বলতে আমার রাগের কাছে তোমার মায়ের রাগ কিছুই না বুঝেছো। তুমি শুধু একবার চলে আসো। তারপর আমরা অনেক দূরে চলে যাবো কোথাও। যেখানে কেউ আমাদেরকে চিনবে না। যদিও তোমার সে সব কথা শুনে আমি স্বপ্নে ভাসতাম। ভাবতাম সত্যিই একদিন আমরা দুজন কোনো পাহাড়ে বা জঙ্গলে চলে যাবো। আমাদের সকল পরিচিত মানুষজন শত্রুদেরকে ছেড়ে। হ্যাঁ আমাদের জন্য তো তখন যেন পুরো পৃথিবীই শত্রু। আমরা সেখানে কি করবো? আমরা তো চালচুলোহীন তায় আবার পরিচিত লোকজনেদের ধরে নিয়ে যাবার ভয়। তাই আমরা স্বপ্ন দেখতাম অনেক দূরে চলে যাবার সবাইকে ছেড়ে আর তারপর নাকি আদিবাসীদের দলে ভীড়ে যাবো। কোনো খাসিয়া কিংবা মুরং মানুষদের সাথে ওদের দলে ভীড়ে গিয়ে লুকিয়ে যাবো আমাদের এই চেনা প্রান্তর ছেড়ে নিশ্চিন্তে নির্ভাবনায়। এই বুদ্ধি অবশ্য আমার না তোমার ছিলো। হা হা ।
তুমি সব সময় আমাকে একেবারেই কুটো ভেঙ্গে দুটো করতে না পারা কোনো অবুঝ রাজকন্যাই ভাবতে। ভাবতে আমি তো কিচ্ছু পারিনা, কিচ্ছু জানিনা, একা একা এতটুকু পথও হাঁটতে জানিনা কি করে আসবো আমি? তাই তুমি একদিন আশ্চর্য্য এক কান্ড করলে।
তোমার খুব ইচ্ছে হলো, তোমার থেকে কিছু একটা আমার কাছে আসুক। আমাকে ছুঁয়ে থাকুক তোমার ছুঁয়ে দেওয়া কোনো এক ভালোবাসার উপহার। কিন্তু কি করে নেবো আমি সেটা? আমি তো এই কড়া প্রহরার রাজপ্রাসাদ ডিঙ্গাতে পারবোনা কোনো ভাবেই।
ভেবে ভেবে আমার দিন যায়। আর তোমার জিদও চলতেই থাকে। জানিনা হঠাৎ তুমি আমাকে তোমার উপহার দেবার জন্য ওমন মরিয়া হয়ে উঠেছিলে কেনো? মানে তখনও জানতাম না। এখন জানি, এতদিন পরে বলেছো তুমি আমাকে সে কথা। কোনো এক বন্ধুকে তার গার্লফ্রেন্ডের জন্য উপহার কিনতে দেখেই তোমারও ওমন শখ চেপেছিলো। মানে ঐ ফ্রেন্ড বলেছিলো মেয়েদেরকে গিফ্ট দিতে হয় ভালোবাসলে। ভালোবাসলে কি করতে হয় সেটাও নাকি তার থেকে শুনেছিলে তুমি। তুমি যে এতই বোকা ছিলে আমি কিন্তু জানতাম না। যাইহোক সেই তোমার গো চাপলো আমাকে তোমার উপহার নিতেই হবে। কিন্তু সেই গিফ্ট কেমনে নেবো সে কথা ভাবতে ভাবতেই তো আমি চোখের জলে নাকের জলে শেষ। আর যতই না করি তোমার রাগ আরও বাড়ে।
শেষমেশ তুমি বুদ্ধি বের করলে। তখনকার দিনে প্লাজা সেন্ট্রাল নামে গুলশান ২ নং এ একটা খুব সুন্দর শপ ছিলো। এখন সেটা প্রিমিয়ার স্যুইটস হয়েছে। মানে তখনও প্রিমিয়ার স্যুইটসই ছিলো কিন্তু সাথে সেখানে সব ইউনিক জিনিসপাতি পাওয়া যেত যা অন্যান্য কোনো শপেই ছিলো না। তুমি বললে ওখানে তুমি রেখে এসেছো আমার জন্য একটা উপহার। আমি যেনো যে কোনো সময় আসা যাওয়ার পথে যে কোনো সুযোগেই সেখান থেকে সেটা নিয়ে আসি। আমার তো সে কথা শুনেই ভয়ে বুক ধুকপুক। কেমনে যাবো? কেমনে নেবো আমি সকলের চোখ ফাকি দিয়ে? তাছাড়া শপের মেয়েগুলো কি ভাববে? কি বলবে? এত সব ভেবেই আমার হাত পা কাঁপাকাপি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তোমার জেদের কাছে সকল পরাজয় হলো। আমি অসম সাহস নিয়ে সকলের চোখ এড়িয়ে চলে গেলাম সেখানে।
আমি যেতেই শপটার তিনটা মেয়ের মাঝে এদকজন চোখ বড় বড় করে বলে-
- তুমি ইন্দ্রনীলা?
