somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মঞ্জু ও শহিদ : একটি বিরহের গল্প

১৩ ই আগস্ট, ২০১১ দুপুর ১২:২৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


[এক লোকেরা আত্মজীবনীর প্রুভ দেখছিলাম। এ অংশটুকু খুব ভাল লাগল তাই শেয়ার করলাম। একটু বড়, তারপরও দিলাম। যাদের ধৈর্য আছে তারা পড়ার চেষ্টা করবেন। ধন্যবাদ।]



একটা মেয়ের সাথে পরিচয় হওয়ার পর জীবনমরণ সমস্যায় পড়েছিলাম। এটি আমার জীবনের স্মৃতিবিজড়িত এক করুণ ঘটনা। আনছার মিয়া নামে এক ভদ্রলোকের সাথে আমার সামান্য পরিচয় ছিল। কথায়-বার্তায়, চলনে-বলনে, পোশাকে আসাকে খুব ভদ্র। এক বন্ধুর সঙ্গে তার বাসায় যাই এবং পরিচয় হয় তার মেয়ের সাথে। নাম মঞ্জু। জীবনে এত সুন্দরী মেয়ে দেখার সুযোগ হয়নি। দেশ বিদেশে অনেক ঘুরেছি কিন্তু তার মত কেউ আজ পর্যন্ত চোখে পড়েনি। তার চলাফেরা-কথাবার্তা সাধারণ মেয়েদের মত ছিল না। আচার ব্যবহার ছিল আদবে শিষ্টাচারে পরিপূর্ণ। তার বাবা আনছার মিয়া ছিল ঠগ প্রকৃতির মানুষ। কোন কাজ করতো না। আজ এর কাছে কাল ওর কাছে হাত পাততো, ধারদেনা করে চলত। বন্ধুর সাথে বেশ কয়েক দিন তার বাসায় গিয়েছিলাম। মেয়েটি বেশ খাতির-যতœ করতো। তার ব্যবহার ছিল অদ্ভুত ধরনের। তারা অত্যন্ত গরিব। তাদের বাসায় মাসে ২/৪ বার যেতে হতো। আনছার মিয়ার অনুরোধে আমার মোটরসাইকেলে করে তাকে বাসায় পৌঁছে দিতাম। বাসায় গেলে চা না খাওয়ায়ে ছাড়ত না। আমার ধারণা ছিল, মেয়েটা অত্যন্ত ভালো। তার বাবা প্রায়ই আমার থেকে টাকা ধার নিত। তবে বেশি দিতাম না। কারণ তার অভ্যাস ছিল ধার করা। একদিন আনছার মিয়া একটা শার্ট এবং প্যান্ট দেখিয়ে বলল, তার মেয়ে মঞ্জু নিজ হাতে এটি তৈরি করে দিয়েছে। বড়ই আশ্চর্য হলাম। আমার বোন হেনা কোনদিন এক গ্লাস পানি ঢেলেও খায়নি। অকাজের মেয়ে। শার্টের বোতাম পর্যন্ত সেলাই করতেও পারত না। মঞ্জুকে আমি বোনের চোখে দেখতাম। তার কাজকর্মে মুগ্ধ হয়ে মনে মনে ভাবতাম মেয়েটা যদি আমার বোন হতো তবে তাকে মাথায় তুলে রাখতাম। আমার হৃদয়ের গোপন মন্দিরে তার জন্য মায়া জমতে লাগল।
আনছার মিয়া একবার রাত এগারোটার সময় আমার কাছে কিছু টাকা ধার চাইলো। টাকা না দিলে ঐ রাতে তাদের না খেয়ে থাকতে হবে। মনের অজান্তে হৃদয় কেঁদে উঠল অসহায় পরিবারটির কথা চিন্তা করে। পকেট থেকে টাকা বের করে দিলাম। টাকা হাতে নিয়ে আনছার মিয়া বলল, এখন বাজার করলে রান্না করবে কখন? ডিম আর রুটি কিনলে মন্দ হয় না। তার অনুরোধে বাসায় গিয়ে দেখলাম, সত্যিই সেদিন হাঁড়ি চড়েনি। আমার প্রাণে মায়ার সঞ্চার হলো। কে যেন কানের কাছে চুপি চুপি বলে গেল আপন কর্তব্য পালনে অবহেলা করতে নেই। মঞ্জুর মা ছিল এক ডাক্তারের স্ত্রী। আনছার মিয়া ভালোবেসে মঞ্জুকে সঙ্গে নিয়ে গোপনে ডাক্তার স্বামীকে পরিত্যাগ করে অনেক আগে চলে এসেছে। মঞ্জু তখন অনেক ছোট। উপযুক্ত স্বামীকে ছেড়ে একটা বাজে লোকের সাথে গোপনে পালিয়ে আসার কারণ জানতে পারিনি কোনদিন।
