১.
ধীরে ধীরে চোখ খুলার চেষ্টা করলো আব্দুল গফুর। চোখের পাতা একটু ফাঁক করতেই তার চোখে এসে ঢুকল রাজ্যের আলোকরশ্মি । এতো তীব্র আলোকরশ্মি সহ্য করতে না পেরে সে আবার চোখ বন্ধ করে দেয়। আব্দুল গফুর তার শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ অনুভব করার চেষ্টা করে, কিছুটা বাতাস নাসারন্ধ্র দিয়ে ভিতরে ঢুকিয়ে নেয়। দুই হাতের আঙুলগুলো নাড়াচাড়া করার চেষ্টা করে, কিন্তু পারেনা। একটু একটু করে সচল হয়ে উঠা মস্তিষ্ক দিয়ে আব্দুল গফুর তার অস্তিত্ব পরখ করে নেয়। হাতের আঙুলগুলো সে অনুভব করতে পারছে না। তাহলে তার হাতে কি কোন আঙুল নেই? নাকী আঙুল গুলো কেউ খুলে নিয়েছে? আব্দুল গফুর এসব ভাবে। ভাবতে ভাবতে আরেকবার চোখ খুলার চেষ্টা করে দেখে । কিন্তু পারেনা। আবারো অসং্খ্য আলোকরশ্মি এসে তার চোখের ভেতর ঢুকে পুড়িয়ে দিতে চায়। আব্দুল গফুর আবার চোখ বন্ধ করে দেয়।
আব্দুল গফুরের সাথে কি ঘটেছিলো সেটা জানতে হলে চলে যেতে হবে পিছনে। গল্পের শুরুতে । সেদিন আব্দুল গফুরের মনে হলো তার আয়না কিনতে হবে । কারণ তার বাসায় কোন আয়না নেই। কেন নেই, এতদিন আয়না ছাড়া কিভাবে কাটল ; এসব প্রশ্ন আব্দুল গফুরের করোটির ভিতর ঘুরপাক খেতে থাকলেও বেশিক্ষণ টেকে না । আব্দুল গফুর গায়ে খয়েরি রঙয়ের শার্ট জড়িয়ে বেরিয়ে পরে। গন্ত্যব্য আয়নার দোকান। কিন্তু আয়না ঠিক কোথায় কিনতে পাওয়া যায় আব্দুল গফুর সেটা জানেনা । সে আফসোসের শ্বাসবায়ু ছাড়ে। কতকিছুই অজানা তার। আব্দুল গফুর মনস্থির করে কাওকে জিজ্ঞেস করে আয়না কোথায় কিনতে পাওয়া যায় সেটা জেনে নেবে।
সিগারেট ধরিয়ে সে রাস্তার ধার দিয়ে হাটতে থাকে।
কিছুক্ষণ হাটার পর আব্দুল গফুর এক চায়ের দোকানে এসে জিজ্ঞেস করে আয়না কোথায় পাওয়া যায়। চায়ের দোকানে বসে থাকা একজন বলল, আয়না কিনবার চাইলে গঞ্জের বাজারে যাওন লাগব। গঞ্জের বাজারে ভিতরের দিকে ২ নাম্বার গলিতে আয়নার দোকান পাইবেন। আব্দুল গফুর রিক্সায় করে দশ মিনিটের মধ্যেই গঞ্জের বাজারে চলে যায়। ততক্ষণে আকাশে মেঘ জমাট বাধতে শুরু করেছে । আকাশের কিছুকিছু অংশে গাঢ় কৃষ্ণবর্ণের মেঘ। আব্দুল গফুর একবার আকাশের দিকে তাকায় এবং পট করে চোখ নামিয়ে নেয়। বৃষ্টি আসার আগেই তার আয়নার দোকান খুঁজে বের করতে হবে।
বর্ষণ শুরু হবার ঠিক আগেই আব্দুল গফুর আয়নার দোকান খুঁজে বার করে । অন্য সব দোকান থেকে এটি একটু আলাদা, বিচ্ছিন্ন। আব্দুল গফুর তাড়াতাড়ি দোকানের ভেতর ঢুকে। মেঘেদের দল তখন আকাশ থেকে ভেঙে পড়তে শুরু করেছে। দোকানে ঢোকার পরই আব্দুল গফুরের মনে হচ্ছে সে একজন না। অনেকজন। সেলুনে গেলে যেরকম দেখা যায়। সে বিভিন্ন শেলফে সাজিয়ে রাখা আয়না গুলো দেখতে থাকে। সব আয়নাই একরকম। শুধু সাইজ কোনটার ছোট, কোনটার বড়। তার বড় সাইজের আয়নার দরকার নেই। মাঝারি ধরনের একটা হলেই চলে। আয়নার দাম জিজ্ঞেস করার জন্য আব্দুল গফুর দোকানী কে খুঁজে। কিন্তু আব্দুল গফুর এটা লক্ষ্য করে নি যে দোকানে একমাত্র ব্যক্তি এখন সে নিজেই। আর কেউ এখানে নেই। ঠিক তখনই ঘটনার সূত্রপাত। আব্দুল গফুরের সামনে থাকা আয়না তাকে টেনে নিতে থাকে। এক সেকেন্ডের ভগ্নাংশ সময়ে আব্দুল গফুরকে আয়না পুরোপুরি গ্রাস করে ফেলে। দোকান টা তখনও খালি থাকে। আব্দুল গফুর আয়নার ভেতর ঢুকে যাওয়ার পর পেছনের দরজা দিয়ে একটা বিড়ালকে নিঃশব্দে ঢুকতে দেখা যায়।
২.
আব্দুল গফুর এবার চোখ খুলে । অনেক কষ্টে উঠে দাড়ায়। হাত-পায়ের আঙুল গুলো ঠিকই আছে। অন্যান্য অংশগুলোও। উঠে দাঁড়ানোর পর আব্দুল গফুর চারদিকে তাকায়। কোথাও কিছু নেই আয়না ছাড়া। উপর-নীচ, ডান-বাম সবদিকে সাজানো আছে অসং্খ্য আয়না। সেসব আয়না থেকে প্রতিফলিত হয়ে আসছে আব্দুল গফুরের সুঠাম দেহের বিম্ব। কিছুক্ষন পর আব্দুল গফুর আবিস্কার করে তার পিছনে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে অসং্খ্য বিড়াল। কালো, সাদা, লাল, সবুজ রঙয়ের বিড়াল। কারো চোখ নেই, কারো বা একটি চোখ অথবা স্বাভাবিক বিড়ালের মতই দুটি চোখ। যেগুলো দেখতে অবিকল মার্বেলের ন্যায়। বিড়াল গুলো একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে আব্দুল গফুরের দিকে। যেন আব্দুল গফুর তাদের সেনাপতি । তারা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে তাদের দলপতির কমান্ডের। আব্দুল গফুর বিড়ালের সং্খ্যা অনুমান করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। আলো যতদূর থেকে তার চোখে এসে পড়ছে ততদূর পর্যন্ত দাঁড়িয়ে আছে অসীম সং্খ্যক বিড়াল।
আব্দুল গফুর হঠাৎ বুঝতে পারে, আয়নায় বিড়ালদের প্রতিবিম্ব নেই।