরামে ইরানের অবস্থানকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতে হবে।
পশ্চিমা শক্তিগুলোর ঔদ্ধত্য ও ইসরায়েলের আগ্রাসী নীতির মুখে ইরানের এই ঘোষণা হবে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। বিশ্বের নির্যাতিত জনগোষ্ঠীর আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক হয়ে উঠবে এই সিদ্ধান্ত। ইতিহাসের এই মোড়ে দাঁড়িয়ে ইরানের সামনে একটিই পথ - পারমাণবিক শক্তির পূর্ণাঙ্গ ঘোষণা। এটি ইরানের জন্য কেবল একটি অধিকারই নয়, বরং জাতীয় অস্তিত্ব রক্ষার অপরিহার্য শর্ত। এই ঘোষণাই নির্ধারণ করবে আগামী দিনের বিশ্ব রাজনীতির গতিপথ, এবং ইরানকে নিয়ে যাবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে একটি অনন্য উচ্চতায়।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে জুন, ২০২৫ সকাল ১০:৩৬