মাননীয় প্রধানমন্ত্রী,
আমরা নতুন প্রজন্মের এক কোটি ভোটার, যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী, যারা যুদ্ধাপরাধী ও তাদের দোসরদের ঠেকাতে আপনাকে দেশের প্রধানমন্ত্রী বানিয়েছি, তারা আজ আকুল আবেদন করছি, আমাদের এক বন্ধু, নতুন প্রজন্মের প্রতিনিধিত্বকারী ঝালকাঠির লিমন, আপনার আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে পঙ্গু হয়ে হাসপাতালে কাতরাচ্ছে। তার সকল স্বপ্ন ধূলিস্যাৎ হয়ে গেছে। তারপরও বাঁচার এতটুকু আশা তার বুকে ছিল। একটি পা নেই, অপর একটি পায়েই দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখছিল, সেই স্বপ্ন আবারো দুঃস্বপ্নে পরিণত হতে যাচ্ছে।
পঙ্গু লিমনের ঘটনাটি সবার জানা। নতুন করে কিছু বলার নেই। আমরা অপেক্ষা করছিলাম হয়তো লিমনের বিরুদ্ধে র্যাবের দায়ের করা মামলা দুটি প্রত্যাহার করা হবে। কিন্তু না, আজকের প্রত্রিকায় প্রকাশ, তরিৎকর্মা পুলিশ, মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশ লিমনের বিরুদ্ধে দায়ের করা অস্ত্র মামলার চার্জশীট দিয়েছে, লিমনকে দোষী সাব্যস্ত করে। দুই দিন পর বিষয়টি মিডিয়াকর্মীরা জানতে পেরেছে। এর আগে লিমনের মায়ের করা মামলাটি থানায় রেকর্ড করা নিয়ে পুলিশের যে লুকোচুরি মনোভাব তা আমরা প্রত্যক্ষ করেছি।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী,
আপনি যদি নিজে লিমনের নিষ্পাপ মুখটি সরাসরি একবার দেখতে পেতেন। আমার বিশ্বাস, আপনি লিমনের মুখটি দেখেই একবাক্যে বলে দিতেন, নিষ্পাপ এই ছেলেটি কোনো অপরাধ করতে পারে না। জানি, সেটি আমাদের কল্পনা, লিমন অতি সাধারণ এক তরুণ। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত এক অঞ্চলে তার বেড়ে ওঠা। তাকে দেখার সময় আপনার নেই। তবে হয়তোবা মিডিয়ার কল্যাণে কিংবা আপনার চারপাশের চাটুকারীদের কাছ থেকে আপনি কিছু না কিছু শুনেছেন, হয়তো মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আপনাকে আশ্বস্ত করছে অথবা লিমন একটা খারাপ ছেলে এমনটি বোঝানো হয়েছে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আমাদের মতো এক কোটি লিমনের ভোটেই কিন্তু এবার আপনার দল আওয়ামী লীগ নির্বাচনে জয়লাভ করেছে। অতএব আমাদের এতটুকু অবহেলা করবেন না। আমাদের মৌলিক সব সমস্যা সমাধান করে দিতে না পারেন তবে নিজের পায়ে দাঁড়াতে বাধা দিবেন না। আমাদের পা কেড়ে নিবেন না।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী,
এক কোটি লিমনের চাইতে মাত্র ছয়জন র্যাব সদস্য আপনার কাছে বড় হতে পারে না। তাদের বাঁচাতে আপনার আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীরা যা করছে তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। র্যাবের মতো একটি এলিট বাহিনীর সকল সুনাম কাঁদায় ফেলতেও তারা দ্বিধা করছে না। আপনার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, লিমনকে ঘিরে অন্তত ছয়টি কমিটি তদন্ত করছে।
তাদের তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার আগেই আপনার পুলিশ বাহিনী লিমনকে সন্ত্রাসী, সন্ত্রাসীর সহযোগী, অস্ত্রধারী বানিয়ে আদালতে অভিযোগপত্র দিয়ে দিল। তাহলে তদন্ত কমিটির কাজটা কী হবে? আপনার এলিট ফোর্স র্যাবের মাননীয় ডিজি সাহেবও সাংবাদিকদের বলেছিলেন, লিমন ঘটনার শিকার। লিমন যদি ঘটনার শিকারই হয় তাহলে তাকে অস্ত্র মামলায় অভিযোগ দেয়া হলো কেন?
