আমি সাধারনতঃ ফেসবুকের নিউজফীড খুবই মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করি। খুবই গুরুত্বপূর্ণ কিছূ তথ্য পাওয়া যায় এখানে। যেমন: ঢাকার এক সাংবাদিক বন্ধূ তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখলো , “ ঢাকা শহরের জ্যাম এমন এক পর্যায়ে পৌচেছে কিছু বলার আর নাই। মন খারাপ হয়ে যায়।” তার স্ট্যাটাসের নীচে বন্ধুরা কমেন্ট করে। মন খারাপ ইমো। কমপক্ষে ৬ জন। বিজ্ঞাপন সংস্থায় কাজ করে এরকম এক রসিক বন্ধূ যানজট নিয়ে তিতি বিরক্ত হয়ে মজার মজার স্ট্যাটাস দেয়। সবচেয়ে নতুনটা হল, “জ্যাম, ব্রেড কই?”। আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থার একজন কর্তা ব্যক্তি স্ট্যাটাসে লিখলেন , “ঢাকার জ্যামে আছি।” আধা ঘন্টার মধ্যে তার বন্ধুরা মতামত দিতে শুরু করলো কিভাবে এই সময়টা কাজে লাগানো যায়। কেউ ঘুমাতে, কেউ “চীল ইউট” করার পরামর্শ দেয়। মন্তব্যগুলো একটির চেয়ে আরেকটি বেশী কৌতুক কর।
সাধারণ মানুষের কৌতুকে সা¤প্রতিক আরেকটি উপাদান হল- ডিজিটাল। এ বছরের নির্বাচনের পর পর আমার বাবা-মা নোয়াখালী ঘুরে এসে গল্প করছিলেন। গ্রামে সারা দিনেও এক ঘন্ট্ াবিদ্যুৎ থাকে না। সকলের জীবন অতিষ্ঠ। দশ মিনিটের জন্য বিদ্যুৎ এসে চলে যায়। বিদ্যুৎ যাবার সাথে সাথে বাচ্চা কাচ্চারা একসাথে চিৎকার করে , “ ডিজিটাল বাংলাদেশ।” এবং বয়স্করা সেটা নিয়ে হাসাহাসি করেন। ফেসবুকেও ডিজিটাল কৌতুকের ছড়াছড়ি। খবর: র্যাবের ক্রস ফায়ারে মানুষ হত্যা। মতামত: ইহা হয় ডিজিটাল বাংলাদেশ। খবর: গার্মেন্টস শ্রমিকদের বিদ্রোহ যে কোন মূল্যে দমাতে হবে। মতামত: এই তো চাই! ডিজিটাল বাংলাদেশ বলে কথা!। খবর: পাহাড়ী ছাত্রদের রাষ্ট্রের সশস্ত্র বাহিনী তুলে নিয়ে গেছে। কোন পরিষ্কার ব্যাখ্যা ছাড়া; পত্রিকার সম্পাদকের উপর রাগ তার সহকর্মী সাংবাদিকের উপর ঝাড়া হচ্ছে। র্যাব দিয়ে পিটিয়ে। খবরের তো আর শেষ নেই। আমার মূল র্পবেক্ষণ হচ্ছে সাধারণ মানুষ এই সব খবরকে কোন না কোনভাবে ডিজিটাল বাংলাদেশের সাথে যুক্ত করে কৌতুক করবেই। বর্তমান সরকারী দলের প্রধানের নির্বাচনী আশার বানী যে মানুষের মনে কৌতুকের উদ্রেক করেছে সেটা এর মাধ্যমে বোঝা যায়।
সাধারণ মানুষ তার দৈনন্দিন জীবনে কর্তাদের (যেমন: স্বামী, রাষ্ট্র, বাজার, বিশ্বায়ন ইত্যাদি) কৃত কর্মে ভুগতে ভুগতে কৌতুকের দ্বারা তাদের অষন্তোষ, বিরক্তি, অতৃপ্তি, ক্ষোভ প্রকাশ করে। সাধারণ মানুষ বোকা না। তারা যে চুপচাপ বসে আছে সেটা ঠিক না। সাধারণ মানুষ সারাক্ষনই তাদের প্রতিবাদ জানিয়ে যাচ্ছে। উপরের উদাহরণগুলো ফোকলোর ও নৃবিজ্ঞানীদের সেই যুক্তিকেই শক্তিশালী করে। তবে আমাদের দুর্ভাগ্য যে কর্তারা সাধারণ মানুষের প্রতিবাদ শুনবেন না বলেই পণ করেছেন। অন্তত তাদের হাবে ভাবে কাজে তাই মনে হচ্ছে।
কয়েকদিন আগে সুরঞ্জিত সেন গুপ্তের একটি উক্তি দেখলাম প্রথম আলোর আজকের দিনের উক্তি বিভাগে। তিনি অর্থমন্ত্রীকে প্রশ্ন করছেন দেশে বিদ্যুৎ নাই তাহলে কি দিয়ে তিনি (অর্থ মন্ত্রী) দেশের উন্নতি করবেন? এই উক্তিটি একটি উদাহরণ হিসেবে নেয়া যেতে পারে। যার মাধ্যমে সাধারণ মানুষের সাথে প্রচলিত উন্নয়ন ধারার ব্যবধানটা বোঝা যায়। আকাশের উন্নয়ন ধারা মাটিতে নামছেনা বলেই অষন্তোষ তৈরী হচ্ছে এবং বিভিন্নভাবে প্রকাশ পাচ্ছে বলে অনেকে মনে করেন।
প্রশ্নের উত্তর খুঁজলে কতগুলো প্রশ্ন আগে আসে। কাপ্তাই বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামে যারা জমি হারিয়েছেন, সংস্কৃতি-স্মৃতি-পূর্বপুরুষের আত্মাদের হারিয়েছেন তাদের কাছে বিদ্যুৎ কি উন্নতির আনলো? কাপ্তাই বাঁধ নিয়ে বিরোধকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা পার্বত্য চট্ট্রগামের জনগনের তিন দশকের বেশী সময় ধরে করা স্বাধীকার আন্দোলনে যারা জীবন হারিয়েছেন এবং এখনও যারা তাদের স্বকীয়তার জন্য লড়াই করে যাচ্ছেন তাদের কাছে বিদ্যুৎ আর উন্নয়নের এই সরল সংযুক্তি কি গ্রহণযোগ্য? নাকি “ওদের” উন্নয়নের তালিকা থেকে বাদ দেয়া হয়েছে?
