হাবিব তানভীর ভারতীয় নাটককে যে জায়গাটিতে দাড় করে দিয়েছেন আর কেউ কিন্তু তেমনটি পারেননি। আমরা যে কোন দৃষ্টিভঙ্গিতে তা বিচার-বিশেস্নষন করি না কেন। চিরায়ত রীতিকে বারবার ভেঙেছেন এবং সফল হয়েছেন। যেমন তার আগ্রাবাজার নাটকটির কথাই ধরি। নাটকটি দিলস্নীতে করা নাটকগুলোর ভিতরে সবচেয়ে স্মরণীয় কৃতি। এ নাটকে তিনি মীর্জা গালিবের আমলের এক কবির জীবনি তুলে ধরেন। নাটকের অভিনয়ের জন্য তিনি স্থানীয় অধিবাসী ও জামিয়া মিলিস্নয়া ইসলামিয়া শিক্ষার্থীদের নির্বাচিত করেন। কোন পেশাদার অভিনেতা না নিয়ে এই এমেচারদের নিয়ে নাটক মঞ্চায়নে সফল হওয়াটা বেশ টাফ। হয়ত প্রচলিত নামিদামি নাট্যকাররা চিন্তাও করতে পারেননি। এমন করে নাটক নির্মাণ করে সফল হওয়া সম্ভব!
তারপরে তিনি অভিনয়ের জন্য কোন স্টেজ বেছে নেননি। নাটকটি প্রদর্শনের জন্য একটি বাজারকে তিনি মঞ্চে পরিণত করেন। অদ্�ভুত অথচ সফল পরীক্ষা নিরীক্ষা। এতে তিনি দেশে-বিদেশে ভাল সুনাম ও প্রশংসা কুড়িয়েছেন। এ মাসের ৮ জুন এ মানুষটি ইহলোকের জীবন ত্যাগ করেছেন। মৃত্যুর সময় তার বয়স হয়েছিল পচাশি। মৃত্যুর জন্য বয়সটি উপযুক্ত হলেও এই রকম সৃষ্টিশীল মানুষদের হারানোটা খুব বেদনাকর।
হাবিব তানভর জন্ম নিয়েছেন ১৯২৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ছত্রিশগড়ের রায়পুরে। মেট্রিকুলিশেন পাশ করেছেন রায়পুরের লুুরিয়া মিউনিসিপ্যাল হাইস্কুল থেকে। বি� এ পাশ করেন ১৯৪৪ সালে নাগাপুরের মরিস কলেজ থেকে। তারপর স্নাকোত্তর পড়াশুনা আলীগর মুসলিম বিশ্ববিদ্যায়ে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাজীবনের ইতি এখানেই।
কর্মজীবনে প্রবেশ করেন ১৯৪৫ সালের দিকে বোম্বেতে অল ইন্ডিয়া রেডিওতে কাজের মধ্যদিয়ে। সেই সঙ্গে যুক্ত হন প্রগেসিভ রাইটার্স ইউনিয়ন ও খুবই পরিচিত আইপিটিএ তে। তখন ভারতে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন চলছে। আইপিটিএ�র সদস্যরা ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে শরিক হয়েছিল। তাই অনেককেই কারান্তরীন হতে হল। হাবিব তানভীর ঠিক এসময়টিতে সংগঠনটির হাল ধরেন একেবারে পাক্কা মাঝির মত।
১৯৫৪ সালের দিকে তিনি দিলিস্নতে চলে যান। তখনতো গোটা ভারত ব্রিটিশ শাসন মুক্ত। এখানে তিনি একটি শিশু থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত হন এবং কুদসিয়া জায়েদি হিন্দুস্থানী থিয়েটারের সঙ্গে কাজ করেন। এখানেই মনিকা মিশ্রের সঙ্গে পরিচয় ও প্রণয় হয়। মনিকা মিশ্রি নাট্যজগতেরই একজন ছিলেন।
১৯৫৫ সালে হাবিব ইংল্যান্ডে পারি জমান। সেখানে রয়েল একাডেমী অফ ড্রামাটিক আর্টস এ যুক্ত হন এবং ব্রিসটল ওলড ভিস থিয়েটারে নাটক পরিচালনা করেন। পরে বছর দুই তিনি সারা ইউরোপে ঘুরে ঘুরে সেখানে বিচিত্র রকমের নাটক পরিচালনার রীতি আয়ত্ব করেন। এ সময়ে তিনি জার্মানির বার্লিনে আট মাসের মত থেকে বারটোল্ড ব্রিচেটের নাটক দেখেন। যদিও তার কিছুদিন পরই বারটোল্ট ব্রিচেট মারা গেছেন। তবে পরবর্তীতে হাবির তানভীরের নাটকে ব্রিচেটের একটা বিশাল প্রভাব থেকে গেছে।
১৯৫৮ সালের দিকে দেশে ফিরে তিনি পুরোপুরি নাটক মঞ্চায়নে লেগে পড়েন। তার নেতৃত্বেই প্রতিষ্ঠিত হয় নয়া থিয়েটার। স্ত্রী মোনাকা মিশ্রীকে সঙ্গে নিয়ে ভুপালে মাদায়া পরিষদ নামদিয়ে একটি থিয়েটার কম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন।