আনছার মিয়া জোর করে মাঝেমধ্যে আমাকে তার বাসায় নিয়ে যেত। মঞ্জুকে আপন বোনের মতো দেখতাম। বাসায় গেলে আমাকে খুব আদর-যতœ করতো। দিনের পর দিন তার প্রতি মায়া বাড়তে থাকে। ধীরে ধীরে সে মায়ামমতা প্রসারিত হয় হৃদয়ের আঙ্গীনায়। তার প্রতি আমার এত দুর্বলতা হবে তা আগে কোনদিন টেরও পাইনি। মঞ্জু তখন কলেজে পড়ে। একদিন আনছার মিয়া আমাকে বলল, মঞ্জুর একটা ডিকশনারি দরকার। অভাবের সংসারে পেট বাঁচে না। তার উপর আবার বোঝা। একটা ডিকশনারি কিনে দেয়ার জন্য আমাকে অনুরোধ করলো। সাধারণত ছোটখাটো জিনিস আমার মনে থাকে না। কয়েদিন পর আনছার মিয়া আবার তাগাদা দিল। আমি বললাম, কাল আমি ডিকশনারি কিনে বাসায় দিয়ে আসব। কিন্তু আমি আবার ভুলে গেছি। একটা ভুল করেছিলাম, সেদিন যদি ৫টা টাকা দিয়ে বলতাম, সে যেন ডিকশনারিটা কিনে নেয় তাহলে সব ঝামেলা চলে যেত। খুব সম্ভবত সপ্তাহ দুই-তিন পর আনছার মিয়ার সাথে আমার পথে দেখা। আমাকে বলল, মঞ্জুর অসুখ। খুব সিরিয়াস। আমার প্রশ্নের উত্তরে বলল, মঞ্জু পাশের বাসা থেকে একটা ডিকশনারি ধার করে বেশ কয়েকদিন গভীর রাত পর্যন্ত নকল করছিল এরপর হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ে। ডাক্তার দেখিয়েছি, ওষুধ কেনার পয়সা নেই। আমি ওষুধ কিনে তার বাসায় গিয়ে দেখি মঞ্জু খুব অসুস্থ। সেদিন নিজেকে খুব অপরাধী মনে হয়েছিল। অনেক ফলমূল কিনে দিয়েছিলাম। আস্তে আস্তে অবস্থ এমন হয়েছিল যে তাকে না দেখে থাকতে পারতাম না। সপ্তাহে দু-একদিন যেতেই হতো। প্রাণে মায়া-মমতা জমতে জমতে সে মায়া-মমতা ক্যান্সারে পরিণত হয়ে গেল। শেষে আমি বুঝতে পারছিলাম এর নাম হয়ত ভালোবাসা। তাকে ভালোবেসে ফেলেছি। অনায়াসে বুঝতে কষ্ট হয়নি যে, আমি এক ভয়াবহ বিপদে পড়ে গেছি। আগে তাদের বাসায় যেতাম বাহানা দিয়ে। এখন আর বাহানা দিয়ে তাদের বাসায় যাওয়ার অবস্থা নেই। তাদের বাসার সবাই অনেকটা আঁচ করতে পেরেছে। আমার যে কি অবস্থা তা বর্ণনা করা খুব কঠিন। ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া এবং ঘুম হচ্ছে না। কিছু একটা হয়েছে আমার তা আমাদের বাসার সবাই টের পেয়েছে। চেনা পথঘাট সবই ভুলতে বসেছি। মোটরসাইকেলে করে বাসায় ফেরার সময় বাসা ছাড়িয়ে চলে যাই। আবার ফিরে আসার সময় সেই একই ভুল করি। আমি তখন ওকে ভুলে যেতে চেষ্টা করি। যতই দূরে সরে যেতে চেষ্টা করি ততই কাছে এসে যাই। যতই ভুলতে চেষ্টা করি ততই মনে পড়ে বেশি। বেশকিছু দিন ধরে তার সাথে দেখা হচ্ছে না। দেখা করতে পারছিও না। কয়েকদিন পর অনেক ঘুম হচ্ছিল না। সারা রাত ছটফট করতাম। মনটা অস্থির। তার সাথে দেখা করা সম্ভব নয়। ভাবলাম, তার বাসার সামনে দিয়ে ঘুরে আসলে হয়ত মনটা একটু ভালো হতে