somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

**** বাথান বাড়ি **** ( স্মৃতির পাতা থেকে )

০৭ ই ডিসেম্বর, ২০১৯ রাত ১১:১০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



আমার নানুদের গ্রামে একটা বাড়ি ছিল , সেই বাড়ির নাম ছিল বাথানবাড়ি । আসলে সেটাকে গ্রাম বলা যায় কিনা আমি ঠিক বলতে পারছি না । এটা ছিল চকের মাঝখানে আশে পাশে অন্য কোন বাড়ি ঘর ছিল না চার পাশে শুধু ফসলের জমি আর জমি, মাঝখানে একটা মাত্র বাড়ি আমার নানাদের তিন ভাইয়ের ছিল সেই বাড়ি সেখানে আমার নানারা কেউ থাকত না। আমি ঠিক জানিনা তবে শুনেছি আমার নানাদের কয়েকশত বিঘা জমিন ছিল । এই জমিতে কাজ করার জন্য অনেক গুলো রাখাল ছিল , তারা এই বাড়িতে থাকত , গরুও ছিল অনেক গুলো।
আমার নানা, মামারা মাঝে মাঝেই যেত জমি টমি, ফসল দেখতে আর কয়েক বছর পর পর বাড়ির মহিলাদের নিয়ে যেত একদিনের জন্য বেড়াতে ,অনেক লোকজন মিলে যেত অনেকটা পিকনিকের মত।

আমার বয়স যখন সাত বা আট বছর তখন ছিল বর্ষাকাল , আমার আম্মুরা সব ভাই বোনেরা মিলে প্লান করে বাথান বাড়ি বেড়াতে যাবে সবাই মিলে । আমার আম্মুর আপন ভাই বোন তো আছেই সাথে চাচাতো, ফুপাতো ভাই বোনরাও অনেকে যাবে।

বাথান বাড়ি যাওয়ার কথা শোনে আমি মহা খুশী । আম্মুর মুখে এই বাথান বাড়ির অনেক গল্প শুনে শুনে সেখানে যাওয়ার একটা স্বপ্ল ছিল ।বর্ষাকালে ওখানে নৌকায় যেতে হয়, এর আগে আমি কখনো নৌকায় উঠিনি ,স্বপ্নের বাথান বাড়ি যাব, আবার জীবনের প্রথম নৌকায় চরব আমার ভিতর অনেক উৎসাহ আর উদ্দীপনা কাজ করছিল। দুই সপ্তাহ পর আমরা যাব, এই দুই সপ্তাহে আমার এত এত প্রশ্ন বাসার সবাইকে করেছি তার জন্য সবার কাছে কত বকা শুনেছি সেগুলো এখন মনে করে হাসি পায়। যাই হোক আমার সব জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে এলো সেই মহেন্দ্রক্ষন।

সকাল দশটায় আমরা ওখানে পৌঁছে যাই। ( আব্বু্, আম্মুর সাথে আমি, আপু , ভাইয়ারা কেউ যাবে না) আমিন বাজারের আশে পাশে কোন একটা জায়গা হবে , এখান থেকেই নৌকা করে আমাদের যেতে হবে বাথানবাড়ি। আমরা পৌছে দেখি অনেকেই আমাদের আগেই পৌছেছে অনেকেই এখনো আসেনি। অল্প সময়ের ভিতরেই সবাই এসে পৌছে গেল। অনেক মানুষ আমার আম্মুর চাচাতো, ফোপাতো ভাই,বোনই সব তবু অনেককেই আমি চিনি না যাই হোক বড় বড় তিনটা নৌকা করে আমাদের যাত্রা শুরু হল ।নৌকা গুলো আমার নানাদের নিজেদেরই। আমি আব্বু আম্মুর সাথেই ছিলাম, এই নৌকাতে আমার কয়েকজন খালামনি, খালুরা, মামা,মামীরা ও তাদের ছেলে মেয়েরা মিলে প্রায় পচিঁশ জনের মতো ছিলাম।

নৌকা ছাড়ার পর সবাই সুবিধা করে বসে, ছেলেরা হেরে গলায় গান গাচ্ছে বিভিন্ন রকম ঠাট্টা মশকরা করছে , বড়রাও যে সময়ে ছোট হয়ে যায় এটা দেখতে আমার বেশ লাগছিল , কিন্ত আমার যত আনন্দ , উচ্ছলতা কিছুক্ষনের মধ্যেই স্তিমিত হয়ে এল ——-আমি গাড়িতে চরতে পারি না , প্রচন্ড বমি হয় , আম্মু বলেছিল নৌকাতে এ সমস্যা হবে না , কিন্ত অল্প কিছুক্ষনের ভিতর ই আমার বমি শুরু হল , কয়েকবার বমি করার পর আমি দূর্বল হয়ে আম্মুর কোলে ঘুমিয়ে যাাই, বড়দের আনন্দ আর দেখতে পেলাম না। হই- চইয়ের শব্দে যখন ঘুম ভাংল তখন আমাদের নৌকা বাথানবাড়ির ঘাটে, সবাই নামার জন্য ব্যাস্ত ।

