
জীবনের পথ চলতে চলতে আমরা কতবারই না আঘাত পাই, কতবারই না হৃদয়ে ক্ষোভ জমিয়ে রাখি। কিন্তু ভেবে দেখুন, জমিয়ে রাখা সেই ক্ষোভগুলো কি আমাদের শান্তি দেয়? না, দেয় না, বরং তা আমাদের মনকে আরও ভারাক্রান্ত করে। আরও ব্যথিত এবং ক্ষতবিক্ষত করে। আজ আমি আপনাদের সঙ্গে কথা বলতে চাই ক্ষমার সেই মহান গুণ নিয়ে, যা আমাদের হৃদয়কে হালকা করে, জীবনকে সুন্দর করে তোলে। মহান আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআ'লার যত গুণাবলি রয়েছে, ক্ষমার গুণ তার মধ্যে অন্যতম। কুরআনুল কারিম এবং হাদিসে নববীর পাতায় পাতায় আল্লাহ তাআ'লার ক্ষমা ও মহানুভবতার পরিচয় মুক্তার মতো ছড়িয়ে আছে। আমাদের হৃদয় যখন দুঃখে ভরে যায়, তখন এই কথাগুলো মনে পড়লে একটা আশার আলো জ্বলে ওঠে।
কুরআন মাজিদে সুরা আয-জুমারের ৫৩ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ তাআ'লা ইরশাদ করেছেন: يَا عِبَادِيَ الَّذِينَ أَسْرَفُوا عَلَىٰ أَنفُسِهِمْ لَا تَقْنَطُوا مِن رَّحْمَةِ اللَّهِ ۚ إِنَّ اللَّهَ يَغْفِرُ الذُّنُوبَ جَمِيعًا ۚ إِنَّهُ هُوَ الْغَفُورُ الرَّحِيمُ। অর্থাৎ, 'হে আমার বান্দাগণ, যারা নিজেদের প্রতি অবিচার করেছ, তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ সব গুনাহ ক্ষমা করেন। নিশ্চয় তিনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।' এই আয়াতটি পাঠ করলে মনের ভেতরে অসাধারণ একটা প্রশান্তির অনুভূতি নেমে আসে। এ থেকে আমরা জানতে পারি, পৃথিবীতে এমন কোনো গুনাহ নেই যার ক্ষমা নেই। কিন্তু এর জন্য তাওবা আবশ্যক। অর্থাৎ, আল্লাহ তাআ'লার হকসম্পৃক্ত সব গুনাহ যথাযথ তাওবা করলে আল্লাহ তাআ'লা ক্ষমা করে দেন। আর বান্দার হকসম্পৃক্ত গুনাহের ক্ষেত্রে তাওবার পাশাপাশি সেই বান্দার কাছ থেকে ক্ষমা চেয়ে নেওয়াও জরুরি। এটা শুধু একটা নিয়ম নয়, এটা আমাদের সম্পর্কগুলোকে মজবুত করে, হৃদয়কে পরিষ্কার রাখারও মাধ্যম।
মুত্তাকিদের গুণাবলি বর্ণনা করতে গিয়ে কুরআন মাজিদের সুরা আলে ইমরানের ১৩৪ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ তাআ'লা বলেছেন: الَّذِينَ يُنفِقُونَ فِي السَّرَّاءِ وَالضَّرَّاءِ وَالْكَاظِمِينَ الْغَيْظَ وَالْعَافِينَ عَنِ النَّاسِ ۗ وَاللَّهُ يُحِبُّ الْمُحْسِنِينَ। অর্থাৎ, 'যারা সুখে ও দুঃখে ব্যয় করে, ক্রোধ সংবরণ করে এবং মানুষকে ক্ষমা করে। আর আল্লাহ সৎকর্মশীলদের