আমাদের বাড়িতে গৃহকর্মীদের মাঝে ঝগড়া বিবাদ, কৌতুক আনন্দ, লড়াই বড়াই, প্রেম বিবাহ, আত্মীয়তার বন্ধন কোনোটাই নতুন নয়। প্রায়ই তারা যেমনই বিবাদ কলহে মেতে ওঠে তেমনই দুদিন পরেই আবার গলায় গলায় গলাগলি। আমি খুঁজেই পাই না কোন মন্ত্রবলে তারা গলাগলি আর গালাগালিকে একই সুতোয় বেঁধে ফেলেছে কবে ও কখন। তবে তারা আমাদের জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং আমি একশো কোটিবার স্মীকার করছি আমাদের জীবনের সকল সাফল্যে তাদের অবদানও কম নয়। আমাদের সকল আনন্দ বেদনা হাসি ও আনন্দে তাদের সহমর্মিতা, সমবেদনা ও ভালোবাসা জড়িয়ে থাকে। যাইহোক বলছিলাম সেই সব ইতিহাসের মাঝেই নতুন করে সুচিত আরেক ইতিহাস শিমুল ফুল ও রুপার দুলের গল্প।
শিমুল এক ২৫/২৬ বছরের ছেলে এই বাড়িতে ১৪/১৫ বছর যাবৎ আছে। এসেছিলো পুচকে এক ছেলে। গাড়ি ধোয়া, সিড়ি মোছা যার কাজ ছিলো সেই পুচকেই এখন হম্বি তম্বীতে একাই একশো হয়ে হয়েছেন এ বাড়ির রাত প্রহরী। তার আরও এক জমজ ভাই আছে এই বাড়িতেই। সেও পুচকে থেকে বুদ্ধিমত্তা আর আদব লেহাজের জোরে ড্রাইভিং শিখে হয়েছেন এই বাড়ির এক নং ড্রাইভার। একটা কথা কানে কানে বলি আমি যে সারাদিন গাড়ি চালিয়ে চালিয়ে মিউজিক ভিডিও বানিয়ে বেড়াই সেই ভিডিওগুলা কিন্তু এই শামীমই করে হা হা ।


আমি যে কদিন আগে অস্ট্রেলিয়া গেলাম ফিরে এসে শুনি আমাদের মিঃ শিমুল নাকি প্রেমে পড়ে গেছেন আমাদের বাসার খুবই লক্ষীমন্ত কন্যা রুপামনির। প্রেম মানে এমনই প্রেম যে তাহারা দোহে এক না হইতে পারিলে ইহ জীবনই আর রাখিতে পারিবেক লাই। কিন্তু এইখানে বাঁধা তাহার একমাত্র জমজভাই শামীম। সে কিছুতেই রুপামনিকে তার ভায়ের বৌ হিসাবে মানবেই না। সারা বাড়িতে সে দক্ষ যক্ষ লাগিয়ে দিলো। রুপা আমার কাছে কাঁদো কাঁদো হয়ে এসে বললো, আফা আপনে আমাদের বিয়ের ব্যবস্থা করেন। আমি শিমুলবাইরেই বিয়া করমু। আমি তো হা, একেবারেই মাছি ঢোকা হা। চোখ গুলুগুলু করে তাকিয়ে রইলাম। মনে মনে অবশ্য বলিলাম- ব্রাভো। বাঘের বাচ্চা বাঘিনী রুপা। সাহসের বলিহারি যাই। এই না হলে তুই আজকের মেয়ে! আমাদের দেশে জন্মে গেছে সেই মেয়ে আজি কথায় না বড় হয়ে সকল কাজের কাজী...................