- হুম। আমার গলা দিয়ে ভয়ে স্বর বেরুচ্ছিলো না। আমি তো ভয়ে শেষ। কখন পালাবো সেই ভেবেই শেষ আর শেষ। সেই অপরূপ দোকানটাও দেখতে যেন এক রুপকথার রাজ্যই ছিলো। আসলে এখনকার মত তখন এত সুন্দর সাজানো গোছানো শপ হাতে গোনা কয়েকটাই ছিলো সেই আদিকালে আর প্লাজা সেন্ট্রাল ছিলো তাদের মধ্যে অনন্য। যাইহোক মেয়েটা তার শোকেসের ডালা চাবি দিয়ে খুলে আমার হাতে যা তুলে দিলো তা দেখে আমি বিস্মিত ও হতবাক!
জীবনে কেউ যে কখনও কোনো গিফ্ট এমন করে সাজিয়ে দিতে পারে জানা ছিলো না আমার। সেই শপটাতেই ছিলো গিফট রয়াপিং এর নানা রকম উপকরণ যা তার আগে বাংলাদেশের কোথাও ছিলো না কিনা আমার সন্দেহ আছে। আচ্ছা আমি বরং বর্ননা দেই সেই গিফ্টটার। একটা বিশাল বড় বেতের গোলট্টে যা ধরে আনতে আমাকে বেশ ভালো রকম বেগই পেতে হয়েছিলো। সেই বেতের ট্রে টা একটা হালটা গোলাপী বেগুনী নেট দিয়ে পরম মমতায় জড়িয়ে দেওয়া। তারপাশে বাধা রয়েছে অপূর্ব সুন্দর এক বিশাল ফিতের বো। তার মাঝে নানা রকমের উপহার অনেকটা বিয়ে বাড়ির হলুদের ডালার মত কিন্তু সেটা কোনো এক্সপার্ট গিফট র্যাপারেরই করা সে বলে দিতে হয় না। সব উপহারগুলো আবার আরেকটা জিলজিলে হালকা রংধনু রং কাপড়ে ঢাকা দেওয়া।
আমি সেই উপহার ভেতরে কি আছে না আছে দেখবো কি আর সেই বেতের ডালায় সাজানো সেই উপহারের সৌন্দর্য্য আর চেহারা দেখেই অবাক! আমি জানিনা আমার কি হলো। ছিঁচকাদুনে ছিলাম আমি সে সব দিনে। ঐ দোকানের মাঝেই ঐ মেয়েগুলোর সামনেই আমার চোখ দিয়ে পানি পড়তে লাগলো। মেয়েটা বললো, কি হয়েছে? আচ্ছা তোমাদের কি কখনও দেখা হয়নি? কি সমস্যা বলো তো আমাকে? আমি বললাম, সে কেমন দেখতে? মেয়েটা হেসে ফেললো, বললো, সুন্দর! আমার লজ্জা লাগলো ভীষন। মেয়েটা কি ভাবলো। আমি বের হয়ে এলাম।
বাসায় ফিরে ওমন বড় সড় একটা উপহারের ডালা কোথায় লুকাবো আমি? কাজের লোকজন সব হা করে তাকিয়ে রইলো। আমি কোনো কথা না বলেই আমার বেডরুমের দরজা বন্ধ করলাম। তারপর মেঝের উপর মেলে বসলাম এক সমুদ্র কৌতুহলে। কি আছে সেখানে?
