আমাদের মধ্যে এমন অনেকেই আছেন যারা অনেক ছোটবেলা থেকে বিভিন্ন ধরণের বাংলা গল্পের বই, উপন্যাস, কবিতা সংকলন পড়ে আসছেন। অনেকে আছেন যারা সেই রবীন্দ্র যুগে এবং তার সমসাময়িক সময়ে রচিত বাংলা বই থেকে শুরু করে আধুনিক বাংলা কথাসাহিত্যিক আর লেখকদের বাংলা বইও পড়ে আসছেন। পশ্চিমা বিশ্বের বিখ্যাত লেখকদের লেখা বইগুলোর বাংলা অনুবাদও এনারা বাদ রাখেন না। পাঠক হিসেবে তাদের বই ক্ষুদা যথেষ্ট মিটলেও সেই ক্ষুদার ষোলকলা পূর্ণ হয় না। শুধু ইংরেজিতে লেখা বই পড়তে অনীহা কিংবা পড়ে বুঝতে না পারার ভয়ের কারণেই অনুবাদ না হওয়া অনেক বই এই পাঠকেরা পড়তে পারেন না।
সাধারণত আমাদের দেশে বেস্টসেলিং, বিখ্যাত লেখকদের ভলিউম ভিত্তিক গল্পের বই, বায়োগ্রাফি ব্যতিত খুব একটা অনুবাদ করা হয় না। যা অনুবাদ করা হয় তার সবগুলো একেবারে মানসম্মতও হয় না। আবার এমন অনেক বিখ্যাত ও অসাধারণ বই রয়েছে যার বঙ্গানুবাদ করা হয়নি। কাজেই নিয়মিত পাঠকদের কাছে বইয়ের জগতের এক বিরাট অংশ অধরাই থেকে যায়।
মূলত এসব ইংরেজিতে লেখা উপন্যাস, ননফিকশন বা অন্য জনরার বইগুলো না পড়তে পারার অন্যতম কারণ হলো অনীহা এবং না বুঝতে পারার ভয়। প্রথমেই কথা বলি অনীহা নিয়ে।
ইংরেজিতে লেখা বইগুলো পড়তে স্বাভাবিকভাবেই আমাদের বেশি সময় লাগবে। মাতৃভাষা না হওয়ায় সমপরিমাণ সাইজের একটা বাংলা উপন্যাস পড়তে যত সময় লাগবে তার থেকে একটা আমেরিকান বা ব্রিটিশ উপন্যাস পড়তে তিন থেকে চারগুণ বেশি সময় লাগার কথা। আর একটা কারণ হলো প্রথম থেকেই বড় বড় থ্রিলার বা সায়েন্স ফিকশন টাইপের বই দিয়ে পড়া শুরু করা। উদাহরণ হিসেবে বলি ড্যান ব্রাউনের দ্য ভিঞ্চি সিরিজের কথা। ক্রাইম, মিস্ট্রি থ্রিলার জনরার কাহিনী একটু ঘোরানো প্যাচানো, যার বাংলা অনুবাদ পড়তেই অনেকের নড়েচড়ে বসা লাগে। সেক্ষেত্রে প্রথম ইংরেজি উপন্যাস পাঠ হিসেবে এই জনরার বই গুলো আদর্শ নয়। আর এ ধরণের লেখা দিয়ে শুরু করে না বুঝতে পারলে আত্মবিশ্বাস নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। তাই শুরুতেই কাহিনীর মারপ্যাচ সমেত বইগুলো দিয়ে ইংরেজি বই শুরু না করে একটু হালকা ধাচের বই দিয়ে যাত্রা শুরু করাই ভালো।
দ্বিতীয় যে সমস্যাটা আছে তা হলো ইংরেজিকে ভয় পাওয়া। ইংরেজি বই পড়তে গেলেই যে ইংরেজিতে অনেক দক্ষ হতে হবে এমন কোনো কথা নেই। তবে কিছুটা দক্ষ হলে ভালো হয়। বই পড়তে বসে এক পেজ পড়তে পড়তে চৌদ্দবার ডিকশোনারিতে শব্দার্থ খোঁজা আসলেই একটা বিরক্তির ব্যাপার ; হোক তা স্মার্টফোনের ডিকশোনারি অ্যাপ। শব্দ চেক করতে করতে কতবার ফেসবুকে ঢুকে বই পড়ার আগ্রহকে মেরে ফেলা হবে তা আর বলার প্রয়োজন নেই। আর এভাবে বেশিক্ষণ মনোযোগও ধরে রাখা কষ্টকর।
