(১)
“আমার বাচ্চাকে আমি কোনো প্রেসার দিবো না”
“আমার বাচ্চাকে আমি কোনো স্ট্রেস দিবো না”
“তার যেটা ভালো লাগে করবে”
এই উক্তিগুলি উন্নত মানসিকতার আশাবাদী বাবা-মায়ের ওয়ালে ঘুরে ফিরে দেখা যায়। এই ধরণের মানসিকতা প্রশংসনীয়। কিন্তু, জীবনে কি আসলে স্ট্রেসকে এড়ানো যায়? প্রেসার থেকে কি মুক্তি মেলে?
একটা না একটা পর্যায়ে এসে স্ট্রেসের মুখোমুখি হতেই হবে। চাপ নিতেই হবে। সারাজীবন কারোই হেসেখেলে রূপকথার বাগানে গোল্লাছুট খেলে কেটে যায় না। একটা শিশুর অবশ্যই চাপহীন, সুন্দর শৈশব কাম্য। কিন্তু কতদিন সে থাকবে চাপহীন? কবে থেকে তাকে চাপের সাথে পরিচয় করাতে হবে?
আপনি আপনার সন্তানের পরীক্ষার ফলাফল নিয়ে মাথা ঘামান না। দীপু নাম্বার টু-এর বাবার মতো উদাস। ঠিক আছে। পড়াশোনা নিয়ে যদি অতটা চিন্তা করার ইচ্ছা না’ই থাকে, তাহলে তাকে অন্য দিকে দক্ষ করে গড়ে তুলুন। গ্রাফিক্স ডিজাইন, বা ইলেকট্রনিক্স, বা কোডিং। কিন্তু কোনো ব্যাপারে দক্ষ হতে হলেও কিন্তু পরিশ্রম করতে হবে। চাপ নিতে হবে। এখন, কেউ যদি কোনো একটা বিষয়ে আগ্রহী হয়, তাহলে চাপ তার কাছে চাপ মনে হবে না। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে, আমাদের সমাজে এত পরিমাণ পছন্দের কাজ নেই, যা সবার মধ্যে সমানভাবে ভাগ করে দেয়া যায়।
ভূমি অফিসে দাগ, খতিয়ান আর মৌজা নিয়ে কাজ করার মানুষের দরকার আছে।
ব্যাংকে হিসাব মেলানো, ঋণ আর কিস্তি নিয়ে কাজ করার জন্যে মানুষের দরকার আছে।
এই যে কম্পিউটারে লিখছি, এই কম্পিউটার যারা উৎপাদন করে তাদের বিক্রয় এবং বিপননের জন্যে লোক দরকার আছে।
এগুলির কোনোটা কারো ড্রিম জব হতে পারে না। জীবনের লক্ষ্য বলতে গেলে তপো সবাই ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বিজ্ঞানী, শিক্ষক, চিত্রশিল্পী বা লেখক- এর বাইরে আর কিছু বলতে পারে না। তাহলে বাকি কাজগুলি করবে কারা?
আর এই স্বপ্নের পেশাগুলিও কি স্ট্রেসবিহীন? একজন ডাক্তারকে কী পরিমাণ পড়াশোনা করতে হয় আর কী পরিমাণ দায়িত্ব নিতে হয় সেটা তো কারও অজানা না। ইঞ্জিনিয়ার? সেদিন একজনের কথা পড়লাম, বিদ্যুৎ বিভাগে চাকরি করে। এই লোডশেডিংয়ের সময়ে তাকে বাসায় ফিরে রাত দুইটা তিনটার সময়ও কাজ করতে হয়েছে, আবার সকাল ছয়টায় উঠতে হয়েছে।
(২)
এশিয়ার দেশগুলিতেই মূলত অভিভাবকেরা পড়াশোনা নিয়ে বেশি সিরিয়াস। এখানকার সমাজ ব্যবস্থাই এরকম, পড়াশোনা-ভর্তি-চাকরি। আমেরিকার মতো হাইস্কুল পাস না করে কিছু একটা কাজ শিখে নিয়ে সাবলম্বী হবার প্রক্রিয়া এখানে নিন্দনীয়।
আপনার সন্তানকে দশ ক্লাস পাস করার পর তো একটা মুদী দোকানে বসিয়ে দিতে পারেন, তা দিবেন না। আপনি কিন্তু চান সেই ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ারই হোক। তাহলে কেন অযথা এই “চাপ দিবো না, ওর যা ভালো লাগবে করুক”- এই গালগল্পে মজে থাকেন?
(৩)
একটা সময়ের পর আপনার সন্তানকে স্ট্রেসের সাথে পরিচিত করাতেই হবে। পরীক্ষায় যা ইচ্ছা তাই করুক, শুধুমাত্র আনন্দ করে বেড়াক, অত চাপ না নিক, রেজাল্ট ভালো করতে চাপ দেয়া যাবে না, এগুলি আমার কাছে সচেতন প্যারেন্টিং মনে হয় না।
হ্যাঁ, আপনি অবশ্যই তাকে পরীক্ষায় প্রথম না হলে বলবেন না যে- অমুকের পা ধোয়া পানি খা,
কিন্তু অংকে কেন ১০০তে ৫০ পেলো, কোন কোন জায়গায় ভুল করেছে, কোন কোন জায়গায় উন্নতির দরকার সেগুলি আপনাকে খেয়াল রাখতে হবে।
অ্যাডমিশন পরীক্ষায় ভালো না করলে তার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিবেন না, কিন্তু অ্যাডমিশন পরীক্ষায় যাতে ভালো করে, সে যেন চেষ্টার কমতি না করে সেজন্যে তাকে অনুপ্রেরণা এবং উৎসাহ যোগাবেন। এবং চেষ্টার পরেও যদি ভালো করতে না পারে, তাকে বোঝাবেন যে এতেই জীবনের শেষ না।
কিন্তু চেষ্টাও করবে না, খারাপ করবে, আপনি তাকে চাপ দিতে পারবেন না, এইসব ইউটোপিয়া তো অচল বাস্তব জীবনে! জীবন অত সহজ না। কোনো দেশেই না।
১৮ কোটি মানুষের জন্যে পর্যাপ্ত কাজ নেই। ড্রিম জব তো বাতুলতা!
ব্যবসা করতে গেলেই যে স্বাধীন, সুন্দর এবং স্ট্রেসবিহীন জীবন তাও তো না!
ফ্রি ল্যান্সিং করতে গেলে সারা বিশ্বের সাথে প্রতিযোগিতা।
এখন আবার মানুষের সাথে প্রতিযোগিতায় যুক্ত হয়েছে ai.
সামনের পৃথিবীতে স্ট্রেস এবং প্রেসার বাড়বে বই কমবে না।
তাই আপনার সন্তানের জীবনে স্ট্রেস, প্রেসার আর রিলাক্সের ভারসাম্য কীভাবে করবেন এটা আসলে খুব ভেবেচিন্তে নির্ধারণ করার ব্যাপার।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই জুন, ২০২৩ সন্ধ্যা ৭:৩১