somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পাঠ প্রতিক্রিয়া- আনোহা বৃক্ষের জ্যামিতি

১৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০২১ সকাল ৯:৫০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


কিস মি বেবে!

একটা খুবই দুঃখের কাহিনী বলি আপনাদের। এক গরীব ছেলে আর এক গরীব মেয়ের মধ্যে একটা সম্পর্ক গড়ে উঠলো। তারা দুজনেই সামান্য চাকুরি করে। মেয়েটাকে তার অফিসে প্রায়ই হয়রানির শিকার হতে হয়। তাদের মধ্যে সম্পর্ক গড়ে উঠলেও ঠিক প্রেমটা জমাট বাঁধে না। তারপরেও তারা দেখা সাক্ষাৎ করতে থাকে। একদিন সিনেমা দেখতে গিয়ে তারা একে অপরকে চুমু খায় প্রথমবারের মত। মেয়েটা চুম্বনের পর সম্মোহিত হয়ে পড়ে প্রায়। ছেলেটির বাসায় গিয়ে উঠতে চায়। কিন্তু ছেলেটির বাসায় কিছু আত্মীয়-স্বজন ছিলো বলে তাকে বাসায় নেয়া সম্ভব হয় না। এরপর তাদের মধ্যে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। দুই বছর দেখা হয় না। তারপর একদিন ছেলেটি রাস্তায় হাঁটছিলো, তার পাশে একটা গাড়ি এসে থামলো। সেই মেয়েটি! এখন বড়লোক হয়ে গেছে। ছেলেটিকে গাড়িতে ওঠালো। তারা গাড়িতে বসে চা খেতে থাকলো। এরপর মেয়েটি ছেলেকে চুম্বনের আহবান জানালো। কিন্তু বোকা ছেলেটি অস্বীকৃতি জানালো চুম্বন করতে। কারণ সে আর তাকে ভালোবাসে না। তখন মেয়েটি তাকে রেগেমেগে বললো, “ কুত্তার বাচ্চা, বের হ গাড়ি থেকে। নেমে যা ফকিন্নির পুত!”

ছেলেটি চায়ের কাপ হাতে বিব্রত মুখে নেমে গেলো। তারপর গম্ভীর হয়ে চুমুক দিতে লাগলো। গল্প শেষ।

এটা হলো কৃষ্ণ জলেশ্বরের “আনোহা বৃক্ষের জ্যামিতি” বইয়ের একটি গল্প “কিস মি বেবে”। কৃষ্ণ জলেশ্বরকে আমি ব্লগ আমল থেকে চিনি। মূলত কবি হিসেবে। কবিরা গল্প লিখলে তাতে গল্পকারদের লজ্জা দেয়ার মত কাব্যিকতা, উপমা, মেটাফর ইত্যাদি থাকে। কৃষ্ণ জলেশ্বরের লেখাতেও কাব্যিকতা, মেটাফর আছে, তবে তাই বলে তিনি হিউমার করার সুযোগ পেলে ছাড়েন না। উপরের গল্পের সমাপ্তিটা তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। আক্ষরিক অর্থে হয়তো এতে কোন কৌতুকের ব্যাপার নেই, বরং একটা দুঃখজনক ব্যাপার। কিন্তু পড়ার সময় পেট ফেটে বিদঘুটে হাসি আসছিলো। এরকমটা প্রত্যাশায় ছিলো না। প্রেম-চুমু-অভাব-বিচ্ছেদ ইত্যাদিতে ভালোই মজে ছিলাম, তারপর হুট করে এভাবে গালাগালি করে নামিয়ে দেয়া! এটার জন্যে একদমই প্রস্তুত ছিলাম না।

