somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

ইসিয়াক
আমি সেই রকম পৃথিবীর স্বপ্ন দেখি যেখানে সবাইকে সমান দৃষ্টিতে দেখা হবে। যেখানে থাকবে না কোন পাপ পঙ্কিলতা।

গল্পঃ কাছের মানুষ

২৪ শে অক্টোবর, ২০২১ সকাল ১০:১৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



(১)
শরৎ পূর্ণিমার নিশি নির্মল গগন,
মন্দ মন্দ বহিতেছে মলয় পবন।

লক্ষ্মীদেবী বামে করি বসি নারায়ণ,
বৈকুন্ঠধামেতে বসি করে আলাপন।

হেনকালে বীণা হাতে আসি মুনিবর,
হরিগুণগানে মত্ত হইয়া বিভোর।

গান সম্বরিয়া উভে বন্দনা করিল,
বসিতে আসন তারে নারায়ণ দিল।

মধুর বচনে লক্ষ্মী জিজ্ঞাসিল তায়,
কিবা মনে করি মুনি আসিলে হেথায়।.........
উদধৃতিটি লক্ষীর পাঁচালীর অংশ বিশেষ
বছর ঘুরে আজ আবার কোজাগরী লক্ষীপুজোর দিন এলো। প্রতি বছর লক্ষীপুজোর রাতে বরুণের বাসায় আমাদের সপরিবারে নিমন্ত্রণ থাকে। এদিন রাতের খাবারটা আমরা বরুণদের ওখানে মহা ধুমধামে সেরে নেই। ঠিক যেমন রোজার ঈদের পরের দিন রাতে বরুনদের বাসার সবাই আমাদের বাসায় নেমন্তন্ন খেতে আসে। এতটা ঘনিষ্ঠ হবার মুল কারণ বাবা আর সৌমেন কাকা ছোটবেলাকার বন্ধু। দুটি দেহ কিন্তু এক প্রান বলা চলে।
লক্ষী পুজো উপলক্ষে সকাল থেকেই নানা কাজে অকাজে অবিরাম বরুনদের বাড়ি যাওয়া আসা চলতে ই থাকে আমাদের বাড়ির সকলের। লক্ষী পুজোর একটা অংশ হলো আলপনা আঁকা, আলপনা আঁকা একটা চমৎকার শিল্প যা দেখতে বরাবরই আমার ভীষণ ভালো লাগে ।হাতের মোচড়ে মোচড়ে নানা নকশা ফুটে ওঠে নিমেষে। আমার মা, বরুণের বড়দি উমা আর তপনদার বৌ লীলাবৌদি দারুণ আলপনা আঁকতে পারেন। কার আলপনা কত সুন্দর হবে এই নিয়ে একটা সুক্ষ্ম অলিখিত প্রতিযোগীতা চলতে থাকতো সবসময়।
অবশ্য লক্ষী পুজোয় আমার আকর্ষণের প্রধান কেন্দ্র বিন্দু ছিল বরুনের মা অর্থাৎ মহুয়া কাকীমার হাতের খিচুড়ি ভোগ,সেই ভোগ যে না খেয়েছে সে আর কি জানবে তার মাহাত্ম্য । অনবদ্য সে স্বাদ। আহ! এখনও যেন মুখে লেগে আছে আমার। খিচুড়ির আর সাথে থাকতো পাঁচ পদের ভাজাভুজি,লাবড়া আর আমসত্ত্বের চাটনি ।আমসত্ত্বের চাটনিটা আমার সেই লাগতো।এত আয়োজনের মধ্যে কোনটা রেখে কোনটা যে খাই দিশেহারা অবস্থা হতো আমাদের মত ভোজন রসিকদের জন্য ।
আমার সবচে ভালো লাগতো ফালি তোলা নারকোল ভাজি,বেগুন ভাজি, মিষ্টি কুমড়ো আর আধ ফালি করে পটল ভাজিগুলো। দুহাতা খিচুড়ি এদিন আমি বেশিই চেয়ে নিতাম । সত্যি কথা বলতে কি খেতাম গলা অব্দি। বরুণ আর আমার পাল্লা চলতো কে কত বেশি খেতে পারে তার প্রতিযোগিতা। সকলের খাওয়া শেষে বসতেন বাবা, মা , সৌমেন কাকা আর মহুয়া কাকিমা। মা ও কাকীমা একটু আড়ালে আর বাবা ও সৌমেন কাকা পাশাপাশি নকশী আসন পেতে দাওয়ায় বসে খাওয়া শুরু করতেন। দারুণ তৃপ্তি নিয়ে আয়েশ করে চেটে পুটে খেতেন সেই খিচুড়ি ভোগ তারা,বাবাতো মহুয়া কাকীমার হাতের নারকোল ভাজি আর লাবড়ার বিশেষ ভক্তই ছিলেন। হ্যাংলার মত চেয়ে চেয়ে নিতেন বারবার ।
নিমন্ত্রিত অতিথি বলতে শুধু আমরাই যে থাকতাম তা কিন্তু নয়। আশেপাশের কাহার পাড়ার প্রায় সকলে ,বাজারের মুসলমান ব্যবসায়ীসহ মিত্র বাড়ির সকলেরই নেমন্তন্ন থাকতো।প্রতিবছরই সবাই কম বেশি তৃপ্তি নিয়ে খেয়ে বিদায় নিতো সহাস্য মুখে । আহার পর্ব শেষে মহুয়া কাকীমা সবাইকে আলাদা করে একটা কাগজের ঠোঙায় নারকেলের নাড়ু, তিলের নাড়ু, মুড়ির মোয়া, চিড়ের মোয়া, মুড়কি, মটকা, নারকেলের চূড়া দিয়ে দিতেন সাথে করে নিয়ে যাওয়ার জন্য। কারণ তখন কম বেশি সবারই পেটে আর এক বিন্দু জায়গা নেই যে। পরদিন সকালে হেমন্তের মিষ্টি রোদ পিঠ করে সেই খাবারগুলোর সদ্ব্যবহার করা হতো আমাদের সহ আশেপাশের মুসলমান বাড়ির প্রায় প্রত্যেকের ঘরে ঘরে ।
দু এক ঘর অবশ্য নেমতন্নে আসতো না কোনদিনও। নাড়ু মুড়কি দিলেও ছুঁয়ে দেখতো না ভুল করে। তাতে অবশ্য তেমন একটা ক্ষতি বৃদ্ধি হতো না। যার যে রকম অভিরুচি সেটাতে কোন জোর জবরদস্তি তো আর নেই । ওই তো ঠাকুর বাড়ির কেউ মুসলমান বাড়ি খাওয়া তো দুরের কথা যাওয়া আসা ওঠা বসা পছন্দ করে না। সবাই জানে ওরা অমন, এক্ষেত্রে কি করবে না করবে সে তাদের ইচ্ছে সেখানে কার কি-বা বলবার আছে ।

