উনিশশো বাষট্টি সালে পাওলো মাতাই নামে এক ইতালীয়ান তরুন প্রত্নতত্ববিদ অনিশ্চয়তা সহকারে সিরিয়ার উত্তর-পশ্চমান্চলের সমভূমিগুলো সামগ্রীকভাবে পরীক্ষা করে। সিরিয়া খুব সামান্যই প্রত্নতত্ব রয়েছে বলে মনে করা হতো। কিন্তু, দুই বছর পরে এলপোর প্রায় ৬০কিলোমিটার দক্ষিনে তেল মারদিখে খনন কাজ থেকে এমন একটা বিষয় আবিস্কৃত হয়, যেটাকে 'বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আবিস্কার' বলে অনেকে বিবেচনা করেন। আজকে italiana a Ebla র একটি সংক্ষিপ্ত বিবরন আপনাদের কাছে শেয়ার করছি।
প্রাচীন অভিলিখনগুলো এবলা নামের এক শহরের অস্তিত্ব সমন্ধে সাক্ষ্য দেয়। কিন্তু, কেউই জানতো না যে, মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অনেক টিলার মধ্যে সেই শহর পাওয়া যেতে পারে। আকাদের রাজা সর্গোনের ''মারি, ইয়ারমুতি ও এবলার'' বিজয় ও সুমেরিয়ার রাজা গুডেয়া মূল্যবান কাঠ সংগ্রহ করেন যা তিনি ইবলা(এবলা) পাহাড়গুলো থেকে পেয়েছিলেন, এ ছাড়া, এবলা নামটা মিশরের কার্নাকের তালিকায় পাওয়া যায়, যে তালিকায় ফরৌন তুতমুসি ৩য় যে প্রাচীন শহরগুলো জয় করেছিলেন, সেগুলোর নাম রয়েছে। তবে, আরো খনন কাজ ফলপ্রসু হয়েছিল, ১৯৬৮ সালে রাজা আইবিটলিমের মূর্তির অংশ বিশেষ আবিস্কৃত হয়েছিল। এর মধ্যে আকাদীয় ভাষায় খোদিত একটা ব্রত ছিল_ যা দেবী ইশ্তারের নামে উৎসর্গীকৃত করা হয়েছিল, যিনি এবলার বিশিষ্ট ছিলেন।
তেল মারদিখের সঙ্গে যে প্রাচীন এবলার মিল রয়েছে, তার প্রমান পাওয়া যায় ১৯৭৪/৭৫ সালে কীলকাকার ফলক আবিস্কৃত হওয়ার মাধ্যমে। কীলকাকার লেখনীতে অনুবাদিত যাঃ শব্দটি কেবল এবলার লোকেদের সর্বদেবতার মন্দিরের অনেক দেবতার মধ্যে কেবল একটা দেবতাকেই নির্দেশ করে।সেই শহর কমপক্ষে দুটো সময়ে অস্তিত্ব ছিল। প্রথমবার আধিপত্য বিস্তারের ফলে, তা ধ্বংস হয়ে যায়। এরপর এবলা পুননির্মিত হওয়ার পরই আবার ধ্বংস হয় এবং শত শত বছর তা অস্তিতহীন অবস্হায় থাকে।
অধিকাংশ প্রাচীন শহরই পাললিক সমভূমিতে যেমন টাইগ্রীস ও ইউফ্রেটিস নদীর মধ্যবর্তী স্হানে গড়ে উঠেছিল। সম্ভবত এবলা শব্দটির অর্থ হল 'শ্বেত প্রস্তর' যা চুনা পাথরের সেই নিম্নস্তরকে নির্দেশ করে, যার উপর শহরটা অবস্হিত ছিল। স্পষ্টতই সেই জায়গাটা বেছে নেওয়ার কারন ছিল প্রাকৃতিক জল সরবরাহের নিশ্চয়তা দেয়, যা প্রধান প্রধান নদী থেকে দুরবর্তী অন্চলগুলোতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
এবলা এলাকায় সামান্য বৃষ্টিপাতের কারনে প্রচুর খাদ্যশষ্য, আঙ্গুর ও জলপাই গাছের উৎপাদন করা যেত। তা ছাড়াও পশুপালনের জন্য বিশেষত মেষ পালনের জন্য এবলা ছিল উপযুক্ত স্হান। এবলার সুবিধাজনক বাণিজ্যিক অবস্হান_ মেসোপটেময়া সমভূমি ও ভূমধ্যসাগরীয় উপকূলের মধ্যবর্তী স্হান__ কাঠ, উপরত্ন ও ধাতু ব্যবসায়ের জন্য উপযুক্ত স্হান ছিল। সেই শহর এমন একটা অন্চলের উপর শাসন করেছিল যেখানে প্রায় ২,০০,০০০ জন বাস করত। যাদের প্রায় দশভাগ রাজধানীতে বসবাস করত।
বিরাট রাজপ্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ এবলীয় সভ্যতার উন্নতির চমৎকারিত্বের প্রমান দেয়। যে প্রবেশদ্বার দিয়ে প্রাসাদে ঢুকতে হতো, তা প্রায় ১২-১৫ মিটার উচ্চ ছিল। ক্রমবর্ধমান শক্তিশালী প্রশাসনের বৃদ্ধিরত চাহিদা পূরণ করার জন্য প্রাসাদকে ধাপে ধাপে প্রসারিত করা হয়েছিল। কর্মকর্তারা জটিল শ্রেণীকাঠামোর___ 'প্রভু' ও 'গভর্নর' দ্বারা সাহায্যপ্রাপ্ত রাজা ও রাণীর অধীনে কাজ করত।