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী,
সাংবাদিকতার পেশার সঙ্গে যুক্ত থাকায়, অ্যাসাইনমেন্টের বাইরেও আমি একবার পঙ্গু হাসপাতালে লিমনের কাছে গিয়ে ছিলাম। লিমনের সঙ্গে কথা বলেছি দীর্ঘ সময়। লিমন এসএসসিতে জিপিএ ৪ পয়েন্ট পেয়েছে। গ্রামের একজন দিন মজুর ছেলে যে, ছুটির সময়ে মাঠে-ঘাটে কাজ করে, তার কিন্তু এ গ্রেড বা জিপিএ ৪ পাওয়া কম কঠিন নয়। লিমন বলেছিল, পরীক্ষার সময় তার জ্বর হয়েছিল, তা না হলে তার রেজাল্ট আরো ভালো হতো। এখন তার একটি পা নেই, দারিদ্র্যতার সংসারে এখন তো তার আর কাজ করে পড়াশোনার খরচ চালানোর উপায় নেই। তার ভবিষ্যত কি এখানেই স্থীর হয়ে যাবে। সেদিনের সেই ঘটনা সম্পর্কে লিমন অবশ্য এখনো সৃষ্টিকর্তার কাছে সবসময় শোকরানা আদায় করে। এক পা হারিয়েও তার এতটা দুঃখ নেই, কারণ পা হারিয়েও এখনো সে বেঁচে আছে। তা না হলে ওই র্যাব নামধারী যমদূত যে তার মাথায় পিস্তল তাক করেছিল। লিমনের ভাষ্য, ‘মাথায় গুলি করতে চাইলে আমি তার পা জড়াই ধইর্যা প্রাণডা ভিক্ষা চাই।’ লিমন বলছিল, ‘স্যার আমারে প্রাণে মাইরেন না, আমারে মাইর্যা ফালাইনে না।’
হায়রে আমার সোনার বাংলাদেশ!
ব্যক্তিগতভাবে আমি র্যাবের সামগ্রিক কর্মকান্ডের উপর খুশিও না বেজারও না। সমান সমান। তারা যখন চিহ্নিত কোনো সন্ত্রাসীকে (যার হাতে অসংখ্য মানুষ নির্যাতিত বা নিহত হয়েছে) ধরে আমি খুশি হই, এমনকি তাদের ক্রসফায়ারে দিলেও। কিন্তু মনটা প্রচন্ড খারাপ হয় যখন এই ধারাবাহিকতায় নিরপরাধ মানুষকে বলি দেয়া হয়। সন্ত্রাসীদের ধরে ক্রসফায়ার বা হাটুতে গুলি করা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কিঞ্চিত পক্ষ নেয়ার আমার একটা যুক্তি রয়েছে। আমাদের দেশের বিচারব্যবস্থা অনেকটা টাকার উপর নির্ভর করে। টাকা থাকলে সবই সম্ভব। খুনের মামলা থেকে পর্যন্ত জামিনে বেড়িয়ে যায়। রাজনৈতিক বিবেচনাতো রয়েছেই। আবার জেলও নিরাপদ না, শোনা যায় জেলে আরাম-আয়েশে থেকেই নাকি সন্ত্রাসীরা তাদের এলাকার চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসী, খুন-খারাবী নিয়ন্ত্রণ করে। তাহলে কুখ্যাত সন্ত্রাসীদের ধরে বিচার পর্যন্ত অপেক্ষা করার চাইতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর এই কাজটি আমি কিঞ্চিত সমর্থন করি।
তাই বলে তারা যখন লিমনের মতো নিষ্পাপ এক তরুণকে বিনাদোষে গুলি, পরে তাকে সন্ত্রাসী বানানোর প্রাণান্ত চেষ্টা করবে তখন চুপ করে বসে থাকা যায় না। আসুন আমরা প্রতিবাদ করতেই থাকি।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, শেষ পর্যন্ত যদি আমাদের প্রতিবাদ বিফলে যায়, তাহলে আসছে নির্বাচন, দশম সংসদ নির্বাচন, আমরা এক কোটি তরুণ ভোটার, এক কোটি লিমন কিন্তু নতুন কিছু খুঁজে বের করবই।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে এপ্রিল, ২০১১ সন্ধ্যা ৭:০৬

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




