সোনাবানের প্রসব বেদনা। স্বাভাবিকভাবে সন্তান ভুমিষ্ট হচ্ছে না। আকাঙ্কিত সন্তান তাদের, দীর্ঘ দিনের চাওয়া পাওয়ার নতুন সওগাত ঘরে তুলবে, সহজ সরল পদ্ধতি ব্যর্থ। ডাঃ জিসি বোসের (গাইনী বিশেষজ্ঞ) সিদ্ধান্তে সিজার হল, সুন্দর ফুটফুটে এক ছেলে সন্তান পৃথিবীর মুখ দেখলো, আদরের নাম শান্ত। সোনাবানের সন্তান হোক এটা কিন্তু অনেকে চায়নি। সোনাবানের সন্তান হলে অনেকের অংশীদারিত্ব কমে যাবে। ভিটামাটি ভাগাভাগিতে অনেকের অংশ কমে যাবে। দিনে দিনে নিঃশেষ করতে পারবে সোনাবানের পরিবার। অনেকের সাধ পূর্ণ হলো না। মাতৃগর্ভে সোনাবানের সন্তানের মৃত্যু হোক এ কামনা ছিল অনেকের। কিন্তু সবার মুখে ছাই ফেললো ডাঃ জি,সি, বোস। সিজার না হলে শান্ত পৃথিবীর মুখ দেখতো না।
আদরের সন্তান ধীরে ধীরে বড় হতে লাগলো। পারিপাশ্বিকতা, কুচক্রীদের লোলুপ দৃষ্টি, ষড়যন্ত্র, রাজনৈতিক অস্থিরতা সব কিছুতে শান্ত হয়ে উঠলো অশান্ত। সন্ত্রাশী। মানব কল্যাণে কাঙ্খিত সোনালী ফসল আজ মানুষের গলার ফাঁদ। সোনাবান যে শান্তকে চেয়েছিল; তাকে নিয়ে যে স্বপ্ন ছিল তা পূর্ণ হল না। কুচক্রীদের ধারণা এ সন্তান পৃথিবীর মুখ না দেখাই ভাল ছিল। শান্ত মাতৃগর্ভেই মারা যেত। দোষ গ্রাম্য দাই, গ্রাম ডাক্তার কারো নয়, তারা চেষ্টা করেও শান্তকে পৃথিবীর আলো দেখাতে পারেনি। যত দোষ ঐ ডাঃ জি.সি বোসের। সে সিজার না করলে শান্ত আসতো না। ও ব্যাটাই সব অশান্তির মূল।
১৯৭১ সাল। স্বাধীনতা যুদ্ধ। মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মত্যাগ, মা বোনের সতীত্ব হরণ। কুচক্রীদের ষড়যন্ত্র। স্বাধীনতার সুর্য্য উদিত হচ্ছে না। ত্রিশ লক্ষ মানুষের রক্ত ঝরলো, তবু যেন সন্তান ভূমিষ্ঠ হচ্ছে না। এগিয়ে এলো বন্ধু দেশ ভারত। জিসি বোসের মত সিজারিয়ান বেবী উপহার দিল পৃথিবীতে। নতুন দেশ, বাংলাদেশ। সবার কাঙ্খিত সোনার বাংলা। সোনার বাংলায় আজ হাহাকার। রাজনৈতিক অস্থিরতা, সন্ত্রাস, রাজনৈতিক হত্যা, ক্ষমতার লোভ, গণতন্ত্রের নামাবলি পরে তাকে কবর দেওয়া হচ্ছে। শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাস। মিল কলকারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ভূমিহীনদের সংখ্যা দিনে দিনে বেড়ে যাচ্ছে। কুচক্রীদের ষড়যন্ত্র দেশকে ঠেলে দিচ্ছে গৃহ যুদ্ধের দিকে। মানুষ শান্তিতে ঘুমাতে পারছে না। মুক্তিযোদ্ধাদের স্বপ্নের দেশে আজ অশান্ত, ধর্ষণ আর গণহত্যা। রক্ত এখনো ঝরছে। যে স্বপ্ন সাধ নিয়ে জন্ম হয়েছিল বাংলাদেশের, আজ তা মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে। কুচক্রীরা সুযোগ নিচ্ছে, স্বাধীনতার পরাজিত সৈনিক বারে বারে সুযোগ খুজছে। বাংলাদেশের জন্ম, দায়ী মুক্তিযোদ্ধারা, স্বাধীনতাকামী মানুষ নয়, দায়ী ভারত। ভারত সিজার করেছিল, জন্ম দিয়েছিল নতুন দেশ। জিসি বোসের মত দোষ ঘাড়ে নিতে হলো তাকে।
