somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্পঃ সাত নম্বর কেবিন

০৮ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২২ রাত ১০:৫৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



(১)
জামালের বেডে নানারকম খেলনা ছাড়ানো ছিটানো। নার্স রুপালী সেই খেলনাগুলো দ্রুত হাতে গুছাতে লাগলো। আজ তার ভীষণ রকমের তাড়া আছে আরও আগে বেরিয়ে যাওয়া উচিত ছিল কিন্তু তুলি এখনও এসে পৌঁছায় নি বলে তার যাওয়া হয় নি।তুলিকে কাজ বুঝিয়ে দিয়ে তারপর তার ছুটি।
জামাল খেলনাগুলোর দিকে এক ঝলক তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে চেয়ে বাইরের দিকে উদাস হয়ে তাকিয়ে রইলো। দুরের মাঠে অনেকগুলো বাচ্চা খেলছে। আজ সম্ভবত শুক্রবার। শুক্রবার এই সময় ছেলেগুলো নিয়মিত খেলতে আসে।জামাল খেয়াল করে দেখেছে সাত আটজনের দল ওটা।ছেলেগুলো জামালেরই বয়সী।অন্যদিনগুলোতে ওরা সম্ভবত স্কুলে যায়। ছুটির দিনগুলো ছাড়া ওদের দেখা পাওয়া যায় না। জামাল অবশ্য স্কুলে খুব একটা যায় নি কোনদিনই তবে খেলার মাঠ বা বন বাঁদাড়ে দূরন্তপনা পুকুরে লাফ ঝাঁপ দেওয়াতে সে বেশ পারদর্শী ছিল একসময় । কোথেকে যে কি হয়ে গেল।
জামালের আবার আগের মত খোলা মাঠে খেলতে এদিকে ওদিকে ছুটে বেড়াতে খুব ইচ্ছে করে কিন্তু এই মরার ছাতার মাথা অসুখের জন্য তার বাইরে যাওয়া সম্পূর্ণ নিষেধ। সারাদিন বন্ধ ঘরে তার দম আটকে আসে তার।সেই কবে সে শেষ খেলা খেলেছে খোলা মাঠে মুক্ত বাতাসে ..ভাবতে ভাবতে তার চোখ আদ্র হয়ে যায়।

জামালের মন খারাপের আরো কারণ আছে। শুধু আজই না অসুখটা হবার পর থেকে প্রায়ই তার মন ভীষণ রকমের খারাপ থাকে। শারীরিক কষ্ট ছাড়াও ছোট্ট মনে মানসিক কষ্ট ক্রমশ আরও বেশি করে দানা বেঁধে উঠছে।
ছোটবেলা থেকে যদিও সে মা ছাড়াই মানুষ ।বাবা সে তো থেকেও নেই। দাদীর কাছে কোন রকমে অনাদরে অবহেলায় বেড়ে ওঠা জীবন তার কিন্তু ইদানীং তার খুব মায়ের স্পর্শ পেতে ইচ্ছে করে মায়ের কাছে যেতে ইচ্ছে করে। মা কে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করে। মাকে সে স্বপ্নেও দেখে তবে মায়ের মুখটা তার কাছে স্পষ্ট নয় কেমন যেন আবছা আবছা ঘোলাটে ।কিছুতেই স্পষ্ট হয় না। মাকে কোনদিন দেখে নি বলে হয়তো এমনটা হয়।মায়ের একটা ছবিও নেই তার কাছে যে তাই দেখে মাকে কল্পনা করবে সে। আচ্ছা মা কি সত্যি হারিয়ে গেছে না-কি তার মা কোথাও লুকিয়ে আছে।অসুখের খবরটা কি তার মা জানেন? এমন কি হয় না একদিন চোর পুলিশ খেলার মত টুক করে পিছন থেকে এসে চমকে দেবে, মা। দেবে কি?

-আজ কেমন আছো জামাল?মুখে হাসি নেই কেন? মন খারাপ?