যাইহোক এই বিয়ে নিয়ে কুরুক্ষেত্র লেগে গেলো দুই ভায়ের মাঝে। আমাদের বাড়িতেই তখন রাম রাবনের যুদ্ধ। আর এই সীতা! মোটেও অবলা নহে তিনি স্বয়ংম্বরা যুদ্ধাংদেহী। ধেই ধেই করে তান্ডব নৃত্য নাচছেন। এমন দুঃসাহসী প্রেমিক প্রেমিকা বুঝি আজকের দিনেই দেখা সম্ভব। যাইহোক আমরা জানতে চাইলাম শামীম কেনো এই বিয়েতে রাজী নহ? শামীমের ভাষ্য তার ভাই মিঃ কুমার শিমুল কেনো ডিভোর্সী মেয়ে ও এক বাচ্চার মা রুপাকে বিয়ে করবে? তার ভায়ের উচিৎ আরেক মিস ওয়ার্ল্ড খুঁজে বের করে তাকেই বিয়ে করা? মিস এর বদলে মিসেস মানে পুরানো কারো মিসেসকে বিয়ে করা কেনো? ইহা সম্ভব নহে। কাভি নেহি!!!!!!!!!!! হতেই পারে না।
পারিবারিক সেন্টিমেন্ট ইগো ইমোশন। এসবের মাঝে আমি নেই। তবে হ্যাঁ তাহারা যা ইচ্ছে তাই করুক তাতেও আমার কোনোই মাথা ব্যথা নেই। গ্রীন ও রেড মিলিয়ে আমি ইয়েলো ফ্লাগ উড়িয়ে নিজের কাজে মন দিলাম। তাহারা সকলেই নানা পক্ষে অবস্থান নিলো।
অবশেষে শামীমের দলে কেউই রইলো না। শামীমের আগে এ বাড়িতে আসা ওস্তাদ ড্রাইভার হাসান, নৈশ প্রহরী, দিবা প্রহরীগন সহ আরও যত তাহাদের কলিগ আছেন সকলেই নায়ক এবং নায়িকার দলে। তারা সকল মহানুভব ব্যক্তিবর্গ। একজন এতিম মেয়ে ও তার মায়ের যদি সদ্বগতি হয় তবেই তারা খুশি। কাজেই সকল বাঁধা বিপত্তি উপেক্ষা করে তারা লুকিয়ে গিয়ে বিয়ে করে ফেললো এই শুক্রবারের আগের শুক্রবারে। যদিও শামীম রেগে মেগে টং সে ঘটনা জানার পরে। তবে আমি বলছি সেই মজার গল্পটা।
রুপা - আফা আমার মাইয়ার জন্য কয়েকটা গরমের জামা কিন্না দ্যাশে পাঠাইতে হইবো । আজ বিকালে ছুটি চাই।
আমি- সদা ভালোমানুষ হ্যাঁ করে দিলাম। স্বপ্নেও ভাবিনি সে এক নতুন নাটকের সূচনা করতে যাচ্ছে।
এইদিকে মিঃ শিমুল যে মিঃ আরবাজ চৌধুরীর কাছে তার মামার বাড়ি যাবার জন্য বিকেলবেলাতেই ছুটি চেয়েছেন সে খবর আমি জানতাম না। জানতে পেয়েই বললাম - সর্বনাশ হয়েছে। আরবাজ চৌধুরী তো চমকে উঠে লাফ দিলো। কিসের সর্বনাশ!
আমি- রুপামনিও ছুটি নিয়েছে। আরেকদিকে মিঃ শিমুলও!!! শামীমকে ফোন দেই ফোন দেই।
কিন্তু ততক্ষনে পাখি খাঁচা ভেঙ্গে উড়ে গিয়ে হয়েছেন অচেনা। যাইহোক কোনো পাখি উড়ে গেলে তারে ধরে এনে শেকল পায়ে দেবার মানুষ নই আমরা। পুরানো যাইবেক নতুন আসিবেক। ইহাই ইহজগত ও আমাদের বাড়ির নিয়ম। যাইহোক আমি ফোনটাও করলাম না।রাত ১১টা বাঁজতে চললো দুজনেরই ফেরার নাম নেই। যখন ফিরলো তখন নতুন নাটকের মিথ্যা ডায়ালগ। হেন হইসিলো তেন হইসিলো। তাই দেরী। আমাদের তাতেও কোনো মাথা ব্যথা নেই.........
কিন্তু রুপামনি কত আর লুকিয়ে রাখবে তাদের সেই নতুন এডভঞ্চারের আনন্দময় গল্পটা। অবশেষে সবচাইতে নিরাপদ ব্যক্তিটি তার আমাকেই মনে হলো। পরদিন বিকালে আমার কাছে এসে বললো-
- আফা। একটা কথা কইতে চাই।
- কি কথা?
