সফর শুরুর আগে... লিডারকে পেলাম না বাগে
টিকেট টু হলিউড থুক্কু হ্যানয়ের কাহিণী তো আগের পর্বেই বলেছি । আমাকে ভ্যাবাচ্যাকা করে ফুটবলের প্রস্থানের মধ্য দিয়ে তার সমাপ্তি ঘটেছে।
ফুটবলতো বলেই খালাস হয়ে গেল সামনের সপ্তাহে তুমি হ্যানয় আসছো। আমিও চাতক পাখির মত হ্যানয় যাবার দিন গুণছি। কিন্তু কেউ কোন টু শব্দ করেনা। ফুটবল এরিমধ্যে হ্যানয়ে ফিরে গেছে। তার সাড়াশব্দ নেই (আমি ভেবেছিলাম তার ওজন বেশি হওয়ায় হো চি মিন টু হ্যানয়গামী ভিয়েতনাম এয়ারলাইনস ক্র্যাশ করছে)। আমার লিডারো দুনিয়ার সব ব্যাপারে কথা বলে কিন্তু হ্যানয়ের কথা শুনলেই বলে মোস্ট বোরিং জায়গা ভাল লাগবে না। আরে বাবা একটা জিনিস টেস্ট না করে আমি কিভাবে বলব আমার ভাল লাগবে নাকি লাগবে না (আর আমার মত ছেলে যে কিনা নতুন কোন রাস্তা দিয়ে গেলেই ভাবে আহা নতুন কিছু আবিষ্কার করে ফেললাম)।
আমি যখন মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে গিয়েছি ফুটবল এই রকম ঘৃণ্য পন্থায় আমার হিন্দি জবানের প্রতিশোধ নিচ্ছে, ঠিক তখনই আমার ডাক পড়ল লিডারের ডেস্কে।
"ব্যাগ নিয়ে অফিসে আসছ??", লিডারের প্রশ্নের আগা মাথা বুঝলাম না... ব্যাগ নিয়ে অফিসে না আসার কি আছে?? হতে পারে আমি একটু ক্ষ্যাত তাই বলে এতটা ক্ষ্যাত না যে ল্যাপটপ হাতে নিয়ে অফিসে আসব।
গলার স্বরে যতটা সম্ভব গাম্ভীর্য (এটা আমার জন্য খুবই কঠিন... বেশির ভাগ সময়ই আমি হাসতে থাকি) ফুটিয়ে তুলে বললাম, "হুমম নিয়ে আসছি"।
"গুড!! এখনি এয়ারপোর্ট চলে যাও... হ্যানয় যেতে হবে"
বলে কি বেকুব.... হতে পারে হ্যানয় যাবার জন্য আমার উৎসাহ তার নজরে পড়েছে তাই বলে কি আমি লাগেজ ব্যাগ নিয়ে অফিসে আসছি!!
"মানে!!! আমি কি এক কাপড়ে হ্যানয় যাবো নাকি?? তবে অফিসের দরকারে যেতে পারি... দু একটা কাপড় চোপড় ওখান থেকে কিনে নিব... পড়ে ক্লেইম করলে আপ্রুভ করে দিয়েন"
"আচ্ছা ঐসব আলাপ বাদ দাও... তোমাকে হ্যানয় যেতে হবে দু' এক দিনের মধ্যে"।
দিনটা ছিল শুক্রবার। পরের দু'দিন ছুটি আমাকে আর পাই কে...