ভালোবাসেন।' এই আয়াতে মুত্তাকিদের তিনটি গুণের কথা বলা হয়েছে। সবই আমাদের হৃদয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত। কৃপণতা না করে সুখে-দুঃখে আল্লাহর রাস্তায় দান করা, ক্রোধ দমন করা, ক্ষমা করা। এগুলো মুত্তাকিদের বৈশিষ্ট্য। আল্লাহ বলেননি যে ক্রোধ না থাকা মুত্তাকিদের বৈশিষ্ট্য। বরং তিনি ক্রোধ দমনের কথা বলেছেন। সৃষ্টির নিয়মে আমাদের ভিতর ক্রোধ থাকবে সেটাই স্বাভাবিক। তবে সেই ক্রোধ কে কতটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারল, আল্লাহ সেটাই দেখবেন। আমি নিজে অনেকবার অনুভব করেছি, ক্রোধের মুহূর্তে যদি একটু থামি, তাহলে পরে অনেক সমস্যা এড়িয়ে যাই। আর ক্ষমা এমন গুণ যে, বান্দা যদি ক্ষমা করে, আল্লাহও তাকে ক্ষমা করেন। ক্ষমা করা বড় হৃদয়ের পরিচয়। যারা ক্ষমা করতে পারে না, তাদের হৃদয় ক্ষুদ্র।
ভেবে দেখুন, সমুদ্রের ভিতর যদি ময়লা পড়ে, মুহূর্তে সেই ময়লার টুকরো সমুদ্রের গর্ভে বিলীন হয়ে যায়। কিন্তু সেই ময়লার টুকরো যদি ছোট্ট একটি কুয়ার ভেতরে পড়ে, তবে ময়লাটি কিন্তু হারিয়ে যায় না। বরং চোখের সামনে দৃশ্যমান হয়ে থাকে। আমাদেরকে সমুদ্রের মতো বড় হৃদয়ের অধিকারী হতে হবে। জীবন চলার পথে নানা আঘাত, দুঃখ-বেদনা আসবে। কিন্তু সেগুলো মনে পুষে রাখলে হৃদয় সেই ছোট্ট কুয়ার মতো ময়লায় ভরে যাবে। বরং সমুদ্রের মতো সেসব দুঃখ-বেদনা বিলীন করে দিতে হবে। আমার জীবনে একবার একটা ঘটনা ঘটেছিল, যেখানে একজন আমাকে খুব কষ্ট দিয়েছিল। প্রথমে রাগ হয়েছিল, কিন্তু যখন ক্ষমা করলাম, তখন মনে একটা অদ্ভুত শান্তি অনুভব করলাম। যেন মাথা থেকে একটা ভার নেমে গেল।
একটা শিক্ষণীয় গল্প আছে। এক চাকর বারবার ভুল করে আর ক্ষমা চায়। মালিক একসময় বিরক্ত হয়ে বলে, আর কত ক্ষমা করব। তোমার কাজই তো সব সময় ভুল করা। তখন চাকর বলে, আপনি আল্লাহর কাছে যতবার ক্ষমার আশা করেন, আমাকেও ততবার ক্ষমা করুন। এই গল্পটা আমাকে সবসময় ভাবায়। আমরা অধীনস্থদের সামান্য ভুলেই বিরক্ত হই, দুর্ব্যবহার করি। স্ত্রী-সন্তানদের সঙ্গেও খারাপ ব্যবহার করি। তাদের সামান্য ভুলে ত্যক্ত হয়ে উঠি। তাদের ক্ষমা করি না। কিন্তু আমাদের ভাবা উচিত, আমরা আল্লাহর কাছেও বারবার ভুল করি এবং প্রত্যাশা রাখি যে প্রত্যেকবারই আল্লাহ আমাদের ক্ষমা করবেন। কিন্তু মনে রাখতে হবেত, আমরা যতক্ষণ না অন্যদের ক্ষমা করব, ততক্ষণ আমাদের হৃদয় ভারী হয়ে থাকবে। ধীরে ধীরে এই ভার বাড়তেই থাকবে। এই বোঝা বহনের কষ্টও আমাদের বৃদ্ধি পেতেই থাকবে।
