somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বড় গল্পঃ মুক্তি নেই

০১ লা নভেম্বর, ২০২১ সকাল ৯:১৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



(১)
গাড়ি নির্দষ্ট গন্তব্যের দিকে তীর বেগে ছুটে চলেছে। জানালার কাঁচ নামানো আছে, বাতাস ঢুকছে হু হু করে। আজকের বাতাসটা সকাল থেকে বেশ আরামদায়ক। রওশন আরা ঘরের জানালা খুলে টের পেয়েছিলেন।কোমল বাতাসের স্পর্শে কিছুক্ষণের মধ্যে শীত শীত ভাব লেগে গিয়েছিল।
হাত বাড়িয়ে রওশন আরা জানালার কাঁচটা একটু তুলে দিলেন। এই বাতাসে ঠান্ডা লেগে যেতে পারে যেকোন সময়ে।বয়স হয়েছে অনেক নিয়ম কানুন মেনে চলতে হয়।

শওকত আলী একমনে জানালা দিয়ে বাইরের প্রকৃতি দেখছেন। তার মনের ভাষা পড়া না গেলেও চোখের ভাষা পড়া যাচ্ছে। চোখে মুখে তার অদ্ভুত প্রশান্তি বিরাজমান। স্বপ্ন দেখার মত মনিগুলো সেখানে অস্থিরতা নিয়ে দ্রুত নড়াচড়া করছে। ছেলেমানুষের মত ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে অবাক বিষ্ময় নিয়ে তিনি প্রকৃতি দেখছেন। যেন সব এই প্রথম দেখা। সব কি তবে সত্যি সত্যি স্মৃতি থেকে হারিয়ে গেছে তাঁর। এত বুদ্ধি দীপ্ত প্রানবন্ত মানুষটা হঠাৎ শিশু হয়ে উঠলো কিভাবে? এটা কি করে সম্ভব? ভাবতেই বেদনায় মনটা তার আরও বেশি ভারাক্রান্ত হয়ে উঠলো। তিনি সাধারণত চোখের জল ফেলেন না। কিন্তু আজ কেন জানি চোখ ভিজে উঠছে বারবার।
অনেক কথা অনেক ভাবনা ভেবে ভেবে কিছুটা বাদে রওশন আরা নিজে ই নিজের মনকে প্রবোধ দিলেন যা হলো ভালোই হলো। সেই ভালো। যার যেমন ইচ্ছে সে তেমন থাকুক।
আসলে এতো হবার ই ছিল আজ অথবা কাল। সকল ক্ষেত্রে তো দেখা যাচ্ছে, বৃদ্ধ বাবা মাকে আজকাল বোঝা ভাবা হয়। সে বোঝার দায় এখন আর কেউ নিতে চায় না।অথচ যাদের ছায়ায় তিল তিল বেড়ে উঠেছে যে সকল মানুষ তাঁদেরই বোঝা ভাবতে কুন্ঠিত হয় না একটুও। সবাই ব্যস্ত তার নিজস্ব গন্ডী নিয়ে, প্রতিযোগীতা নিয়ে। অতীত ভুলে যাবার চর্চা এখন সর্বত্র জোরে শোরেই চলছে নির্লজ্জভাবে। এটাই মনে হয় এ যুগের নিয়ম। দিন বদলায় সাথে সাথে বদলায় সামাজিক আচার আচরণ নিয়ম নীতি। মেনে নিতে মন না চাইলে মেনে নিতে হবে।ফলাফল সে ভিন্ন কথা।

নিজেই নিজেকে স্বান্তনা দেন তবুও রওশন আরা বুকের মধ্যে একটা কষ্ট অনুভব করেন।মানুষের জীবনটা কেন যে এমন হয়,কে জানে? কাছের মানুষগুলো হয় হারিয়ে যায় নয়তো দুরে সরে যায় একে একে সময়ের পালাবদলে। সব কেমন অদ্ভুত।

হঠাৎ রওশন আরার ফোন বেজে ওঠে। তিনি ফোন ধরবেন না বলে ঠিক করেছেন কিন্তু অনেকক্ষণ ধরে ফোন একনাগাড়ে বেজে যাওয়াতে কৌতুহলী হল তার নারী মন। নাম্বার দেখে চিন্তিত হলেন, জামালের ফোন। কেন ফোন দিলো কে জানে? খুব জরুরী না হলে ফোন দিতে তিনি নিষেধ করে দিয়েছেন। অথচ কিছু আগে তো কথা হলো। আর তো কোন কথা বাকি নেই। তিনি চান সম্পর্ক থাকুক ভাসা ভাসা। এতোকাল যে সম্পর্ক তিনি আকড়ে ধরে বসে থাকতে চেয়েছেন আজ সেই সম্পর্ক থেকে দুরে চলে যেতে চাইছে তার মন।কুৎসিত কিছু ঘটনার পরিপেক্ষিতে তিনি আর সম্পর্কগুলো টেনে নিতে আর উৎসাহ পাচ্ছিলেন না তাই এই সিদ্ধান্ত। অন্য এক উপলব্ধি থেকে সেচ্ছায় সংসার ত্যাগ বলা চলে। আগেকার যুগে মানুষ মনে হয় সংসারিক এই সব জটিলতা থেকে মুক্তি পেতেই সন্ন্যাস জীবন বেছে নিতো।
তার এ সিদ্ধান্তের ভালো দিক বা মন্দ দিক সময় বলে দেবে। আপাতত তিনি একটু শান্তিতে থাকতে চান।
রওশন আরা কিছুটা অনিচ্ছা সত্ত্বেও ফোন ধরলেন,
- জামাল বলছো?
জামাল প্রায় আর্তনাদ করে ফোনের অপর প্রান্ত থেকে বলল,
- মা সর্বনাশ হয়ে গেছে।
শান্ত নির্লিপ্ত গলায় রওশন আরা বললেন
- কেন কি হয়েছে?