পারে। তখন অনেক রাত। মোটরসাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়ি। কিন্তু মুশকিল হলো তার বাসার গলির রাস্তা শেষ। সোজা যাওয়ার কোন পথ নেই। বাসার সামনে গিয়ে ফিরে আসতে হবে। সেই সময় বরিশালে মোটরসাইকেল ছিল শুধু আমার। তাই মোটরসাইকেলটা অনেক দূরে রেখে তার বাসার সামনে গিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ফিরে আসি। তারপর দেখি মনটা কিছুটা ভালো হয়ে গেছে।
আমার অবস্থা তখন পাগলপ্রায়। ভাবলাম, ভালোবাসার কথা তাকে জানিয়ে দেই, কিন্তু কীভাবে জানাব? তার হাবভাবে আমি নিশ্চিত যে, সে আমাকে খুব ভালোবাসে। কেউ যদি আনছার মিয়াকে ডাকতে যায় তখন মেয়েটা বাসার ভেতর থেকে গম্ভীরভাবে বলে দেয় যে, তার বাবা বাসায় নেই। কিন্তু আমি যত বার তার বাসায় গিয়ে ডাক দিতাম উপরতলা থেকে দৌড়ে নেমে আসতো। সিঁড়ি দিয়ে নামার শব্দ পেতাম। আনছার মিয়া বাসায় না থাকলেও চা না খেয়ে আসতে পারতাম না। আমার যে পাগলদশা তা কী করে জানাই। ভালোবাসা আদান-প্রদানের একমাত্র মাধ্যম চিঠি। কিন্তু ওসব আমার দ্বারা সম্ভব ছিল না।
আমার স্কুলের এক বাল্যবন্ধু ছিল পড়াশুনা ছেড়ে হয়ে গেল মাস্তান। বেশ বড় মাস্তান। নাম খোকন। আমার এ ব্যাপারটা জানতো সে আমাকে প্রায়ই বলতো তাকে একটা চিঠি দিতে। কিন্তু আমি বলেছিলাম, আমার দ্বারা সম্ভব নয়। তখন সে বলেছিল, আমি যদি দিতে না পারি তবে খোকন নিজে হাতে দিয়ে আসবে। কিন্তু এসব কাজ আমার দ্বারা সম্ভব ছিল না। এদিকে আমি কুষ্টিয়ায় ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি হয়ে গেছি। ৭ দিন পর আমার ক্লাস শুরু হয়ে যাবে। আমার এমন অবস্থা এমন যারা তাবিজ তুমারে বিশ্বাসী তারা বলবে যে, ছেলেটিকে তাবিজ করেছে মেয়েটি ।
আমার এক বন্ধুর নাম বিজয়। ছেলেটা খুব ইনটেলিজেন্ট এবং একজন সাহিত্যিক। একদিন আমাকে নিরিবিলি জায়গায় ডেকে বলল, ‘শহীদ ভাই আপনি যে আমার কত বড় প্রিয় বন্ধু তা আপনাকে কোনদিন বলিনি। বলার প্রয়োজনও মনে করিনি। আপনি জানেন না আমি আপনাকে কতখানি শ্রদ্ধা করি এবং ভালোবাসি। আপনার কী হয়েছে বলেন তো। আপনার অবস্থা খুব ভালো দেখছি না। বিজয়কে সব কথা খুলে বলার পর বিজয় বলল, ‘সহিদ ভাই আমি বেঁচে থাকতে আপনার এ সর্বনাশ হতে দিব না। সব সমস্যার একটা সমাধান আছে। মেয়েটিকে একটা চিঠি দেন। একটা এসপার ওসপার হয়ে যাক।’ তখন আমি বললাম যে, এটা কী করে সম্ভব? বিজয় বলল, ‘আমি আপনার কোন কথা শুনতে চাই না। এভাবে চলতে থাকলে ২/৪ মাসের ভেতরে আপনাকে পাবনা হসপিটলে ভর্তি হতে হবে। আপনি যদি না পারেন তবে আমি আপনার হয়ে আপনার নাম সই করে মেয়েটির হাতে দিয়ে আসব। মঞ্জু মেয়েটাকে আমি খুব ভালো করে চিনি সে আপনার সমকক্ষ নয়, সে কথা সত্য কিন্তু তাকে বিয়ে করে আপনার জীবনটা ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া শতগুণে ভালো। আমার অনুরোধ, আপনি একটা চিঠি লিখে কাল ঠিক সময়ে এখানে চলে আসবেন।’