বাথানবাড়ি এত সুন্দর আম্মুর মুখে গল্প শুনে শুনে আমি যতটুকু কল্পনা করেছিলাম তার চেয়েও অনেক বেশী সুন্দর , চারদিকে অনেকগুলো ঘর মাঝে অনেক বড় উঠান , আর ঘরগুলোর পিছন দিয়ে তাল, নারিকেল আর সুপারী গাছে ঘেরা ।ওহ্ —- কিছু কলাগাছও ছিল।
বাথানবাড়িতে মানে উপরে যাওয়ার পর মনে হচ্ছিল আমরা একটা দ্বীপে আছি চারিদিকে শুধু পানি আর পানি । এত ভালো লাগছিল আমার কোন দূর্বলই লাগছিল না ।

উঠানের এক পাশে কয়েকটা খেজুর পাতার মাদুর একত্র করে মেলা হয়,সবাই কিছু না কিছু খারার নিয়ে এসেছিল প্রথমে সেগুলো বের করে সবাই যার যার পছন্দ মত খাচ্ছে । মহিলারা সবাই গল্প জুরে দিয়েছে , অনেকের সাথেই অনেকদিন পর দেখা হয়েছে। একটু পর ছেলেরা উঠানের এক পাশে গর্ত করে চুলো তৈরী করে রান্নার আয়োজন করছে । সব কিছু শহর থেকেই নিয়ে আসা হয়েছে।

ঢাকা শহরের বন্ধি জীবনের বাচ্চারা খোলা মেলা জায়গা পেয়ে আমরা তো খুশীতে লাফা-লাফি , দৌড়া-দৌড়ি শুরু করেছি, কিন্ত সমস্যা হল চারিদিকে শুধু পানি আর পানি বাড়ির চারপাশ তো খোলা বড়দের এটা নিয়ে টেনশন কিন্ত বাচ্চারা তো আর বসে থাকবেনা।যেগুলো বেশী ছোট বাচ্চা তারা তো মায়েদের সাথে থাকবে, সাত থেকে ১১ বছরের বাচ্চাও অনেক গুলো । চৌদ্দ- পনের বছরের বাচ্চা ছিল তিনজন
।এই তিনজনকে দায়িত্ব দেয়া হল আমাদের নিয়ে কিছু একটা করার আর কেউ যেন পানির দিকে না যায় সেদিকে খেয়াল রাখার । তারা তিনজনে মিলে সিন্ধান্ত নিল পলান - টুক্কু খেলার। বড়রা বলে দিল তোমরা ঘরের ভিতর লোকাবে গাছ টাছের কাছে বা পানির কাছে যাবা না

খেলার নিয়ম হল : একজন চোর থাকবে বাকীরা সবাই লুকিয়ে বিভিন্ন জায়গা থেকে টুক্কু বলবে ,চোর একজন , একজন সবাইকে খুঁজে বের করবে , প্রথমে যাকে পাবে পরবর্তীতে সে চোর হবে কিন্ত চোর কোন একজনকে দেখার আগেই সে চোরকে ছুয়ে দিতে পারে তাহলে সেইই আবারও চোর হবে ।
এভাবেই খেলা চলছে , কয়েক রাউন্ড খেলার পর হঠাৎ খেয়াল হল আমাদের এক খেলোয়ার তানভীর ভাইয়াকে খুঁজে পাচ্ছে না চোর, আমরা সবাই বাহিরে চোর যে সে বলতেছে কোন ঘরেই তাকে পাইনি, ছোটদের বলাবলিতে বড়রাও শুনে ফেলেছে আমার খালামনি তো চিৎকার করছে আমার ছেলে পানিতে পরেছে , সবার ভিতর উত্তেজনা , টেনশন , সবাই বাড়ির চারপাশ ঝোপ ঝারগুলো খুজছে , ঘর গুলো বড়রা আবার ভালো করে চেক করছে, একটা ঘর থেকে আমার মামা তানভীর ভাইয়াকে কোলে করে হাসতে হাসতে, সে ঘেমে একেবারে গোছল হয়ে গিয়েছে, সে কান্নাও করছে।