- মা দুপুরের পর থেকে মনির অনবরত টয়লেট হচ্ছে। হসপিটালে ভর্তি করা হয়েছে। শরীর একদম নেতিয়ে পড়েছে। মা ও তোমাকে খুঁজছে। দিদা, দিদা করে অস্থির করে তুলছে।
- কোন হাসপাতাল ভর্তি করেছো?
জামাল হাসপাতালের নাম বলল।
রওশন আরা কিছুটা সময় ভাবলেন। তার চোখে জল তিনি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ড্রাইভারকে গাড়ি ঘোরাতে বললেন। হসপিটালের লোকেশন ও বললেন।
এখন রওশান আরার নিজেরই খানিকটা অনুশোচনা হচ্ছে। মনির এ ঘটনার জন্য তিনিও কি কিছুটা দায়ী নন? তিনিই তো মনিকে নিজের হাতে খাইয়েছেন সকালে?
এমনই হয় সংসার থেকে কেউ স্বেচ্ছায় দুরে চলে যেতে চাইলেও সংসার আরও কষে বেঁধে ফেলে তাকে।

(২)
না চাইলেও কখনও কখনও জীবন মানুষকে ভয়ংকর কিছু সত্যের মুখোমুখি দাড় করিয়ে দেয় আর তখন এই নিত্য কর্ম, বেঁচে থাকা, সংসারধর্ম অর্থহীন হয়ে পড়ে।
আজ সকালে তেমনি এক ভয়ংকর সত্যের মুখোমুখি হয়েছেন রওশন আরা। এ ব্যপারটা তিনি না পারছেন সহ্য করতে না পারছেন কারও কাছে প্রকাশ করতে। এ ব্যর্থতার দায় যে কম বেশি তার উপরেও বর্তায়।
এ এমনই সত্য যা প্রকাশের সাথে সাথে কয়েকটি মানুষের আসল চরিত্র বেরিয়ে পড়বে। মহা বিপর্যয় ডেকে আনবে পুরো পরিবারে জন্য। ছোট ছোট কয়েকটি শিশুর জীবন চরম ঝুঁকির মুখে পড়বে। যা রওশন আরা কোন ক্রমেই চান না। তিনি চান না তার চোখের সামনে তার সংসার ভেঙে খন্ড খন্ড হয়ে যাক। ।নিজের ভালো মন্দ যা কিছু বয়সের সাথে সাথে বেশ খানিকটা গৌন হয়ে এসেছে।তিনি বা শওকত সাহেব আর কদিন।সবচেয়ে বড় কথা ফুলের মত নাতি নাতনিদের তিনি প্রাণের চেয়ে বেশি ভালোবাসেন।
আর তাই সবদিক বিবেচনায় রওশন আরা অনেক ভেবে চিন্তে বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আর সেই সিদ্ধান্ত জানাবার জন্যই ছেলেদের একান্তে ডাকিয়ে এনেছেন এখন ।
জীবনভর রওশন আরার চট জলদি সিদ্ধান্ত নেবার একটা ভালো গুণ আছে অবশ্যই সততার সাথে নিয়েছেন সে সব সিদ্ধান্ত। তার ফলাফল বেশির ভাগ সময় ইতিবাচক হয়েছে। জীবন এগিয়ে গেছে অনেকটা ই মসৃণ গতিতে। কিন্তু আজ সকালে নেওয়া সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে কিছু দ্ধিধা এখনও কাজ করছে তার মনে। হোক সে নিজেদের লোক, তাই বলে তিনি কি অন্যায় কে প্রশ্রয় দিচ্ছেন না? এই অপরাধের ধারাবাহিকতায় আরো অপরাধের জন্ম নেবে না, তার নিশ্চয়তা তিনি কি দিতে পারবেন?
একটা দীর্ঘশ্বাস তার বুক চিরে বের হয়ে এল। জীবন আজ এক জটিল সমীকরণে এসে দাড়িয়েছে।
একেই বলে বুঝি শাঁখের করাত। প্রাণপ্রিয় সন্তান, নাতি নাতনি এদের মায়া তিনি কি করে এত সহজে ত্যাগ করবেন? রক্তের সম্পর্ক কি চাইলেই ছিড়ে ফেলা যায়?
দক্ষিণমুখী সুদৃশ্য সাজানো গোছানো টেবিলটিতে রওশন আরা আর শওকত আলী পাশাপাশি বসে আছেন।উল্টো দিকে বসে আছে শরীফ আর জামাল।তারা কিছুটা আগে এসে পৌঁছেছে। মায়ের গম্ভীর মুখ দেখে ছেলেরা বুঝতে পারছে এখন জরুরি কোন বিষয়ে নিয়ে আলোচনা হবে। খুব জরুরি না হলে মা এভাবে কখনও ডেকে আনেন না। বিশেষ করে বাইরে কোথাও।
সব তো ভালো ই চলছে হঠাৎ করে আবার কি হলো, কে জানে? জামাল ভাবলো।
ব্যবসায়ীক কারণে ডেকেছে কিনা কে জানে? মা এখনও খানিকটা সেকেলে রয়ে গেছে। নীতি নৈতিকতা দিয়ে আজকাল আর ব্যবসা চলে না,এটা মা কিছুতেই বুঝতে চায় না।অনেক সময় শর্টকাট পথ ধরতে হয় বাধ্য হতে হয়।সব জায়গায় চলছে নোংরা প্রতিযোগীতা।এমন প্রতিযোগীতায় আসলে টিকে থাকাই কষ্ট। একটা ছোট ভুল পদক্ষেপে ছিটকে পড়তে হয় শত মাইল পিছনে। আর গোপন শত্রুতার কথা?সে সব না বলাই ভালো।
