এই ঘটনাটি অনেকদিন আগের ।তখন আমরা শের শাহ শুরী রোডের বাসায় বছর দুই হল এসে উঠেছি এর আগে আমরা সেকেন্ড ক্যাপিটাল এ থাকতাম ।তার আগে থাকতাম বাংলা মটরে।
শের শাহ শুরি রোডের নতুন জায়গায় প্রথম প্রথম আমাদের প্রতিবেশিরা প্রায় সবাই বিহারী ছিল।সময়ের সাথে সাথে বিহারীরা অবশ্য এলাকা ছাড়তে শুরু করেছিল নানাবিধ কারণে।এদের মধ্যে কেউ কেউ বাড়ি বেঁচে দিয়ে সপরিবারে পাকিস্তান অথবা অন্য কোথাও চলে যাচ্ছিলো তখন। বছর কয়েক পরে আমাদের এলাকাটি প্রায় বিহারি শূন্য হয়ে বাঙালীদের জন্য বসবাস যোগ্য হয়ে উঠেছিল বেশ তাড়াতাড়িই।
তিন শতকের ছোট বাড়িগুলোতে তখন নিত্য নতুন লোকজনের আনাগোনা চলছে। দ্রুত পট পরিবর্তন হচ্ছে, কোন কোন বাড়ি রাজনৈতিক কানেকশনের সূত্রে ভাড়াটিয়ারাই দখলদার হয়ে বাড়ির মালিক বনে যাচ্ছিল ,কিছুটা অস্থির সময় ছিল তখন সেটা বলা বাহুল্য । বৈধ অবৈধ বহু লোকের সমাগমে বিহারী পাড়া দিনে দিনে আদর্শ বাঙালি পাড়া হয়ে উঠলো। এরকম এক সময়ে আমাদের বাসার কয়েক বাসা পরে আমাদের পাড়ায় এক নতুন প্রতিবেশি এলো।তারা যে বেশ অবস্থাপন্ন আর অভিজাত তা তাদের আচার-আচরণ আর আনুষাঙ্গিক কর্মকান্ডে প্রকাশ পেল প্রথমদিনেই। তাদের নতুন মডেলের গাড়ি আর ফার্ণিচারগুলো দেখে আমরা বন্ধুরা মিলে নানা কমেন্ট করলাম।স্বাভাবিকভাবে এই সব নিয়ে আমার বন্ধু মহল ভীষণ উত্তেজিতও ছিল। খেলাধূলা করার জন্য নিশ্চয় কিছু নতুন বন্ধু পাওয়া যাবে এবার কারণ নতুন বাড়িতে আমাদের সমবয়সী দুটি ছেলের আগমন দৃষ্টি এড়ায়নি কারোই আর সেই সাথে চমৎকার কিছু বান্ধবীও জুটবে বলে আশা করছিলাম।
এক ফাঁকে আমাদের সবারই দেখা হয়ে গেছে নতুন আসা মেয়ে তিনটিকে,দেখতে ওরা যথেষ্ট সুন্দরী একথা অনস্বীকার্য। মুন্না তো দিওয়ানাই হয়ে উঠলো। সে বলল
- সে ঠিক করেছে ওসব বন্ধু বান্ধবী পাতিয়ে তার পোষাবে না সে এদের তিনজনের মধ্যে যে কোন একজনের সাথে সরাসরি প্রেম করবে।বড়লোক বাড়ির জামাই হলে কি কি সুবিধা তার বর্ণনায় উঠে এলো,আমরা অবাক হলাম সব শুনে। মনে মনে ভাবলাম এতো কিছু ও জানে কিভাবে?
