সময়টা ২০০১ শেষ হবে হবে। সাভারে বেড়াতে গিয়েছি বড় কাকুর বাসায়। এতো স্পষ্টভাবে মনে রাখার কারণ হচ্ছে,তখন বিজয়ের ৩০ বছর পূর্ণ হয়েছে আর এজন্য সারাদেশ থেকে সকল মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানে বিরাট সংবর্ধনার আয়োজন করেছিল সরকার। তবে এটা শুধু সময় বোঝানোর জন্য উল্লেখ করছিনা, কিছু ব্যাপারও আছে।
বড়কাকুর বাসায় সারাক্ষন টিভির সামনে বসে থাকি। বাংলাদেশ-জিম্বাবুয়ে টেস্ট চলছে। জিম্বাবুয়েকে বাংলাদেশ শেষ ইনিংসে টার্গেট দিয়েছে মাত্র ১১ কি ১২রান (কোনমতে ইনিংস হার এড়াতে পেরেছে)!!! জিম্বাবুয়ে ব্যাটে নেমেছে। বল করতে এসেছে অনূর্ধ্ব-১৯ থেকে জাতীয় দলে চান্স পাওয়া নতুন বোলারটা। এরকম বাচ্চা একটা বোলার, তাও ব্যাটসম্যানরা আগ বাড়িয়ে খেলার সাহস পাচ্ছেনা। অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার,গ্রান্ড ফ্লাওয়ার এর মত ব্যাটসম্যানদেরকেও আগের ম্যাচে ঘাম ঝরিয়ে ছেড়েছে। কি চমৎকার বোলিং!! প্রথম ওভারেই শুন্য রানে দুই উইকেট নাই!!!
হঠাৎ করে কানের কাছে এসে সেজ আপু ঝাড়ি দেয়া শুরু করল, “সারাদিন কি দেখিস এত টেস্ট খেলার? বাইরে গিয়ে একটু ঘুরেও তো আসতে পারিস।"
- আপু বস। এই ছেলেটার খেলা দেখ। অনেক ভাল খেলছে। জানো, এর বাড়ি কিন্তু আমাদের নড়াইলে।
-তাই! কি নাম?
-মাশরাফি বিন মুর্তাজা কৌশিক।
-কি বলি...স কৌশিক!!! ভিক্টোরিয়া কলেজের কৌশিক ?!
-তা তো জানি না। তুমি চেন নাকি?
-না। মেজ আপুর এক ক্লাসমেট আছে কৌশিক,অনূর্ধ্ব-১৯ দলের ক্যাপ্টেন ছিল।
-হ্যা হ্যা ঐ কৌশিকই। অনূর্ধ্ব-১৯ এ এত ভালো খেলেছে যে একবারেই জাতীয় দলে খেলতে নিয়ে নিয়েছে। আপু,আপু,মেজ আপুকে বলনা আমি কৌশিকের সাথে দেখা করব। বলনা আপু প্লি...জ।
-আচ্ছা দেখি। আগে খেলা দেখতে দে।............একি! বাংলাদেশ হেরে গেল। কি খেলল কৌশিক!?
-কি খেলল মানে! মাত্র ১১ রান টার্গেট। তারপরও কৌশিক ফার্স্ট ওভারেই ২ উইকেট ফেলে দিয়েছে। যদি অন্তত ১০০রানও টার্গেট দিত,কৌশিক একাই এ ম্যাচ জিতিয়ে আনত বুঝেছ? তুমি যাওতো এখন। আমার জন্য তোমার কিছু করতে হবে না।
টিভি অফ করে চুপচাপ বসে থাকলাম।
ক্লাস সিক্সে পড়ি। কতইবা বয়স। এই বয়সের ভাল লাগা বেশী দিন থাকে না। কিন্তু আমার আছে,এখনো আছে। সারা জীবন থাকবে। কারণ এটা শুধু আমার ভাল লাগা না, আমার প্রথম প্রেম। আর প্রথম প্রেমের কথাতো কখনই ভোলা যায় না,তাই না?!
এরপর থেকে বাংলাদেশের খেলা হলে শুধু অপেক্ষা করি কখন মাশরাফি আসবে,কখন উইকেট নেবে। বাংলাদেশের অনেক বিজয়ের বীর মাশরাফি,আমার অনেক স্মৃতির ভাগিদার মাশরাফি। সেসব স্মৃতির সাক্ষী আপনারাও। কিছু স্মৃতি শেয়ার না করলেই না।
“ধরে দিবানি”...... মনে হয় আর কিছু না বলে দিলেও চলবে। ২০০৭ বিশ্বকাপে ভারতের সাথে ম্যাচের আগে ভাইস ক্যাপ্টেন ‘ম্যাশ’ শুধু বলেছিল-“ইন্ডিয়ারে ধরে দিবানি।” সেই ম্যাচ এখন ইতিহাস, আর ইতিহাসের নায়ক “ম্যাশ”(৯.৩-২-৩৮-৪)।
ম্যাচ চলাকালীন একটা ছবি দিলাম-‘ম্যাশ’এর পারফর্মেন্সের।
“হরতাল’’......শুধুমাত্র একজন খেলোয়াড়ের জন্য। পৃথিবীর আর কোথাও হয়েছে কিনা আমার জানা নেই। তবে বাংলাদেশে হয়েছে। ২০১১-র বিশ্বকাপের চূড়ান্ত দলে জায়গা হয়নি মাশরাফির। আমার মত অসংখ্য ভক্ত এটা শোনার পর চূড়ান্তভাবে হতাশ হয়ে পড়ে। ভেবেছিলাম ম্যাশকে না খেলান হলেও দলে রাখা হবে। দেশের নানা জায়গায় মানববন্ধন হয়,মিডিয়ায় তর্ক বিতর্কের ঝড় ওঠে। আর শোক সহ্য করতে না পেরে নড়াইলবাসীরা হরতালই ডেকে বসে।