"কালকেই চলে যাই... আমি এখনই ট্রাভেল অর্ডার রেইজ করছি"
লিডার কিছু একটা নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন সম্ভবত অতটা খেয়াল করলেন না ... আমিও মনের সুখে ট্রাভেল প্ল্যান করে ফেললাম। শনিবার সকাল ১০টায় রওনা দেব ভিয়েতনাম এয়ারলাইনসে ... শনিবার হ্যানয় ঘুরব ... রবিবার চলে যাব হ্যা লং বে (আমার সাথে এক ট্রাভেল গাইডের হেভি খাতির আছে... তার মাধ্যমে ট্যুর ম্যানেজ করতে প্রবলেম হবে না)... সোম আর মঙ্গলবার নাম কা ওয়াস্তে অফিসে ঢু দিয়ে মঙ্গলবার রাতে ব্যাক করে চলে আসব। যেই ভাবা সেই কাজ ম্যানুয়েল ট্রাভেল অর্ডার ফিল আপ করে অপেক্ষা করতে লাগলাম লিডার কখন ব্যস্ত থাকবেন .... আমার মিশন এখন তার সই নেওয়া ... (বলে রাখা ভাল আমার লিডারের ছুটি বিষয়ক চরম আল্যার্জি আছে। সে নিজে অবিবাহিত ছুটি নেয়না ... আমাদেরও চরম ভোগান্তিতে রাখে)। কোন রকম দুর্ঘটনা ছাড়ায় সই হাসিল করে নিয়ে দৌড়ে পৌছে গেলাম খিটখিটে কো অর্ডিনেটরের কাছে। মহিলা সবার সাথেই চেঁচামেচি করে... আমি পারতপক্ষে তাকে এড়িয়ে চলি। তবে অবাক হলেও আমার কোন কাজই সে কখনো আটকে রাখেনি। তার টেবিলে ট্রাভেল অর্ডার রেখে উৎফুল্ল মনে ডেস্কে ফিরে আসলাম। মনের আনন্দে ওয়ার্কিং আওয়ারেও সামুতে একটা চোরাগুপ্তা হামলা চালায় দিলাম... কয়েক লেখা না পড়েই মন্তব্য করে ফেললাম .... কয়েকটা লেখা এত ভাল লাগল যে কি লিখবো বুঝে পেলাম না ... নীরবে প্লাস দিয়ে প্রস্থান করলাম। প্রায় সোয়া এক ঘন্টা আউটলুকে মেইল চলে এসেছে... অনলাইন টিকেট। কিন্তু এ কি !!! টিকেটে তো তারিখ ভুল হয়েছে... শনিবারের জায়গায় রবিবার সকাল ১০টা। আমি আবার খুব তড়িৎকর্মা ছেলে (মানে যেখানে আমার স্বার্থ জড়িত থাকে আর কি) কোঅর্ডিনেটরকে গিয়ে বললাম তার এজেন্সি ভুল তারিখে টিকেট ইস্যু করেছে। অর্ডিনেটর দেখি কিছু না বলে মিটিমিটি হাসে। তারপর বলল "ঠিকই আছে... তোমার লিডারের কাছে যাও"
কি ঘটনা ঘটছে আমার বুঝতে বাকি থাকলো না... আমি ডালে ডালে চলেছি লিডার দেখি পাতার শিরায় জার্নি করেছেন। তাও ভাগ্য ভাল সোমবারের টিকেট ইস্যু হয়নি। ব্যর্থ মিশন শেষে হ্যানয় যাবার প্রস্তুতি শুরু করলাম।
যা্ত্রা হলো শুরু
এয়ারপোর্ট থেকে হ্যানয় পর্যন্ত যা্ত্রা পথে তেমন কোন উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটলো না। শুধু আমার মত খাদ্য রসিককে অভুক্ত থাকতে হয়েছিল এই যা। একটা রাষ্ট্রায়ত্ত বিমানে শুয়োরের মাংস ছাড়া কোন আইটেম থাকবে না এটা আমার মত আনাড়ীর কল্পনার বাইরে ছিল। বাসা থেকে পেট খালি রেখে বের হয়েছিলাম যেন প্লেনের খাবারগুলো মজা করে খেতে পারি। কিন্তু আবার সেই কি আশায় বাধি খেলা ঘর টাইপ সিম্পটমের শিকার।