বিজয়ের কথামতো একটা চিঠি লিখলাম। নিজের কথা জানিয়ে, ক্ষমা চেয়ে, আমার পরিস্থিতির কথা বর্ণনা করে কয়েক পাতার একটা চিঠি লিখে পরের দিন বিজয়ের কাছে চলে এলাম। আমার জন্য অপেক্ষা করছিল সে। হাতে একটা বই। চিঠি পড়ে বিজয় বলল, ‘সহিদ ভাই চিঠিটা খুব সুন্দর হয়েছে। এটি যেকোন মেয়েকে দিলে আর যাইহোক খারাপ মন্তব্য করতে পারবে না। এটি আসলে প্রেমপত্র নয়Ñ জীবন বাঁচাবার ‘সনদপত্র। যান দিয়ে আসেন।’ সেটি বইয়ের ভেতরে রেখে আমাকে বলল, ‘ বইটা দিয়ে আসেন। আপনি এতো ইতঃস্তত করছেন কেন? আপনি তো কোন অন্যায় বা কোন নোংরামি করতে যাচ্ছেন না। পত্রের মাধ্যমে জানাতে যাচ্ছেন, আপনি তাকে ভালোবাসেন রঃ রং াবৎু ংরসঢ়ষব. এতে যদি মেয়েটা কিছু মনে করেও তাতে আপনার কিছু আসে যায় না। আপনি আপনার বিবেকের কাছে নিরপরাধী।’
আমি তার বাসায় যাওয়া মাত্র মোটরসাইকেলের শব্দ শুনে উপর তলা থেকে দৌড়ে নিচে নেমে বলল, তার বাবা বাসায় নেই। তার বাসায় অনেকদিন ধরে যাইনি বিধায় ভেতরে আসার জন্য বেশ অনুরোধ জানাল। আমি তার হাতে বইটা দিয়ে খুব তাড়াতাড়ি বিজয়ের কাছে চলে এসে বললাম, দিয়ে এসেছি। বিজয় বলল, খুব ভালো করেছেন। উত্তর কীভাবে পাব তা বিজয় দা’র কাছে জানতে চাইলে সে বলল, ‘আপনি কাল বিকেলে তার বাসায় গেলেই সে আপনাকে বই ফেরত দিবে এবং বইয়ের ভেতরে একটা চিঠি পাবেন।’ বিজয় জানে , আমার ক্লাস শুরু হয়ে গেছে। শীঘ্রই আমাকে কুষ্টিয়া চলে যেতে হবে। পরের দিন আমি বাসায় গিয়ে আনছার ভাই বলে ডাক দিলে সে আগের মতো উপর তলা থেকে দৌড়ে আসেনি। জানালা খোলা ছিল, জানালার দুই কপাট কিছুটা আড়াল করে দাঁড়াল। আমি তাকে বললাম, কাল কুষ্টিয়া চলে যাচ্ছি, আমার ক্লাস শুরু হয়ে গেছে। সে কোন কথা বলল না। ফিরে এসে বিজয়কে সবকিছু বললাম। বিজয় বলল, আপনি কালই চলে যান, একটা মেয়ের জন্য আপনার কলেজ, লেখাপড়া নষ্ট করতে পারেন না। ৭/৮ বছর পর আবার আপনি কলেজে ভর্তি হয়েছেন। আপনি কালই চলে যান যেভাবেই হোক আমি এর রেজাল্ট বের করে ঠিক ৭ দিনের ভেতর আপনাকে জানিয়ে দেব।
বিজয় ছিল আমার প্রিয় বন্ধু। আমার মঙ্গল কামনা করতো। ছেলেটা খুবই ভালো ছিল। খোকানও ছিল আমার প্রিয় বন্ধু। এমন বন্ধু যে আমার জন্য প্রয়োজনে জেল খাটতে পারে। সে-ও বলল, ‘তুই চলে যা, আমি এর খোঁজ নিব। আমি তোকে লঞ্চঘাট পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দেব।’ আমার বইপত্র এবং মোটরসাইকেল নিয়ে লঞ্চে উঠেছি। লঞ্চ ছেড়ে দিয়েছে। আমার অবস্থা যে কীরকম ছিল তা বলা কঠিন। হঠাৎ মনে পড়ল , আমি এ অবস্থায় একা খুলনা থেকে মোটরসাইকেলে করে কুষ্টিয়া যেতে পারবো না। চিৎকার দিয়ে খোকনকে বললাম, ‘খোকন তুই চলে আয়।’ খোকন তৎক্ষণাৎ একটা নৌকা করে লঞ্চে উঠে আসলো। তাকে বললাম, খোকন আমি একা খুলনা থেকে কুষ্টিয়া যেতে পারবো না। তুই আমার সাথে চল।’ খোকন বলল, ‘আমার কাছে টাকা-পয়সা কিছুই নাই।’ আমি বললাম, ‘টাকা-পয়সা আমার আছে, তুই চল আমি একা যেতে পারবো না।’