সেই ছোটবেলা হতে দেখে আসছি আমাদের গ্রামে পুজো পার্বণ,ঈদ উৎসব, শবেবরাত সবই পালন হয় দু’সম্প্রদায়ের মিলিত ভালোবাসায়। এর বাইরে অন্য সকল মানুষের পছন্দ অপছন্দ ইচ্ছে অনিচ্ছা থাকতেই পারে। সবার যে সব কিছু ভালো লাগবে তা কিন্তু নয়। যার ভালো লাগবে না সে সেটা এড়িয়ে গেলেই হলো। এই ছিল আমাদের গ্রামের বেশির ভাগ মানুষের নীতি, মুল কথা হলো সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখতে হবে সর্বোচ্চ ছাড় দিয়ে । মিলেমিশে থাকতে হবে একসাথে এটাই সবার কাম্য । প্রতিবেশির সাথে সদ্ভাব বজায় না রাখলে সেখানে বাস করা যায় না। সে বসবাস সুখের ও হয় না।

ঈদ শবেবরাত বা অন্য কোন আয়োজনে বরুনদের বাসার সবাই কম বেশি আমার মায়ের হাতের তৈরি ছিটা রুটি আর দেশি মোরগের মাংস বেশ তৃপ্তি নিয়ে খেতো আর এদিকে বরুনের বিশেষ পছন্দ ছিল মায়ের হাতের মোরগ পোলাও। প্রতি ঈদে আমাদের হাটখোলায় জবাই হতো গোটা কতক খাসি। জবাই করে সবাই ভাগ করে নেওয়া হতো সেই খাসির মাংস হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে সব ঘরগুলোতেই। খাসি বাছাই করা, তারপর দাম দর করে কেনা থেকে জবাই করা,ঝুড়া কুটা সব কিছু বাবাই দেখাশোনা করতো নিজ দায়িত্বে ।
শবেবরাতে হালুয়া রুটিও বরুনদের বাড়ির সকলে বেশ পছন্দ করতো।উমাদি মায়ের কাছ থেকে কয়েক পদ হালুয়া রান্না শিখে নিয়েছিল। উমাদি হাতে মেহেদী দিতো দারুণ নকশা তুলে। প্রায় আমায় দুষ্টুমি করে বলতো তোর বিয়ের মেহেদীর দায়িত্ব আমার। এমন টুকরো টাকরা সংস্কৃত মেলবন্ধন চলে আসছিল যুগ যুগ ধরে।
বিয়ে বা অন্যান্য অনুষ্ঠানে আমরা ছিলাম একে অপরের কাছে অপরিহার্য ।

তবে ধর্মীয় ঠোকাঠুকি যে একেবারে হতো না তা কিন্তু নয়। তবে তা যত দ্রুত সম্ভব সামলে নেয়া হতো দক্ষ হাতে বুদ্ধিমত্তার সাথে।
কালের পরিক্রমায় সেই লোকগুলো আর নেই। সেই জায়গা দখল করে নিয়েছে কিছু সংকীর্ণ চিন্তাধারার স্বার্থবাদী মানুষ। সাম্প্রদায়িক বিষ বাষ্পে ছারখার হয়ে যাচ্ছে পরিবার তথা সমাজ। এরকমই এক ঘটনার শিকার আমরা দুইটি পরিবার হবো তা কে জানতো? কয়েক দিনের মধ্যে কত কিছু বদলে গেল অকস্মাৎ । বরুনরা দেশ ত্যাগে বাধ্য হলো একরকম।
ঘটনার ঘনঘটায় কত মানুষের মুখোশ খুলে গেল এক পলকে ।মানুষের এমন হিংস্রতা বর্বরতার সাথে আমার এই ক্ষুদ্র জীবনে সেই প্রথম পরিচয় হলো।সেই প্রথম জীবনের বাস্তবতার মুখোমুখি হলাম বলা যায়। কি ভয়ংকর আর কি বিভৎস সে রুপ। যে না দেখেছে সে বুঝবে না।এখন শুধু ভাবি এটাই কি ভবিতব্য ছিলো।এটাই কি অনিবার্য ছিল বরুনদের ভাগ্যে দিন দিন কেন জানি আমরা কেমন অচেনা হয়ে যাচ্ছি।একে অন্যের প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলছি।ভাই ভাইকে সামান্য স্বার্থের কারনে আঘাত করছি। সহনশীলতা, মানবিকতা ,মানবিক মূল্যবোধ হারিয়ে যাচ্ছে সমাজ থেকে। চারদিকে এত শিক্ষিত মানুষ তবু সেই সব মানুষেরা এত অমানুষ এত হিংস্র হয়ে উঠছে কেন শিক্ষিত হয়ে কেন অসাম্প্রদায়িক চেতনায় নিজেকে উজ্জীবিত করতে পারছে না, তৎকালীন তথাকথিত অশিক্ষিত মূর্খ মানুষগুলোর মত।


লক্ষী পুজোয় বরুণদের বাড়িতে কোন আয়োজন হয়নি আজ। সেই লোকগুলো যে আর নেই ভিটেয়।কে করবে আয়োজন? সব আজ অতীত। কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে সব বেঁচে আছে শুধু স্মৃতিগুলো।
মনুষ্যবিহীন শুনশান বাড়িটা একবার নয় বেশ কয়বার উঁকি মেরে দেখে এলাম সারাটা দিনের মধ্যে । জানি বরুনরা আর ফিরে আসবে না। আসবার মত পরিস্থিতি ও নেই। প্রতিবারই বুকের মধ্যে একটা ব্যথা খচখচ করে বেজে উঠতে লাগলো। আহা! কোথায় যে গেল ওরা ?
উমাদির করুন পরিণতির কথা বার বার মনে পড়ছে এখন। সৌমেন কাকুর অসহায় মুখচ্ছবি এখনও আমাকে উদ্বেলিত করে। আর বরুন আমার প্রিয় বন্ধু.....