প্রথমেই বড়সড় প্যাকটা খুলতেই বেরিয়ে এলো অপূর্ব সুন্দর এক ঝলমলে জামা। কমলা আর ব্রাউনে মিশানো সেই কাপড়ের ঝলমলে কারুকাজের সাথে মিলানো দুল, মালা, চুড়ি সব একটা জুয়েলারী বক্সে করে সাবধানে সাজানো আছে। সাথে আবার একটা ছোট্ট চৌকোনো বক্সের ভেতরে দুইটা ছোট্ট টেডিবিয়ার। একটা লাল টুকটুকে হার্ট ধরে আছে। এসব নিয়ে খেলতে খেলতে কেটে গেলো আমার সারাদুপুর। অবাক এক কৌতুহলে! বিকাল হয়ে আসতেই তড়িঘড়ি লুকিয়ে ফেলতে গেলাম সব কিছু।মা আসার আগে সব অপরাধের চিহ্ন আমাকে লুকিয়ে ফেলতে হবে। কিন্তু হঠাৎ এক কোনে চোখে পড়লো একটা কালো চৌকোনো চামড়ার বক্স। বক্সটা খুলতেই আমার মন খারাপ হয়ে গেলো। একটা ডায়ামন্ড রিং ধ্রুবতারার মত সেখানে জ্বলজ্বলে চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
স্তম্ভিত বসে রইলাম আমি। ভেবেই পাচ্ছিলাম না আমার এই ছোট্ট রাজকুমার এত টাকা কোথায় পেলো? সে কিভাবেই বা এত খরচ করলো? কোথায় পেলো? কত মিথ্যা বলতে হলো বুঝি তার বাড়িতে বাবা মাকে? আমার ভীষন কষ্ট হচ্ছিলো। নিজেকে এত অপরাধী মনে হচ্ছিলো যে সকল ভালোবাসা আনন্দময় ক্ষন এবং সকল উপহারের আনন্দ ভুলে গেলাম আমি। একগাঁদা প্রশ্ন, চিন্তা,ভাবনায় আর কষ্টে বুক ফেটে যাচ্ছিলো আমার। আমি কিছুতেই মানতে পারছিলাম না এটা যে আমার জন্য তুমি মিথ্যে বলে বাবা মাকে লুকিয়ে এত খরচ করে ফেলেছো।
আমাকে তুমি বোকা বলো, ভাঁজা মাছ না উলটে খাওয়া একটা বোকা মেয়ে মনে করতে সেসব দিনে কিন্তু সেই বোকা মেয়েটাই সেদিন চরম পরিপক্ক মানুষের মত ভাবতে বসেছিলো। এটা কি ঠিক হলো? নাকি ঠিক হচ্ছে? তুমি আমাকে বহু পরে জিগাসা করেছিলে বার বার
আমার কিছু কঠিন ডিসিশনের কথা নিয়ে যে ঐ ছোট্ট বয়সে আমি এত ভেবেছিলাম কি করে! এই প্রশ্নের উত্তর নাকি তুমি খুঁজেই পাওয়া কোথাও একেবারে। আসলে একটা কথা বলি? তুমি আমাকে বেশিই বোকা বা ইনোসেন্ট এক রাজকন্যা ভাবতে তাই মাথা কাজ করেনা তোমার আজও।
যাইহোক এখনও সেসব দিনের কথা মনে পড়লে কেনো যে চোখে এত জল আসে? কিন্তু জানো বহু বছর আমি কাঁদতে ভুলে গেছিলাম। কিন্তু আজকাল আমার বড় কান্না আসে। মনে মনে তাই গুন গুন করি আবারও সেই গানটাই-
আমার চোখের জলের মাঝে
তোমার স্বপ্নকমল আছে
তুমি জানো কি তা?
সেদিন তুমি হঠাৎ ভয়েস মেসেজ পাঠালে-
দেখবো কী করে তারে?
নীরব অহংকারে আমার গহন মনে
সে যে গান হয়ে বাজে
তুমি জানো কি তা?
আমি তো অবাক! তোমার এই গান আজও মনে আছে? আমি তোমার গানের মুগ্ধ শ্রোতা । এ কথা তোমাকে বলেছিও। তবে তুমি বলো তুমি নাকি শুধু আমার জন্যই গান গাও। আর পৃথিবীর কেউ জানেই না তুমি গান গেতে পারো। এ কথা আমার বিশ্বাস হয়না বলে তোমার অনেক রাগও লাগে। তুমি বলো আমার কাছে তুমি ঠিক যেমনটা মানে যেমনটা ছিলে বা আজও আছো এই দুনিয়ার সব মানুষের কাছেই তুমি ঠিক উল্টোটাই। আমি বুঝি না, একেবারেই বুঝিনা আমি। তুমি আমার কাছে এখনও সেই ছোট্ট রাজকুমারই হয়ে আছো। যেমন তোমার কাছে আমি অচিন দেশের বদ্ধ টাওয়ারে বন্দিনী এক রাজকন্যা।
তাই তো তোমাকে যখন দেখি মনেই থাকে না মাঝে যে এতগুলো দিন পেরিয়ে গেছে। ফিরে যাই সেই দিনগুলোতে। যেসব দিনে কেউ ছিলোনা কোথাও আমাদের আশে পাশে। আমরা ছিলাম কোনো এক অজানা পৃথিবীতে যেি পৃথিবীর সন্ধান আজও কেউ পায়নি।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা সেপ্টেম্বর, ২০২১ রাত ৯:৫৮