আর তারপর!
আমার চারিদিকের রংধনু সাত রঙ আলো ঝলমলে পৃথিবীটা ঝুপ করে হঠাৎ এক নিমিষে আঁধার হয়ে এলো। যেন চারিদিক নিস্তব্ধ নিশ্চুপ। কোথাও কেউ নেই। এই জগতে আমার কোনো কাজই নেই আর। আমার মাথা কাজ করছিলো না। আমি ভাবতেই পারছিলাম না এত এত ভালোবাসা এত এত গান, কবিতা গল্প বলা। এত শত এক সাথে কাঁটানো সময়, কত শত মধুর লগন এসব কি তবে মিথ্যে ছিলো? কোনো ভাবেই মেলাতে পারছিলাম না কিছু আমি।
কাউকে সে কথা শেয়ার করবো সে সাহস বা সাধ্যও ছিলো না আমার। আমার এই পুতুলখেলার ছোট্ট বাক্সের মাঝে আমার রক্তমাংসের পুতুল পুতুল সত্যিকারের রাজকুমারকে নিয়ে আমার খেলা খেলা দিনগুলোর কথা আমি তো এই পৃথিবীর কাউকেই বলিনি। না বলার কারণই ছিলো আমার মায়ের ভয়। জানতে পেলেই আমার এই র্যাপু্ঞ্জেল টাওয়ারের সবগুলো জানালা্ই মা বন্ধ করে দেবেন। একটা মাত্র খোলা জানালা তখনও খোলা পড়ে আমার সামনে। কিন্তু আমি আমার সুদীঘল বিনুনী গুটিয়ে নিয়েছি তখন। সেই বিনুনী বেয়ে উঠবে না আর কোনো রাজারকুমার।
আমার মা যতই কড়া শাসনে রাখুক না কেনো আমাকে তারই মাঝে আমার উচ্ছলতার পায়ে বেড়ি পরানোর কোনোই সাধ্যই ছিলোনা তার। মানে মায়ের সামনে ভালো মানুষ সেজে থাকলেও আমার চাপা উচ্ছাস আমি গলগল ঢেলে দিতাম মা একটু চোখের আড়াল হলেই বা তাকে লুকিয়ে চুরিয়ে নানা ফন্দি ফিকিরে। মা যতই ছড়ি ঘুরাক রক্ত চক্ষু নিয়ে সেই চোখে আমি জল ঢেলে দিতে শিখে গিয়েছিলাম খুব ছেলেবেলা থেকেই। মোট কথা আমারে বাঁধবি তোরা সেই বাঁধন কি কারোর আছে?
তবুও আমি সেই ঘটনার পরে যেন এইপৃথিবীর রুপ রস বর্ন ও ছন্দ সবই হারিয়ে ফেললাম। জীবন থেকে নির্বাসনে চলে গেলাম। হ্যাঁ সে ছিলো আমার অজান্তেই আমার স্বেচ্ছা নির্বাসন। আমার খুব মনে পড়ে সেদিনগুলোর কথা। মনে পড়ে হারমোনিয়াম নিয়ে বসি। আঙ্গুলগুলো থমকে যায়। হারমোনিয়ামের রিডগুলো দারুন শক্ত লাগে, আমার আঙ্গুল চলে না। ছবি আঁকতে যাই একটা আঁচড়ও ফোটেনা আমার স্কেচ বুকের পাতায়। এই আমি যেন অন্য এক আমি। হঠাৎ যেন আমার চির পরিচিত আমির মৃত্যু হয়েছে। আমার চারিদিক ছুঁয়ে না ভালো লাগা। কিছুই আমাকে আর টানে না। বুকের মধ্যে শুধুই কাঁটার খচ খচ। আর অবাক বিস্ময়!
বিস্মিত আমি সারাদিন ভাবি। অবাক হয়েই ভাবি। এ কি করে সম্ভব? আজ বড় হাসি পায় এই কথা ভেবে। তবে আসলে কিশোরকালের আবেগ বা কাউকে পুরোটাই মন দিয়ে ফেললে সেই মন আর নিজের বশে থাকে না । একেবারেই অন্যের বশীভূত হয়ে যায়। সেই বশীভূত বোকা মনটাকে আর হয়ত কখনই নিজের করে ফিরে পওয়া হয় না। সে তখন অন্যের হৃদয় পিঞ্জরে বন্দি হয়ে পড়ে সারাজীবনের জন্য। হয়তবা কোনো প্রতারক পিঞ্জরে আরও অনেকগুলো হৃদয় যেখানে বন্দী রয়েছে। দক্ষ কিডনাপাররা তো একটার পর একটা কিডন্যাপই চালাবে তাই না?