কিন্তু কেন? ভারত প্রতিবেশী দেশ। বাংলাদেশের সীমান্ত জুড়ে আছে ভারত। সেই সীমানার এক ইঞ্চিতে কমতি হয়নি বাংলাদেশের। বারে বারে বলা হচ্ছে স্বাধীনতা স্বার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য সজাগ থাকতে হবে। স্বাধীনতার ৩৮ বছরে একবারও কি ভারত বাংলাদেশকে আক্রমন করেছে বা তাদের অংগ রাজ্য বলে দাবী করেছে? ভারতের সাথে হানাহানি পাকিস্তানের, তাতে কি আমরা অখুশী? হতেও পারে। ভারত শ্রীলংকা ক্রিকেট খেলায় ভারত পরাজিত হলে পাকিস্তানের পতাকা উড়ে বাংলাদেশের আকাশে, ভারত পাকিস্তান খেলা হলে আমরা পাকিস্তানের পক্ষে দাড়াই। গরুর গোস কিনে রাখি পাস্তিান জিতলে খাব। কিন্তু গরুর গোসটা ভারতের তা খেয়াল নেই, খেয়াল থাকে না পাকের সামগ্রী পিয়াজ লবণ তাও ভারতের, যারে দেখতে নারী তার চলন বাকা, ভাবটা তদ্রুপ।
আসলে কথাটা হলো পাকিস্তান প্রীতি। স্বাধীনতার সাধ যদি মানুষকে দেওয়া যেত তাহলে এমনটা হতো না। ভারতের প্রতি যে কেমন বিদ্বেষ তা বোঝা যায় একজন বসের কথায়। বললেন “আমি কখনো বিদেশী জিনিষ ব্যবহার করি না”। আমি জবাবে বললাম বস, আপনার গাড়ীটাতো বিদেশী। তিনি বললেন “ওটাতো জাপানী”। আমি বললাম “আপনার সার্ট প্যান্ট খুব সুন্দর, ওটা কি বাংলাদেশের?” তিনি বললেন, “না” ওটা থাইল্যান্ডের, খুব সুন্দর সুতা; পরে আরাম আছে”। আমি বললাম “বস আপনি যে বললেন, আমি বিদেশী জিনিষ ব্যবহার করি না”। তিনি আমাকে বুঝান, “দেখেন মোল্যা, আমি যখন বাজারে যাই, গরুর গোস কিনি, জিজ্ঞাসা করি ওটা ভারতের গরু কিনা, পিয়াজ, লবন, ডিম, চিনি আগেই জেনে নিই”। ভারতের হলে কিনবোই না। আঙ্গুর কমলা ভারত থেকে আসে বলেই আমি বা আমার পরিবারের কাউকে এগুলো খেতে দেই না। এতক্ষণে বুঝলাম বিদেশী জিনিষ বলতে ভারতীয় জিনিষ তিনি বোঝাচ্ছেন। তিনি দুঃখ করে বললেন ভারতের মাল বাজারে ভর্তি, দেশীয় শিল্প শেষ, ভারতীয় নগ্ন ছবি দেশের ছেলে-মেয়েদের নষ্ট করছে। আমি বললাম, “বস, এগুলো কি ভারতের মানুষ এসে আমাদের দেশে পৌঁছে দিচ্ছে? আপনি কি কখনো দেখেছেন ভারতের মানুষ মাথায় করে তাদের জিনিষ এদেশে আনছে? না আমাদের দেশের মানুষ মাথায় করে ঐ দেশের জিনিষ আনছে? আমরা আনছি। দোষটা কিন্তু আমাদের। আপনি লেখাপড়া করলেন, ভাল ভাল বই কিন্তু কিনেছেন ভারত থেকে। আপনার একটা ভাই কিন্তু দিল্লীতে দেওবন্দ মাদ্রাসায় পড়ে। তিনি