খুলনা থেকে রওয়ানা হলাম। ঘণ্টা এক দেড় ঘণ্টা পথ চলার পর হঠাৎ দেখি একটি রেস্টুরেন্ট নাম ‘ঝাউতলা রেস্টুরেন্ট’। মঞ্জু মেয়েটার বাসা ছিল ঝাউতলা। আমি যেন আর সামনে আগাতে পারছিলাম না। সেই রেস্টুরেন্টে খেয়েদেয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে আবার রওয়ানা হলাম। মেয়েটার প্রতি বোধহয় আমার প্রেমছিল না। তার করুণ অবস্থা দেখে হয়তে মায়ামমতায় নিবিড়ভাবে জড়িয়ে পড়েছিলাম। না হলে এভাবে আমার পাগলদশা হবে কেন?
কুষ্টিয়া পৌঁছে গেলাম। পরের দিন ক্লাসে গিয়েছি। আমার রোল নং ছিল ১৬। পাশে বসা ছিল যে ছাত্রটি তার নাম সাদি। প্রথমেই তার সাথে অনেক আলাপ হলো। রোল নং ডেকে গেছে কিন্তু আমার কোন খেয়াল ছিল না। তখন সাদি বলল, আমার রোল নং ডেকে গেছে। আমাকে জিজ্ঞেস করল, ‘ভাই আপনার কী হয়েছে? একটু খুলে বলেন তো। আপনাকে দেখলে মনে হয় আপনি অত্যন্ত অন্যমনষ্ক। কোন মেয়ের পাল্লায় পড়েছেন নাকি। একটু খুলে বলুন আপনার কী হয়েছে?’ আমি তাকে সব কথা জানালাম।
কলেজ শেষে বাসায় ফেরার সময় অল্পের জন্য বেঁচে গেছি। মোটরসাইকেলসহ ট্রেনের নিচে চাপা পড়ার উপক্রম হয়েছিল। পরের দিন সাদিকে ঘটনাটা বললাম। এরপর থেকে সে আমার পিছনে ছায়ার মতো লেগে থাকতো। প্রত্যেকদিন আমার বাসায় এসে আমাকে নিয়ে যেত। আবার পৌঁছিয়ে দিয়ে বাসায় চলে যেত। পাছে সাইকেলের চাবি হারিয়ে ফেলি তাই সাইকেলের চাবি তার কাছে থাকতো। বন্ধের দিন আমার বাসায় ছুটে আসতো। আমরা বেড়াতে যেতাম তখন সাইকেলের চাবি এবং মানিব্যাগ তার কাছেই থাকতো। আমাকে বলতো ‘সহিদ ভাই আপনি একা কোথাও বের হবেন না। কিন্তু কোথাও যেতে হলে আপনাকে আমি নিয়ে যাব।’ এরপর আমার এমন অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল যে, তাকে ছাড়া কোথাও বের হতাম না। কোনকিছু কেনাকাটা করতে কিংবা রেস্টুরেন্টে গেলে চাবি এবং মানিব্যাগ থাকতো তার কাছে। সে ব্যাগ খুলে দাম পরিশোধ করতো। সাদি অত্যন্ত প্রিয় বন্ধু হয়েছিল। কুষ্টিয়া ছেড়ে আসার পর তার সাথে আর কোনদিন দেখা হয়নি। এসব জীবনজড়িত মধুর স্মৃতি মনে পড়লে মনটা হাহাকার করে ওঠে। এসব স্মৃতি কোনদিন ভোলা যায় না।
খোকনকে আমি সময় দিতে পারছি না। তাই দু’তিন দিন পর খোকন বলল, ‘তুই তো সময় দিতে পারছ না। একা একা বসে কী করব বরং চলে যাই’। খোকন চলে গেল। কিছুদিন পর বরিশাল থেকে আমার নামে একটা চিঠি আসলো। তখন আমার যে কী অবস্থা! মনে হলো আকাশের চাঁদ হাতে পেয়ে গেছি। ভাবছিলাম মঞ্জুর চিঠি। কিন্তু দেখি হাতের লেখা বগের ঠ্যাং। চিঠি খুলে দেখি আমার মিলের কর্মচারী একটা চিঠি দিয়েছে।