(২)
ঘটনার শুরু এভাবে ........
সৌমেন কাকার বড় মেয়ে উমাদি সবে কলেজে ভর্তি হয়েছিল। বরুনের বড়দি উমাদি,রূপে গুনে অনন্য। দারুণ তার হাতের কাজ। চমৎকার স্পষ্ট উচ্চারণে দারুণ রবীন্দ্র সংগীত গায় সে। উমাদির ব্যবহারটাও যে কি মিষ্টি কি বলবো,কথা বলায় একটা আর্ট লক্ষ করা যেতো সবসময়।দেখে কখনও মনেই হত না যে ও অজ পাড়া গায়ে বাস করে। চলনে বলনে চমৎকার রুচিবোধে সমন্বয় দেখে কম বেশি অবাক হতাম সকলে। যেহেতু বিবাহ যোগ্যা কন্যা, এত গুণ যার, স্বাভাবিকভাবে ভালো ভালো বিয়ের প্রস্তাব আসা শুরু হলো।

উমাদির বিয়ে ঠিক ও হয়ে গেল একসময়। পাত্রের সন্ধান বাবা ই এনেছিলেন। গৃহস্থ ঘরের ছেলে, সরকারি চাকুরে। দেনা পাওনা সব ঠিক ঠাক হলো অল্প কথায়।সামনের অগ্রহায়ণে বিয়ে। দিন যায়।একদিন সাত মাইলের হাট থেকে বাড়ি ফিরছিলাম আমি আর বাবা। পাশ্ববর্তী গ্রামের আজিজ চেয়ারম্যানের ছেলে জামাল হঠাৎ বাবার পথ রোধ করে দাঁড়ালো,
- আস সালামু আলাইকুম চাচা,একটু দাঁড়ান কথা আছে আপনার সাথে ।
- ওয়ালাইকুম আস সালাম।
- চাচা কেমন আছেন
- আছি মাশাল্লাহ ভালো। তুমি ভালো আছো তো ।বাবা জানতেন চেয়ারম্যানেরর এই ছেলেটি আচরণে স্বভাবে দুর্দান্ত খারাপ। গত ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে এই পরিবারটির বিতর্কিত কর্মকান্ডে অনেকেই অসন্তুষ্ট এবং বিরক্ত। কিন্তু ক্ষমতাসীনদের ছত্রছায়ায় থাকা পরিবারটিকে কেউ ঘাটাতে চায় না পারতপক্ষে । বাবার রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় দিন দিন মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে জামাল । জামাল বলল,
-ভালো আর থাকতে দিলেন কই
বাব বললেন
- কেন কি হয়েছে আমি আবার কি করলাম
- আপনার জন্য ই তো অশান্তি শুরু হলো।
- মানে কি বলছো কিছু ই তো বুঝতে পারছি না।খুলে বল।কি করেছি আমি।
- কথা বেঝেন না না- কি ভান করেনআমার পিঠ ভাইরা ভাই জোগাড় করে আনছেন কেন কে আপনাকে দায়িত্ব দিয়েছে সৌমেনের মেয়ে আর আপনের মাথা ব্যথা। এত মাখামাখি ক্যান ও হলো হিন্দু আর আপনি মুসলমান। তেল আর পানিতে মিলে কখনও, শুনছেন
- মানে
-উমা শুধু আমার। ওরে আমি ভালোবাসি।
- এসব তুমি কি বল এসব বলতে হয় না। সে ভিন্ন ধর্মাবলম্বী।
- আপনি মেশেন কেন আপনিও তো ভিন্ন ধর্মাবলম্বী সব তথ্য আমার কাছে আছে। আপনি নাটের গুরু। সময় থাকতে চুপ যান। না হলে বিপদ আছে।
- বাপজান বাড়ি যাও। তোমার বয়স অল্প। এখন নিশ্চয় কোন কারণে মাথা গরম হয়ে আছে। একটা বড় ঘুম দাও। মাথা ঠান্ডা হোক তখন না হয় কথা বলি
- শালা তোর উপদেশ শুনতে আসি নাই। ....
সেদিন বাবাকে অনেক অপমানিত হতে হয়েছিল। বাবা সে রাতে খুব ক্ষিপ্ত ছিল। শালা রিফিউজির ছেলের এত সাহস আমাকে শাসায় সৌমেনের মেয়ের দিকে কু দৃষ্টি দেয়। সৌমেনর মেয়ে মানে আমার মেয়ে। কি ভেবেছে ওরা যা নয় তাই ....
পরের দিন খুব সকালে বাবা আর সৌমেন কাকা উপজেলা চেয়ারম্যানের সাথে দেখা করতে গেল। ঘটনা টা বিস্তারিত জানালো।উপজেলা চেয়ারম্যান সব শুনে বললেন