আমাদের অবশ্য শোনা কথা ও নাকি কয়েকটি প্রেমও করেছে ইতিমধ্যে যদিও কোন প্রেমিকার দেখা আমরা পাই নি কোনদিনই সম্ভবত সব চরিত্রগুলিই ছিল কাল্পনিক রঙে আঁকা।
ওর চারিত্রিক গুণাবলির জন্য ওকে আমরা নায়ক রাজ রাজ্জাক বলে ডাকতাম। ওর স্টাইলিস্ট মুভমেন্টের সত্যি অনবদ্য ছিল।গুন্ডা আর রংবাজ মুভি তখন হিট সেই সাথে মুভিগুলোর গানগুলো তখন দারুণ চলছে রেডিওতে। আমরা হলে ছবি না দেখলেও শ্যমলী আনন্দ ছন্দ সিনেমা হল ঘুরে রাজ্জাক কবরী,ববিতার পোস্টার দেখে মজা নিতে ভুল করতাম না আর রাজ্জাক আংকেল সহ আরও অনেক অভিনেতা অভিনেত্রী কাজের সূত্রে আমাদের বাসায় এলে মুন্না তো আমাদের বাসা থেকে নড়তেই চাইতো না।আমি অবশ্য এজন্য মুন্নার কাছ থেকে বিশেষ কিছু সুবিধা আদায় করতাম ফাঁকতালে। যাহোক প্রসঙ্গে ফিরে আসি।
যেহেতু নতুন প্রতিবেশি বাড়িতে তিনজনকে দেখা গেল আমাদের বয়সী আমরাও সময় সুযোগ বুঝে ঝটপট ভাব জমিয়ে ফেললাম তাদের সাথে কে জানে ওরা যদি পরে আর ভাব করতে রাজি না হয় এই আশঙ্কায়। খুব দ্রুত সম্পর্ক জমে গেল অবশ্য ।কত শত গল্প কত হাসি মজা সে এক দারুণ সময় কাটতে লাগলো।
কার কি খেলা পছন্দ, টিভিতে দেখানো শো গুলোর মধ্যে কে কোন শো( কার্টুন, সিক্স মিলিয়ন ডলার ম্যান,কোজাক, বায়োনিক ওম্যান, দ্যা সেইন্ট,টারজান.....)গুলোর ভক্ত কার কি কি হবি,কোন কোন সেরা লেখকের বই কে কে পড়েছে , কে কোন স্কুলে পড়ে। রোল কত ইত্যাদি ইত্যাদি।
তো এসব বাহাস মহা ধুমসে চলল বেশ কয়েকদিন
হঠাৎ একদিন দেখি সেই বাড়ির সামনে অপূর্ব রূপবতী এক মেয়ে দাড়িয়ে আছে বয়সে একটু বড় যদিও কিন্তু দেখতে ঠিক যেন সুচিত্রা সেন।আহ! অবিকল সেই মুখ সেই হাসি সেই চাহনি। সত্যি কি মহানায়িকা উঠে এলেন আমাদের পাড়ায়? এতটাই তার রূপের ছটা যে তার আগুনে যে কেউ ঝলসাতে বাধ্য। পাড়ার বড় ভাইদের মধ্যে মৃদু গুঞ্জন উঠলো। বাহির পাড়ার ছেলে ছোকরাদের উৎপাতও বাড়তে লাগলো ক্রমশ। সবাই সুচিত্রা সেনকে পেতে চায়।একটু কথা বলা,লুকিয়ে লুকিয়ে দেখা, চিঠি পাঠানোর জন্য সে কি অস্থিরতা। আমি তো জানি চিঠি মানেই প্রেম পিরীতি। হাত খরচার টাকা পাওয়া।বিনা পুঁজির ব্যবসা। ঠিক করলাম মাছের তেলে মাছ ভাজবো।আসলে কার কথা কি বলবো আমিই তো ঝলসে গেলাম সোনালীর রূপের ঝলকে।মুন্নাকে বললামও সে কথা।মুন্না আমাকে বলল দেখ অপু, ওটাকে আমি বুকিং দিয়ে রেখেছি। ওর দিকে তাকালে তোর সাথে আমার জন্মের মত আড়ি হয়ে যাবে কিন্তু তুই এখনও বাচ্চা বলা যায় দুধভাত। অতএব চুপ যা।
ইশ বললেই হল আমিও কম যাই না বললাম,
- সোনালী শুধু আমার।
- ওর নাম সোনালী ?