মা যদি ব্যবসায়ীক কারণে ডেকে থাকে তাহলে জহির কাকু নিশ্চয়ই কিছু একটা বলেছে ।জহির কাকু মায়ের আমলের বিশ্বস্ত লোক। মা প্রায় সময় উনার কথা ধ্রুব সত্য বলে ধরে নেন । লোকটি বিশ্বস্ত ,মেধাবী আর দূরদর্শী অস্বীকার করবার উপায় নেই । তার দূরদর্শিতার কারণে কোম্পানি তরতর করে এগিয়ে চলছে দূর্বার গতিতে ।সবচেয়ে বড় কথা তিনি একজন পরিপূর্ণ সাধাসিধা মানুষ।
শরীফ আর জামাল দুই ভাইয়ের মনে একরাশ বিরক্তি, তারা সেই বিরক্তি নিয়েই বাধ্য ছেলের মত বসে আছে তবে একটু সাবধানে । পাছে চোখে মুখের বিরক্তি ফুটে ওঠে তাহলে ধরা পড়ে যাবে মায়ের কাছে। তখন এক গাঁদা কথা শুনতে হবে। আর তাই তারা মুখ লুকাতে মোবাইলের স্ক্রীনে ডুবে আছে। রওশন আরা ছেলেদের দিকে মাঝে মাঝে তাকাচ্ছেন তবে আজ এখন তিনি অন্য জগতে আছেন । বুকটা কষ্টে ভেঙে পড়তে চাইছে তাঁর । এই দিনটা দেখতে হবে এটা তিনি কষ্মিনকালেও ভাবতে পারেন নি।এখন শুধু ভাবছেন কিভাবে কথাটা শুরু করবেন। কতটুকু বলবেন।
মা আজ আর ছেলেদের ডেকে এনে নানা প্রশ্নবানে জর্জরিত বা সেই সূত্র ধরে গভীর কোন পর্যবেক্ষণ করছেন না দেখে একটু অবাকই হচ্ছে শরীফ আর জামাল। সবকিছু যে আজ সবরকম পর্যবেক্ষণের উর্ধ্বে উঠে গেছে তারা কি তা জানে? বিশ্বাসের ভিতটাই যে টলে গেছে আজ এবং সমাধানের সূত্র হারিয়ে গেছে হঠাৎ করেই।চেনা ছকে সমাধানের সূত্র প্রয়োগে মহা বিপর্যয় উপস্থিত হতে পারে যে কোন সময় । ছেলেরা তার খোঁজ রাখেনি, রাখেও না ? না থাক অত শত ভাবনার সময় নেই জীবনকে অযথা জটিল করে তোলার কোন মানে হয় না। যে যতটুকুপানিতে নামবে তার কাঁপড় ততটুকুই ভিজবে। আজ অথবা কাল। নিজেকে আবার স্বান্তনা দেন রওশন আরা।
এই বয়সেও শরীফ আর জামিল বাবা মাকে তারা যথেষ্ট ভয় পায়। বন্ধুরা আড্ডায় এ নিয়ে হাসি ঠাট্টা কম করে না।যদিও বাবাকে এখন ভয় না পেলেও চলে কারণ তিনি একজন ডিমেনশিয়ার রুগী। স্মৃতি শক্তি প্রায় হারিয়ে গেছে তাঁর । প্রায় অক্ষম এবং ক্ষমতাহীন অর্থব একজন মানুষ। পরিচিত লোকজনকে তেমন একটা চিনতেও পারেন না আজকাল।তবে বহুদিনের অভ্যাসবশত হোক আর অন্য কোন কারণে ই হোক তার প্রতি ছেলেদের ভয় মিশ্রিত শ্রদ্ধাবোধটা হারিয়ে যায়নি এখনও। গত বছর হঠাৎ করে মাঝারি একটা স্ট্রোকের পর থেকে এমন অবস্থা শওকত আলীর। রওশন আরা যেহেতু খুব শক্ত ধাঁচের মহিলা তিনি এমন বিপর্যয়ে সামান্য সময়ের জন্য হলেও একটুও বিচলিত হননি, হলেও তিনি অন্তত তা বাহ্যিক আচরণে প্রকাশ করেন নি কখনও ।
শওকত আলীর আচার আচরণে তার যে ডিমেনশিয়া তা বোঝা যায় না। তবে আগের চাইতে বড় বেশি নীরব আর শান্ত থাকেন তিনি সারাটা সময় । জাগতিক কোন কিছুর প্রতি তার যেন কোন আগ্রহ বা আকর্ষণ নেই। তবে একমাত্র শুধু রওশন আরা কে কিছুটা সময় না দেখলে অস্থির হয়ে পড়েন তিনি।
এদিকে সময় চলে যাচ্ছে কিন্তু মায়ের দিক থেকে কোন সাড়া শব্দ না পেয়ে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে মোবাইল টেপাটেপি বাদ দিয়ে হঠাৎ মুখ তুলে চাইলো শরীফ,
- আমরা কি শুধু বসে থাকবো , মা? মনে হচ্ছে তোমরা জরুরী কিছু বলাবার জন্য ডেকেছো। যা বলবে একটু তাড়াতাড়ি বল আগামীকাল আমার জরুরি একটা মিটিং আছে। এ সংক্রান্ত কিছু পেপার ওয়ার্ক এখনও বাকি।আমায় তাড়াতাড়ি উঠতে হবে।
- মোবাইলের সুইচ অফ করে দে।
- কেন?
- মোবাইলের সুইচ অফ কর।শীতল নির্লিপ্ত গলায় বললেন রওশন আরা।
জামিল স্বর নরম করে বলল,
- আচ্ছা অফ করলাম। এবার কি বলা যাবে ঠিক কি কারণে এই জরুরি তলব?
- খাবার আসুক। অর্ডার দিয়েছি তো, খেতে খেতে না হয় বলি?
- বাসায় মিট করতে পারতা। অথবা সবাইকে ডাকতে পারতা ।বাসার অন্যরা কে কি ভাববে বল তো? বাকি সবাই কি দোষ করলো?
রওশন আরা যেন কিছু ই শুনতে পাননি তিনি বললেন,
- তোদের দুই ভাই কে কতদিন আমরা একান্তে পাই না।। মাঝে মধ্যে আগেকার জীবনে ফিরে যেতে ইচ্ছে করে খুব,জানিস তো। সেটা কি খুব দোষের?
-না তা দোষের হবে কেন? অন্যায়টা আমাদেরই .