- আমি আজিজ চেয়ারম্যানকে বুঝিয়ে বলবো, অল্প বয়সী ছেলে তার, ছেলেমানুষ ভুল ভ্রান্তি না করলে শিখবে কীভাবে আমাকে জানালে ভালো হলো আমি দেখবো। আর এতে এত উত্তেজিত হবার কিছুও নেই সামান্য ব্যপার,। চেপে যাও।শুনে রাখো জামাল আমার অবাধ্য হবে না।আমি মানা করে দেবো। আমার উপর ভরসা করতে পার। তারপর কিছুক্ষণ চুপ করে কি যেন ভেবে উপজেলা চেয়ারম্যান আবার শুরু করলেন।
- একটা কথা বলি, শুনবা
- কি
- মেয়েকে ইন্ডিয়ায় নিয়ে যাও।দেখ সেখান থেকে বিয়ে দিতে পারও কি- না।
- তা কি করে সম্ভব ?
- ভেবে দেখ, আমার বলার দরকার আমি বললাম। অনেকেই তো এমনটা করে। অনেকে ইন্ডিয়ায় জমি জায়গা কিনে রাখে তো। তুমি কেন নাই?
আরও কিছু কথা হলো, বোঝা গেল খবর খুব একটা সুবিধার না,এখানে দেন দরবার করে লাভ নেই। ।তার উপর ফিরবার পথে আজিজ চেয়ারম্যানকে উপজেলা চেয়ারম্যানেরর বাড়িতে ঢুকতে দেখে মনে কু ডাক ডেকে উঠলো দুজনের ই। উপজেলা চেয়ারম্যানের একটা কথা কানে এখনও বাজছে দুজনের ই ,
- পোলাপান মানুষ সুন্দরী মেয়ে ছেলে দেখলে শখ আহ্লাদ জাগে। তাই একটু ভুল ভাল বকেছে। ও অত আমলে নেওয়ার কিছু নেই।
উমাদির কলেজ যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। সে আর গান গায় না। সারাক্ষণ মন মরা হয়ে থাকে। তপনদার বৌকে বাবার বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হলো বাচ্চা হবে বলে। উমিদি একদিন কি মনে করে আমাকে আর বরুণকে ডেকে বলল,
-জানিস আমার ভুলে আজ এই পরিস্থিতি।
- কেন কি করেছিস মিছে নিজের উপর দোষ দিচ্ছিস দিদি?
- কলেজে থাকতে চেয়ারম্যানের ছেলের সাথে দুদিন হেসে কথা বলেছিলাম রে। তাতেই ও দূর্বলতা ভাবলো ।
বরুন বলেছিল চেপে যা দিদি। বাবা জানতে পারলে কপোতাক্ষের জলে কেটে ভাসিয়ে দেবে তোকে।চিন্তা করিস না। সব ঠিক হয়ে যাবে।তুই একদম এই নিয়ে মন খারাপ করবি না।
এর কদিন পর থেকে শুরু হলো ধারাবাহিক অত্যাচার । দোষী কে বা কারা অজানা কুশীলবরা ধরা ছোঁয়ার বাইরে । অনুমানে তো আর বিচার হয় না। প্রথমে বরুনদের বড় বন্দের জমির পাকা ধান কে বা কারা কেটে নিয়ে গেল অমাবশ্যার নিশুতি রাতে। হাজার দেন দরবারে কোন কুল কিনারা হলো না। চেনা মানুষের অচেনা রুপ দেখে বাবা আর সৌমেন কাকা হতাশ হলো ক্রমে ক্রমে । এ ব্যপারে উচ্চ বাচ্য করলে বা কাউকে নালিশ জানালে পুরো পরিবারের লাশ কপোতাক্ষ নদে ভাসানোর হুমকি এলো পরোক্ষভাবে ।
কিছু দিন চুপচাপ তারপর আবার
হঠাৎ একদিন সৌমেন কাকার পুকুরে এক রাতে এনড্রিন দিলো যেন কারা। কত কত মাছ মরে পঁচে ম্যাসাকার হলো। আমাদের সকলের মন খারাপ হলো খুব।কোন প্রতিকার নেই।বিচার নেই। অসহায় বোধ করতে লাগলাম সকলে। মহুয়া বৌদি বিলাপ করে কাঁদতে লাগলো। গোপন সূত্রে জানা গেল এই কাজটা সৌমেন কাকুর জেঠতুতো দাদা কমলের। কমলের সাথে সৌমেন কাকুদের জমি জমা সংক্রান্ত গন্ডগোল বহুদিনের পুরানো । বিপদ একা আসে না। এতদিন পরে সময় সুযোগ বুঝে সেই বিষ বৃক্ষ মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো।