বললেন, ওদেশের হিন্দুরা মুসলমানদের উপর অত্যাচার করে। ওরা বাবরী মসজিদ ভেঙ্গেছে। আমি জবাবে বললাম তা ঠিকই অন্যায় করেছে। কিন্তু আমরাতো সেই জন্য এদেশে মন্দির ভেঙ্গেছি, দুটো বেশী মসজিদ তো গড়ে দেখিয়ে দিতে পারিনি? বসনিয়ায় হাজার হাজার মুসলমানদের হত্যা করা হয়েছে। কোন মিছিল নেই মুসল্লিদের, কিন্তু ভারতে যদি একজন মুসলমানকে হত্যা করা হতো মিছিলে মিছিলে ভরে যেত দেশ, হয়তো বা বোমা পড়তো সি,আর, দত্তের বাসায়। সেদিন একজন বলছিলেন, শেখ মুজিব দেশটা বিক্রি করে রেখে গেছে। দেশটা না ভাঙ্গলে ভারতীয় নগ্ন ছবি আমাদের দেশে আসতো না। যুব সমাজ এভাবে ধ্বংস হয়ে যেত ন্ াআমি জবাবে বললাম, ১৯৭৫ সালের প্রথম দিকে বাংলাদেশে মাত্র ২ সপ্তাহের জন্য ৫ খানা ভারতীয় ছবি আসলো ঢাকার বিভিন্ন হলে, ২ সপ্তাহ দেখানো হলো মাত্র। ছবি গুলো ভারতে ফিরে গেল। এখন যে নগ্ন ছবি আসছে সে চুক্তিপত্রে কি শেখ মুজিব সই করে গেছে? বিদেশ বলতে ভারতের উপরে শুধু বিদ্বেষ। ভারতীয় অপারেশানে দেশ স্বাধীন হলো। যদি অপারেশনটা সৌদী আরব করতো? তাহলে কি তারাও আমাদের শত্র“ হত? আমার মনে হয় না।
আমার এক বড় ভাই পেশায় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। আবার আর্মি মেডিকেল কোরে চাকুরীও করেছেন। সব সময় জিন্নাহ ক্যাপ মাথায় নিয়ে চলতেন। কথায় কথায় একদিন বললেন, “মোল্লা, আমি যতই অসুস্থ্য হই না কেন, চিকিৎসার জন্য অন্ততঃ ইন্ডিয়া যাব না।” রুগীর সমস্যা হলেই ভারতে চলে যায়। এমনি এক আলোচনার মধ্যে তিনি কথাটা বলে ফেললেন। আমি বললাম, “ইন্ডিয়া যাবেন না, মরে গেলেও কিন্তু কেন?” তিনি বললেন, “ওদের প্রতি আমার খুব রাগ। ওরা আমার পাকিস্তানকে ভেঙ্গে ফেলেছে। ওদের দেশে আমি কখনো যাব না।” বছর শেষ হতে না হতেই বড় ভাইয়ের হার্ট এ্যাটাক হলো। চলে গেলেন ইন্ডিয়া। কারণ বাংলাদেশের চিকিৎসার পরে আস্থা রাখতে পারছিলেন না ভাবী সাহেবা। আমি অবশ্যই জানতাম যে তিনি চিকিৎসার জন্য ইন্ডিয়া গেছেন। তার ছেলের কাছ থেকেই খবর শুনলাম। বড় ভাই প্রায় ২ মাস পরে দেশে ফিরলেন, দেখা হল- কথা হল, ওপেন হার্ট সার্জারী করে এসেছেন। অনেক গল্প করছিলেন ইন্ডিয়ার। ওখানকার ডাক্তাররা খুব মানবিক, চিকিৎসা বিজ্ঞানে তারা নাকি অনেক এগিয়ে গেছে। ইন্ডিয়ার ভাল ভাল কথা বলছেন শুনে অনেকটা অবাক লাগলো। আগের কথাটা আমার মনে পড়ে গেল। