৩য় পর্ব
(৪)
বেশ অস্বস্তিকর পরিবেশ, স্নেহলতা একটানা কেঁদেই চলেছে, অচিরেই কামরুন্নাহারের চোখও আদ্র হয়ে এলো ,সে বুঝতে পারছে না কী আলাপ করবে বা কী কথা বলবে। আসলে সে নিজেই তো জানে না, সে কেন এখানে এসেছে।
পলাশ তাকে নিয়ে কেন যে এ-ই দুঃখী, রোগে শোকে জীর্ণ মেয়েটির সাথে দেখা করতে এসেছে, সেটাও তার কাছে একটা রহস্য । তিনি প্রথমে অবশ্য ,প্রেম সংক্রান্ত কোন ব্যপার ভেবেছিলেন। কিন্তু এখন সে সব কিছু মনে হচ্ছে না।
আহারে কার না কার মেয়ে। কত কষ্ট পাচ্ছে, এ বাসার ভদ্রমহিলাটি ওর মা। তবে তার ব্যবহারটা অস্বাভাবিক। মেয়েটির সঠিক চিকিৎসা হচ্ছে না বোঝাই যাচ্ছে,চারিপাশে প্রকট আকারে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সীমাহীন দারিদ্র্যের চিহ্ন। আর পলাশই বা হঠাৎ কোথায় গেল? বেশ কিছুটা সময় পরে কামরুন্নাহার বললেন,
-তোমার কী খুব কষ্ট হচ্ছে ? খারাপ লাগছে?
স্নেহলতা মাথা নাড়ালো,
-তুমি কিছু বলতে চাইলে বলতে পারো।আমি শুনছি।
-না ঠিক আছে। আপনি বসে থাকুন আমার পাশে, তাতেই আমার ভালো লাগবে।এটুকুই বা কে করে।
স্নেহলতা জোরে জোরে শ্বাস নিলো।
- ওই ভদ্র মহিলা কে হন তোমার?
- আমার মা মণি।
-নিজের মা?
স্নেহলতা অবাক চোখে চাইলো। সে আহত হলো কিনা বোঝা গেল না।
- বাসায় আর কেউ থাকে না?
- না। মা মণি আর আমিই থাকি।
-ও,তাহলে তো দেখা শোনার লোকের সমস্যা।
স্নেহলতা অনেক কষ্ট করে বলল,
- আমি কি আপনার হাতটা একটু ধরতে পারি? কামরুন্নাহার নিজের হাতটা বাড়িয়ে দিলেন।
এরপর আবার বিরতি অনেকক্ষণ আর কোন কথা নেই, দুজনে হাতে হাত দিয়ে বসে থাকলো চুপচাপ । কামরুন্নাহারেরও খুব ভালো লাগছে মেয়েটির হাতের স্পর্শ।
এদিকে কিছুক্ষণ পরে স্নেহলতার মা মণি এঘরে এসে এসে কটমটিয়ে বলে উঠলো,
- আপনি ওর হাত ছেড়ে বসুন। একটু সরে বসুন। রোগী মানুষ বোঝেন না?
স্নেহলতার মা মণির ব্যবহার অদ্ভুত লাগছে কামরুন্নাহারের কাছে। তিনি কামরুন্নাহারকে পছন্দ করছেন না তা বোঝাই যাচ্ছে। কামরুন্নাহার সরে এলেন,
আরো কিছুটা বাদে স্নেহলতার মা মণি ক'খানা বিস্কুট দিয়ে গেলো,বিস্কুট দেওয়ার সময়ও সে বেশ অদ্ভুতভাবে তাকাচ্ছিল। সে এই অতিথিদের যে একেবারেই পছন্দ করেনি তা তার হাবভাবে বুঝিয়ে দিচ্ছিলো বারংবার।
চারদিকে প্রবল দারিদ্র্যের চিহ্ন , ঘরখানাও জীর্ণ তবে বেশ পরিপাটি ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। ভদ্রমহিলা ব্যবহারে রুক্ষ হলেও কাজে যে তিনি পটু তা বোঝা যাচ্ছে। দেয়ালে একটা ছবি ঝুলছে একজন ভদ্রমহিলার সাথে কিশোরী কন্যা । আশ্চর্যজনক ভাবে ছবিটির কিশোরীর সাথে কামরুন্নাহারের চেহারার প্রচন্ড মিল। এটা কি করে সম্ভব?