আরও কিছু দিন বাদে নিয়ম করে সন্ধ্যা রাতে আমাদের আর সৌমেন কাকার বাড়ির টিনের চালে কারা যেন ঢিল ছুড়তে লাগলো। ছোট বড় মাঝারি। নানান আকৃতির ঢেলা। সবাই বলতে লাগলো এসব জ্বীন ভুতের কারবার। শুধু আমি আর বরুণ জানি এসব জ্বিন ভুত না মানুষ ভুতের কারবার। জ্বিন ভুত বেছে বেছে শুধু আমাদের দু বাড়িতেই ইট পাথর ছুড়বে এটা অবিশ্ব্যাস সেই কৌতুহলে গোয়েন্দাগিরি শুরু করলাম । যখন সব সত্য সামনে এলো আমি আর বরুন মিলে ঠিক করলাম যে দিক থেকে ইটে আসে সেদিকে সে সময়ে আমরাও সর্বশক্তি দিয়ে ইট ছুড়বো। এতে কাজ হলো বন্ধ হলো ইটের বৃষ্টি কিন্তু আমরা ধরা পড়ে গেলাম। কিছু ইট কমল কাকুর উঠানে পড়েছিল তার হম্বিতম্বি হলো বেশি। তিনি ব্যপারটিকে ব্যক্তিগত ভাবে নিলেন। । গ্রামে আমাদের নামে সালিশ বিচার ডাকা হলো। সালিশ বিচারে আমাদের দুজনকে পিঠ মুড়ে দশ ঘা করে বেতের বাড়ি দেওয়া হলো। সাথে দশ হাজার টাকা জরিমানা হলো আর এক ঘরে করে রাখার হুকুম হলো আমাদের দু পরিবারকে।

আমাদের গ্রামে সৌমেন কাকা সহ বেশ কঘর হিন্দু সম্প্রদায়ের বসবাস। তারা ও এক বিচিত্র কারণে মুখে কুলুপ এঁটে বসে রইলো। বাবার পক্ষে ও এগিয়ে এলো না কেউ। কেউ কেউ বলতে লাগলো আরে হিন্দু বাড়ির সমস্যায় মুসলমান বাড়ির জাফরউল্লার এত মাথা ব্যথা কেন? কে ও?