রুপালীর দিকে একবার তাকিয়েই জামাল মুখ ঘুরিয়ে নিল। এই নার্সটিকে তার খুব একটা পছন্দ নয়। কথাবার্তার ধরণ কেমন যেন রোবটিক।রস কষ নেই। মেপে মেপে কেটে কেটে কথা বলে।প্রয়োজনের অতিরিক্ত কথা একদমই বলে না। এক প্রশ্ন দুবার করলে বিরক্ত হয়। এজন্য অবশ্য ডাক্তার আঙ্কেলের কাছে প্রায় বকা খায় রূপালী আন্টি।জামাল জানে এখন যা বলছে এগুলো সব রুটিন ওয়ার্ক।
রূপালীর কথায় কোন উত্তর না দিয়ে শুধু মাথা নাড়ালো জামাল।
কিছু বুঝতে না পেরে রূপালী আবার বলল,
- শরীর কি বেশি খারাপ লাগছে? অন্য কোন সমস্যা ?

জামাল এবারও কোন উত্তর দিল না। কথা বলতে তার ভালো লাগছে না। মনে হচ্ছে এখান থেকে এই মুহুর্তে একছুটে বাইরে কোথাও চলে যায়।ভেসে বেড়ায় পাখির মত ওই নীল আকাশে কিন্তু তা সম্ভব না। আগে দুবার চেষ্ট করেছে এবং প্রতিবারই ধরা পড়ে গেছে সে।তার বাইরে যাবার খবরে ডাক্তার রুবায়েত রাগ করবেন। তিনি রেগে গেলে বকা দেন না ঠিকই তবে কথা বলেন না খুব একটা গম্ভীর হয়ে থাকেন। জামাল ডাক্তার রুবায়েতকে ভীষণ পছন্দ করে।ডাক্তার রুবায়েতও জামালকে ভালোবাসেন। সে ডাক্তার আঙ্কেলের গম্ভীর মুখ দেখতে চায় না।
আজকে জামালের শরীরে আবার যন্ত্রণাগুলো দ্বিগুণ বেগে ফিরে এসেছে। সত্যি সত্যি ভীষণ যন্ত্রণা হচ্ছে।কদিন বেশ একটু কম ছিল। কেন যে যন্ত্রণাগুলো ফিরে আসে বারবার। যেদিন বেশি যন্ত্রণা হয় সেদিন তার মাথায় উল্টাপাল্টা চিন্তা এসে জড় হয়। যন্ত্রণা হলে আজকাল সে আর কাঁদে না। দাঁতে দাঁত চেপে যন্ত্রণা সহ্য করার চেষ্টা করে ।যন্ত্রনা যখন বেশি হয় তখন সে মনে মনে আল্লাহকে ডাকে আর বলে আল্লাহ তুমি আমাকে তুলে নাও। আমি আর বাঁচতে চাই না।
এই অল্প সময়েই তার বেঁচে থাকার আকাঙ্খা আশ্চর্যজনক ভাবে হারিয়ে গেছে। জীবনের প্রতি কেমন যেন একটা বিতৃষ্ণা এসে ভর করেছে।
রূপালী কাজ গুছিয়ে এনেছে প্রায় এমন সময় হঠাৎ হন্তদন্ত হয়ে এক বৃদ্ধা জামালের সাত নম্বর কেবিনে প্রবেশ করল। সাথে আরেক বোরখা পড়া মহিলা ।তাদের দুই হাতে নানা জিনিসপত্র।
বৃদ্ধা মহিলাটি এদিক ওদিক তাকিয়ে বলল
- জামাল আমার জামাল কোথায়। ও জামাল? ভাইজান কোথায় তুমি? এটা সাত নম্বর কেবিন না?
- কি হচ্ছে কি?