আরেকটি গল্প - “কাহারেও সে খুঁজে পায় নি কখনও”, এতে আবু ইউসুফ নামক এক নিম্নবিত্ত কর্মচারী পত্রিকা মারফত জানতে পারে যে মালয়েশিয়ার একটি বিমান সাগরের গর্ভে হারিয়ে গেছে। সে এখুবই চিন্তিত হয়ে পড়ে এ বিষয়টি নিয়ে। এক জ্বীন বিশারদের কাছে যায় বিমানের খবর নিতে। জ্বীন বিশারদ তার অতীতের অনেক কথা গড়গড় করে বলে দেয়। হারিয়ে যাওয়া মানুষেরা কোথায় আছে জানিয়ে দেয়। কিন্তু আবু ইউসুফ তো এসবের খবর নিতে আসে নি! সে জানতে চায় মালয়েশিয়ার হারিয়ে যাওয়া বিমানটি কোথায় আছে। জবাবে জ্বীনবাবা চোয়াল শক্ত করে শীতল কণ্ঠে বলে “তোরা নানির গুয়ার ভিত্রে”।

এটা যে খুব ভালো গল্প, বা ভালো সমাপ্তি “কিস মি বেবে”র মত তা বলা যাবে না, তবে দমকা হাসি্টা একইভাবে এসেছিলো।

এই দুইটি গল্পের উদাহরণ দেয়ার কারণ এটি বোঝানো, কৃষ্ণ জলেশ্বর কবি হলেও গল্প লেখার ব্যাপারে শুদ্ধতাবাদীদের দলে নন। তিনি তার ইচ্ছামত গল্পের ভাবকে ছেঁদো করে দেন, সব গল্পকেই যে মহৎ কিছু হয়ে উঠতে হবে এমন কোন কথা নেই। তিনি লিখতে আনন্দ পেয়েছেন, আমরা পড়ে আনন্দ পাবো, এটাই বা কম কী!


কৃষ্ণ জলেশ্বরের বইটিতে মোট গল্পের সংখ্যা একুশটি। সবগুলি গল্প পড়ার পর কিছু জিনিস বারবার ফিরে আসবে। বয়সে বড় মেয়ের প্রতি আকর্ষণ, টিউশনি, টিউশনি করতে গিয়ে প্রেম, দারিদ্র, হঠাৎ করে চেনা কারো বড়লোক হয়ে যাওয়া, হঠাৎ করে কাউকে হারিয়ে ফেলা ইত্যাদি। অনেক ক্ষেত্রেই এ ব্যাপারগুলি পুনরাবৃত্তিক মনে হতে পারে, এবং আসলেই সেরকমই, কিন্তু আমার কাছে কেন যে ক্লান্তিকর লাগে নি। ক্লান্তিকর না লাগার কারণ হলো, গল্পগুলি ছোট ছোট, একই গল্পে প্রায় সাত-আটটি করে অনুচ্ছেদ, গীতল ভাষা, যা একই সাথে প্রাঞ্জল এবং গভীর। তাই একটানা পড়ে যাওয়া যায়, ক্লান্তি লাগে না।

হিউমার নিয়ে কথা হলো, এবার মেটাফর নিয়ে কথা হোক। এই বইয়ের আমার সবচেয়ে পছন্দের গল্প “একটি কালো গোলাপ”। এই গল্পে বিপরীত পাশের ছাদে এক মেয়ের সাথে চোখে চোখে কথা হয় এক যুবকের। সেই মেয়েটি তার কাছে একটি কালো গোলাপ চায়। মেয়েটি থাকে তিনজন পুরুষের সাথে। একজন বৃদ্ধ, একজন যুবক আর একজন কিশোর। তিনজন পুরুষের নামই আবার এক!