সৌমেন কাকুর ফল বাগানে উৎপাত শুরু হলো এরপর। গরুর গোয়াল খালি হয়ে গেল হঠাৎ । অনেকে বলতে লাগলো আরে সৌমেন এখন ইন্ডিয়ায় যাবে তাই খুত খুঁজছে। দেখ গরু বেঁচে নগদ পয়সায় ওপারে জমি জায়গা কিনছে। মেয়ে বিয়ে দেবে টাকা পয়সার এমনিতেই টান ছিল মাঠের জমি বেচতে হতো। কিন্তু সেই জমি বেঁচতে গিয়ে চাউর হয়ে গেল সৌমেন এবার ইন্ডিয়ায় চলে যাবে।
এক রাতে সৌমেন কাকার পোষা ছাগল মেরে বনভোজন হলো দক্ষিণ মাঠে। সে ভোজনে অংশ নিলো কত চেনা মুখ।যারা সৌমেন কাকুর বাড়িতে পাত পেড়ে খেয়েছে কত শত বার তার হিসেব নেই। এদিকে দ্রুত কিছু মানুষের মুখোশ খুলে আসতে লাগলো। অনেকে আকারে ইঙ্গিতে বলতে লাগলো এবার নাকি ভিটে ছাড়ার সময় হয়েছে সৌমেন কাকুর।পরদিন রাতে মুখোশধারী কারা যেন এসে হুমকি দিলো। চাঁদা দিতে হবে!
পাচ লাখ। সময় দশ দিন।