যার কারনে ম্যাশের দলে জায়গা হয়নি সেই ভিলেন আর কেউ না-ইঞ্জুরি। ম্যাশকে যতটা না প্রতিপক্ষের সাথে লড়াই করতে হয়েছে,তারচে বেশি লড়াই করতে হয়েছে এই দানবের সাথে। ম্যাশের অভাব বাংলাদেশ টিম বিশ্বকাপে হাড়ে হাড়েই টের পেয়েছে। বিশ্বকাপে ম্যাশের জায়গা পাওয়া না পাওয়ার ব্যাপারটা যে তর্ক বিতর্কের উর্ধ্বে তা ম্যাশ নিজেই বুঝিয়ে দিয়েছেন-একটা বিশ্বকাপ খেলতে গিয়ে যদি আবার ইঞ্জুরিতে পড়তে হয় তবে তা হবে মারাত্মক।হয়ত সারা জীবনই দলের বাইরে থাকতে হবে। তারচে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে মাঠে ফেরাটাই দলের জন্য যেমন ভাল,আমার নিজের জন্যও ভাল।
কৌশিক ওরফে ‘পাগলা’ ম্যাশ ইঞ্জুরিকে জয় করে আবার মাঠে ফিরেছে সবাই জানে। এটা আমাদের জন্য অনেক খুশির ব্যাপার। এপর্যন্ত একাই অনেক ম্যাচ সে জিতিয়েছে,ভবিষ্যতেও জেতাবে। যেদিন বল হাতে উইকেট পায় নি, সেদিন ব্যাটকে তলোয়ার বানিয়ে খেলেছে। এসব ম্যাচের বিবরন আমার থেকে আপনারাই ভাল দিতে পারবেন।
এবার একটু অন্য বিষয়ে বলতে চাই। বিজয়ের ৩০তম বছরে বাংলাদেশ পেয়েছিল মাশরাফির মত একজন খেলোয়াড়। সে তার সামর্থ্যের মধ্যে দেশকে কতটুকু দিতে পেরেছে তা বলার অপেক্ষা রাখেনা।তামিম,সাকিব,মুশফিক,নাসির,রাজ্জাক,রিয়াদ,আশরাফুল,রফিক,বুলবুল,সুজন,পাইলট,দুর্জয়,সুমনের মত খেলোয়াড়দের বেলায়ও একথা সত্য। (রাসেলকেও আমি এই মিছিলে রাখতে চাই। তার মত বোলার কেন এত দীর্ঘ সময় কোন কারণ ছাড়াই জাতীয় দলে সুযোগ পায়না তা আমার জানা নেই।) একটা সময় ছিল যখন আমরা মারামারি করতাম আনোয়ার-আফ্রিদি আর শচীন-সৌরভ কে নিয়ে। খেলার সময় বলতাম এটা জয়সুরিয়ার শট, এটা ম্যাকগ্রার সুইং, এটা জন্টি রোডসের ক্যাচ,আজকে ব্যাটে নেমেছি লারার মত ৪০০ না করে উঠবো না............আরো কত কি!!! আর আজকে আমার গলির ক্ষুদে বোলারটা বলে, “ভাই,দেখেন তো আমার স্টাইল মাশরাফির মত না! আর এইসব পোলাপাইন মানতেই চায়না।” আমার ছোট ভাইকে যখন বল করি তখন ছয় মেরে বলে, “ভাইয়া,ভয় পাইছো? এইটা তামিমের শট।” বল হাতে নিয়ে আমার ছয় বছরের ভাইপো বলে, “চাচ্চু,আমি এই বলটা করব সাকিবের মত।”... এই অনুভূতিগুলো আসলে বলে বোঝানোর মত না। আমি জানি,আজকে বাংলাদেশের যেখানেই যাই আমাকে এই কথাই শুনতে হবে।
৭১এ আমাদের বাবা-চাচারা অনেক কিছুই হারিয়েছেন,অনেক কিছুই ত্যাগ করেছেন। কিসের জন্য? এই ছোট্ট দেশটার জন্য। তাঁরা শুধু হাসি ফোটাতে চেয়েছিলেন বাংলা মায়ের মুখে, চেয়েছিলেন মায়ের সন্তানেরা বুক ভরে নিঃশ্বাস নিক স্বাধীন বাতাসে। আজ তাদের অনেকেই নেই। যারা আছেন নিশ্চয়ই তাদের বুকটা গর্বে ভরে যায় এটা ভেবে যে-‘তারা বাংলাদেশকে একটা মানচিত্র দিয়েছেন, দিয়েছেন লাল-সবুজে রাঙানো একটা পতাকা। আর সবার কাছে সেই মানচিত্রকে চিনিয়েছে,সারা দুনিয়ায় লাল-সবুজের পতাকা উড়িয়েছে তাদেরই সন্তান মাশরাফি,সাকিব,তামিম,মুশফিক......।’ আমাদের নতুন দিনের বীর,আমাদের নতুন দিনের যোদ্ধা।
গতকাল ছিল আমার জান -‘পাগলা’ ম্যাশ এর হ্যাপ্পি বার্থডে ।ব্যস্ততার জন্য লেখাটা সময় মত পোস্ট করতে পারিনি। জানের জন্য অনেক অনেক শুভেচ্ছা, জানের কিউট পিচ্চিটার জন্য অনেক অনেক আদর। আল্লাহ, আমার জানটাকে আর ইঞ্জুরি দিও না। তাকে তুমি সবদিক থেকে সুখে রেখ।
ছবিঃগুগল
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা ডিসেম্বর, ২০১২ রাত ২:১৭

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।