সুফিয়া নার্স ধমকে উঠল তারপর কি মনে হতে চাপা গলায় বলল
-এটা হাসপাতাল, বাজার নয়। আস্তে কথা বলুন। কাকে চাই?
বয়স্ক মহিলা কাঁদো কাঁদো হয়ে বললেন
- জামাল এই হাসপাতালে আছে। ওর বাপের নাম শাহেদ কবির। খুঁজে পাচ্ছি না।
- কে হন আপনি ওর?
- আমি ওর দাদী।
-ও! এত দিনে ঘুম ভাঙলো আপনারদের তা কি খবর কতদিন হয়ে গেল কোন খোঁজ খবর নেই, কেন? রুবাইয়েত স্যার দেখা করতে বলেছেন আপনাদেরকে,খুব দরকার। যাওয়ার আগে অবশ্যই দেখা করে যাবেন। স্যার কিছু কথা বলবেন।
- মা আমি বুড়ো মানুষ।বলতে গেলে এক রকম অক্ষম। আমি বেশ কদিন আগেই খবর পেয়েছিলাম জামাল এখানে আছে । এই মেয়েকে ধরে বেন্ধে কত করে বলে তারপর এলাম।এ না এলে আমি আসতে পারতাম না ।পথঘাট চিনি না একা একা আসতে পারি না। আমার পেটের ছেলে মেয়েগুলো একটাও মানুষ না। কি আর বলবো। কিছু বলার নেই।
রুপালী জামালকে বলল
-চেন নাকি? ইনি তোমার দাদী?
জামালের কোন ভাবান্তর হলো না। সে এই মহিলা আর তার মেয়েকে দুচোখে দেখতে পারে না। হোক সে আপন দাদী আর ফুফু। তার স্মৃতি শক্তি ভালো। অতীতে তার উপর হওয়া অনাচার সে এখন ভুলে যায় নি।কখনও ভুলবে না।
দাদী জুনাইরা আর ফুফু ময়না আজ সত্যি সত্যি আন্তরিক। তারা এসে জামালের গায়ে মাথায় হাত বুলাতে লাগলো। রূপালী জামালের ওষুধের খোঁজ খবর নিতে নিতে আগন্তুকদের উদ্দেশ্যে বলল,
- ওর মার কোন খোঁজ পাওয়া গেল? ওর মাকে ওর খুব দরকার। কোথায় আছে সেই মহিলা।
-জানি নাগো বুবু। ওই বেটি তো কার না কার সাথে রঙ্গরসে ব্যস্ত ।তাকে আর কোথায় পাবো আমি? ওর পাপে তো ছেলেটার এই দশা। এমন খা......। রুপালির কটমটে চোখের দিকে তাকিয়ে জামালের দাদী বুঝতে পারলো ভুল হচ্ছে কোথাও আমতা আমতা করে সে কথা ঘুরিয়ে আহাজরি করল
-আহারে। আহারে আমার সাধের পোতা ছেলে রে। ..
-দেখুন কান্নাকাটি করলে আমি আপনাদের এখানে থাকতে দেবো না। যা কথা বলার ঝটপট বলুন। আর ফোন নাম্বার থাকলে দিয়ে যান। আর অবশ্যই যাবার আগে রুবাইত স্যারের সাথে দেখা করে যাবেন। উনি আর কিছুক্ষণের মধ্যে আসবেন।
-উনি কে? আমি তো উনাকে চিনি না। ও মা উনি কে?
রুপালির ফোনে ফোস এসেছে সে দ্রুত নিচে নেমে গেল।তার মায়ের শরীরটা আবার বেশি খারাপ হয়েছে কথা আর এগুলো না।