আরেকটা উদাহরণ দেই। আধা লিটার পানি ভর্তি একটি বোতল হাতে ধরে রাখা খুব সহজ। কিন্তু এই বোতলটাই যদি আমরা পাঁচ-সাত ঘণ্টা যাবত ধরে রাখি, তবে এটাই আধামণ ভারী হয়ে উঠবে। ক্ষোভ পুষে রাখার ব্যাপারটাও তেমনই। প্রথমে ছোট লাগে, কিন্তু সময় গড়াতে গড়াতে তা আমাদের মনকে অসহ্য করে তোলে। আমাদের নিজেদের প্রয়োজনেই অন্যকে ক্ষমা করা উচিত। কারণ, আমরা যত ক্ষমা করব, তত নির্ভার থাকব। আমরা যতক্ষণ ক্ষমা না করব, ততক্ষণ কুয়ার ময়লার মতো আমাদের হৃদয় ময়লা হয়ে থাকবে। এ ময়লা নিয়ে কেউ ভালো থাকতে পারে না। তাই নিজেদের ভালো থাকার স্বার্থেই আমাদের ক্ষমার গুণ অর্জন করা উচিত। ক্ষমা করলে শুধু দুনিয়ার জীবন শান্তিময় হয় না, আখিরাতও সুন্দর হয়।
হাদিসের একটা ঘটনা বলি। অন্যান্য দিনের মতই একটি দিন। নবীজী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। উপবিষ্ট মসজিদে নববী প্রাঙ্গনে। সাহাবীগনও তাঁর সামনে। অধীর আগ্রহে অপেক্ষমান। সবার মনে তাঁর কথা শোনার আগ্রহ। নিরবতা ভেঙ্গে কথা বলে উঠলেন প্রিয় নবীজী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। বললেন,
يَطْلُعُ عَلَيْكُمُ الْآنَ رَجُلٌ مِنْ أَهْلِ الْجَنّةِ.
‘তোমাদের মাঝে এখন একজন জান্নাতী মানুষ আসবে।’
নবীজীর মুখে একথা শুনে সবাই খুব উৎসুক হয়ে উঠলেন, কে সেই সৌভাগ্যবান মানুষটি যাকে প্রিয় নবীজী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জান্নাতী বললেন -তা দেখার জন্য। ইতিমধ্যে একজন আগমন করলেন, যিনি সবেমাত্র উযু করেছেন। দাড়ি বেয়ে ফোঁটা ফোঁটা পানি ঝরছে তখনও। জুতা জোড়া বাম হাতে ভাঁজ করা। ধীরে ধীরে মসজিদের দিকে আসছেন। এ দরোজা দিয়েই প্রবেশ করলেন তিনি। নবীজী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মজলিসে শরীক হওয়ার জন্য। এবং বসে পড়লেন নবুয়তের ঐশী আলোয় উদ্ভাসিত মোবারক সেই জমায়েতে।
দ্বিতীয় দিন। নবীজী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ঘিরে বসে আছেন সবাই। পিনপতন নিরবতা দরবারে নববীজুড়ে। মৌমাছির মত জমে বসে আছেন অসংখ্য সাহাবী। তবু যেন কেউ নেই। একসময় প্রিয় নবীজী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গত দিনের মতই বললেন-
يَطْلُعُ عَلَيْكُمُ الْآنَ رَجُلٌ مِنْ أَهْلِ الْجَنّةِ.
