গতকাল শরীরটা ভালো ছিলো না। তার জেরেই সম্ভবত ঘুম থেকে উঠতে বেশ বেলা হয়ে গেল। ঘুম ভাঙলেই আমি প্রথমে মোবাইল চেক করে দেখি কোন জরুরী কল এসেছিল কিনা। আজ মোবাইল অন করতেই দেখি সুলতার সাতটা মিসকল। আসলে সে কল দিয়েছিল আমার সাড়া না পেয়ে মিস কল হিসাবে দেখাচ্ছে কলগুলো। আমি ওয়াশ রুম থেকে ফিরে কল ব্যাক করলাম।
-হ্যালো,সুলতা?
-ভাইয়া তুই কি সত্যি বিয়েতে আসবি না?
-আমার আসাটা কি খুব জরুরী?
-তুই এত অবুঝ কেন? কাল কত করে বললাম।
- তোরা কত বড়লোক। তোদের কোন অনুষ্ঠানে গেলে আমার কেমন যেন অস্বস্তি হয়। ভালো লাগে না।
- এসব তোর হীনমন্যতা। তোকে কেউ কিছু কি বলেছে কোনদিন? বল?
মনে মনে একটু হাসলাম।বোনটা অবুঝ !কি করে যে বোঝাই। দাওয়াতটা আমার বোন দিচ্ছে। সেই দাওয়াতে কি করে যাই। একবার আমার বোনের শ্বাশুড়ী বা বোনাই বললেও না হয় কথা ছিলো।হঠাৎ যদি তারা বলে বসে তুমি কার দাওয়াতে এলো? তখন তো মান সম্মানের ফালুদা হয়ে যাবে। যদিও সেটা আমার বোনের শ্বশুরবাড়ি তবুও বিয়ের এতগুলো বছর পরেও তারা আমাদের ব্যপারে ততটা আন্তরিক নয় সেটা তাদের হাবভাবে বোঝা যায়। বিশেষ করে বাবার মৃত্যুর পরে তাদের আচরণ চোখে পড়ার মত।
-কিরে কথা বলছিস না যে।
ভাবনার জগত থেকে ফিরে এসে আমি আর কথা না বাড়িয়ে বললাম,
- না মানে? লোক জনের ভীড় আমার ভালো লাগে না।অস্বস্তি হয়।
- তুই না এলে আমার সম্মান থাকবে ? লোকেরা জিজ্ঞেস করলে আমি কি উত্তর দেবো।বোনের সম্মানের দিকে একটু তাকাবি না। আর আমরা কি একেবারে এলেবেলে? কেন এসব আবোল তাবোল ভেবে নিজেকে ছোট করছিস?
- আচ্ছা দেখি। কথা দিতে পারছি না তবে চেষ্টা করবো নিশ্চয়।
- না ওসব দেখি টেখি বাদ। আসতেই হবে। না হলে তোর সাথে আমার সব সম্পর্ক শেষ। আর কোনদিন কথা বলবো না তোর সাথে প্রমিজ করছি। মা আর তুই ছাড়া আর কে আমার আছে, বল? সুলতা কাঁদতে লাগলো।
-আমি ভীষণ অস্বস্তিতে পড়লাম। এ মাসে যে টিউশনির যে টাকা পেয়েছি তাতে মায়ের ডাক্তার দেখাতে আর ওষুধ কিনতে ই বড় অংশ বেরিয়ে যাবে। কি যে করবো ভাবছি। এদিক সুলতার একমাত্র দেওরের বিয়ে বলে কথা। যে সে জিনিস কি সেখানে দেওয়া যাবে? অথচ আমাদের সেই দিন আর নেই। বাবা মারা যাবার পর পর যৌথ ব্যবসার সুত্র ধরে বড় চাচা কুটকৌশলে একে একে ব্যবসা সম্পত্তি সব নিজের আয়ত্ত্বে নিয়ে নিয়েছেন। বাবা তাকে খুব বেশি বিশ্বাস করেছিল বলে আজ আমাদের চড়া মূল্য দিতে হয়েছে। এসব ভেবে অবশ্য কোন লাভ নেই তাই আজকাল আর ভাবি না এসব নিয়ে। তবুও কখনও কখনও ভাবনারা নিজের অজান্তে জেকে বসে মাথার মধ্যে।
বোনের বড়লোক শ্বশুরবাড়ি বলে কথা। সেখানে বোনের একটা সম্মান আছে। সেটা দেখা ও আমার অবশ্য কর্তব্য এটা আমি জানি।