- তোদের কি ইচ্ছে করে না মা বাবার সাথে একান্তে সময় কাটাতে। তাদের খোঁজ খবর রাখতে।
শরীফ বলল,
- মা তমা আর মীনা আছে তো। ওরা তো তোমাকে অনেক মান্য গন্য করে। খাতির যত্নও তো কম করে না। আমরা ব্যবসার কাজে ব্যস্ত তাই হয়তো সেভাবে..
-নিজের ছেলেদের খাতির যত্ন আশা করা কি অন্যায়? তোমরা তো আমার সন্তান।তবে ছেলে সন্তান। একটা মেয়ে থাকলে মনে হয় ভালো হতো।
-এ কথা উঠছে কেন?
-আমি কি তোমাদের এখনকার মায়েদের মত করে মানুষ করেছিলাম? কোন কমতি রেখেছিলাম কোন কিছুতে? বল
ছেলেরা আবার অনুযোগ করে বলল,
-এখন এ কথা উঠছে কেন? কি হয়েছে? খুলে বল।
রওশন আরা কথাটা এড়িয়ে গেলেন
-কি ছিলো সেই দিনগুলো।আহ! সব এখন স্মৃতি! তোর দাদীজান, তোদের বাবা আমি আর তোরা দুই ভাই। খুব ফিরে যেতে ইচ্ছে করে সেই দিনগুলোতে । অভাব ছিল কিন্তু শান্তি ছিল।
- মা তুমি কি আমাদের এখানে স্মৃতি রোমন্থনের জন্য ডেকেছো? তাহলে দুঃখের সংঙ্গে জানাতে হচ্ছে আমাকে উঠতে হবে। বয়সের সাথে সাথে তোমাদের পাগলামি বাড়ছে বলে মনে হয়। জীবন কিন্তু এখন খুব কঠিন মা ,একটু বুঝতে চেষ্টা কর। তোমাদের সময়ের চেয়ে এখন সবখানে আরও বহুগুণ প্রতিযোগীতা মাত্রা বেশি।প্রতিটা সময় এখন মহা মূল্যনান।
- এই একটা দিন আমি তোদের কাছে চেয়ে নিচ্ছি। আর কোনদিন বিরক্ত করবো না। কথা দিচ্ছি। তোদের বাবা তো দিন দিন সব কিছুর উর্ধ্বে উঠে যাচ্ছেন। কোনদিন হয়তো টুপ করে ডুব দেবেন।আর আমি ..
- মা!
দুই ভাই একসাথে মুখ চাওয়া চাওয়ি করে তারপর বলল,
- ঠিক আছে মা তোমার ইমোশন আমরা বুঝি কোন কারণে কি তুমি আপসেট?
- ফোনটা সুইচ অফ কর আর আমার কাছে দে!
- ফোন সুইচ অফ করেছি তো।
- একদিন আমাদের জন্য তোরা একটু ত্যাগ স্বীকার করবি না? এই এখন আমরা চাই তোরা যতক্ষণ আমাদের সাথে থাকবি। কেউ যেন বিরক্ত না করে।
দুজনেই বুঝতে পারলো আজ মায়ের হাত থেকে মুক্তি নেই। অথচ....।
ততক্ষণে খাবার চলে এসেছে। শরীর আর জামিল অবাক হয়ে লক্ষ করলো সব তাদের পছন্দের খাবার। খাবারের মন মাতানো গন্ধে ওরা যেন আবার ছোট বেলায় ফিরে গেল হুট করে ।এই রেস্টুরেন্টটা মায়ের এক বান্ধবীর। সীমা আন্টির। রওশন আরা জানালেন সব রান্না মায়ের বান্ধবী সীমা আন্টি নিজ হাতে রেঁধেছে।
রওশন আরা সেই পুরানো দিনের মত স্বামী আর ছেলেকে খাবার বেড়ে দিতে লাগলেন। শরীফ আর জামিলও যেন ভুলে গেল তাদের দৈনন্দিন ব্যস্ততা। খাবারের গন্ধে তাদের মনে পড়ে গেল দুপুরের খাওয়াটা এখনও হয়নি বেশ ক্ষিদে পেয়েছে। এখন আর ব্যপারটা তাদের দুই ভায়ের কাছে বিরক্তিকর লাগছে না। ওরা যেন এখন কারো বাবা বা স্বামী নয়। ওরা এক স্নেহময়ী মায়ের সন্তান। অবিকল দশ বছর বা তার আগের জীবনের মত মুক্ত স্বাধীন বন্ধনহীন।খাওয়া শেষে, রওশন আরা আর শওকত জামিল এরপর ছেলেদের নিয়ে কয়েকটি পরিচিত জায়গায় ঘুরলেন। এরমধ্যে ছেলেরা কেউ একবারও জানতে চাইলো না কেন তাদের ডাকা হয়েছে বা অন্য কিছু। তারা দুই ভাই দারুণ এনজয় করতে লাগলো ।ছোটবেলার সেই ঘুরে বেড়ানো জায়গায় আবার আসতে পেরে তাদের মনের মধ্যে অন্য রকম এক আমেজ কাজ করছে। মাঝে মাঝে এমন আয়োজন মন্দ নয়।বাবা- মায়ের ও ভালো লাগবে।
পার্কের এক বড় বটগাছটার নিচে পাতা কাঠের বেঞ্চে চুপচাপ বসে ছিলেন রওশন আরা। স্বামীকে পানি খাওয়ালেন।ছেলেরা কাছে আসতেই একেবারে তারপর হুট করে বলে বসলেন,
-আমরা যদি তোমাদের ছেড়ে আলাদা থাকতে চাই । তোমরা নিশ্চয় আপত্তি করবে না।
শওকত আর জামিল দুজনেই যেন হঠাৎ রূঢ বাস্তবে ফিরে এলো। অবাক হলো..
- আলাদা থাকার কথা আসছে কেন, মা?