১৯৭৯ সন। অনির্দিষ্টকালের জন্য ধর্মঘট। চলে আসলাম বরিশালে। বিজয় দা’র বাসায় হাজির। সে বলল, ‘সহিদ ভাই আপনার জন্য এক বড় সুখবর। জানি না এই সুখবরটা আপনি কীভাবে নিবেন। আমি জানি আপনি বেশ বুদ্ধিমান। আশা করি এটা সুসংবাদ হিসেবেই নিবেন।’ জানতে চাইলাম, ‘বিজয় দা সুখবরটা কী আগে বলেন না?’ সে বলল, ‘হ্যাঁ বলছি। মেয়েটি মানে মঞ্জু আপনার চিঠি তার বাবার হাতে দিয়েছে। এখন আপনার প্রতিক্রিয়া কী?’ উত্তরে বললাম, ‘বিজয় দা, এখন আমার মনে হয়Ñ আমি এক জীবন-মরণ সমস্যা থেকে রক্ষা পেয়েছি। সংবাদটা শুনে এক মুহূর্তেই তার প্রতি মায়ামমতা ভালোবাসা, মোহ এক অজান আঘাতে ধ্বংস হয়ে গেছে। আমি এখন পুরোপুরি সুস্থ একটা মানুষ। এখন তার প্রতি কোন ফিলিংস নাই। ঘৃণাও নাই।’
-সহিদ ভাই আমি জীবনে কারও কোন উপকার করতে পরিনি। সামর্থ্যও নেই। তবে জীবনে এই প্রথম কাউকে সামান্যতম উপকার করতে পেরেছি। বিশ্বাস করুন আপনার অবস্থা কিন্তু খুব সিরিয়াস ছিল।
-না বিজয় দা, এটা সমান্য উপকার নয়। আমার জীবন চলার পথে একটা বিরাট উপকার।
-আমি আপনাকে পূর্বে বলিনি। বললে কোন কাজ হতো না। তাই বলিনি। মেয়েটার বাসা আমার বাসার কাছে। তাকে অনেক আগে থেকেই চিনি। মেয়েটা কিন্তু ভালো নয়। আমি এর বেশি আর বলতে চাই না। আপনার মতো একজন মানুষের ভালোবাসার চিঠি পেয়ে প্রত্যাখ্যান করতে পারে এমন মেয়ে এলাকায় নেই। যে মেয়ের সমাজে কোন পরিচয় নেই সে আপনার ভালবাসা গ্রহণ করলো না ভাবতেও অবাক লাগে। তবে আমি মনে করি ভগবান আপনার সহায়। মেয়েটার হৃদয় পাথর দিয়ে তৈরি।
-যাইহোক না কেন, বিজয় দা আামি কিন্তু মেয়েটার কাছে কৃতজ্ঞ। ইচ্ছা করলে নাকে দড়ি সে ইচ্ছামত ঘুরাতে পারতো। জিম্মি করে রাখতে পারতো। পাগল বানাতে পারত। বড় বাঁচা বেঁচে গেছি। এসব কথা মনে পড়লে আজও মনে প্রশ্ন জাগে। কেন একটা আজেবাজে মেয়ের জন্য পাগলদশা হয়ে গিয়েছিলাম? আসলে প্রকৃতি থেকে বিপদ আসে আবার প্রকৃতিই মানুষের জীবন থেকে বিপদ কাটিয়ে নেয়।
এর দু’তিন দিন পর আনছার মিয়ার সাথে পথে দেখা। লজ্জায় আমার মাথা কাটা যাওয়ার মতো অবস্থা। আমাকে দেখে প্রশ্ন করল:
-কবে আসছ তুমি?
-দু’তিন দিন আগে।
-পড়াশুনা চলছে কেমন?
-ভাল।
আমায় একটু আড়ালে ডেকে নিয়ে বলল, তাকে ১০ টাকা দিতে পারি কিনা। চাইবামাত্র টাকা দিয়ে দিলাম। যে অন্যায় করেছি তা ১০ টাকা কেন আরও বেশি চাইলেও দিয়ে দিতাম। চিঠির কথা জানিয়ে দিল।
-তুমি একটা আকাম করছ সেটা তোমার দোষ নয়। তোমার মাস্তান বন্ধু খোকনের পাল্লায় পড়ে করছ। চিঠিটা আমি পড়েছি। তুমি তো খুব সুন্দর বাংলা লিখতে পার।
-না না আনছার ভাই কারও পরামর্শে নয়। আসলে আপনার মেয়েকে আমি ঠিক বোনের চোখে প্রথম দেখেছি। পরে মায়ামমতায় আমাকে সর্বনাশ ডেকে এনেছিল। আমার ঠিক দোষ নয় তবে আমাকে ক্ষমা করে দিবেন। আপনার মেয়েকে জানিয়ে দিবেন যে আমি আপনার কাছে এ অপরাধের জন্য ক্ষমা ভিক্ষা চেয়েছি।