মেয়েটি হাতের স্পর্শে কি কোন জাদু আছে? তার মনের মধ্যে শান্তি শান্তি লাগছিল। এই মেয়েটির সাথে তার কি কোন সম্পর্ক আছে? কিন্তু.....
মেয়েটি বেশ দূর্বল তা স্পর্শে বোঝা গেছে। সমস্যা হচ্ছে মেয়েটি নিজের কথা তেমন কিছুই বলছে না এড়িয়ে যাচ্ছে। কামরুন্নাহার এখনও জানেন না এই মেয়েটির সাথে সে কেন দেখা করতে এসেছে। পলাশকে এখনই কোন প্রশ্ন করা যাচ্ছে না।
পলাশ অনেক আগেই আসছি বলে উঠে গেছে এখনও তার কোন খোঁজ নেই।কোথায় গেছে কে জানে!
এবার কামরুন্নাহার বললেন,
- তুমি কি আমায় কিছু বলতে চাও মা? মানে দেখা করতে চেয়েছিলে।সেজন্য বলছিলাম।
স্নেহলতা মাথা ঝাঁকালো।
-হ্যাঁ বলতে চাই।
-বলো,তোমার কি বলার আছে?
-আমি কি আপনাকে মা বলে ডাকতে পারি?
কামরুন্নাহার অবাক হলেন।
- মা! ডাকবে? কেন?
তারপর কী ভেবে বললেন,
-আচ্ছা ডাকো।
কামরুন্নাহারের বিয়ে হয়নি আজ অবধি ।মা হওয়া তো দুরের কথা তবে মা ডাক শোনার আকাঙ্খা তার মনে চির জাগরূক প্রতিটি নারীর মত।
এখন কামরুন্নাহারের কেন জানি মনে হচ্ছে মেয়েটি বুকে টেনে নিলে শান্তি লাগতো । সে জানে না কেন তার এই ভাবনার উদয় হচ্ছে, মনে হচ্ছে মেয়েটিকে সে অনেক দিন ধরে চেনে,কোথায় যেন দেখেছে। এমন মনে হচ্ছে কেন তার? এটুকু সময়ের মধ্যে কি কারো প্রতি এতোটা মায়া পড়া সম্ভব?
ছবির ওই মহিলাকেও তার চেনা চেনা মনে হচ্ছে। কেন এমন মনে হচ্ছে?
নানান কথা ভাবতে ভাবতে নিজের অজান্তে স্নেহলতাকে তিনি বুকে জড়িয়ে নিলেন। চোখ মুছিয়ে দিলেন, পরম মমতায় পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন, ওর সান্নিধ্যে তার নিজের মন প্রাণ জুড়িয়ে যাচ্ছে অজানা কোন কারণে। আহ!
কী যে ভালোলাগা ছুঁয়ে যাচ্ছে, এমন মনে হচ্ছে কেন তার?
চলবে
© রফিকুল ইসলাম ইসিয়াক
ছবিঃ গুগোল
ফুটনোটঃ পরভৃত ১. /বিশেষণ পদ/ পরপুষ্ট, পরের দ্বারা প্রতিপালিত। ২. /বিশেষ্য পদ/ পরের দ্বারা প্রতিপালিত এইজন্য. কোকিল। /পর+ভৃত/। /বিশেষণ পদ/ স্ত্রীলিঙ্গ. পরভৃতা।
গল্পটি সাত পর্বে সমাপ্ত। আশা করি সবাইকে পাশে পাবো। শুভকামনা।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে জানুয়ারি, ২০২৩ সন্ধ্যা ৭:০৮