(২)
-তুলি আপু কেমন আছো? অনেকদিন পর!
- আছি এই তো। ভালোই।কেটে যাচ্ছে। তুমি কেমন আছো রোকেয়া?
মাস দুয়েক ডাক্তার রুবায়েতের নিকট আত্নীয়ার সেবা শুশ্রূষার কাজে নিয়োজিত ছিল তুলি।তিন দিন হল সেই রুগী মারা যাবার পর দু’দিন বিশ্রাম নিয়ে আবার হাসপাতালে ফিরে এসেছে সে।
কোন কোন রুগির সেবা করতে করতে তার প্রতি অন্যরকম একটা ভালোবাসা জন্মে যায়। ডাক্তার রুবাইয়েতের মরহুম আত্নীয়াও তেমনি একজন মহিলা ছিলেন।
অসাধারণ ভদ্র আর মার্জিত স্বভাবের ।
অসুস্থ হলে মানুষ মেজাজ হারায় কিন্তু শেষ দিন পর্যন্ত তিনি ব্যবহারে ছিলেন একই রকম শান্ত, নম্র ভদ্র। তুলিও বাড়তি কাজের চাপে কখনোই তার সাথে কটু ব্যবহার করে নি। অসীম ধৈর্য তার। এটা অবশ্য তুলির চরিত্রের একটা অন্যতম বৈশিষ্ট্য। সে কখনও কোন কিছুতে ধৈর্য হারায় না।শেষ পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যায়।
আধ ঘন্টার মধ্যে কাজ বুঝে নিয়ে সোজা জামালের কেবিনে চলে এসেছে সে।রুপালীর কাছ থেকে দায়িত্ব বুঝে নিতে হবে। সম্ভবত সে তার অসুস্থ মা কে দেখতে গ্রামে যাবে। নার্সের সল্পতার কারণে তুলিকে আজই জয়েন করতে হলো। না হলে আরও একদিন ছুটি ছিল।
ছেলেটির দিকে একঝলক তাকিয়ে চোখ আটকে গেল তুলির! কেমন যেন চেনা চেনা লাগছে।
অদ্ভুত তো!এমন মনে হচ্ছে কেন?
কি মায়া চেহারা বাচ্চাটার । আহা! এতটুকু বাচ্চার কি কঠিন অবস্থা।বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় যে এই ছেলেটি খুব বেশিদিন বাঁচবে না আর। অথচ কত কিছু করবার কত কি দেখবার ছিল ওর।জীবনের কিছুই দেখা হয় নি তার।
না আর কারো মায়ায় জড়াবে না তুলি।এরপর মায়ায় জড়ালে সে ঠিক অসুস্থ হয়ে পড়বে।সারাজীবন বঞ্চনা সয়ে সয়ে কারো একটু মিষ্টি কথায় বা হাসিতে সে খুব সহজে মায়ায় জড়িয়ে যায়।এক সময় তারা টুক করে পৃথিবী ছেড়ে চলেও যায়। এই পৃথিবীটা আসলে আজব জায়গা। এখানে মায়া মমতা বেশি থাকলে সমস্যা।
তুলির একটা ভয়ঙ্কর অতীত আছে।সেই অতীতে স্বামী সংসার সন্তান সবই ছিল একসময় । স্বামী যেদিন তাকে পাচারকারী হাতে তুলে দিলো সেদিনের মত অবাক সে আর কোন দিন হয় নি। এত ভালো মানুষটা হঠাৎ কিভাবে এত বদলে গেল নাকি সবটা তার ছিল অভিনয়। তাকে বেঁচে আর কতই বা টাকা পেয়েছিল?এত সহজে সব কিছু কীভাবে বদলে যায়? অনেক কাঠ খড় পুড়িয়ে তুলি যদিও স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পেরেছে কিন্তু ক‘জন মেয়ে মেয়ে পারে বেঁচে ফিরতে ওই পাপের পথ থেকে?
-তুমি কে? তোমার নাম কি?
মিষ্টি রিনঝিনি আওয়াজে চমকিত হল তুলি
-আমি? আমি তুলি? তোমায় দেখাশোনার দায়িত্বে আছি।
- রুপালী আন্টি? বলে জামাল মুখ ঘুরিয়ে নিল।
- একটু ব্যস্ত আছে। কেন আমাকে পছন্দ হয় নি? কি নাম তোমার?
জামাল মুখ না ঘুরিয়ে ই বলল
- জামাল।
- জামাল এখন তুমি কেমন আছো?
-ভালো না ... খুব ব্যথা।খুব কষ্ট।
-খুব ব্যথা? সেরে যাবে সোনা? সকালে কি খাওয়া হয়েছে? ঔষধ খেয়েছো?
-খেতে ইচ্ছে করে না। আচ্ছা তুমি তো বাইরে যাও,না ?