এ ঘটনার ৬/৭ বছর পরে আমি ঢাকা পাবলিক হেলথ ইঞ্জিনিয়ারিং অফিসে চাকরি নেই। আনছার ভাই সপরিবারে ঢাকা চলে আসে। একদিন আনছার ভাই আমার অফিসে এসে হাজির।
-আমি শুনেছি তুমি চাকরি নিয়েছ। কিন্তু তুমি কোথায় বসো তা জানা ছিল না। মতিঝিল অফিসে গিয়ে জানতে পারলাম তোমার অফিস সেগুনবাগিচায়। তুমি কেমন আছ?
-হ্যাঁ বেশ ভালো আছি।
-মঞ্জুর তো বিয়ে হয়ে গেছে। আমি অত্যন্ত দুঃখিত তোমাকে বিয়ের কার্ড দিয়ে বিয়ের আমন্ত্রণ জানাতে পারিনি।
আনছার ভাই মাঝে মাঝে আমার অফিসে আসতো। চা-সিগারেট খেত। গল্পগুজব করতো। আমি না জানতে চাইলে আমাকে বলত যে, জামাই ইঞ্জিনিয়ার। একদিন বলত জামাই ডাক্তার। একদিন বোধহয় সিএসপিও বলেছিল। যারা ধূর্ত বা চতুর তাদের স্মরণশক্তি খুব ভালো থাকে, কিন্তু তার সেটা ছিল না। একদিন আমাকে জানাল তার জামাই এমিরিকা চলে গেছে। এসবের কিছুই আমার জানার আগ্রহ ছিল না। কারণ সে মিথ্যা কথা বলে। সত্য কথা খুব কম বলে। তবে তার মেয়ের বিয়ে হয়েছিল সে কথা সত্য। এর ছয় মাস পর একদিন অফিসে এসে আমার সামনে বসল। মুখ মলিন। খুব চিন্তাগ্রস্ত।
-সহিদ আমি খুব ভয়ানক বিপদে পড়েছি।
-কেন কী হয়েছে?
-আমি কয়েক মাসের বাড়িভাড়া দিতে না পারায় কিছু গুন্ডাপন্ডা এসে বাসার সব আসবাবপত্র বাইরে ফেলে দিয়ে আমাদের সবাইকে বের করে দিয়েছে। আমার স্ত্রী এবং মেয়েকে গাছতলায় বসায়ে রেখে তোমার কাছে চলে এসেছি। আমাকে কিছু টাকা দাও।
টাকা দেয়ার পর বলল, ‘তুমি আমার সাথে চল’।
-আনছার ভাই আমি যাব না।
-শোন এই বিপদের সময় আমার সাথে একটু চল।
-আনছার ভাই আমায় ক্ষমা করে দিন। আমি যাব না। আপনার স্ত্রী এবং মেয়েকে আমার মুখ দেখাতে পারবো না। আমি খুব লজ্জা পাব।
-শোন তারা এখন খুব অসহায়। খুব ভেঙ্গে পড়েছে। তোমাকে দেখলে হয়ত একটু সাহস পাবে। ভারসাম্য ফিরে পাবে। বুঝবে যে, আমারও দু-একজন লোক আছে।
অবশেষে না যেয়ে পারলাম না। যাওয়ার পর ওদের খুঁজে পেলাম না। আনছার ভাই বলল, ‘আমি এই গাছটার নিচে বসায়ে তোমার কাছে ছুটে গিয়েছিলাম। তারা এখন কোথায় গেল’?
আমরা তখন চারদিকে তাকাই। একটু সামনে গিয়ে আবার পিছনে ফিরছি এমন সময় এক ভদ্রলোক আমাদেরকে জিজ্ঞাসা করলেন কাউকে খুঁজছি কিনা। বক্তব্য শুনে তিনি বললেন, গাছতলায় বসে থাকতে দেখে তাদের বাসায় নিয়ে এসেছি। ভদ্রলোক আমাদের চা-নাস্তা দিয়ে আপ্যায়ন করলেন। চলে আসার সময় বললাম, ‘আনছার ভাই কোন চিন্তা করবেন না দু-একদিন পরে অফিসে আসবেন।’ একটু উঁচু গলায় বললাম, যেন তারা শুনতে পায় এবং ভরসা পায়।
এর কয়েক বছর পর আমি ইরান থেকে ফিরে এসে বিয়ে করলাম। আনছার মিয়ার সাথে আবার দেখা। তখন আমাকে বলল, ‘সহিদ তুমি তো বিয়ে করছ, আমি তোমার সব খবর রাখি। জাসদের সাথে তোমার ভাল যোগাযোগ। ‘জাসদ’ অর্থাৎ আমার স্ত্রীর বড় ভাই জাসদের নেতা। রাজনীতি করে। বহু বছর জেল খেটেছিলেন।’