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “বড় ভাই ওপেন হার্ট সার্জারি করে আসলেন তা কত ব্যাগ রক্ত লাগলো অপারেশনের সময়?” তিনি জবাবে বললেন, “৭ ব্যাগ রক্ত লেগেছে। আমি বললাম, বড় ভাই মানুষ বাছাই করেন নি? রক্ত নিয়েছিলেন, হিন্দু না মুসলমানের রক্ত?” তা তো করিনি, এ কথাটা তো আমার মাথায়ই আসেনি। কি হয়ে গেল। আমার স্ত্রী ছেলেও তো এ কথাটা ভাবেনি। শেষ পর্যন্ত ঐ রক্ত আমার শরীরে ঢুকানো হলো? জীবনে এমন ঘটনা ঘটবে ভাবতে পারিনি। আমি জবাবে বললাম, “বড় ভাই, ঐ রক্ত ঢোকাতে কোন অসুবিধা হচ্ছে? ৭ ব্যাগ রক্ত আপনার শরীরে, আপনি কি পানিকে জল বলতেছেন বা এখন গোসকে মাংস বলছেন?” তা বলবো কেন? বলা যায় না- ঐ রক্ত মাংসের শরীর তো জল মাংসই বলে। যদিও সব মানুষের রক্তই লাল। একই রক্ত কনিকা থাকে। বড় ভাই আমার হাত দু'টো ধরে বললেন, “মোল্লা, আমাকে আর লজ্জা দিও না। তোমার কথা আমি বুঝতে পেরেছি। আসলে মানুষে মানুষে ভেদাভেদ, সামাজিক বৈষম্য মানুষেরই সৃষ্টি।” মনে মনে বললাম, “পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের যদি এমন বোধদ্বয় হতো!”
আমরা দেশকে গড়তে পারিনি, সোনার খনিতে গড়ে উঠেছে চোরের খনি। সাধারণ মানুষ নিঃস্ব হচ্ছে। এক শ্রেণীর মানুষ আকাশ চুম্বি মুনাফা গড়ছে। বারেবারে এক বোতলের মদ অন্য বোতলে যাচ্ছে। মদের কোন গুণগত মান পরিবর্তন হচ্ছে না- আমরা চাই সামাজিক বিপ্লব, সমাজের খেটে খাওয়া মানুষের ভাগ্য উন্নয়নের বিপ্লব। অপরকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। ভারত আমাদের বন্ধু রাষ্ট্র। ডাঃ জিসি বোসের সিজারিয়ান বেবী শান্ত যদি অশান্ত হয়, দোষ জিসি বোসের নয়, দোষ পারিপার্শ্বিকতার। যে সমাজের আকাশ বাতাসে বারুদের গন্ধ, সেখানে সুষ্ঠু জীবন গড়ে উঠতে পারে না, স্বপ্নের সোনার বাংলা আজ ধ্বংসের পথে, দোষ ভারতকে দিয়ে লাভ নেই। দোষ আমাদের। দোষ দেশপ্রেম বিবর্জিত রাজনীতির। স্বাধীনতার পরাজিত শত্র“ সজাগ। মুক্তিযোদ্ধারা নীরব। স্বাধীনতা দিবস বিজয় দিবসে মিছিল করেই দায়িত্ব শেষ। দেশ গড়ার দায়িত্ব তাদেরই নিতে হবে। স্বাধীনতার শত্র“কে দিয়ে দেশ গড়া যাবে না। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ, স্বাধীনতাকামী মানুষকে একত্রিত হতে হবে, তাহলে রাত পোহাতে দেরি হবে না, অচিরেই দেখবো পূর্ব দিগন্তে নতুন সূর্য্য-সুখী সমৃদ্ধ বাংলাদেশ।
মনে বড় কষ্ট পেলাম। মুক্তিযোদ্ধা ছিলাম। শুনলাম শেখ হাসিনা দেশ ভারতের কাছে বিক্রি করে এসেছেন। একজন রিক্সাওয়ালা বললো, “দেশ বিক্রি হলে তা দাগ নং, খতিয়ান নং লাগে তা বাংলাদেশের দাগ, খতিয়ান নং কত?” আবার শুনছি স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব নষ্ট হচ্ছে। কে আনলো স্বাধীনতা- কে করবে রক্ষা। আসলে মার থেকে কি মাসীর দরদ বেশী হয়?