আমার ছেলেবেলার বন্ধুদের মধ্যে চঞ্চল ছিল আমার খুব কাছের একজন।ওর সাথে ই আমার বেশির ভাগ ওঠা বসা,শুধু ওঠাবসা নয়, খেলাধূলা, মারামারি, দুষ্টুমি সবই চলতো সমানতালে। ওর সব ভালো ছিল শুধু একটাই দোষ ছিল, সেটা হলো ওর হিংসুটে মনোভাব। ভীষণ হিংসুটে ছিল ও। আমার সাথে অবশ্য সবসময় হিংসা না করলেও,কখনও কখনও করতো বৈকি।
সেদিন কি একটা উৎসবের জন্য স্কুল ছুটি ছিল। আমি পড়াশোনা শেষ করে সকাল দশটার দিকে গেলাম চঞ্চলদের বাসায়, উদ্দেশ্য ওর সাথে ক্যারাম খেলবো।
আমাকে উঠানে দেখেই চঞ্চলের মা খালাম্মা ইশারায় ডাকলেন,
আমি ভাবলাম কিছু খেতে দিবেন হয়তো তাই ডাকছেন।বেশ খুশি মনে এগোলাম। খালাম্মার রান্নার হাত দারুণ ছিল আর তার থেকে মাঝে মাঝে আমার জন্যও বরাদ্দ হতো। তবে আজ সেসব দিকে না গিয়ে বেশ কাটা কাটা স্বরে বললেন
- ও এখন বাইরে যাবে না অপু।পারসোনাল কাজে ব্যস্ত আছে ।ওকে তুমি এখন বিরক্ত করো না। তারচেয়ে ভালো হয় বরং ওবেলায় এসো। এখন বাড়ি যাও।
আমি খালাম্মার কথা আমলে না নিয়ে কৌতুহলঃবশত চঞ্চলের ঘরে উঁকি দিলাম। পড়াশোনার চাপ নেই আপাতত তাহলে কি এমন রাজকার্য করছে যে খেলতে পারবে না সে।জানালা দিয়ে তাকাতে ই দেখি চঞ্চলের হাতে একটা গল্পের বই। ও সেই বইটা পড়ছে আর খিলখিল করে হাসছে । কি পড়ছে কে জানে? আমি চুপিচুপি ওর ঘরে ঢুকলাম।
এই কিছু দিন আগে ও রিডিং পড়তে পারতো না,এখন বেশ উন্নতি করছে।তখন খালাম্মা আমাকে প্রায় বলতেন
- শোন অপূর্ব তুমি রোজ সময় করে আমাদের বাসায় আসবে? আসবে কিন্তু।
- কেন খালাম্মা?
- তুমি তো ভালো রিডিং পড়ো চঞ্চলকে একটি রিডিং পড়তে সাহায্য করবে।তুমি না ওর বন্ধু।
- জ্বী।
- তুমি দেখিয়ে দিলে ও রিডিং পড়া তাড়াতাড়ি শিখতে পারবে ।
তো সেই দিন থেকে চঞ্চলদের বাসায় আমার অগাধ যাতায়াত শুরু হলো।
হিসাব করলে আমিই চঞ্চলের গুরু মশাই । তো সেই গুরু মশাইয়ের এমন অমর্যাদা!মনে পড়ে গেল সেই বিখ্যাত প্রবাদ বাক্য "কাজের বেলায় কাজী কাজ ফুরালে পাঁজী "।
স্বাভাবিক ভাবে ই খালাম্মার এমন ব্যবহারে আমার আঁতে ঘা লাগলো।
এদিকে খালাম্মার কথা অমান্য করে চঞ্চলের রুমে ঢুকতেই চঞ্চল বইটাকে লুকাতে চাইলো তখন আমার জেদ আরও বেশি চড়ে গেল।
আমি বললাম,
-দেখ চঞ্চল আজকাল তোর দেখি খুব দেমাগ হয়েছে।হঠাৎ এমন বাক্যবানে সে বেশ হকচকিয়ে গেল। আমিও বুঝলাম বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে তাই গলা নামিয়ে মধুর স্বরে জানতে চাইলাম
- কি বই পড়ছিস?
কিন্তু চঞ্চল আমাকে পাত্তা না দিয়ে বরং বেশ বিরক্ত হয়ে তাকালো। আমি সে সব উপেক্ষা করে বইয়ের দিকে হাত বাড়ালাম।
-দেখি দেখি কি এমন ঘোড়ার মাথা বই যা পড়লে শুধু হাসি পায়। দেখি তো....
আমি হাত বাড়িয়ে বই নিতে যেতেই চঞ্চল তারস্বরে চেঁচিয়ে উঠলো
- মা অপু আমাকে মারছে।
সাথে সাথে খালাম্মা বলে উঠলো,
অপু তোমাকে না বললাম ওকে বিরক্ত করা যাবে না কেন ওকে বিরক্ত করছো। এখন তুমি যাও তো যাও। পরে এসো।
ভীষণ অপমানিত বোধ করলাম। তবে মনে মনে ঠিক করলাম আমাকে জানতেই হবে ওই বইতে কি আছে যা পড়লে হাসি আর থামানো যায় না।
কথায় আছে সোজা আঙ্গুলে ঘি না উঠলে আঙ্গুল একটু বাঁকাতেই হয়।
আমি বিকালে আবার গেলাম ওদের বাসায়।গিয়ে দেখি দরজা খোলাই আছে। চঞ্চল বিছানায় ঘুমোচ্ছে। আমি যখনকার কথা বলছি তখন ঢাকাতে আমাদের এলাকা অমন ই ছিল।চোরের তেমন উপদ্রব ছিল না বললেই চলে।
যাহোক ঘরে ঢুকে দেখি চঞ্চলের মাথার কাছে সেই বইটা। বইয়ের নামঃ বাছাই করা হাসির গল্প সংকলন।
আমি সুযোগ মত আস্তে করে বইটা নিজের আয়ত্বে নিলাম।সুকৌশলে ঝটপট সোয়েটারের নীচে লুকিয়ে ফেললাম।তারপর একছুটে বাসায় এসে গোগ্রাসে গিলতে লাগলাম আর হো হো করে হাঁসতে লাগলাম।সত্যি বেশ মজার ছিল বইটি। আর গল্পের বই পড়া এত মজার সেটাও জানা ছিল না এর আগে। সর্বোপরি নতুন একটা দিকও সহসা উন্মোচিত হলো আমার জীবনে।
পরদিন দেখি চঞ্চল মনমরা হয়ে খেলতে এসেছে।আমি তো জানি ওর সমস্যাটা কোথায়। কিন্তু এমন স্বাভাবিক ব্যবহার করলাম যেন কিছু ই জানি না। ওকে স্বান্তনাও দিলাম। চোরের গুষ্টির শাপ শাপান্তর করতেও কম করলাম না।পরে অবশ্য কৌশলে বইটা ওর ঘরে পৌঁছে দিয়েছিলাম ঠিক ই। সেও আরেক মজার ঘটনা। আজ থাক অন্য দিন করা যাবে আজ এ পর্যন্ত ই...
© রফিকুল ইসলাম ইসিয়াক
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই মে, ২০২৩ সকাল ১১:৫৭