৩৩ বছর পূর্বের সেই দুঃখজনক ঘটনা। এখন জানিনা তারা কোথায় ও কেমন আছে। তবে এখনও তাদের কথা মনে পড়ে।
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

নেতানিয়াহুও গনহত্যার দায়ে ঘৃণিত নায়ক হিসাবেই ইতিহাসে স্থান করে নিবে

লিখেছেন ঢাকার লোক, ০৭ ই মে, ২০২৪ রাত ১২:৩৮

গত উইকেন্ডে খোদ ইজরাইলে হাজার হাজার ইজরাইলি জনতা নেতানিয়াহুর সরকারের পদত্যাগের দাবিতে বিক্ষোভ করেছে।
দেখুন, https://www.youtube.com/shorts/HlFc6IxFeRA
ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ করার উদ্দেশ্যে নেতানিয়াহুর এই হত্যাযজ্ঞ ইজরায়েলকে কতটা নিরাপদ করবে জনসাধারণ আজ সন্দিহান। বরং এতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

খুন হয়ে বসে আছি সেই কবে

লিখেছেন জিএম হারুন -অর -রশিদ, ০৭ ই মে, ২০২৪ রাত ২:৩১


আশেপাশের কেউই টের পাইনি
খুন হয়ে বসে আছি সেই কবে ।

প্রথমবার যখন খুন হলাম
সেই কি কষ্ট!
সেই কষ্ট একবারের জন্যও ভুলতে পারিনি এখনো।

ছয় বছর বয়সে মহল্লায় চড়ুইভাতি খেলতে গিয়ে প্রায় দ্বিগুন... ...বাকিটুকু পড়ুন

জাম গাছ (জামুন কা পেড়)

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ০৭ ই মে, ২০২৪ সকাল ৯:০৩

মূল: কৃষণ চন্দর
অনুবাদ: কাজী সায়েমুজ্জামান

গত রাতে ভয়াবহ ঝড় হয়েছে। সেই ঝড়ে সচিবালয়ের লনে একটি জাম গাছ পড়ে গেছে। সকালে মালী দেখলো এক লোক গাছের নিচে চাপা পড়ে আছে।

... ...বাকিটুকু পড়ুন

অনির্বাণ শিখা

লিখেছেন নীলসাধু, ০৭ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩১



রাত ন’টার মত বাজে। আমি কি যেন লিখছি হঠাৎ আমার মেজো মেয়ে ছুটতে ছুটতে এসে বলল, বাবা একজন খুব বিখ্যাত মানুষ তোমাকে টেলিফোন করেছেন।

আমি দেখলাম আমার মেয়ের মুখ উত্তেজনায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

=ইয়াম্মি খুব টেস্ট=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৭ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:১৪



©কাজী ফাতেমা ছবি
সবুজ আমের কুচি কুচি
কাঁচা লংকা সাথে
ঝালে ঝুলে, সাথে চিনি
কচলে নরম হাতে....

মিষ্টি ঝালের সংমিশ্রনে
ভর্তা কি কয় তারে!
খেলে পরে একবার, খেতে
ইচ্ছে বারে বারে।

ভর্তার আস্বাদ লাগলো জিভে
ইয়াম্মি খুব টেস্ট
গ্রীষ্মের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×