১৭,০০০রের ও বেশি ফলক ও খন্ডাংশ পাওয়া গিয়েছিল, মূলত সেখানে ৪,০০০রের বেশি পূর্ণাঙ্গ ফলক ছিলনা। যেগুলো যত্ন সহকারে কাঠের সেলফে রাখা হয়েছে।এই নথিগুলো এবলার ব্যাপক বাণিজ্যিক প্রসারের প্রমান দেয়। উদাহরনস্বরূপ, সেই শহর মিশরের সঙ্গে বাণিজ্য করত, যা দুইজন ফরৌনের রাজকীয় প্রতীকের মধ্যে দেখানো হয়েছে। সেই ফলকগুলো মূলত সুমেরীয় কীলকাকার লেখনীতে লেখা হয়েছিল, কিন্তু কিছু অংশ এবলীয় ভাষায় অর্থাৎ খুব প্রাচীন সেমেটিক ভাষায় লেখা হয়েছিল, যা এই নথিগুলির কারনে সংকেতগুলির অর্থোদ্ধার করা যেতে পারে। প্রাচ্যবিশারদরা এইধরনের প্রাচীন সেমেটিক ভাষা আবিস্কার করতে পেরে আশ্চর্য হয়েছিল। কিছু ফলকে দ্বিভাষিক সুমেরীয়-এবলীয় তালিকা রয়েছে। এবলা- আলি, ওরিজিন ডেলা চিভিলটা উরবানা (এবলা- শহুরে সভ্যতার উৎপত্তিতে) বইটি সবচেয়ে প্রাচীন অভিধান বলে উল্লেখ করে।
নিশ্চতভাবেই এবলা এক সামরিক শক্তি ছিল কারন খনন কাজের খচিত কর্ম, এবলীয় যোদ্ধারা তাদের শত্রুদের হত্যা করেছে এবং কেটে ফেলা মাথা উপস্হাপন করেছে বলে তুলে ধরে। কিন্তু এবলার চমৎকারীত্বের শেষ হয়ে যায়, যখন অশূর ও বাবিল ক্ষমতা লাভ করে, সম্ভবত প্রথমে সর্গোন এবং পরে তার নাতি নারান সিন এবলা আক্রমন করেছিল। প্রত্নতাত্বিকগনের মতে, আক্রমনকারীরা হিংস্র ছিল এবং তাদের আক্রমন ভয়ংকর ছিল।
তবে যেমনটা উল্লেখ করা হয়েছে যে, বেশ কয়েক বছর পর সেই শহর আবার পুননির্মিত হয় এবং সেই অন্চলে গুরুত্ব লাভ করে। শহরটি পরিকল্পনা মাফিক নির্মিত করা হয়েছল যা এর আবির্ভাবকে আরো অসাধারন করে তোলে। ছোট শহরটা একটা পবিত্র এলাকা ছিল, যা দেবী ইশ্তারের নামে উৎসর্গীকৃত ছিল যাকে বাবলীয়রা উর্বরতার দেবী হিসেবেও দেখত। বিখ্যাত ইশ্তার গেট যা বাবিলের ধ্বংসাবশেষ থেকে পাওয়া যায়। এবলার বিশেষভাবে অসাধারন একটি দালান দেখে মনে হয় যে, সেটা সিংহের ঘর হিসেবে ব্যবহার হতো, যা ইশ্তার দেবীর কাছে পবিত্র বলে গন্য করা হয়েছিল।
প্রাচীন প্রাচের যেকোন জায়গার মতো এবলাতেও সর্বদেবতার এক মন্দির ছিল। সেগুলোর মধ্যে কয়েকজন ছিল বাল, হদদ এবং দাগন। এবলার লোকেরা এদের সবাইে ভয় পেত। তারা এমনকি অন্যান্য লোকের দেবতাদের সম্মান করত, প্রত্নতাত্বিক আবিস্কার থেকে দেখা যায় যে, মুলত সা.কা.পূ. দ্বিতীয় সহস্রাব্দে দেবত্তপ্রাপ্ত রাজবংশীয় পূর্বপুরুষের উপাসনা করা হতো।
এবলার লোকেরা পুরোপুরিভাবে তাদের দেবতাদের উপর নির্ভর করেনি। নতুন এবলা শহরের চারিদিকে দ্বি-দেওয়াল বিশিষ্ট বেষ্টনী ছিল, যা যেকোন শত্রুর উপরই ছাপ ফেলেছিল। বাইরের দেওয়াল প্রায় দুই মাইলের সমান একতা বহিঃসীমা তৈরী করেছিল। তা সত্ত্বেও পুনর্নিমিত এবলার ইতি ঘটে। সম্ভবত সা.কা.প. প্রায় ১৬০০সালে হিত্তোরীয় রা সেখানে চুরান্তভাবে পরাজিত করতে হানা দেয়, যা এক সময় বিরাট শক্তি ছিল, যা এবলাকে সিরামিক পাত্রের মতো চূর্ণবিচূর্ণ করেছিল। ১০৯৮ সালে যিরূযালেমে যাওয়া ধর্মযুদ্ধে অংশগ্রহনকারীদের দ্বারা লিখিত এক নথি সেই জায়গা সমন্ধে উল্লেখ করে, যেখানে এক সময় এবলা ছিল আর এটা মারদিখ নামক দেশের প্রত্যন্ত ঘাটি বলে উল্লেখ করে। এবলাকে প্রায় ভুলেই যাওয়া হয়েছিল, যেটাকে কেবল অনেক শতাব্দী পরে পুনর্রায় আবিস্কার রা হয়।
(দুঃখিত, ফলকগুলির ছবি সংযুক্ত করতে না পারার জন্য।)
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০০৯ রাত ২:২৩