আগে একটা সময় ছিল যখন ঘুমানোর সময় আমাদের মাথার কাছে স্মার্টফোন চার্জে থাকত না । সাদা-কালো টিভি ছিল । ডিশের লাইন ছিল না । একটা চ্যানেল দেখেই সারাদিন পার করে দিতে হত । ফেসবুক ছিল না । হাই কনফিগারেশনের গেমিং পিসি ছিল না । তাহলে তখনকার ছেলেমেয়েরা কিভাবে সময় পার করত?
এখন এগুলো সব আছে। একটু চিন্তা করে দেখেন তো? উপরে যে জিনিসগুলোর কথা বললাম তা থেকে আপনাকে যদি এক মাসের জন্য বঞ্চিত করা হয় তাহলে আপনার কেমন লাগবে? আচ্ছা, এক মাস বাদ দিলাম । এক সপ্তাহের কথাই ধরেন । কেউ বলবে জীবন তেজপাতা হয়ে গেছে । একটা সেলফি আপলোড দিতে পারল না সেই দুঃখে অনেকে হা-হুতাশ করবে । ক্লাশ অফ ক্লান্সে এক সপ্তাহ এটাক দেওয়া হবে না এই চিন্তা করেই তো কারো অজ্ঞান হওয়ার মত অবস্থা হবে । তাহলে আগের জেনারেশনের ছেলেমেয়েরা কি করত? তাদের জীবনও কি তেজপাতা ছিল?
দেশ ডিজিটাল হচ্ছে । মানুষ স্মার্ট হচ্ছে । কিন্তু একটা অভ্যাস ধীরে ধীরে আমাদের মধ্য থেকে হারিয়ে যাচ্ছে । বই পড়ার অভ্যাস । এখন আর কেউ শখের বশে গল্পের বই নিয়ে বসে না । কারণ অবসর সময় কাটানোর হাজার হাজার মাধ্যম আমাদের কাছে চলে এসেছে । একটা বই নিয়ে বসলে এসব উপভোগ করার সময় কোথায়? প্রযুক্তি আমাদের মাথায় জেঁকে বসেছে । এর থেকে মুক্তি নিয়ে বই পড়তে বসবে কখন? ক্লাস ফাইভে থাকতে যে ছেলেটা এক রাতে তিন গোয়েন্দার একটা ভলিউম শেষ করত, এখন সে দিনের পর দিন, রাতের পর রাত ক্লাশ অফ ক্লান্স নিয়ে পড়ে থাকে । যে ছোট্ট মেয়েটি বাবা-মায়ের ভয়ে পাঠ্যবইয়ের মধ্যে গল্পের বই নিয়ে লুকিয়ে পড়্ত সে এখন এলাকার ক্রাশ । ছেলেদের হৃদয় হরণ করার জন্য তার নিয়মিত সাঁজগোজ করে ফেসবুক ইন্সটাগ্রামে পিক আপলোড দিতে হয় । বয়ফ্রেন্ডের সাথে মাঝরাতে চ্যাট করতে হয় । ফোনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলতে হয় । এত এত কাজের মাঝে বই পড়ার সময় কই?
দিন যত যাচ্ছে বই থেকে আমরা তত নিজেদের দূরে সরিয়ে নিচ্ছি । নিজের কথাই বলি । আগে একটা উপন্যাস ধরলে তা এক-দুই দিনে শেষ হয়ে যেত। আর এখন এক মাসেও শেষ হয় না ।
একদিন আমার এক বন্ধু বাসায় বেড়াতে আসে । রুমে বিছানার উপর জেনিফার নিভেনের অল দ্য ব্রাইট প্লেসেস বইটা রাখা ছিল । সে বইটা কিছুক্ষণ নেড়েচেড়ে জিজ্ঞেস করে যে এসব ছাইপাস পড়ে কি লাভ? খালি খালি সময় নষ্ট। তার প্রশ্ন শুনে তৎক্ষণাৎ আমার মাথায় ভাল কোনো উত্তর আসে নাই । শুধু বলেছিলাম যে সবকিছুতে লাভ-ক্ষতির হিসাব করলে জীবনে কারো উপকারে আসা যায় না ।
ড. মোহাম্মদ জাফর ইকবাল বলেছেন, "একটা বাচ্চার হাতে বই ধরিয়ে দিতে পারলে তার ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করা লাগে না ।" বই পড়ে কি লাভ তা কেবল একজন বই পড়ুয়াই বুঝতে পারবে । যে জীবনে একটা উপন্যাসও পড়ে নাই তাকে ব্যাপারটা সহজে বোঝানো যায় না।