কাকে বলবে এসব অনাচার অবিচারের কথা কেউ তো শুনছে না। চেয়ারম্যানের ছেলে ই কি আসল হোতা না- কি অন্য কেউ যদিও বাবার সাথে কথোপকথন টুকু ছাড়া আর কেন প্রমান নেই। তাও মৌখিক। বাবাও আজকাল কেমন যেন থম মেরে গেছে। আরোও অবাক কান্ড ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান একদিন বলে বসলো,
- বুঝলে সৌমেন এদেশে তোমার এখন আর থাকা ঠিক না। সময় থাকতে পথ দেখা ভালো। দেখছো না আমার বাবা সময় মত ঠিক ই ভারত ত্যাগ করেছিল বলেই না সব কুল রক্ষা হয়েছে। তোমার এখন যাবার সময় হয়েছে। জমি জায়গা যদি বেঁচ আমার সাথে যোগাযোগ করো উপযুক্ত দাম পাবা।আমি অবশ্য কাউকে ঠকাই না। জানো ই তো। খরিদদার আরও এলো। অসহায় সৌমেন কাকা দর দাম করতে থাকলেন গোপনে গোপনে। সব পানির দর। চেয়ারম্যানের নজর পড়েছে এ জমি নিলে অনেক হ্যাপা পোহাতে হবে যে..
তারপর কিছু দিন পর এলো ভয়ংকর সেই রাত। কারা যেন উমাদিকে তুলে নিয়ে গেল। তপন দা সৌমেন কাকু আহত হলেন বাধা দিতে গিয়ে ।মহুয়া কাকীমা মুর্চ্ছা গেলেন লজ্জায় ঘৃণায়। বাবা, বরুন আর আমি হাঁটে ছিলাম। বাড়ি ফিরে সব শুনে কিংকর্তব্যবিমূঢ হয়ে বসে রইলাম। মা সেদিন ই গেছে বাপের বাড়ি, আমার নানাজানের শরীর খারাপের খবর পেয়ে।
- বাবা বললেন থানায় চল সৌমেন!
সৌমেন কাকু রাজী হলেন না। এই প্রথম তাকে কেমন যেন চরম হতাশ আর বিহ্বল লাগলো সে বলল
- এ দেশ এখন আর আমার নয় রে জাফরুল্লাহ। এ মাটি আর আমার না। সব পর হয়ে গেছে। পর.......
.
অনেক খুঁজে মধ্যে রাতে উমাদিকে তলা বিলের মাঝখানে পাওয়া গেল। সৌমেন কাকা সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি আর এদেশে থাকবেন না। কমল কাকুর সাথে তার নাকি কথা হয়েছে জমি সে নেবে। যা দাম দেয় দেবে। বাবা বা আমার আসলে বলার কিছু ছিল না।... সেই রাতে ভোর হবার আগে একটি অসহায় পরিবার পারিপার্শ্বিক নানা চক্রান্তে দেশ ছাড়া হলো নিরবে নিঃশব্দে। ভোরের আযান যখন দিলো তখন আমি আর বাবা তিন রাস্তার মাথায়।বরুনরা চলে গেছে ওপারে। বাবা আপনজন হারানোর দুঃখে হাউ মাউ করে কেঁদে উঠলেন। আমি ও কাঁদতে লাগলাম। ভোর হচ্ছিল। আলো ফুটছিল একটু একটু করে। নতুন একটা দিন। কিন্তু সম্পূর্ণ অচেনা তার রূপ। বাড়ি ফিরে যাচ্ছিলাম আমরা । পরিপূর্ণ আলো ফোটার আগে ফিরতে হবে।....