‘এখন তোমাদের মাঝে একজন জান্নাতী মানুষের আগমন ঘটবে।’
দেখা গেল। এদিনও এলেন সেই মানুষটিই। যিনি এসেছিলেন আগের দিন।
তৃতীয় দিন। গত দু’দিনের মত আজও। নবীজী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন। পূর্বের মত। সেই একই কথা। দেখা গেল নবীজী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কথার পরে। আজও আগমন ঘটলো। সেই একই ব্যক্তির। সেই মানুষটিই মজলিসে আগমন করলেন আজও।
কে এই সৌভাগ্যবান ব্যক্তি? যিনি তিন তিনটি দিন, তিন তিনবার নবীজী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর মুখে জান্নাতী হওয়ার সনদ পেলেন? তিনি আর কেউ নন। তিনি হচ্ছেন প্রখ্যাত সাহাবী হযরত সা‘দ ইবনে আবী ওয়াক্কাস রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু।
হ্যাঁ, হযরত সা‘দ ইবনে আবী ওয়াক্কাস রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু! কেমন ছিলেন তিনি? কী ছিল তাঁর গুণ-বৈশিষ্ট্য? নবী কারিম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যাঁর সম্পর্কে এই মহাসুসংবাদ দিলেন তার পরের জীবনটুকু কীভাবে কেটেছে?
সংক্ষেপে বললে তিনি ছিলেন নবীজীর অত্যন্ত প্রিয় এবং বিশ্বস্ত সাহাবী। স্বয়ং নবীজী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে গভীর মহব্বত করতেন। তিনিও নবীজী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ভালবাসতেন প্রাণ দিয়ে। মাত্র সতের বছর বয়সে তিনি ইসলাম কবুল করেন। তাঁর ইসলাম কবুলের বিবরণও খুবই চমৎকার। দ্বীন-ঈমানের জন্য অতুলনীয় ত্যাগ স্বীকার করেছেন তিনি। জিহাদের ময়দানে ছিল তাঁর অসাধারণ নৈপুণ্য। নবীজী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বয়ং তাঁর সমরকুশলতার প্রশংসা করেছেন। ইসলামের ইতিহাসে তিনিই সর্বপ্রথম শত্রুর বিরুদ্ধে তীর নিক্ষেপ করেছেন।
বদর, ওহুদসহ বড় বড় যুদ্ধে নবীজী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে থেকেছেন। অংশগ্রহণ করেছেন গুরুত্বপূর্ন প্রতিটি জিহাদে। সেনাপতির দায়িত্বও পালন করেছেন বিভিন্ন যুদ্ধে।
ইলমের দিগন্তে তিনি ছিলেন এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। অনেক হাদীস বর্ণনা করেছেন তিনি।
খলীফাতুল মুমিনীন হযরত উমর রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু -এর আমলে তিনি কুফার খণ্ডকালীন গভর্নর ছিলেন। এই সব কিছু সত্বেও তিনি ছিলেন সাদামাটা স্বভাবের একজন মানুষ। ৫৫ হিজরী সনে ৮২ বছর বয়সে তিনি ইন্তেকাল করেন। (দ্র. সিয়ারু আলামিন নুবালা, যাহাবী)
তাঁর জীবনটিই প্রমাণ করে নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর বাণী কত সত্য। তিনি যাকে জান্নাতী বলেছেন বাস্তবেও তাঁর জীবন জান্নাতী আমলের মধ্যেই অতিবাহিত হয়েছে।
যে ঘটনাটি বলার জন্য সামনে এগুচ্ছিলাম- নবী পাক সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর মুখে হযরত সা‘দ রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু সম্পর্কে এই মহাসুসংবাদ ঘোষিত হওয়ার পর যা ঘটলো; মজলিস শেষে হযরত সা‘দ রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু যখন বাড়ির পথে রওয়ানা হলেন তখন সাহাবী হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু তাঁর পিছু পিছু হাঁটতে লাগলেন। তাঁর মনে একটিই প্রশ্ন- হযরত সা‘দ রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু কী এমন আমল করেন? কোন্ আমলের গুণে তিনি এই মহাসৌভাগ্য অর্জন করলেন? যে করেই হোক, এ প্রশ্নের উত্তর তাকে খুঁজে বের করতেই হবে! রহস্য উদঘাটনে তিনি একটুখানি কৌশল করলেন।
হযরত সা‘দ রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু -এর কাছে গিয়ে বললেন, চাচা, কিছু সমস্যা থাকার কারনে ভেবেছিলাম, তিন দিন বাড়িতে যাব না। তো মেহেরবানী করে কি এই তিন দিন আমাকে আপনার বাড়িতে থাকতে দিবেন?