- আসলে তোমাদের সংসার হয়েছে। নিজস্ব জগত সেও অনেক আগে ই তৈরি হয়েছে। নিজেদের ব্যপারে ভালো মন্দ সিদ্ধান্ত নেবার সক্ষমতা তৈরি হয়েছে তো আর কেন? অনেক তো হলো। আমরা দুজন এবার নিজেদের মত থাকতে চাই। আমরা মুক্তি চাই।
- বাবা অসুস্থ , তুমি যা বলছো ভেবে বলছো?
- তোমাদের ভাবতে হবে না। আমি দেখে রাখবো তোমাদের বাবাকে।কথা দিলাম।
- জুই ,চামেলি, কেয়া, রঙ্গন,মনি এরা তো তোমায় খুব ভালোবাসে। ওরা তোর প্রিয় নাতি নাতনি ওরা তোমাদের মিস করবে। ওদের আমরা কি জবাব দেবো? ওরা কি তোমায় ভালোবাসে না?
- ভালো সবাই বাসে আবার বাসে না। একটা সময় গাছ তার পরম প্রিয় পাতাকে ছেড়ে দেয়। খসে পড়ে পাতা।এটাই সময়ের প্রয়োজন। মানতে হবে,মেনে নিতে হয়।
অনেক যুক্তি তর্ক হলো। নিজের সিদ্ধান্তে অটল রইলেন রওশন আরা। তারপর একে একে সব কিছু বুঝিয়ে দিলেন।
-তো তোমার সাথে দেখাও করতে যেতে পারবো না?
-খুব প্রয়োজন না হলে দেখা করার দরকার নেই। ফোনে আলাপ তো হবেই।
-মা কি কারণে এই কঠোর সিদ্ধান্ত জানতে পারি?
-না পারো না। আমি বলতে চাই না। আশা করি জোর করবে না।
হসপিটালের গেটে রওশন আরার বড় ছেলে #শরীফ অধীর আগ্রহে দাঁড়িয়ে আছে।নির্দিষ্ট গাড়ির দেখা মিলতেই চেহারা থেকে চিন্তার মেঘ সাময়িক দুর হল তার। গাড়ি থেকে নামতে নামতে উদ্বিগ্ন স্বরে রওশন আরা জানতে চাইলেন
- মনি? মণি এখন কেমন আছে?
-মা তাড়াতাড়ি এসো,বারবার মনি তোমাকেই খুঁজছে শুধু। ও এখন ভালো আছে।
- আমি যাচ্ছি এখুনি ওর কাছে। তুমি তোমার আব্বার কাছে একটু থাকো। আমায় খুঁজলে ফোন দিও আমি চলে আসবো। উনি ঘুমিয়ে পড়েছেন,ঘুমাচ্ছে ,ঘুমাক ডেকে তুলো না আবার।
কত তলায় কত নম্বর কেবিন খুঁটিয়ে সবটা জেনে নিয়ে লিফট নির্দিষ্ট তলায় পৌঁছাতেই লিফটের সামনে ছোট ছেলে #জামালকে পেয়ে গেলেন রওশন আরা, মা ফিরে আসছে আগেই জানতো সে। মাকে দেখে জামাল কিছু বলতে চাইলো রওশন আরা হাত ইশারায় থামতে বললেন।
জামালের দেখানো পথে কেবিনে ঢুকে শিশুদের মত এক ছুটে দৌড়ে এসে প্রিয় নাতিকে জড়িয়ে ধরলেন রওশন আরা । যেন কতকাল পরে দেখা।
- দাদুভাই কি হয়েছে তোমার?
মণির দিদার উপর ভীষণ রাগ হয়েছে। সে ভেবে রেখেছিল আর কোনদিন দিদার সাথে কথা বলবে না,কিছুতেই না কিন্তু দিদা ওকে জড়িয়ে ধরতেই সব রাগ পানি হয়ে গেল সেখানে একরাশ অভিমান এসে জড়ো হলো। অনুযোগের সুরে ঠোঁট ফুলিয়ে মনি বলল,
- তুমি খুব পঁচা?আমাকে ছেড়ে কোথায় চলে গিয়েছিলে তুমি দিদা?
- কোথায় যাবো? এই তো আমি দাদুভাই। ছিলামই তো।
- না তুমি চলে গিয়েছিলে, আমি জানি।মা একটুও ভালো না তোমাকে মেরে ফেলতে চেয়েছিল তাও জানি। কি সব মেশানো ছিল বেলের শরবতে।তাই তো আমার বমি আর ডায়রিয়া হলো।বাবা সব জানতে পেরে গেছে। ।মা বাবার কাছে সব স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে। মাকে আর কাকীমাকে খুব বকেছে বাবা আর কাকু। নানা নানুমনিকে নালিশও করে দিয়েছে। নানু নানা ভাই সবাই মাকে আর কাকীমাকে ভীষণ বকেছে।ভীষণ। বাবা বলেছে মাকে তাড়িয়ে দেবে।
যা বোঝার বুঝে গেছেন রওশন আরা তিনি তাড়াতাড়ি কথা চাপা দেওয়ার জন্য বললেন
- ওরে পাকা বুড়ো আমার। এত খবর তুমি কোথায় পেলে? এসব নিয়ে তোমায় ভাবতে হবে না। একটা বাপ্পা দাওতো সোনা।
- দেবো না পাপ্পা,এটা তোমার পানিশমেন্ট আর শোন আমি মোটেও বুড়ো না। তুমি বুড়ো না না বুড়ো না বুড়ী। তুমি বুড়ী। পঁচা বুড়ী।
দিদা আর নাতির খুনসুটি চলল
এর মধ্যে দুই ছেলের বউ নীরবে এসে শ্বাশুড়ীর সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো। রওশন আরা এক ঝলক দেখে বুঝতে পারলেন অনুতপ্ত তারা কিন্তু তিনি তাদের সাথে কোন কথা বললেন না। আসলে কথার বলার রুচি হলো না তার।তিনি মুখ ঘুরিয়ে নিতে ই দুজনে রওশন আরার পা ধরে কান্নাকাটি শুরু করলে। এমন পরিবেশে এরকম আচরণ অস্বস্তিকর একটা ব্যপার।এটা পাবলিক প্লেস। প্রথমে একটু চমকে গেলেও রওশন আরা পা ছাড়িয়ে নিতে গিয়ে দেখলেন সেথায় বজ্র আঁটুনি। বাধ্য হয়ে তিনি বললেন