বরুন আমার একমাত্র প্রিয় বন্ধু ছিল ।ও আমার সব দুঃখ সুখের সঙ্গী ছিল। সব আজ অতীত। এ জীবনে আর হয়তো কোনদিন দেখা হবে না। হবে না পদ্ম দীঘির জলে সাঁতার প্রতিযোগীতা।আর হবে না কোনদিন দখিন মাঠে লাইলনের সুতো দিয়ে সিমেন্টের শক্ত কাগজ দিয়ে ঘুড়ি ওড়ানো।
সেই বার বোস বাড়িতে, শহর থেকে আসা অহংকারী ছেলেটির চিল ঘুড়িটা কেটে দিয়ে যে কী আনন্দ পেয়েছিলাম কি আর বলবো।দারুণ মজা হয়েছিল।
সেই বরুন এখন স্মৃতি, এত সহজে মানুষ স্মৃতি হয়ে যায় কেমন করে। ওদের ভিটেয় আজ কয়েকদিন জ্বলেনি কোন সন্ধ্যা প্রদীপ। কোন মানুষের পদচারণা নেই কোথাও, ওদের পোষা বেড়ালটাকে দেখতে পেলাম কিছুক্ষণ আগে।আমায় চিনতে পারলো মনে হয়। ম্যাও বলে একবার ডেকে উঠলো। তাকিয়ে রইলো।বরুনদের গোয়ালটাও খালি। একদম খালি আগেই খালি হয়ে গিয়েছিল অবশ্য। কারা যেন গরুগুলো নিয়ে গেছিলো সেই রাতে। বরুনদের এই গ্রামে থাকা শেষ রাত। দুর্বিষহ একটা অধ্যায় আমাদের জীবনে।
ছাগল ছিল তিনটা। ওরাও বড় গোয়ালের এক কোনে থাকতো। লালীটা ছিল ভীষন দুষ্ট। চুরি করে ঘরে ঢুকে চাল খাওয়া ছিল তার নেশা। তারাও নেই আজ। ঘরের টালি গুলো সব এখানে ওখানে ছড়ানো ছিটানো। সেই বারান্দায় বসে আজ আকাশ দেখা যাচ্ছে। খোলা আকাশ। সেই আকাশে পূর্ণ চন্দ্র জোছনা বিলাচ্ছে। বরুন খুব ভালো কবিতা লিখতো। জোছনা নিয়ে একটা কবিতা লেখা আছে ওর। বরুণ ও নেই সেই কবিতাও নেই আজ। সব আজ স্মৃতি। শুধু মানুষগুলোই নেই। পরিচিত কেউ নেই কোথাও।
বরুন আর আমার কেনদিন কি আর দেখা হবে ? কত যে না বলা কথা ছিল তা আর বলা হলো না এ জনমে। বরুনের উপর আমার ক্রমে ক্রমে এক বুক অভিমান জমা হচ্ছে। বর্ডার পেরিয়ে কে জানে কোথায় গেছে ওরা। কেমন আছে এখন?
© রফিকুল ইসলাম ইসিয়াক
গল্পের সব চরিত্র কাল্পনিক। বাস্তবে এই সব চরিত্রের অস্তিস্ত নেই।
কপি বা শেয়ার করা সম্পূর্ণ নিষেধ।

সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই জুলাই, ২০২২ বিকাল ৫:১৮
৭টি মন্তব্য ৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×