ছেলেটি কালো গোলাপ খুঁজতে থাকে, কিন্তু কোথাও পায় না। হঠাৎ একদিন তার বারান্দায় কালো গোলাপ ফোটে। সে তখন মেয়েটিকে কালো গোলাপ দিতে গেলে বৃষ্টিতে মেয়েটি এবং গোলাপটি ধুয়ে যায়। কালো থেকে সাদা হয়। মেয়েটি ছেলেটিকে তার নাম জিজ্ঞেস করে, কিন্তু ছেলেটি আর তার নাম বলতে পারে না।


এখানে একই নামের বিভিন্ন বয়সের তিনজন পুরুষের সাথে বসবাস করার অর্থ, তারা আসলে তার জীবনে কোন অর্থ বহন করে না। সে চায় আরো গভীর অনুভূতি। কিন্তু যে ছেলেটির কাছে সে কালো গোলাপ চেয়েছিলো, তাকে দূর থেকে দেখে যতই রহস্যময় এবং আকর্ষণীয় মনে হোক না কেন, কাছে আসলে সেও নাম ভুলে যায়, কালো গোলাপের মাধুর্য হারিয়ে ফেলে, অবিশেষ হয়ে বিশেষভাবে।

“রক্তদালিমের ফুল” গল্পটাও খুব উপভোগ্য। অবৈধ যোগাযোগ, সাপলুডু খেলা, খেলনা বন্দুক দিয়ে গুলি ছোড়া, হত্যা পরিকল্পনার মাধ্যমে দাম্পত্য জীবনের নানাবিধ জটিলতা ডার্ক হিউমারের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। “রসনা ও বিষাদের গল্প”তে জীবনের বিভিন্ন বিষাদী ঘটনার সাথে রান্না এবং খাদ্যের একটা চমৎকার মন্তাজ গড়ে উঠেছে।

কৃষ্ণ জলেশ্বরের ভাষায় কাব্য আছে, আবার ইচ্ছেমত ভাষার পরিবর্তনও আছে। দেখা যায় হুট করে সাধু ভাষা নিয়ে এসেছেন, হুট করে কথ্য ভাষায় বর্ণনা করা শুরু করেছেন। এগুলোর বিশেষ কোন ব্যাখ্যা আছে বলে মনে হয় নি। মনে হয়েছে তার মর্জিমত লেখা। কিছু কিছু গল্পের কাহিনী অতি সাধারণ। যেমন “যে-বছর বসন্তে ফুল ফোটে নাই” গল্পটিতে দেখা যায় প্রেমিকাকে এক বছর অপেক্ষা করিয়ে ছ্যাকা দিয়ে প্রেমিক শেষতক বিশ্বাসঘাতকতা করে বসে। সুতরাং, সে বসন্তে কোন ফুল ফোটে না। দুর্বল গল্পের সরলতম মেটাফর। এরকম প্রেমিক-প্রেমিকার মধ্যে বিচ্ছেদ, আত্মহত্যা, বিশ্বাসঘাতকতা, এই জাতীয় বেশ কিছু গল্প আছে, যা বিশেষ কোন অনুভূতি জাগ্রত করে না। বিষয় নির্বাচনে তার আরেকটু বৈচিত্র আনা উচিত।

কৃষ্ণ জলেশ্বরের গল্পে বারবার সিনেমা এবং গানের প্রসঙ্গ এসেছে। সালমান শাহ, রুবেল এর সিনেমা থেকে শুরু করে সেক্স আফটার সিগারেটের গান সবই আছে। এসবের সাথে পাঠক বেশ একাত্মতা বোধ করবেন।

বইটি জ্যামের মধ্যে একটানে পড়ে শেষ করেছি। মতিঝিল থেকে মিরপুর আসতে আজকে জ্যাম একটু বেশিই পড়েছিলো। যাত্রীরা বিভিন্নসময় ড্রাইভার এবং কন্ডাক্টরকে গালাগালি করেছে। তবে আমি কানে হেডফোন লাগিয়ে বই পড়তে পড়তে আয়েশের সাথে গন্তব্যে পৌঁছে গেছি। এই সময়টাকে সুন্দর করার জন্যে তাকে ধন্যবাদ।

বইটি অর্ডার করতে পারেন এখান থেকে- Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০২১ সকাল ৯:৫০
১৩টি মন্তব্য ১০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(

লিখেছেন সোহানী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৯:৫৪



আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

×