আমার ক্ষুধার্ত মগজ দ্রুত গতিতে হিসাব কষতে শুরু করে দিল হ্যানয়ে কার ফ্ল্যাটে গিয়ে হামলা করা যায়। একটা ব্যাক আপ প্ল্যানো থাকল ফাস্টফুড।
হো চি মিন থেকেই ট্যাক্সি বুক করে রেখেছিলাম। কারণ হ্যানয় এয়ারপোর্ট থেকে মূল শহর ১ ঘন্টারো বেশি দূরত্বে। আমার ট্যাক্সি বুক করা আছে সো নি চিন্তা ডু ফুর্তি মুডে লাউঞ্জে বের হয়ে আসলাম। শত শত প্ল্যাকার্ড নিয়ে লোকজন দাড়িয়ে আছে। কি অদ্ভুত অদ্ভুত সব নাম... কিন্তু আমার অদ্ভুত নামটা কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না কেন!!! এদিকে ঘড়ি জানান দিচ্ছে বেলা ১:৩০টা বাজে... পেট জানান দিচ্ছে তোমার ফুয়েল শ্যাষ... মাগাড় আমার ট্যাক্সি কোথায়... একে একে সব প্ল্যাকার্ডে চোখ বুলাতে থাকলাম ... অং টিং পং কত নাম কিন্তু আমার নাম নাই। হঠাৎ চোখে পড়ল লেখা মি: শুন। খটকা লাগল ... মধ্য বয়স্ক লোকটার দিকে এগিয়ে গেলাম ... তাকে জিজ্ঞেস করলাম তার যাত্রীর নাম কি?? ব্যাটা কিছুই বোঝে না বলে শুধু মি: শুন মি: শুন ... এক এয়ারপোর্ট স্টাফকে দিয়ে তাকে আবার জিজ্ঞেস করালাম... তখন সে বলল সে মি: প্রা শুনের জন্য ওয়েট করছে ।
সব ভুল বুঝাবুঝির অবসান ঘটিয়ে টেক্সিতে যখন সাওয়ার হয়েছি ... বেলা তখন প্রায় আড়াইটে। এখন শুরু হবে আমার খাবার মিশন। ফার্স্ট অপশনে কল দিয়ে শুনলাম তার আজকে বাইরে ডিনারের দাওয়াত আছে... আমাকে সোমবার দিন রাতে খেতে বিশেষ করে বলে দিল। কল গেল সেকেন্ড অপশনে ... সে তার এক দোস্তের বাসায়। বিকালে আমার সাথে মিট করবে আর রাতে খেতে বলে দিল। আহা কি আনন্দ!!! আর সৌজন্য কল করার দরকার নাই। টার্গেট এচিভ। খানা জুট গ্যায়া ... অর ক্যায়া চাহি হে??
এক সময় হোটেলে পৌঁছে গেলাম। হাত মুখ ধুয়েই সেকেন্ড অপশনকে আবার কল দিলাম লাঞ্চ কোথায় করা যায়। সে দেখি ফোন ধরে অস্বস্তিবোধ করছে ... বলল "ইয়ে প্রসূন একটু সমস্যা হয়ে গিয়েছে... আজকে আমার একটা ডিনার ইনভাইটেশান আছে ... তুমি কালকে রাতে আমার বাসায় খাও... লাঞ্চের জন্য ভিয়েত টাওয়ার পার্কসনে চলে যাও... ওখানে পিজা হাট, কেএফসি থেকে শুরু করে অনেক দোকান আছে "
আমি বজ্রাহত.... সবারই একই সাথে ডিনার পার্টি পড়ল কেমন করে!!! ... মানুষজন না খাওয়াবার অজুহাতো খুঁজতে পারে না ঠিক করে। ধুর ছাই!! বাইরে খাবো যা আছে কপালে।