-হ্যাঁ যাই তো। তুমি কি বাইরে যেতে চাও?
-হ্যাঁ। বাইরে যেতে চাই। ঘুরতে চাই।খেলতে চাই। পাখির মত উড়তে চাই।
- বাড়িতে তোমার কে কে আছে ?
জামাল হঠাৎ চুপ করে গেল কোন কথা বলল না।প্রশ্নটা তার পছন্দ হয় নি।
- কি হলো? মন খারাপ হয়ে গেল? শরীর কি খুব খারাপ লাগছে?
- হ্যাঁ
- ক্যাডবেরি খাবে?
- কিছু ভালো লাগে না। কিছু খাবো না। একটু বাইরে যাবো । ওই যে ওখানে...
তুলির মনটা আদ্র হয়ে গেল। আহারে!
সে জামালের মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। ততক্ষণে দুপুরের খাবার চলে এসেছে। জামাল যখন বলল খাবে না। তুলি জামালকে ভালোবেসে বুঝিয়ে খাইয়ে দিল।কেন জানি জামাল চুপচাপ খেয়ে নিল। জামাল তার ছোট্ট জীবনে এমন আদর স্নেহ খুব একটা পায় নি। এই নার্সটিকে তার ভীষণ পছন্দ হয়েছে তার চোখ ভিজে এল। জামাল তার জন্য আনা আপেলের মধ্য থেকে একটি আপেল তুলিকে উপহার দিল। তুলি জামালের সরলতায় মুগ্ধ হল। এত মায়া কেন ছেলেটার চেহারায়?
খাবার ও ঔষধ খাইয়ে জামালের ঘুমানো পর্যন্ত তুলি কেবিনেই কাটালো। তার অন্য জায়গায় ডিউটি আছে একটু দেরি হয়ে গেলেও জামালের সঙ্গ তার ভালো লাগছে। কেন লাগছে কে জানে?
৩)
ডাক্তার রুবায়েত মনোযোগ দিয়ে কি একটা বইয়ের পাতা উল্টাচ্ছেন।হঠাৎ মাথা তুলে তুলিকে লক্ষ করে বললেন
- জামাল ছেলেটির দিকে একটু বেশি কেয়ার দিও।পারসোনালি বলছি। বুঝছো?
- আমি দেখছি স্যার সমস্যা নেই।
- এই পৃথিবীতে কিন্তু ওর কেউ নেই আবার সব আছে ?
-মানে?
- যা সত্যি তাই বললাম। ডাক্তার রুবায়েত বইয়ের পাতা উল্টাতে উল্টাতে বললেন।
- আসলে স্যার আমি আপনার কথা ঠিক বুঝতে পারলাম না। কেমন যেন রহস্যময়।
- জামালের কথা বলছি।
- সে তো বুঝতে পারছি।
- তাহলে শোন এই ছেলেটার জীবনে অন্যরকম গল্প আছে।গল্পটা অনেক করুন। জামাল আমার বড়ভাবীর বাবা বাড়ির দিকের আত্নীয়ার ছেলে। বয়স যখন এক বছর তখন ওর মা ওর বাবাকে ছেড়ে অন্য একজনের হাত ধরে ঘর ছাড়ে। বাবা আর সৎ মায়ের সংসারে অনাদর আর অবহেলায় মানুষ। কিছুদিন দাদীর কাছেও ছিল। শেষে বড় ভাবির বাসায় কাজের সহকারী হিসাবে যোগ দেয় গত বছর।তারপর আমি ওকে আমার বাসায় নিয়ে আসি।
- ওইটুকু একটা ছেলে কি মর্মান্তিক ঘটনা!
- অবাক হলে তো।
- না ঠিক অবাক নয়।এইটুকু ফুটফুটে একটা বাচ্চাকে রেখে ওর মা চলে গেল? পারলো?ছি! ভাবতে পারছি না আর আমি। কিভাবে পারে এসব?
-পৃথিবীতে কত কিছুই তো ঘটে যাহোক ওসব নিয়ে আমাদের না ভাবলেও চলবে। ছেলেটিকে এই শেষ কটা দিন কীভাবে ভালো রাখা যায় সেই চেষ্টাই আমাদের করতে হবে। একটু আনন্দ হাসি ভালোবাসার মধ্যে রাখতে হবে বুঝতে পারছো নিশ্চয় কি বলতে চাইছি।
তুলি কোন কথা না বলে ডাক্তার রুবাইয়েতের কথা মন দিয়ে শুনছে
ডাক্তার রুবাইয়ে আরও যোগ করলেন
- আমি চাই ছেলেটি তোমার নিবিড় তত্ত্বাবধানে থাকুক। যে কটা দিন বাঁচে মাতৃ স্নেহটুকু পাক ।
ও খুব মা মা করে। মাকে কোনদিন কাছে পায় নি তো! মাকে খুব মিস করে। তুমি কি আমাকে এই ব্যপারে একটু সাহায্য করবে না?