-ঠিক আছে, থাকো। কোনো অসুবিধা নেই।
হযরত আবদুল্লাহ একে একে তিন রাত হযরত সা‘দ রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু এর বাড়িতে থাকলেন। কৌতুহলের এ তিন রাতে তিনি যা কিছু আবিষ্কার করতে পারলেন তার মুখেই শোনা যাক সেই বিবরণ-
' তাঁর বাড়িতে আমি তিন রাত কাটালাম। তাঁকে রাত জেগে জেগে তাহাজ্জুদও তেমন পড়তে দেখলাম না। তবে রাতে ঘুম ভাঙ্গলেই পাশ ফেরার সময় আল্লাহু আকবার বলতেন; আল্লাহর যিকির করতেন; এরপর ফজরের সময় হলে নামাযের জন্য উঠে পড়তেন।'
'তবে এ তিন দিন তাঁকে কোনো অর্থহীন শব্দ বা বাক্য বলতে শুনিনি। শুধু ভালো কথাই বলতে দেখেছি।' আব্দুল্লাহ বিন আমর রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু যোগ করলেন।
তিনি বলে চলেছেন- 'তিন রাত কাটানোর পর তাঁকে বললাম- চাচা, বাড়িতে আসলে তেমন কোনো সমস্যা আমার ছিল না। শুধু আপনার সাথে কিছু সময় থাকা এবং আপনার আমল পর্যবেক্ষণ করাই ছিল আমার উদ্দেশ্য। কারণ পর পর তিন দিন আল্লাহর রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
يَطْلُعُ عَلَيْكُمُ الْآنَ رَجُلٌ مِنْ أَهْلِ الْجَنّةِ.
‘এখন তোমাদের মাঝে একজন জান্নাতী মানুষের আগমন ঘটবে।’
'তিন বারই দেখা গেল আপনার আগমন হয়েছে। তখন থেকেই আমি সংকল্প করেছি, আপনার সাথে থেকে আপনার ‘আমল’ পর্যবেক্ষণ করব এবং সে মোতাবেক আমল করে আমিও জান্নাতী হব।' তিনি বলে যাচ্ছেন।
'কিন্তু চাচা, আপনাকে তো বেশি কিছু আমল করতে দেখলাম না! তাহলে কী এমন বিষয়, যা আপনাকে নবীজী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পাক যবানে উচ্চারিত এই সৌভাগ্য এনে দিল?' জানতে চাইলেন আব্দুল্লাহ বিন আমর রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু।
সা‘দ রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু বললেন, 'ভাতিজা! আমার আমল তো ঐটুকুই যা তুমি দেখেছ!'
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু বোধ হয় কিছুটা আশাহত হলেন। ফিরে যাওয়ার সময় পেছন থেকে ডাক এলো- 'আবদুল্লাহ!'