অনেক ভেবে অবশেষে একটা বুদ্ধি এলো মাথায়। কিছু রেয়ার কালেকশন বই ছিল বাবার আমলের । বিক্রি করার মধ্যে এখন এগুলো ই বাকি আছে । এন্টিক হিসাবে সংগ্রহকারীর সংখ্যা আজকাল নিতান্ত কম নয় । গত পাঁচ বছরে একে একে অন্যান্য জিনিস হাতছাড়া হয়েছে সব।যাহোক বইগুলো বিক্রি করবো বলে ফেসবুকের পুরাতন বই বেঁচাকেনা একটা গ্রুপে ছবি সহ বিজ্ঞাপন( পোস্ট) দিলাম।সময় যদিও কম। বিক্রি হলে ভালো না হলে জারিফের কাছ থেকে ধার নিতে হবে।জারিফ আমার ছোটবেলার বন্ধু ওর কাছ থেকে টাকা নেওয়ার বড় সুবিধা হলো ও টাকা ফেরত চেয়ে বিরক্ত করে না। সময় সুযোগ মত ফেরত দিলেই হলো্ তাতেই ও খুশি। আমিও জায়গাটা ঠিক রাখি যাতে বিপদের সময় হাত বাড়ালেই পাওয়া যায়। তবে এবারকার মত জারিফের দারস্থ হতে হলো না। বই বিক্রির বিজ্ঞাপনে বেশ ভালো সাড়া পাওয়া গেল।পেমেন্ট ও পেয়ে গেলাম দ্রুত।
জামা আর জুতো কিনলাম তাই দিয়ে। আর কিনলাম একটা জিন্সের প্যান্ট । দামি পোষাকে দামি মানুষ সেজে যেতে হবে বোনের সম্মান বলে কথা! যদিও এসব আমায় পোষায় না। তারা কত অবস্থা সম্পন্ন মানুষ। তাদের সম্মানের দিকটা আমরা না দেখলে কে দেখবে? আর বোন ই বা কি ভাববে। তার আত্নীয় স্বজন সহ হাজার শুভাকাঙ্খী সবাই আছে না? সবাই তো থাকবে অনুষ্ঠানে।
টিউশনির টাকা থেকে দুহাজার টাকা নিলাম সাথে আরো কিছু যোগ করে একটা উপহার কিনলাম। যদিও জিনিসটা ততটা ভালো হলো কিনা বুঝতে পারলাম না। তবে আকারে বেশ বড় আকৃতির হওয়াতে আমি সন্তুষ্ট হলাম। যখন তখন তো আর খুলে দেখবে না যে কি আছে
ভিতরে? যারা দেখবে সবাই ভাববে না জানি কত দামি জিনিস দিয়েছি । এই মুহুর্তে শেখ সাদির পোষাকের গুণে গল্পটার কথা মনে পড়ে গেল। ছোটবেলায় বাবার মুখে শুনেছি অনেকবার এখনও বেশ মনে আছে।
যাহোক নির্দিষ্ট দিনে বোনের বাসায় পৌঁছে দেখলাম লোকে লোকারণ্য আগেই জেনেছিলাম বরযাত্রী যাবে প্রায় তিনশত লোক ।আমি সরাসরি ভিতরের ঘরে চলে গেলাম। যাকে বলে অন্দর মহল। সেখানে দেখি আমার বোনের দেওর যে বর আর কি , সে চেঁচামেচি করছে। এত লোক গেলে তার মান সম্মান আজই চলে যাবে সে কিছুতেই তিন শত লোকের একটাও বেশি নেবে না। তার সাথে নাকি তেমনই কথা বার্তা। ইত্যাদি ইত্যাদি। প্রথমেই হোঁচট খেলাম । আমি সুলতাকে চারদিকে চোখ বুলিয়ে খুঁজতে লাগলাম।
হঠাৎ বোনের শ্বাশুড়ির আমার দিকে চোখ পড়ল । আমি সালাম দিলাম।তিনি সালামের উত্তর দিলেন কি না বুঝতে পারলাম না তবে
আমায় দেখে কিছুটা অন্য রকম সুরে বললেন,
- তুমি এসেছো?
- জ্বি আমি একাই।
- কে দিলো দাওয়াত?
- সুলতা ,কেন?
-কি? এই সুলতা এই সু--লতা....।
সুলতা দ্রুত চলে, এলো এদিকে আমি কিছুটা অপ্রস্তুত। বুঝতে পারছি না কি হচ্ছে। সুলতা কোথেকে দৌড়ে আসবার কারণে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল
-জ্বি মা,কি হয়েছে?
-তুমি আয়াতকে দাওয়াত দিয়েছো?
-হ্যাঁ ,মা।
-তোমার আক্কেল জ্ঞান আছে?
-কেন মা? কি ভুল করেছি?
-তোমাকে দাওয়াত দিতে বলেছি?
- মা ভেবেছিলাম আপনার মনে নেই তাই আমি নিজে থেকে আর আপনার ছেলেকে বলেছিলাম তো।
- তোমার কি কমন সেন্স কোনদিন ই হবে না।
- কি ভুল করলাম মা।
- সব তোমাকে শিখিয়ে দিতে হবে? সেদিন শুনলে না নতুন বৌয়ের মামা শ্বশুরের বাড়ি তোমার ভাই টিউশনি করে। পরিচয় দেওয়ার মত? যাবে পরিচয় দেওয়া লোকের মধ্যে? এখন তোমার ভায়ের জন্য আমার পুরো পরিবারের নাক কাটা যাবে। ছি! ছি!! ছি!!!