-স্যার আমি মা!মাতৃ স্নেহ!! তা কি করে হয়?
-ঠিক মা না।মা হতে বলছি না। মায়ের বিকল্প নেই।আমি জানি।ছেলেটিকে মায়ের মত ভালোবাসা দিয়ে যত্ন করবে সত্যি কথা বলতে কি আসলে এই ছেলেটির প্রতি আমি বিশেষ কারণে অতিশয় কৃতজ্ঞ সেই ঘটনা অন্য আরেকদিন বলবো।
-আমি সবাইকে যত্ন করি স্যার কিন্তু কাউকে তো বেঁধে রাখতে পারি না। আমার সে ক্ষমতা নেই।
অকারণে চোখ জলে ভিজে উঠলো তুলির।
-ডোন্ট বি ইমোশনাল তুলি এটাই বাস্তব আমাদের এখানে বেশির ভাগ রুগী ক্যান্সারের। মৃত্যুও তাই বেশি যা হোক তবু একজন মানুষ তার শেষ সময়টা যেন একটু ভালো কাটায় সেই চেষ্টাটুকু আমরা করতে দোষ কোথায়? ক‘দিনের তো জীবন। একদিন তো আমরাও মারা যাবো তাই না?
- স্যার এবারের মত আমাকে অন্যত্র দিলে হয় না? আসলে আজকাল আমি যেন কেমন বেশি বেশি ইমোশন্যালি... বাস্তবতা হচ্ছে এত মৃত্যু এত অনাকাঙ্খিত ঘটনা এখন আর এসব আমার ভালো লাগে না।
-আচ্ছা এই কাজটা শেষে তোমাকে দীর্ঘ একটা ছুটি পাওয়া রইলো। কথা দিলাম।
- স্যার প্লিজ!
- তোমার উপর আমার অনেক ভরসা তুলি! দয়া করে না করো না।
(৪)
তুলির সাথে জামালের আন্তরিকতা জমতে সময় লাগলো না। তবু মা তো মা ই তার কি কোন বিকল্প হয়?
জামাল বেঁচে ছিল আরও ছয় মাস। জামালের মৃত্যুর আগে থেকেই তুলির মধ্যে কেমন যেন একটা পরিবর্তন লক্ষ করা গেল সে কারো সাথে প্রয়োজন ছাড়া কথা বলে না । হাসে না সে শুধু জামালে সাথেই থাকতে পছন্দ করে তার সাথে হাসে গান গায় আর কথা বলে।এর বাইরে পৃথিবীতে বুঝি আর কিছু নেই।
দিনের বেশির ভাগসময় তার চোখ অশ্রুতে টলমল করে।মনের কোনে যেন কিসের ব্যথা। সর্বদা স্বজন হারানোর ভয় চোখে মুখে ।
ডাক্তার রুবায়েতও তুলির এরকম ব্যবহারে চিন্তিত হয়ে পড়লেন। নার্সিং পেশায় এত ইমোশন বিপদ ডেকে আনতে পারে।
তিনি তুলিকে ডেকে কয়েকবার জিজ্ঞেস করলেন ,ব্যক্তিগতভাবে তার কোন সমস্যা হচ্ছে কি-না?
তুলি কোন উত্তর না দিয়ে সরাসরি এড়িয়ে গেছে সে সব প্রসঙ্গ।
জামাল মারা গেল তিরিশে বৈশাখ। তুলির কোলে তখন ঘুমন্ত জামাল মাথা রেখে ঘুমিয়ে আছে এই দৃশ্য দেখে কে বলবে এই ছেলেটি আর কোন দিনও জাগবে না। জামাল যে মারা গেছে তুলি তা বুঝতে পেরেছে কি-না কে জানে ? স্বার্নালী যখন কিছু অস্বাভাবিকতা দেখে ডাক্তার রুবায়েতকে খবর দিল তখন এই স্বর্গীয় দৃশ্য দেখে সবার চোখে পানি চলে এলো । তুলি তখনও জামালকে ঘুম পাড়ানি গান শোনাচ্ছে সবাই কতবার ডাকলো। তুলির যেন সেই ঘোর আর কাটে না। নার্স তুলি যেন অন্য জগতের বাসিন্দা।
না সেই ঘোর আর কাটে নি তুলির। জামালের বাবা দাদী সৎমা এলো লাশ নিতে । তুলি তাদের ফিরিয়ে দিলো। কাউকে দিলো না সেই মৃত লাশের অধিকার। জামালের দাদীর স্বীকারোক্তিতে জানা গেল তুলিই জামালের মা কিন্তু..... । জামালের বয়স যখন এক বছর তখন ঘুরতে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে তুলিকে মোটাটাকার বিনিময়ে পাচারকারীর হাতে তুলে দেয় জামালের বাবা।