ঘটনা হল: সেই ঘরে বড় একটা চাল রাখার ড্রাম ছিল , চাল বেশী ছিল না , সে সেই ড্রামের ভিতর লুকিয়ে ছিল কিন্ত সে যখন ভিতরে ঢুকে ডাকনা দিয়ে দেয় দুর্ভাগ্যজনক ভাবে ডাকনার কয়রাটা আটকে যায় সেটা সে আর ভিতর থেকে খুলতে পারছিল না , বের হতেও পারছিল না , সে ভিতর থেকে অনেক ডেকেছে কিন্ত তার ডাক বাহির পর্যন্ত আসেনি , সে হাত দিয়ে ড্রামের গায়ে থাপ্পর দিয়ে শব্দ করেছে সেটাও কেউ শুনতে পায়নি।
যাক বাবা বাচাঁ গেল বলে সবাই নি:শ্বাস নিলেন ।কিন্ত আমাদের ছোটদের মন খারাপ এত মজা ঘরে খেলছিলাম সেটা বন্ধ হয়ে গেল ।

এরই মধ্যে রান্নাও শেষ হয়েছে এবার খাওয়া দাওয়ার পালা । ছোট বড় সবাই গোল হয়ে বসেছে সবার সাথে আমিও বসেছি । আমার এক মামা সবার সামনে কলা পাতা দিয়ে যাচ্ছে , আমি ফট করেই বলে ফেলি মামা এটা কি খাব? মামা হেসে বলে বেটি তুমি কি ছাগল নাকি কলা পাতা খাবা ? ওটাতে খাবার খাবা । খাবার আহামরি কিছু ছিল না , আলু ভর্তা, গরুর গোস্ত, মুশুরীর ডাল । আমি অবশ্য খাইনি , আম্মু খাইয়ে দিয়েছিল একটু আর খাবারটা টেষ্টি ছিল এটা আমার কথা না সবাই বলছিল।

এর পর আমরা আরো কিছুক্ষন ছিলাম , অনেকেই গোছল করছিল। আমার বয়সী ছেলেমেয়েরা খুব আনন্দ করছিল কিন্ত ফিরে যাবার সময় যত ঘনাচ্ছিল আমার ভিতর বমির টেনশন ছিল তাই আমার আর কিছু ভালো লাগছিল না আম্মুর গা ঘেসে বসেই ছিলাম।


বাথানবাড়ির কথা মনে পরে, খুব মনে পরে, যখন খুব বেশী মন খারাপ হয় কোন কারনে আমি চোখ বন্ধ করে চলে যাই আমার স্বপ্নের সেই বাথানবাড়ির । ওরকম সুন্দর দ্বীপের মত একটা বাড়ি যদি আমার থাকত , এত বড় না হলে হবে ছোট একটা বাড়ি হলেই হবে।

যতটুকু শুনেছি আমার মামাদের সেই বাথানবাড়ি আর সেই রকম নেই, আশে পাশে অনেক বাড়ি ঘর হয়েছে, মামারা এখন আর নিজেরা চাষাবাদ করে না , জমিগুলো প্রতি বছর পত্তন দিয়ে নগদ টাকা নিয়ে আসে। তাই আর রাখাল, গরু কিছুই নেই। সেই বাড়িতেও নাকি অন্যলোকদের থাকতে দিয়েছে।

বেলা অনেক গরিয়ে গিয়েছে ,আমি বড় হয়েছি , কয়েকদিন আগে আমার আপুর সাথে কথা বলছিলাম , আপু বলল , জানিস তানভীরের বিয়ে । আমি কোন তানভীর ? কারন আমাদের আপন আত্বীয়দের ভিতর দুইজন তানভীর আছে । তখন আপু হাসতে হাসতে বলে ড্রাম তানভীর ----। সেই ঘটনার পর আমরা সবাই তাকে ড্রাম তানভীর বলতাম।

আমিও খুব হাসলাম , হাসতে হাসতে চোখে পানি চলে এল , জানি না এই পানিটা সুখের নাকি কষ্টের বাথান বাড়ির কথা খুব মনে পরল খুব ।

ফটো : আমাদের উঠোন থেকে ।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে মার্চ, ২০২১ দুপুর ১২:১৪
১৯টি মন্তব্য ১৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

অন্যায় অত্যাচার ও অনিয়মের দেশ, শেখ হাসিনার বাংলাদেশ

লিখেছেন রাজীব নুর, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৪:৪০



'অন্যায় অত্যাচার ও অনিয়মের দেশ, শেখ হাসিনার বাংলাদেশ'।
হাহাকার ভরা কথাটা আমার নয়, একজন পথচারীর। পথচারীর দুই হাত ভরতি বাজার। কিন্ত সে ফুটপাত দিয়ে হাটতে পারছে না। মানুষের... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

দ্য অরিজিনস অফ পলিটিক্যাল জোকস

লিখেছেন শেরজা তপন, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১১:১৯


রাজনৈতিক আলোচনা - এমন কিছু যা অনেকেই আন্তরিকভাবে ঘৃণা করেন বা এবং কিছু মানুষ এই ব্যাপারে একেবারেই উদাসীন। ধর্ম, যৌন, পড়াশুনা, যুদ্ধ, রোগ বালাই, বাজার দর থেকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×