-পা ছাড়ো । এটা হাসপাতাল , বাসা নয়। স্বাভাবিক আচরণ আশা করছি তোমাদের কাছ থেকে। আমি চাই না আমাদের কারণে অন্য কারো অসুবিধা হোক। আর এসব পারিবারিক ব্যপার সাত কান হোক তাও আমি চাই না।তোমরা যা করেছো তা অত্যান্ত গর্হিত কাজ।তোমাদের যা বলার আছে পরে শুনবো। এখন আমাকে বিরক্ত করো না।
রওশন আরার দুই ছেলের শ্বশুর শ্বাশুড়ি সবাই এখন হাসপাতালে । তমা ও মীনার বাবা মা বেশ বিব্রত ও সেই সাথে লজ্জিত । সেই লজ্জার কারণে তারা সম্ভবত বেয়াইনের মুখোমুখি হতে পারছে না । নিজ শ্বাশুড়িকে হত্যা চেষ্টাকে খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। মেয়েদের এমন গর্হিত কাজে রওশন আরার সামনে কি করে মুখ দেখাবেন সেই ভাবনায় তারা অস্বস্তিতে দুরে সরে রইলেন।সামনে আসার সাহস হলো না।এ অবস্থায় কারণে পরিবেশটা বেশ খানিকটা গুমোটই বলা যায়। মনি সুস্থ হলেও এই ভালো খবরটা তেমন একটা প্রভাব ফেলল না।
মনির ডাক্তারি চেক আপ ও রিলিজ সংক্রান্ত কাগজ পত্রতৈরি হতে হতে রাত হয়ে গেল। কি করবেন এখন রওশন আরা? তিনি কি তার সিদ্ধান্তে অটল থাকবেন? না- কি বাসায় ফিরবেন?এত আত্নীয় স্বজন ছেড়ে তাদের চোখের সামনে দিয়ে নিজের গন্তব্যে প্রস্থান করাটা শিষ্টাচার বহির্ভূত। তার উপর রাতও হয়ে গেছে এই অবস্থায় এখন কাঙ্খিত গন্তব্যে পৌছানো বেশ কিছুটা ঝুঁকি পূর্ণ। পথঘাট ভালো না, মানিকনগরের ওখানে প্রায় ই ডাকাতি হয়।কিন্তু অবিশ্বাস আর লোভের যে রূপ তিনি সকালে ঘুম থেকে উঠে নিজ চোখে অবলোকন করেছেন তা থেকে তাঁর মনে এক ভয়াবহ ঘৃণা ও বিতৃষ্ণা সৃষ্টি হয়েছে এই সংসারের প্রতি।। যদিও সব জানাজানির পর এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি না হবারই সম্ভাবনা আছে । তবু ঘর পোঁড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখে ডরায় প্রবাদটি তাঁর মন জগতকে বারবার আচ্ছন্ন করে রাখছে ।
ছোট ছেলে জামাল তার মেয়ে মনিকে মায়ের কাছে দিয়ে বলল
- মা তুমি মনি আর বাবাকে নিয়ে বাড়ি যাও আমরা পেছনে আসছি।
এত আত্নীয় স্বজনের মধ্যে তিনি ছেলের কথা নিম রাজী হয়ে মেনে নিলেও হাজার চিন্তা যথারীতি মাথায় চলতেই লাগলো।
অস্বস্তিটা কিছুতেই মন থেকে যাচ্ছে না।
ঘটনা এমন করে মোড় নিবে তিনি কল্পনা করতে পারেন নি। এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে যে সময় নিয়ে অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই কোন।
মনি এখন দিব্যি ছোটাছুটি করছে। অথচ কয়েক ঘন্টা আগে একদম নেতিয়ে পড়েছিল না-কি।চরম সর্বনাশ হতে যাচ্ছিল। আহা! তিনি নাতনিকে জোরে জড়িয়ে ধরলেন। মনের মধ্যে একটু অপরাধবোধ এখনকাজ করছে । ওই ঘটনার পর তাঁর কেন অতি প্রিয় নাতির কথা একবারও মনে আসেনি।এত স্বার্থপর তিনি কি করে হলেন।
এ সময় #তমা আর #মীনার বাবা মা এগিয়ে এলেন।কতক্ষণ আর মুখ লুকিয়ে থাকা যায়। তমা ও মীনা আপন বোন তাদের বাবা মা কিছুটা নত মস্তকে মলিন মুখে ভালো মন্দ জিজ্ঞেস করলেন রওশন আরাকে।তাদের হাবভাব দেখে মনে হলো যেন তারাই অপরাধী। নিজের মেয়েদের হয়ে বারংবার ক্ষমা চাইতে লাগলেন। একবার সুযোগ দেওয়ার বিনীত অনুরোধ করতে লাগলেন।
জামাল আর শরীফ দুজনে এগিয়ে এসে বলল,
- মা তুমি বাসায় চল তারপর দেখছি কি করা যায়। প্লিজ ....তুমি আর বাগ করো না।
অবশেষে রওশন আরা বাসায় ফিরে যেতে রাজী হলেন।
বাসায় ফিরতে পরিবেশ আরও গম্ভীর হয়ে গেল। বাচ্চাদের ঘুমাতে পাঠানো হলো।সকালের উদ্ভুত পরিস্থিতি এবং তার পরিপেক্ষিতে জরুরি পারিবারিক মিটিং বসতে বাধ্য হলো যদিও রাত হয়ে গেছিলো।
শরীফ বলল,
-মা ঠিক কি হয়েছে তুমি আগে বল। তমা বা মীনার উপর তার বিশ্বাস ও আস্থা দুটোই উঠে গেছে। ওরা এমন কিছু করতে পারে কল্পনাতেও আনতে পারেনি।
রওশন আরা বরাবরই সোজা সাপটা কথা বলতে পছন্দ করেন। ঘোর প্যাঁচ চাপান উতোর তাঁর পছন্দ নয়,তার উপর রাত বাড়ছে , বিশ্রামের প্রয়োজন, তিনি বেশিক্ষণ বসতে পারবেন না রওশন আরা শুরু করলেন