- অবাক হচ্ছিস যে বড়?
- নাম জানলি কি করে?
- আরে ও তো আমাদের আত্নীয়! জায়গা মতো একটা গুল ঝেড়ে দিলাম।
- কি?
- মা বলছিল ও যদি বয়সে আমার থেকে কিছু বড় না হতো তবে আমার সাথে ওর বিয়েটা দিয়ে দিত তবে অবশ্যই আমার পড়াশোনা শেষ হলে।মুন্না কেমন যেন মিইয়ে গেল।আমি সোনালীর আশপাশের ঘুরঘুর করতে লাগলাম নতুন এ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে হাতে কিছু নগদ প্রাপ্তি হয়েছে বড় ভাইদের আশীর্বাদে। তো একদিন সময় সুযোগ বুঝে ঝেড়ে কাশলাম যা হয় হোক ভেবে।
- সোনালী আপু আমি আপনাকে একটা কথা বলতে চাই।আশা করি রাগ করবেন না।
- কি কথা?
- আই লাভ ইউ ভেরি মাচ।দাঁত কেলিয়ে সাহস করে বলে দিলাম।
- আই লাভ ইউ মানে জানিস?
- হু জানি তো,জানবো না কেন?
- বলতো কি?
- আমি তোমাকে ভালোবাসি, বহুত বহুত পেয়ার করতি হু মে তুমকো মেরি জান।উর্দুতেও বললাম।
তারপর হঠাৎ এক ঝটকা এলো যেন, সপাটে বাম গালে চড় সহ ভৎসনা
-বেরো এখন থেকে ইচড়ে পাকা বেয়াদব ছেলে। তোর থেকে যে আমি বয়সে বড় সেটুকু জ্ঞান নেই তোর? আসছে উনি প্রেম করতে। ভাগ,ভাগ এখান থেকে আর যদি কোনদিন আমার আশেপাশে ঘুরঘুর করতে দেখি তখন খবর আছে।সোজা বাড়িতে নালিশ জানাবো।
আমি কাঁদতে কাঁদতে বের হয়ে এলাম।আসলে চড়টা ভীষণ জোরে মেরেছিল যে! মেয়েরা এত নিষ্ঠুর কি করে হয় কে জানে। পথে দু একজন জিজ্ঞেস করলো কাঁদছি কেন? কি হয়েছে?
কিছু একটা বলতে গিয়ে ভাবলাম তাই তো একটু আগের ঘটনা তো কাউকে বলবার মত নয়।লজ্জা! লজ্জা!!
আমি চোখের জল মুছে বললাম
- দাঁতে ভীষণ ব্যথা করছে হঠাৎ ।
- ওমা তাই তো তোমার মুখটাও ফুলে গেছে দেখছি।
বাহ! পাঞ্চ হিট হয়েছে দেখছি আমিও মনের সুখে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ির পথ ধরলাম দাঁত ব্যথার প্রত্যক্ষ প্রমান নিয়ে । বাড়ি গিয়ে অবশ্য এত কান্না কাটি করা যাবে না আসল গুমোর ফাঁস হয়ে যাবে।সিদ্ধান্ত বদলালাম বাড়ি না গিয়ে তাড়া খাওয়া সারমেয়র মত মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরী স্কুলের পিছনের মাঠের এককোনায় ঝিম মেরে বসে রইলাম অনেকটা ক্ষণ।কারণ বাম গালে চড়ের দাগের উপযুক্ত ব্যাখ্যা দাড় করাতে না পারলে,বাসায় গেলে আমার আজ খবর আছে। মনে মনে ভাবলাম এর প্রতিশোধ আমি নেবই নেব কিন্তু কিভাবে?
© রফিকুল ইসলাম ইসিয়াক
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই জুলাই, ২০২২ রাত ৮:১৩

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