কোন কোন মানুষের অতীত হঠাৎ ভয়ংকর ভাবে ফিরে আসে।কেউ সেই ঝড় সামলায় সুকৌশলে কেউ সামলাতে পারে না। তুলি জেনেছিল কি-না জানা যায় নি তবে তুলি চিরদিনের তরে সম্ভবত এজীবন থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নিয়েছে।

আর তাই আজ দুবছর স্বরূপপুর মেন্টাল হাসপাতালের পেশেন্ট সে।তার জ্ঞান বোধ আজ অবধি আর ফেরে নি। ফিরলে হয়তো জানতে পারতো জামাল আসলে তারই ছেলে ছিল কিম্বা হয়তো জেনে গিয়েছিল কোন না কোন ভাবে। কে জানে?
সমাপ্ত

© রফিকুল ইসলাম ইসিয়াক
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই জুলাই, ২০২২ বিকাল ৪:৫৩
১৬টি মন্তব্য ১৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

গৃহবধূ থেকে প্রধানমন্ত্রী; অভিভাবক শূন্য হলো বাংলাদেশ |

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ৩০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:১২


খালেদা জিয়া। ইস্পাতসম বজ্রকঠিন দেশপ্রেমের নাম খালেদা জিয়া। যিনি ভালো বেসেছেন দেশকে, নিজের জীবনের চেয়েও দেশকে ভালো বেসেছেন। দেশের বাহিরে যার নেই কোন লুকানো সম্পদ। নেই বাড়ি, গাড়ি অথবা... ...বাকিটুকু পড়ুন

২০২৫ সালের সেরা মশকরা কোনটি

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ৩০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:১৪



ইয়ে মানে বছর শেষ। ২০২৫ সাল বিদায় নিচ্ছে । তা আপনার কাছে ২০২৫ সালের সেরা মশকরা কোনটি ?


আমার কাছে সেরা মশকরা হচ্ছে- এনসিপির জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে নির্বাচনী সমঝোতা করা।

আরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বেগম খালেদা জিয়াঃ এক দৃঢ়চেতা, সাহসী অধ্যায়ের সমাপ্তি

লিখেছেন সামহোয়্যারইন ব্লগ টিম, ৩০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১:৩৭



প্রিয় ব্লগার,
আমরা অত্যন্ত দুঃখের সাথে জানাচ্ছি যে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপার্সন এবং বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব বেগম খালেদা জিয়া আর আমাদের মাঝে নেই, ইন্না লিল্লাহি ওয়া... ...বাকিটুকু পড়ুন

খালেদা জিয়ার মৃত্যু রাজনীতির মাঠে বিরাট শূন্যতা

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ৩০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৮:১৯

 
বাংলাদেশের রাজনীতিতে বেগম খালেদা জিয়া এক উল্লেখযোগ্য চরিত্র। সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ডের পর বিএনপির টালমাটাল পরিস্থিতিতে তিনি দলটির হাল ধরেন। সেনানিবাসে গড়ে উঠা দলটাকে রাজপথে বেড়ে উঠতে গৃহবধূ থেকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

খালেদা জিয়া মরিয়া প্রমাণ করিলেন , তিনি মরেন নাই ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ৩০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৮:৩৮


বেগম খালেদা জিয়া মারা গেছেন। এই খবরে জাতি শোকাহত। কিন্তু একদল মানুষ আছে যারা উনার মৃত্যুর পরেও নিজেদের রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক স্বার্থে তার মৃত্যু নিয়ে ঘৃণ্য মিথ্যাচার চালিয়ে যাচ্ছে। বদনা... ...বাকিটুকু পড়ুন

×