- রোজকার মত আজ সকালে ঘুম থেকে উঠে তোমাদের বাবাকে নাস্তা আর ঔষধ খাইয়ে আমি নাস্তা খেয়ে নিলাম। আগের দিন বড় বৌমাকে বেলের শরবত বানাতে বলেছিলাম।সকালের নাস্তা শেষে খাবো তাই। এর মধ্যে মনি এলো আদর খেতে। কি মনে হতে সে বায়না ধরলো বেলের শরবত খাবে। বেল তো যে কোন মানুষের জন্য ভীষণ উপকারী।বায়না যখন ধরেছে খেয়ে দেখুক একটু আমি মনিকে বেলের শরবত দিলাম। সে এক চুমুক খেল।মনে হয় ভালো লাগেনি আমি মজা করে আর ও খাবে কি- না জানতে চাইলাম।ঠিক তখনই ছোট বৌমা কোথেকে এসে তীব্র চিৎকার করে জানতে চাইলো
- মা আপনি এই মাসুম বাচ্চাকে মেরে ফেলতে চান না- কি? কেন ওকে বেলের শরবত খাওয়ালেন। ওসব আজে বাজে জিনিস আপনি খান সে ঠিক আছে আমার মাসুম বাচ্চার মুখে তুলে দিলেন কেন? এখন যদি ওর কিছু একটা হয়ে যায়।
এখন যদি কিছু একটা হয়ে যায় কথাটা ও এমন ভাবে বলল আমি বেশ অবাক হলাম।
- মানে ? এমন ব্যবহারে আমি অভ্যস্ত নই। আমি বিব্রক হলাম।
ছোট বৌমা তখনও বলছে
- আপনি ওকে বেলের শরবত খেতে দিয়েছেন কেন? আপনার ইচ্ছে হয়েছে আপনি খান।বারবার খান পেট ভরে খান আত্না ভরে খান। আমার কোন আপত্তি নেই। কেন আমার মেয়েকে খাওয়ালেন।
সমস্যাটা কোথায় আমি ধরতে পারছিলাম না। আমি বেশ খানিকটা হকচকিয়ে গেলাম। জ্ঞানত আমার জানা নেই যে বেলের শরবতে অপকারী কিছু আছে।
আমি কোন রকমে বললাম,
- তুমি এমন রিয়াক্ট করছো কেন বৌমা? সমস্যা কি হয়েছে? আমি তো কিছু ই বুঝতে পারছি না।
ছোট বৌমা কখনও আমার সাথে এরকম টোনে কথা বলে না। বরাবরই সে অর্ন্তমুখী। স্বাভাবিকভাবে তার ব্যবহারে আমি ভীষণ আহত হয়েছি। চোখ মুখ পাকিয়ে ছোট বৌমা ভীষণ বিরক্ত হয়ে বলল,
-আপনার সে সব না বুঝলেও চলবে। বলে মেয়েকে নিয়ে ঘরে চলে গেল। তারপর ওর পরবর্তী কিছু আচরণে আমার মনে কেমন যেন সন্দেহের সৃস্টি হল । ছোট বৌমা বার বার মনির কাছে তার গলা বুক জ্বলছে কি-না। পেট জ্বালা করছে কি- না শরীর খারাপ লাগছে কি-না ইত্যাদি জানতে চাইলো ।
তার উপর সবচেয়ে বড় কথা এত কিছুর মধ্যেও বড় বৌমা একবারও এদিকে এলো না। কি হয়েছে জানতে। যেন কিছুই হয়নি বা বা সে শুনতেই পায়নি।
আমি আমার বাসার সবচেয়ে পুরানো কাজের মেয়ে গোলাপীকে ডাকলাম আমার ঘরে। ও যদি কিছু জানে তাহলে আমার কাছে কখনও লুকাবে না। ও ছোট বেলা থেকে এ বাড়িতে মানুষ্ আমাকে জমের মত ভয় পায়। আমার সামনে মিথ্যা বলার সাহস নাই ওর। সন্দেহ হওয়াতে কিছু কথা জিজ্ঞেস করলাম ওকে। তারপর তার মুখে যা শুনলাম তাতে ভীষণ আতঙ্কিত হলাম আমি।
আমার বেলের শরবতের মধ্যে টিকটিকি সিদ্ধ পানি ও কি এক গাছের শেকড় মিশিয়েছে আমাকে খাওয়ানোর জন্য দুই বৌমা মিলে। গোলাপী আড়াল থেকে দেখেছে কিন্তু আমাকে বলার সুযোগ পায়নি। কারণ আমি ঘুম থেকে উঠে নাস্তা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেছি। সে ভেবেছে আমি দুপুরে বেলের শরবত খাবো তার আগে সে সুযোগ মত জানাবে।কিন্তু... আমি এরপর বৌমাদের ডাকি আমি চেপে ধরতে প্রথমে অস্বীকার করলেও পরে সব স্বীকার করল । যা শুনলাম তাতে আমার রক্ত হিম হয়ে এলো। স্লো পয়জনিং এর মাধ্যমে আমাকে হত্যা করার পরিকল্পনা করা হয়েছে। আমি ভাবতেও পারছিলাম না আমার সাথে কোনদিন এরকম কিছু একটা হতে পারে। আমার বিশ্বাসের ভীত নড়ে উঠলো্ আমি অনেক কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে পারতাম। কিন্তু আমার ছোট ছোট নাতি নাতনিদের কথা ভেবে। ছেলেদের সংসার জীবনের কথা ভেবে তার চেয়ে বড় কথা পারিবারিক সম্মানের কথা ভেবে।, বাসা ছেড়ে অনত্র থাকার সিদ্ধান্ত নিলাম।ওরা থাকুক ওদের মত। আমাদের কারণে ওদের হয়তো সমস্যা হচ্ছে। না হলে এমন কাজ করবে কেন? আমি সিদ্ধান্ত নিলাম আমার স্বামীকে নিয়ে আমাদের গ্রামের বাড়ি চলে যাবো। শরীফ আর জামালকে ও সবটা না জানালেও আমার শেষ সিদ্ধান্তের কথা জানালাম।
শরীফ সরাসরি তমা ও মীনার কাছে জানতে চাইলো
- কেন এ কাজ করেছো?