- মা ও তে টিউশনি করে। চুরি তো নয়!
- তুমি চুপ করো। আমি তোমাকে বলেছিলাম এমনিতে লোক বেশি তোমার ভাইকে বৌ ভাতে বলো। এখন যারা আমার আত্নীয় স্বজন বড় বড় দামি দামি গিফট দিয়েছে তাদের বাদ রেখে তোমার ভাইকে আগে আগে নিয়ে যেতে হবে?
সুলতা কি বলবে বুঝতে পারলো না। তার চোখ ছল ছল। সে অন্য দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে আছে।
আমি ভীষণ বিব্রত বোধ করলাম। চলে যাবো কি না ভাবছি এমন সময় সুলতার দেওর এগিয়ে এলো গাড়িতে লোক সব গুনে গুণে ওঠানো হয়ে গেছে ততক্ষণে। বাড়তি পাঁচজন কে নিয়ে ঝামেলা হচ্ছে। কাকে রেখে কাকে বাদ দেয় শেষে সুলতার শ্বাশুড়ীর নির্দেশে সুলতাকে না নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আত্নীয়দের নিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত হলো। মাত্র তো চারজন বাড়তি লোক এবার আর অসুবিধা নেই। এদিকে ভদ্রতার খাতিরে কি না জানি না।সুলতার দেওর এক ফাঁকে এসে আমায় এই মাত্র দেখেছে এমন ভাবে বলল,
-কি আয়াত কি খবর বিয়ে খেতে এলে নাকি?
আমি কি বলবো বুঝতে পারছিলাম না। কোন রকমে ঠোঁট টেনে হাসবার চেষ্টা করলাম।
-তুমি তো ঘরের লোক তাই না?
-জ্বি !
-তোমাকে যদি রেখে যাই তুমি কি কিছু মনে করবা?
-আরে না না । তাতে তো আমি খুশিই হবে। আপনার বিয়েটা আগে। আমার উপস্থিতি মুখ্য নয়।
-তাহলে তুমি থাকো ,কিছু মনে করো না প্লিজ। খাওয়া দাওয়া করো। আমরা সন্ধ্যার মধ্যে ফিরবো তখন কথা হবে। ভাবি শোন বধূবরনের দায়িত্ব কিন্তু তোমার। সবকিছু সুন্দর করে রেডি রাখবা। দোয়া রইখো ভাবি সব যেন ঠিকঠাক হয়।
সুলতার সাথে চোখাচোখি করবো না ভেবেও চোখা চোখি হয়ে গেল। সে মুখখানি মলিন করে কাঁচুমাঁচু হয়ে বলল,
-এরা এমনই কিছু মনে করিস না ভাই তোকে ডেকে এনে অপমান করতে চাইনি। এ বাড়িতে কেমন আছি বুঝতেই পারছিস। বলিনি কোন দিন, বলে লাভ নেই শুধু শুধু কষ্ট পাবি। আর আমিই বা কোথায় যাবো।
-অপমান কোথায় দেখলি এরা তো আর বাড়ি থেকে বের করে দেয়নি। থাকতে বলেছে। বসতে বলেছে। সেটাই কত।
সুলতা চোখ ছল ছল মুখে দাঁত বের করে বৃথা হাসবার চেষ্টা করে বলল,
-শরবত খাবি ভাই? যা গরম পড়েছে !
-শুধু শরবত খাওয়াবি? আর কিছু না?
-আর কি খাবি?
-অনেকদিন মাংস পরোটা খাই না। খাওয়াবি?
সুলতা রহস্যময় হাসি দিলো।
আমি বললাম,
- চল আমরা রেস্টুরেন্টে যাই। হোটেল আল সালাদিয়ার মাংস পরোটা দারুন বানায়। দুজনে মিলে খাবো। মায়ের জন্যও কিছুটা নেবো। কি আছে জীবনে। ......
© রফিকুল ইসলাম ইসিয়াক
কপি বা শেয়ার করা সম্পূর্ণ নিষেধ
গল্পটি এই মাত্র লিখলাম। ব্লগে আজকাল পোস্ট একদম কম। কমেন্ট ও কম। প্রিয় ব্লগ ঝিম মেরে গেলে মনটা খচখচ করে । তাই হাজার ব্যস্ততায় ও পোস্ট দিলাম তাড়াহুড়ো করে। গল্প হয়েছে কি না জানি না। গল্পের সব চরিত্র কাল্পনিক। শুভকামনা রইলো।
ছবি গুগল থেকে।
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে জুলাই, ২০২২ সকাল ৯:০৮