আমার সাথে হওয়া এই প্রতারণা আমি মানতে পারিনা। কিছুতেই না। সারাক্ষনই মাথার ভেতরে সেই ভোঁতা অনুভূতিটা কিলবিল করে। কি তার প্রশ্ন কি তার উত্তর জানিনা তো আমি। আসলে আমি ভাবতেই পারছিলাম না এটা কি হলো? এই কারনেই নির্বোধের মত একরাশ চাপ ধরা নিশ্বাস আটকে থাকে আমার বুকের গভীরে। আমি ঠিক মত শ্বাস নিতে পারিনা। মনে হয় একটু প্রাণ ভরে কাঁদতে পারলে বড় ভালো হত। কিন্তু সেই কান্নারও কি জো আছে? অকারণে কাঁদছি কেনো, কি তার কারণ সেই সব প্রশ্নবানে আর জবাবাদিহিতায় তো মরেই যেতে হবে আমাকে তাহলে।
তাই আমার কান্নার সবচাইতে নিরাপদ স্থান হয় আমার গোসলের সময়টাই। আমি শাওয়ার ছেড়ে দিয়ে হাউ মাউ করে কাঁদি। নির্ভয়ে নির্ভাবনায়। প্রান খুলে কাঁদি আমি। বদ্ধ ঘরের কোনে চোখের পানি মুছে ফেলতে হয়না। শাওয়ারের ঝমঝম আওয়াজে আমার কান্নার শব্ধ ঢেকে যায়, মিলেমিশে ধুয়ে যায় শাওয়ারের ঝরঝর জল আর আমার চোখের সকল অশ্রু। কতক্ষন যে এমন হয় রোজ রোজ আমার খেয়াল থাকে না । এইভাবে একদিন ধরা পড়ে যাই মায়ের কাছে। বহুক্ষন গোসলের দরজা বন্ধ দেখে মা ধাক্কাতে থাকে বোধ হয়। সেদিন ছুটির দিন থাকায় মা বাসায় ছিলেন।
কান্নার কারণে আমার গলা বুজে আসছিলো। আমি কোনোরকমেন উত্তর দেই আমি বের হচ্ছি কিন্তু মা শোনেন না চাবি দিয়ে দরজা খুলে ফেলেন এবং আমাকে দেখে অবাক হন। মা সেদিন আমার কান্নার শব্দ শুনেই আসলে এমন কাজ করেছিলো। আমি ভয়ে কুকড়ে উঠি। কি জবাব দেবো আমি এখন তাকে? এমন আকুল হয়ে কাঁদার কারণ কি মা এখুনি জিগাসা করবেন । ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে থাকি মায়ের দিকে।
আমাকে অবাক করে দিয়ে মা আমাকে জড়িয়ে ধরেন। একটা কথাও জানতে চায়না কেনো আমি কাঁদছিলাম। আমার মাথা মুছিয়ে বুকের সাথে জাপটে ধরে ভেতরে নিয়ে আসেন। আমি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে পড়েছিলাম। তবুও মায়ের মুখে কোনো রাগ বা অবাক হবার চিহ্ন না দেখে আমি তার বুকের মধ্যেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়ি। মা কিচ্ছু বলেন না। একটা প্রশ্নও না। পরম মমতায় আমাকে বুকে চেপে রাখেন। আমি অবসন্নতা আর ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়ি।
পরদিন মা আমাকে নিয়ে যান শাকিলা আন্টির বাসায়। সেখানে গিয়ে মা বলেন তুমি একটু এখানে থাকো আমি কিছুক্ষনের মধ্যেই ফিরে আসছি। আমি জানি শাকিলা আন্টি একজন ডক্টর মানে পাগলের ডক্টর। হা হা আমার হাসি পায়। ভাবি মা মনে হয় ভেবেছে আমি পাগল হয়ে গেছি। তাই আমাকে নিয়ে এসেছেন পাগলের ডক্টর দেখাতে। শাকিলা আন্টি আমাকে পুডিং খেতে দেন। তার সাজানো সবুজ সজীব ঘরবাড়ির প্রতিটা ইঞ্চিতে যেন প্রানের সজীবতা। চারিদিকের এই সবুজ সবুজ ডেকোরেশন আমার চোখ আর মনে প্রশান্তুির পরশ বুলিয়ে দেয়। আজ এতগুলো বছর পরেও আমার একটা শান্তির বাড়ি মনে পড়লেই শাকিলা আন্টির সেই সবুজ সবুজ সজীবতায় ঘেরা জানালার চিক বেয়ে ওঠা মানিপ্লান্টের সবুজ জানালাটাই মনে পড়ে।
আন্টি আমার সাথে আয়েস করে গল্প করতে বসলেন। ততখনে আমি বুঝে গেছি আন্টি আর আমার মা দুজনে মিলে আমাকে পাগলের ট্রিটমেন্ট দিতে চান। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি মরে গেলেও তাকে আমি কিছুই বলছি না আমার মনের কথা। আন্টি তার এলবাম খুলে বসেন। দেখান তার ছোটবেলার ছবি। তার কিশোরীকাল। তার হিল্লী দিল্লী কাশ্মীর ভ্রমনের না না কিচ্ছা কাহিনী ও ছবিগুলি। এর মাঝে কাশ্মীরের পোশাকে উনার আর উনার হাসব্যান্ডের হানিমুনের ছবি দেখে আমার হঠাৎ মনে পড়ে যায় আমাদের সবাইকে লুকিয়ে খাসিয়া বা মুরংদের দেশে চলে যাবার কথা ছিলো। সেখানেই সন্ধ্যায় এডি ফিরে আসবে বলেছিলো আর আমি অপেক্ষা করে থাকবো তার জন্য। সে এসে কাঁঠ দিয়ে আগুন জ্বালাবে। তারপর রান্না করে আমাকে খাইয়ে দেবে। আমি তার প্রিন্সেস। প্রিন্সেসকে সে কোনো কাজই করতে দেবে না। আমি অন্যমনস্ক হয়ে পড়ি। আমার চোখ জলে ভরে ওঠে।
আন্টি বলেন কি ভাবছো?