ব্যাগ খুলে কাপড় চেঞ্জ করতে গিয়ে মনে পড়ে গেল একজনকে কিছু জিনিস পৌঁছে দিতে হবে। ভাবলাম আগে পেট পুজা করেনি তারপর বাদ বাকি সব। প্যাকেট টা সাথে নিয়েই বের হয়ে পড়লাম হ্যানয় ভ্রমণে।
প্যাচাল কম ছবি বেশি
হো চি মিন মিউজিয়াম
পেট পুজা করেই বের হয়ে পড়লাম হ্যানয় দর্শনে। প্রথমেই চলে গেলাম হো চি মিন মিউজিয়াম। মিউজিয়ামের প্রতি আমার আলাদা দুর্বলতা আছে।
মিউজিয়ামে ঢুকেই হো চি মিনের এই ভাস্কর্য। আমি ভেবেছিলাম মিউজিয়াম যেহেতু একজন ব্যক্তির নামে সুতরাং তাঁর স্মৃতিরই আনাগোণা হবে এখানে । কিন্তু ভুল ভাঙল একটু পড়েই।
রেঁনেসা থেকে কিভাবে বিশ্ব সভ্যতার চুড়ান্ত শিখরে পৌছেছিল... কিভাবে মানুষ তার যুগের থেকে একশ বছর এগিয়ে ভাবতে শিখেছিল। তারই এক অদ্ভুত লেখচিত্র ... সম্পূর্ণ কাঁচের উপর... গঠনশৈলীটা ঠিক লুকোচুরি খেলার ভুল ভুলইয়্যার মত।
আলো আঁধারীর খেলা চলছে এই কাঁচঘরে নিরন্তণ
গ্রেট বস চার্লি চ্যাপলিন
ছবিটা দেখে কেন জানি শীর্ষেন্দুর মানবজমিন বইটার কথা মনে পড়ে গিয়েছিল
এর পাশাপাশিই এই জাদুঘরে আছে ভিয়েতনামিজদের ভবিষ্যত যাত্রার ইতিহাস.. সামন্তবাদ... বিপ্লব... কমিউন্যুজম... রক্ত ... যুদ্ধ .... সব কিছুর এক অপূর্ব মিলনমেলা ...
ভিয়েতনামিজ সামন্ততন্ত্রের খন্ড চিত্র (সামন্তবাদী প্রভুদের প্রতিভু বৈঠকখানা .. পোষাক)
এরকম শত শত দলিল দস্তাবেজ, রাজনৈতিক চিঠি, পেপার কাটিং ... এমন কি বন্ধু বা প্রেয়সীর কাছে লেখা বিপ্লবীদের চিঠি পরম যত্নে সজ্জিত আছে স্লাইডে স্লাইডে... এগুলো দেখে বা স্পর্শ করেই যে কেউ পার করে দিতে পারেন পুরোটা দিন... তবে আমার সময় ছিল না
এরকম অনেক শিল্পকর্মই আছে বিভিন্ন ঘটনার প্রতিভূ হিসেবে... আমার এটা খুব ভাল লেগেছে নাম : রোড টু ফিউচার ১০০০০ দিন যুদ্ধ শেষে ভিয়েতনামের মেরুদন্ড সোজা করে দাড়ানোরই প্রতিচ্ছবি যেন।
সামান্য এই অস্ত্র নিয়েই (নামটা ভুলে গেছি) ঝাপিয়ে পড়েছিল ট্যাঙ্কের সামনে... নাম: প্রতিরোধ
এই বুঝি শৃঙ্খলমুক্তি
পোষ্টার আর ফ্যাস্টুন পিরামিড
বিপ্লব... ধ্বংস ... অত:পর মুক্তি
আজকে এখানেই শেষ করে দিচ্ছি... আশা করছি আরেক কিস্তিতেই শেষ করে ফেলব...
যারা আমাকে লজ্জা দিয়েছিল তাদের নাম বলার লোভ সামলাতে পারছি না...
হা মা ভাইডি
সাই ফাই সিজার ভাই
আহাম্মক রাকু
শামসু নানা থুক্কু ভাই
এই লজ্জা আমার প্রাপ্য ছিল... তোমাদেরকেই এই লেখা উৎসর্গ করলাম
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে জানুয়ারি, ২০১০ রাত ৮:০২