আব্দুল্লাহ বিন আমর রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু ফিরে তাকালেন। হযরত সা‘দ রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু বললেন, 'ভাতিজা, তুমি আমাকে যেমন দেখেছ আমার আমল তো ঐটুকুই। তবে একটি বিষয় আছে।'
হযরত আবদুল্লাহ বিন আমর রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহুর আগ্রহ যেন হঠাত বহুগুনে বেড়ে গেল। তন্ময় হয়ে শুনতে লাগলেন তিনি। হযরত সা‘দ রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু বললেন, 'কোনো মুসলিম ভাইয়ের প্রতি আমি অন্তরে কোনো কূট চিন্তা পোষণ করি না। আর আল্লাহ পাক যাকে যে নিআমত দান করেছেন তার কারণে কাউকে হিংসা করি না। এককথায়, সকলের দাবি দাওয়া ছেড়ে দিয়ে প্রতি রাতে আমি ঘুমুতে যাই। কোনো মাখলূকের প্রতি আমার কোনো দাবি অবশিষ্ট রাখি না। সকলকে মাফ করে দিয়ে প্রতিটি দিন পার করি।'
এ কথা শুনে হযরত আবদুল্লাহ বিন আমর রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু বলে উঠলেন, 'হ্যাঁ, এই একটি গুণই ঐ মহাসৌভাগ্যের অধিকারী হওয়ার জন্য যথেষ্ট। এই গুনটিই আপনাকে জান্নাতী মানুষে পরিনত করেছে। আর এটিই আমরা পারি না।' –মুসনাদে আহমাদ ৩/১৬৬, হাদীস ১২৬৯৭; কিতাবুয যুহদ, হাদীস : ৬৪৬
এই হাদিস থেকে আমরা বুঝতে পারি, নিয়মিত ক্ষমা করতে থাকা, কারও প্রতি রাগ-ঘৃণা-বিদ্বেষ পুষে না রাখা জান্নাতি মানুষের আলামত। এটা শুধু একটা গল্প নয়, এটা আমাদের জীবনের জন্য একটা আলো। আমাদের সমাজে কেউ হঠাৎ বড়লোক হয়ে গেলে তার ব্যাপারে আমাদের কৌতূহল হয়। ধনী হওয়ার রহস্য উন্মোচন করে আমরাও তার মতো ধনী হওয়ার চেষ্টা করি। কিন্তু সাহাবিদের ধ্যানজ্ঞান ছিল পরকাল, জান্নাত। তাই আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) ওই সাহাবির গোপন আমল অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিলেন। আজ আমরাও যদি এইভাবে জান্নাতের রহস্য খুঁজি, তাহলে আমাদের জীবন বদলে যাবে।
আসুন, আমরা হৃদয়টাকে কোমল করি, প্রশস্ত করি, ঋদ্ধ করি, শুদ্ধ করি। সবাইকে ক্ষমা করার মহান গুণ অর্জন করি। তাহলে আমাদের দুনিয়া ও আখিরাত শান্তিময় হয়ে উঠবে। ক্ষমা করা শুধু অন্যের জন্য নয়, এটা আমাদের নিজেদের মুক্তির পথ। যখন রাতে ঘুমুতে যাই, তখন মনে মনে সবাইকে ক্ষমা করে দেই। দেখবেন, সকালে উঠে মনটা কতটা হালকা লাগে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআ'লা আমাদের সবাইকে এই চমৎকার গুণ দান করুন।
হাদিসটির মূল আরবি পাঠ আগ্রহী পাঠকদের জন্য এখানে যুক্ত করে দেওয়া হলো-