প্রথমেই ইংরেজি উপন্যাস পড়তে বসার অনীহা দূর করতে গেলে যা করতে হবে তা বলা যাক। একেবারে শুরুতেই পৃথিবী বিখ্যাত লেখকদের বেস্টসেলিং বই দিয়েই শুরু করা উচিত নয়। সব থেকে সহজ যেটা করা যায় তা হলো ইন্ডিয়ান ঔপন্যাসিক রচিত ইংরেজি উপন্যাসগুলো দিয়ে পড়া শুরু করা। ইন্ডিয়ান রাইটারদের ইংরেজি উপন্যাসে ব্যাকরণের প্যাচ কম থাকে। কাহিনী উপমহাদেশভিত্তিক বলে সকল ঘটনার সাথে নিজেকে মানিয়ে নেওয়া যায় আর জটিল শব্দের ব্যবহারও অনেক কম। আমার নিজের পড়া প্রথম ইংরেজি উপন্যাসও একজন ইন্ডিয়ান লেখকের লেখা। এটি ছিল চেতন ভগতের রিভোলিউশন ২০২০। রোমান্টিক জনরার একটা হালকা ধাচের বই ছিল, যেটা পড়তে প্রথমবার হিসেবে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি। এরপর আমি একই লেখকের আরো কিছু বই পড়ি। এছাড়াও অন্যান্য নামকরা ইন্ডিয়ান লেখক যেমন সালমান রাশিদি, অরুন্ধতি রায়ের বইগুলোও আস্তে আস্তে পড়া হয়। এভাবে একসময় সহজ হয়ে আসলে ইংরেজ কিংবা আমেরিকান লেখকদের বইগুলোতে হাত দেওয়া যায়। খুব জটিল কোনো জনরার দিকে না যেয়ে রোম্যন্স, ইয়াং এডাল্ট, নন ফিকশন কিংবা বায়োগ্রাফি বই দিয়ে শুরু করা উচিত। উল্লেখযোগ্য হিসেবে জন গ্রিন, জেনিফার নিভেন এদের বইগুলো পড়া যায়। এভাবে আস্তে আস্তে অভ্যস্ত হতে পারলে একটু কঠিন জনরার বই ধরতেও অসুবিধা হবে না।
একটা ব্যাপার মাথায় আসতে পারে যে আমরা বই পড়তে বসলে তো অনেক অজানা ইংরেজি শব্দের মুখোমুখি হই। এ কথাটা আগেই বলেছি। এতো ইংরেজি শব্দ বারবার ডিকশোনারিতে খুঁজে পড়া সম্ভব না। তাহলে কি করা যেতে পারে?
একটা বিষয় চিন্তা করে দেখুন। আমরা সকলেই কম বেশি হলিউডের সিনেমা দেখি। দেখার সময় সিনেমার সাথে সাবটাইটেল ব্যবহার করতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। এই সিনেমাগুলো দেখার সময় কিন্তু আমরা হাতে ডিকশোনারি নিয়ে বসি না প্রত্যেকটা শব্দের অর্থ জানার জন্য। তাহলে সিনেমা দেখার মজাই থাকবে না। আমরা পরিবেশ দেখেই সকল কথার আর প্লটের অর্থ পুরোপুরি না হলেও কিছুটা আঁচ করতে পারি। উপন্যাসের ক্ষেত্রেও অনেকটা একই রকম। সব শব্দের অর্থ না বুঝে পারিপার্শ্বিক অবস্থা দেখেই ঘটনা আঁচ করা যায়। আর একই নতুন শব্দের পুনরাবৃত্তি থেকেই তার অর্থ বুঝে নেওয়া যায়। আমরা কিন্তু আসলে এভাবেই বেশির ভাগ ইংরেজি শব্দ শিখে আসছি। কাজেই একান্ত প্রয়োজন না হলে শব্দের অর্থ খুঁজে বের করার দরকার নেই। তবে কেউ যদি নিজের ভোকাবুলারি শক্ত করার জন্য পড়তে বসেন তবে তাদের ক্ষেত্রে ব্যাপার ভিন্ন।
এভাবে ইংরেজি উপন্যাস পড়া শুরু করলে ইংরেজিতে দক্ষতা যেমন বাড়বে, তেমনি অনেক ভালো ভালো বই পড়ার অভিজ্ঞতাও হবে। সকল বইয়ের বাংলা অনুবাদ ভালো হয় না। আমার নিজের কাছে ব্যক্তিগতভাবে শার্লোক হোমস সিরিজ আর জুল ভার্ন রচনাসমগ্রের বাংলা অনুবাদ মোটেই ভালো লাগে নাই। তাই এভাবে ইংরেজিতে লেখা বই পড়ার অভ্যাস করতে পারলে পাঠক হিসেবে এক বিরাট দরজা আমাদের সামনে খুলে যাবে। আর বই পড়ার আনন্দও অনেক বেড়ে যাবে।