প্রথমে কথা না বললেও যখন ওদের বাবা এসে দুই মেয়েকে চড় মারতেই ওরা দুবোন একেবারে ভেঙে পড়লো।
তমা আর মীনা যা বলল তার সংক্ষিপ্ত সারাংশ হলো
রওশন আরার ভয়ে ওরা নিজেদের মত জীবনটাকে উপভোগ করতে পারছে না।প্রায় সব কাজে জবাবদিহিতায় ওরা ক্লান্ত। অন্যান্য পরিবারের বউয়ের মত ওরা নিজেদের মত থাকতে চায়। চলতে চায় কিন্তু দাপুটে শ্বাশুড়ীর ভয়ে তেমন কিছু করতে পারে না।কোথাও যেতে পারে না।ইত্যাদি যেহেতু স্বামীরা মা বাবা ছাড়া কিছু চেনে না এবং সব সিদ্ধান্ত এখনও রওশন আরাই নেন । সে কারণে নিজেদের তারা বঞ্চিত মনে করে।
সব শুনে রওশন আরা একটু হাসলেন শুধু এই টুকু বললেন
-শোন বৌমারা তোমাদের এই বাড়ি এই ব্যবসা এত শান শওকত আর যা কিছু সব কিন্তু একদিনে হয়নি ।তিল তিল করে গড়ে তুলতে হয়েছে রক্ত পানি করে। আমরা যখন বিয়ে হয়েছিল তখন আমরা দু কামরার ভাড়া বাড়িতে থাকতাম।কোথাও যাওয়া তো দুরের কথা অনেকদিন না খেয়ে
শুধু পানি খেয়েও থেকেছি। তোমার বাবার নির্দিষ্ট আয় রোজগার ছিল না ।ভালো একটা কাপড় জোটেনি তখন কিন্তু কোন অনুযোগ জানানোর কথা ভাবতেই পারিনি। কেন পারিনি? সাহসই পাইনি। অবস্থার সাথে মানিয়ে নেওয়ার মানসিকতাও কিছুটা কাজ করেছে।
আমারও হয়তো ভুল আছে কিছু। আসলে এখন যা কিছু সব তো তোমাদের জন্যই করা। আমি আর তোমার শ্বশুর ক’দিন। তোমাদের সমস্যা হচ্ছিলো জানাতে পারতে আমাকে না হলেও তোমাদের স্বামীকে বা বাবা মাকে । আলোচনায় সব সমস্যার সমাধান কিছুটা হলেও মেলে। তাই বলে আমাকে মেরে ফেলার পরিকল্পনা করতে হবে? আমি তো ভাবতেও পারিনি । আমাকে স্লো পয়জনিং এর মাধ্যমে মারতে চেয়েছিলে এটা সত্যি আমাকে আমার চিন্তা চেতনার ভিতকে সামগ্রিকভাবে নাড়িয়ে দিয়েছে। এটা কি করে পারলে? আমি কি এতটাই খারাপ?
ঘরের প্রতিটি প্রাণী তখন নিরব নিথর যেন সবাই কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলেছে।
তমা আর মীনার বাবা ওদের মারতে উদ্যত হলে রওশন আরা বাধা দিলেন তিনি বললেন
- মারামারি কোন সমাধান নয় বেয়াই। যে কোন জিনিসের উপর বিশ্বাস একবার উঠে গেলে সেই বিশ্বাস ফিরিয়ে আনা কষ্টকর। যা হয়েছে ভালো হোক মন্দ হোক বাদ দিলাম। নতুন করে নিজের ভুল শুধরে নতুন পথ চলা শুরু হোক আবার।
আমি কিছু প্রস্তাব দিচ্ছি এখন, আমার সিদ্ধান্ত ই সব নয়, এক্ষেত্রে সবাইকে মন খুলে মতামত দিতে হবে। মনের মধ্যে এক আর বাইরে এক এরকম করলে হবে না।
অবশেষে সে রাতে যে সিদ্ধান্ত গুলো হলো তা হলো
-রওশন আরা আর শওকত জামিল গ্রামের বাড়িতে থাকবেন। বাচ্চারা সহ অন্যান্যরা চাইলে সেখানে বেড়াতে যেতে পারবে।
-ব্যবসায়িক কোন গুরুত্বপূর্ণ ব্যপার ছাড়া রওশন আরাকে বিরক্ত করা যাবে না।
-দুই ছেলে তারা পরিবার নিয়ে আলাদা আলাদা থাকবে। কারণ একই সমস্যার পুনরাবৃত্তি তিনি চান না।
-ব্যবসা আপাতত একসাথে থাকলেও আস্তে ধীরে তা আলাদা করে নিতে হবে। ইত্যাদি।
চমৎকার রৌদ্র উজ্জ্বল সকাল। সবকিছুর পরে আবার গাড়ি ছুটে চলেছে তার নির্দিষ্ট গন্তব্যের দিকে। রওশন আরার মন ভীষণ খারাপ। মন খারাপ হোক তা তিনি চান না। আসলে মানুষ এই সংসার পারিবারিক বন্ধন থেকে মুক্তি চাইলেও মৃত্যু ছাড়া এর থেকে কোন মুক্তি নেই।
© রফিকুল ইসলাম ইসিয়াক


ছবিঃ গুগল থেকে
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে জুলাই, ২০২২ সকাল ৯:০৯
৬টি মন্তব্য ৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×