(حديث مرفوع) حَدَّثَنَا عَبْدُ الرَّزَّاقِ ، حَدَّثَنَا مَعْمَرٌ ، عَنِ الزُّهْرِيِّ ، قَالَ: أَخْبَرَنِي أَنَسُ بْنُ مَالِكٍ قَالَ: كُنَّا جُلُوسًا مَعَ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَقَالَ:" يَطْلُعُ عَلَيْكُمْ الْآنَ رَجُلٌ مِنْ أَهْلِ الْجَنَّةِ" فَطَلَعَ رَجُلٌ مِنَ الْأَنْصَارِ، تَنْطِفُ لِحْيَتُهُ مِنْ وُضُوئِهِ، قَدْ تَعَلَّقَ نَعْلَيْهِ فِي يَدِهِ الشِّمَالِ، فَلَمَّا كَانَ الْغَدُ، قَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مِثْلَ ذَلِكَ، فَطَلَعَ ذَلِكَ الرَّجُلُ مِثْلَ الْمَرَّةِ الْأُولَى، فَلَمَّا كَانَ الْيَوْمُ الثَّالِثُ، قَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مِثْلَ مَقَالَتِهِ أَيْضًا، فَطَلَعَ ذَلِكَ الرَّجُلُ عَلَى مِثْلِ حَالِهِ الْأُولَى، فَلَمَّا قَامَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، تَبِعَهُ عَبْدُ اللَّهِ بْنُ عَمْرِو بْنِ الْعَاصِ، فَقَالَ: إِنِّي لَاحَيْتُ أَبِي، فَأَقْسَمْتُ أَنْ لَا أَدْخُلَ عَلَيْهِ ثَلَاثًا، فَإِنْ رَأَيْتَ أَنْ تُؤْوِيَنِي إِلَيْكَ حَتَّى تَمْضِيَ، فَعَلْتَ، قَالَ: نَعَمْ، قَالَ: أَنَسٌ وَكَانَ عَبْدُ اللَّهِ يُحَدِّثُ أَنَّهُ بَاتَ مَعَهُ تِلْكَ اللَّيَالِي الثَّلَاثَ، فَلَمْ يَرَهُ يَقُومُ مِنَ اللَّيْلِ شَيْئًا، غَيْرَ أَنَّهُ إِذَا تَعَارَّ وَتَقَلَّبَ عَلَى فِرَاشِهِ ذَكَرَ اللَّهَ عَزَّ وَجَلَّ، وَكَبَّرَ، حَتَّى يَقُومَ لِصَلَاةِ الْفَجْرِ، قَالَ عَبْدُ اللَّهِ غَيْرَ أَنِّي لَمْ أَسْمَعْهُ يَقُولُ إِلَّا خَيْرًا، فَلَمَّا مَضَتْ الثَّلَاثُ لَيَالٍ، وَكِدْتُ أَنْ أَحْتَقِرَ عَمَلَهُ، قُلْتُ يَا عَبْدَ اللَّهِ، إِنِّي لَمْ يَكُنْ بَيْنِي وَبَيْنَ أَبِي غَضَبٌ وَلَا هَجْرٌ ثَمَّ، وَلَكِنْ سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ لَكَ ثَلَاثَ مِرَارٍ" يَطْلُعُ عَلَيْكُمْ الْآنَ رَجُلٌ مِنْ أَهْلِ الْجَنَّةِ" فَطَلَعْتَ أَنْتَ الثَّلَاثَ مِرَارٍ، فَأَرَدْتُ أَنْ آوِيَ إِلَيْكَ، لِأَنْظُرَ مَا عَمَلُكَ فَأَقْتَدِيَ بِهِ، فَلَمْ أَرَكَ تَعْمَلُ كَثِيرَ عَمَلٍ، فَمَا الَّذِي بَلَغَ بِكَ مَا قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ؟ فَقَالَ: مَا هُوَ إِلَّا مَا رَأَيْتَ، قَالَ: فَلَمَّا وَلَّيْتُ دَعَانِي، فَقَالَ: مَا هُوَ إِلَّا مَا رَأَيْتَ، غَيْرَ أَنِّي لَا أَجِدُ فِي نَفْسِي لِأَحَدٍ مِنَ الْمُسْلِمِينَ غِشًّا، وَلَا أَحْسُدُ أَحَدًا عَلَى خَيْرٍ أَعْطَاهُ اللَّهُ إِيَّاهُ، فَقَالَ عَبْدُ اللَّهِ هَذِهِ الَّتِي بَلَغَتْ بِكَ، وَهِيَ الَّتِي لَا نُطِيقُ".
দ্রষ্টব্য: ২০১৮ সালে একটি পোস্টে এই হাদিসের ঘটনাটি উল্লেখ করা হয়েছিল। সেটিই পরিমার্জিত এবং বর্ধিত কলেবরে এখানে পুনঃপ্রকাশ করা হলো।
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:৩৩

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