২০০৬ সালে কানসাটে পল্লী বিদ্যুৎ প্রজেক্ট কাজ না করায় মানুষের ক্ষোভ জোট বাঁধলো। গ্রামের পর গ্রাম মানুষ বলল যে পল্লী বিদ্যুতে তাদের উন্নয়ন হচ্ছেনা। তারা বলল পল্লী বিদ্যুতের কারণে তাদের বেশী টাকা কর পরিশোধ করতে হয়। তাতে গ্রামের গবীব চাষীর কোন লাভ হয়না। বরং কষ্ট বাড়ে। নাকি “্ওদের” আরামের কথা উন্নয়নে ভাবা হয়নি?
২০০৬ এ আরেকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ফুলবাড়ির সাধারণ মানুষের কয়লা খনি বিরোধী আন্দোলন। সেখানকার মানুষের বক্তব্য বসত বাড়ি ধ্বংস করে কয়লাখনি চাই না। তারা তাদের মাটির বাড়ি আর ফসলের জমি নিয়েই থাকতে চায়। তারা বলে এই এলাকা থেকে বছরে তিনবার ফসল যায়। ট্রাক ভরে ভরে ধান যায় রাজধানীর দিকে। শীতের সময় সবজী যায়। গ্রীষ্মে যায় আম , লীচু। তাও সরকার তাদের ঘর ছাড়া করবে? এশিয়া এনার্জি কি দেবে সরকারকে? এশিয়া এনার্জি যদি গ্রামে ঢুকে পড়ে তাহলে কিছু থাকবেনা। গাছ পালা, নদী, মাছ, ফসলের জমি কিছুই থাকবে না। কি খাবে তখন সরকার? নাকি “ওদের” অবদান অস্বীকার করাই উন্নয়নের ধর্ম?
অনেক বৈজ্ঞানীক তথ্য, গবেষণা ও যুক্তি থাকার পরও বাংলাদেশের উন্নয়ন ধারা পশ্চিমা ধ্যাণ ধারনার উপর পূর্ণ বিশ্বাস রেখে বসে আছে। অথচ এই বিশ্বাসের আগে পশ্চিমা উন্নয়নের ভিত্তিটা দেখা দরকার। উন্নয়নের শীর্ষে আছে যারা তাদের উন্নয়নের রসদ এসেছে উপনিবেশগুলো থেকে। বাংলাদেশের কি সেই বাস্তবতা আছে যে হীরা আসবে এ দেশ থেকে, মজুর আসবে অন্য দেশ থেকে, কফি আসবে আরেক দেশ থেকে ? নাকি আছে শিল্প বিপ্লবের সম্ভাবনা? সাধারণ মানুষ কি আশা করে ঢাকার আকাশে পাতালে মেট্রো রেল চলবে, রাস্তায় ট্রাম চলবে, বাস চলবে, প্রশস্ত ফুটপাথ থাকবে, সেখানে দোকান বসানোর জন্য গরীব মানুষের ঢল থাকবেনা, বস্তি থাকবেনা?
আমরা আমাদের বাস্তবতা জানি। আমাদের এর মধ্যেই কোনমতে দিন গুজরান হলেই চলে। কিন্তু সেটা না শুনে পুলিশের বুটের লাথিতে হকার সরিয়ে পুটপাথ পরিষ্কার করে, মাস্তান লাগিয়ে বস্তি পুড়িয়ে পরিষ্কার করে, মানুষ মেরে উন্নয়নের প্রদর্শনী করা এ কেমন উন্নয়ন?

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।