একেকটা বই হল একেকটা জগৎ। সেই জগতে বাস করে বিচিত্র সব চরিত্র । বই পড়লে এসব বিচিত্র জগতে বিচিত্র চরিত্রগুলোর জীবনের সাথে মিশে যাওয়া যায় । তাদের সুখ-দুঃখ, আবেগ, চিন্তা-চেতনার অংশীদার হওয়া যায় । তাদের জীবনের শিক্ষা থেকে শিক্ষা নেওয়া যায় । যারা নিয়মিত বই পড়ে তাদের মধ্যে ম্যাচুরিটি অনেক দ্রুত আসে । আর একটা ভাল বইয়ের শেষ পৃষ্ঠা উল্টানোর পর মনে যে প্রশান্তি আসে তা জগতের আর অন্য কোনো কিছুর সাথে তুলনা করা যায় না ।
আমাদের নিজেদের মধ্যে যে কেবল বই পড়ার উৎসাহ কমে গেছে তাই না । আমরা আমাদের পরবর্তী জেনারেশনকেও উৎসাহিত করছি না । এখন বাবা-মা দুজনই চাকরি করে । বাড়ির ছোট বাচ্চাটি কোনো হুলস্থুল করলে তার হাতে স্মার্টফোন ধরিয়ে দেওয়া হয় । সে সারাদিন তাতে গেম খেলে । কিংবা কার্টুনের চ্যানেল ছেড়ে দেওয়া হয় । যাতে দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা কার্টুন দেখে বাচ্চারা সময় কাটিয়ে দেয় । আগের মত মা তাদের ছবিওয়ালা বই দেখিয়ে দেখিয়ে ‘অ তে অজগর’ শেখানো হয় না। কারণ এখন বাচ্চাদের পড়ালেখা শেখানোর জন্য অহরহ প্রোগ্রাম টিভি আর ইন্টারনেটে পাওয়া যায় । যে জিনিস বাবা-মার কাছে শেখার কথা তা তারা কার্টুনের কাছে শেখে । হিন্দি ডাবিংয়ের কার্টুন দেখে দেখে বাংলা ঠিক মত বলার আগেই গড় গড় করে হিন্দি বলা শিখে যায় । টকিং জিঞ্জারে এদের পাজল মিলানো দেখে প্রতিবেশীরা অবাক হয়ে বলে, “ বাহ! ভাবী, আপনার বাচ্চা তো দারুণ স্মার্ট ।“ কিন্তু আমরা এটা বুঝি না যে এতে তাদের কত বড় ক্ষতি হচ্ছে । আমাদের সময় স্মার্টফোন ছিল না । এতগুলো কার্টুন চ্যানেল ছিল না । তখন আমরা বইয়ের পাতায় কার্টুনের ছবি দেখে লাফিয়ে উঠতাম । বাজার থেকে আমাদের কার্টুনের ছবি ওয়ালা গল্পের বই কিনে দেওয়া হত । আর এর থেকেই জন্ম হত একজন ক্ষুদে পাঠকের ।
এখনকার তরুণ সমাজ বই পড়ে না । তারা ব্যস্ত । তাদের ঘাড় এখন কুঁজো হয়ে যাচ্ছে । রাস্তায় হাটতে হাটতে তারা স্মাড়টফোন চালায় । আশেপাশে কি হচ্ছে কিছুর দিকে খেয়াল নেই । সন্ধ্যার সূর্যাস্ত দেখার জন্য তারা ছাদে যায় না । আকাশ মেঘলা হলে তারা আনন্দিত হয় না । সমুদ্র সৈকতে বেড়াতে গেলে তারা চোখ বন্ধ করে বাতাসের শোঁ শোঁ আওয়াজ আর সমুদ্রের ঢেউয়ের কল্লোলের অদ্ভুত সংমিশ্রণে অভিভূত হয় না । তাদের মাথায় থাকে সেলফি স্টীক দিয়ে কিভাবে সবচেয়ে সুন্দর ছবি তুলে আগে সোশ্যাল মিডিয়ায় আপলোড দেওয়া যায় । সত্যিকারের সৌন্দর্য উপভোগ না করেই তারা স্ট্যাটাস দেয় feeling awesome ।
এভাবেই প্রযুক্তি আস্তে আস্তে আমাদের অনুভূতি নষ্ট করে দিচ্ছে । এসব আধুনিক যন্ত্রপাতির নিরন্তর ব্যবহার আমাদেরকেই যন্ত্রে পরিণত করছে । যেগুলোকে আমরা শখ ভেবে ভুল করি সেগুলোই আমাদের অবসেশনে পরিণত হচ্ছে । ফোনের পাঁচ ইঞ্চির পর্দায় জীবন আটকে গেছে । দিন-রাত চ্যাটিং চলছে । অনলাইন গেমিং চলছে । মাঝরাতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফোনে প্রেম চলছে । ঐদিকে বহুদিন আগে পড়ব বলে কিনা বইগুলো শেল্ফেই পড়ে আছে । এগুলোতে ধুলো পড়ছে, ভিতরে তেলাপোকা বাসা তৈরী করে সুখের সংসার পাতিয়েছে । কেউ খেয়াল করছে না ।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই এপ্রিল, ২০১৭ রাত ১০:০০

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