আমিঃ কিছু না
আন্টিঃ আমাকে বলতে পারো।
আমিঃ না আমি কাউকেই বলবোনা।
আন্টিঃ কেনো বলোতো?
আমি নিরুত্তর থাকি।
আন্টি বলেন, তোমার এইজে আমারও এমন হত কোনো কোনো গোপন কথা আমিও কাউকে বলতাম না। কারণ আমি কাউকেই ট্রাস্ট করতে পারতাম না জানো? মনে হত আমি তাকে বললে সে একে ওকে বলে দেবে। তারা সেসব নিয়ে হাসাহাসি করবে বা ঝামেলায় ফেলবে। এই কারণে আমি কাউকেই বলতাম না। কোথাও আমার মেন্টাল সেইফ জোন ছিলো না। এমনকি জানো মাকেও না। কারণ মা তো শুধুই শাসন করতো। তখন আমি জানতাম না মা এমন শাসন করে কেনো আমাকে? কিন্তু মা এ কারনেই করেন আমরা যেন কোনো বিপদে না পড়ি। কারণ কি জানো? এই বয়সে এসে আমরা অনেক ভুল করি। ভুল সিদ্ধান্ত নেই। যা করতে বড়রা নিষেধ করে তাই করি লুকিয়ে। আর তারপর যখন কোনো ঝামেলায় পড়ি আমাদের সাহায্যের জন্য কাউকেই খুঁজে পাইনা। এই কারণেই আমি এমন একটা সাবজেক্টে পড়েছি যে আমি হবো সবার মেন্টাল সেইফ জোন। আমি সবার কথা শুনবো। কাউকেই বলে দেবো না কিন্তু আমি আমার অভিজ্ঞতা আমার রিসার্চ নলেজ সব কিছু দিয়েই মানুষকে সাহায্য করবো। তুমি কিন্তু বলতে পারো আমাকে তোমার কথা। বিশ্বাস করে দেখো একবার আমাকে। আমি কাউকেই বলবোনা। তোমার মাকেও না।
আমি বললামম থ্যাংক ইউ শাকিলা আন্টি আমি জানি আমাকে কি করতে হবে এখন।
আন্টি মনে হয় একটু ভয় পেলেন। বললেন কি করতে হবে?
আমি হাসলাম। বললাম আমাকে ভালো থাকতে গেলে কি করতে হবে সেই উত্তর পেয়ে গেছি আমি।
বাসায় ফিরলাম রাত দশটার দিকে। চেইঞ্জ করে হাত মুখ ধুয়ে চুল বেঁধে ঠান্ডা মাথায় এডিকে মেইল লিখলাম আমি। লিখলাম আমি তার সাথে কথা বলতে চাই। তাকে ছাড়া আমি ভালো নেই। প্রায় সাথে সাথেই এডি চলে এলো। মনে হলো যেন এই মেইলটার অপেক্ষাতেই ছিলো সে। আমার চোখ দিয়ে পানি পড়ছিলো। কিন্তু সেটা আনন্দাশ্রু।
আমি বললাম- আমি ভেবেছিলাম তুমি আসবেনা।
তুমি বললে- কোথায় যাবো আর! তোমাকে ছেড়ে!
আমি তোমায় ভুলে বলো যাবো কোনখানে!
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই সেপ্টেম্বর, ২০২১ বিকাল ৫:১৬