-আমরা বিয়া করছি।
- আচ্ছা। তোমরা এডাল্ট। চাইলে বিয়ে করতেই পারো।
- আফা আপনেরা অনেক বালা কিন্তু শামীমভায়ের জন্য ভয় পাইতেসি।
- বিয়ে করেছো রিস্ক নিয়ে এখন রিস্কের মোকাবেলাও তোমাদেরকেই করতে হবে তাইনা? আমাকে বলছো কেনো?
- আফা তাইলে কারে বলবো?
- জানিনা
- আফা জানেন ওর দুলাভাই আমগো বিয়া পড়াই দিসে। এই দেখেন নাকের স্বর্ণের ফুল দিসে। হাতে ইমিটিশনের বালা কিন্না দিসে। ওর বইনে পোলাও, মাংস পায়েস রানছিলো। আফা শিমুল কইসে আমার মাইয়াডারে ঢাকা নিয়ে আসবে। আমরা কি নীচের ঐ রুমে থাকতে পারবো?
আমার একটু বিরক্ত লাগছিলো এইভাবে সবাইকে না জানিয়ে বিয়ে করে ফেলার জন্য। কিন্তু রুপার চোখে নতুন করে দেখা স্বপ্নের আশা ও অনিশ্চিততা দেখে আমার হৃদয় আদ্র হয়ে উঠলো। মনে পড়লো ও বলেছিলো ওর প্রথম বিয়ের পর স্বামী ও শ্বাশুড়ির অকথ্য নির্যাতন, অপমান ও বেদনার কথা। কি নিদারুন কষ্ট বুকে চেপে এক মাসের মেয়েকে নিয়ে বের হয়ে এসে দ্বারস্ত হয়েছিলো ভাই ভাবীর। কত লাঞ্ছনা, গঞ্জনা ও বেদনার ইতিহাস। কত কষ্টে মেয়েকে মায়ের জিম্মায় রেখে কাজ করতে চলে এসেছিলো ঢাকা শহরে। এইখানে কাজ করে যা টাকা পায় তাই বাড়িতে পাঠায়। মেয়েকে স্কুলে দিয়েছে। মেয়ের সাধ যতটা পারে পূরণ করে।
ভাবছিলাম কি করে বলবো ওকে যে নীচের রুমে থাকা যাবে না। এগুলো প্রায় সবই ব্যাচেলর গৃহকর্মীদের জন্য। অনেক কষ্টে বললাম-
- রুপা তোমরা একটা বাসা খুঁজে নাও। রোজ সকালে কাজে আসবে আর সন্ধ্যায় চলে যাবে। রুপার কানে সে কথা গেলো কি গেলো না জানিনা সে আমার এত টুকু আশ্বাস পেয়েই সব ভয় বেদনা ভুলে আবার তার আকস্মিক প্রাপ্তি আনন্দের স্মৃতিটুকুর রোমন্থনে মেতে উঠলো
- জানেন আপা শিমুলের মামী না অনেক বালো। সে আমাকে ফুন দিয়া কইলো কিরে মা কেমন আছিস? কবে আসবি? শিমুলের ভাগনা বলেছে মামী ঈদে কি আসবা?
নতুন পাওয়া স্বপ্ন, সন্মান, আদর, ভালোবাসা চিকচিক করছিলো ওর চোখে........... সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করলাম মনে মনে-
এবারে যেন সুখী হয় মেয়েটা, অতীতের পাওয়া সকল কষ্ট বেদনা আর অপমান ভুলে.............
এই লেখা লিখতে গিয়ে মনে পড়লো আমাদের বাড়ির সেই সিনডেরেলাকে
ছবিটা আমি এঁকেছি। যদিও এক সাইডে মুখটা একটু বেঁকে গেছে। চুল দিয়ে পরে ঢেকে দেবো .............

আর এই ছুটির দুপুরে লেখাটা লিখলাম আমার মিররমনি আর একলব্য ভাইয়ুর জন্য।

তোমরা দুজন গিফট নিয়ে আসো শিঘ্রী ওদের জন্য .............



সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই জুন, ২০২৩ বিকাল ৪:৩৮