বলা বাহুল্য, হাবিব তানভীর লোকনাট্যকে একটি শক্তিশালী জায়গায় নিয়ে গেছেন। দর্শকের কাছে নাটক তুলে ধরেছেন খুবই চমৎকার বিশ্বাসযোগ্যতার সঙ্গে। এ সময়ে তিনি আধুনিক লোকনাট্যকলার সঙ্গে লোকনাট্যকে একাট্টা করে ফেলেছেন। তার ১৯৭৫ সালের সৃষ্টি চরনদাস চোর নাট্যাঙ্গনে তুমুল জড় তুলতে সক্ষম হয়। বছরের পর বছর ধরে মঞ্চায়ন হয়ে চলছে। এ যেন কখনও পুরনো হবে না, হওয়ার নয়। নাটকটি সৃষ্টির মাধ্যমে ভারতের নাট্যজগতের স্রোতের মোড়টিকে ঘুরিয়ে নতুন একটি ধারায় বইয়ে দিলেন।
তার সৃষ্ট লোকনাট্যের বিস্ফোরণটা হয়েছে মুলত ১৯৭০-৭১ সালের দিকে। তার প্রায় সমস্ত নাটকের ভাসন ছিল হিন্দিতে। এ সময়ে তিনি কবিতা লিখতে শুরু করেন এবং তাকালস্নুজ নামের একটি কবিতার বই বের করেন। তবে কবিতার বেলায় হাবিব আহমদ খান নাম বাদ দিয়ে হাবিব তানভীর ছদ্মনাম গ্রহণ করেন। পরে তো সব কিছুতেই তিনি হাবিব তানভীর নামে পরিচিত হয়ে যান। তিনি ছত্রিশগড়ের আঞ্চলিক ভাষায়, আঞ্চলিক গানের স্টাইলে, মন্দিরের প্রচলিত প্রথানুসারে কিছু নাটক নির্মাণ করেন। এ সব নাটক লোকনাট্যকে গৎবাধা ধরণ-ধারণ থেকে সম্পূর্ণভাবেই বের করে আনতে পেরেছে। ১৯৭২ সালে ছত্রিশগড়ের স্থানীয় নাচের স্টাইলে গোন কা নাম সাসুরাল, মোর নাম দামাদ শিরোনামে একটি কমিক নাটক রচনা করেন। নাটকের কাহিনিটি ছিল ছত্রিগড়ের প্রচলিত মজাদার কাহিনী নিয়ে- একজন বৃদ্ধ একটি যুবতির প্রেমে পড়ে, পরে তাকে নিয়ে পালিয়ে যায়। তার এসব পরীক্ষা নিরীক্ষা কিন্তু ব্যর্থ হয়নি মোটেও। যেখানেই তার হাত পড়েছে সেখানেই সোনা ফলার মত বেশ সফলতার সঙ্গেই নাটকগুলো মঞ্চায়ন করে গেছেন।
হাবিব তানভীর যাদের অভিনেতা হিসেবে বেছে নিয়েছেন তারা কেউই কিন্তু মঞ্চের নিয়মিত অভিনেতা ছিলেন না। তার হাত ধরেই তারা অভিনয়ে দক্ষ হয়ে উঠেছে। মঞ্চে প্রথম পা রেখেই একজন নিয়মিত পারফর্মারের চেয়ে ভাল অভিনয় করা অবশ্যই তার নির্দেশনার গুনের কারণেই সম্ভব হয়েছে। আগ্রা বাজার সেটটি তিনি গোটা একটা গ্রামকে তুলে এনেছিলেন। তার চরনদাস চোর নাটক ১৯৮২ সালে আন্তর্জাতিক নাট্য উৎসবে বিশেষ সম্মানে ভূষিত হয়েছে। হিন্দুস্থান টাইমস এ নাটকটিকে ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতার পর সেরা ৬০ টি রচনার মধ্যে স্থান দিয়েছে। নব্বুই সালের দিকে ধর্মীয় ভন্ডামির বিরুদ্ধে পঙ্গা পন্ডিত লিখেন। ফলে উগ্র হিন্দুদের কোপানলে পড়েন। রাষ্ট্রিয় সেবক সংঘের( আর এস এস) সমর্থকরা তাকে বারবার হেস্তনেস্ত করেছে। কিন্তু কোন বাধাই তাকে থামাতে পারেননি, হারাতেও পারেনি। এখনও ভারতের সব জায়গায় পঙ্গা পন্ডিতের সফল মঞ্চায়ন চলছে।
হাবিব তানভীরের ছত্রিশগড় ফোক ট্রুপ ১৯৯৩ সালের দিকে সেপিয়ারের এ মিড সামার নাইটস ড্রিম অবলম্বনে হিন্দি ভাসনে কামডিও কা আপনা বাসান্ত রিতুকা সাপনা মঞ্চায়ন করেছিল। বেশ সফলতা পায় তাতে।
জীবনের শেষ দিকে রবীন্দ্রনাথের রাজর্সী উপন্যাস ও বিসর্জন নাটক অবলম্বন করে রাজরক্ত নাটক লিখেন এবং মঞ্চায়ন করেন। বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্রেও অভিনয় করেছেন। বিশেষভাবে উলেস্নখযোগ্য রিচার্ড অটেনবরোর গান্ধি এবং রাহুল ভারমার ভুপাল গ্যাস ট্রাজেডি। ২০০৫ সালে �গৌন কি নৌন থিয়েটার, মোর নৌন কি হাবিব� শিরোনামে হাবিব তানভীরের জীবনি ভিত্তিক ডকুমেন্টারি নির্মাণ করেন সঞ্জয় মাহারিশি এবং সুডনাভা ডিসপান্ডি। ঠিক এ বছরই তার স্ত্রী মারা যায়।
মাতমিলি চাদারিয়া শিরোনামে তিনি তার আত্মজীবনি প্রায় শেষের পথে ছিল। কিন্তু তার আগেই তাকে ইহধাম ত্যাগ করতে হল। এখন আমরা তার নাটকের ভিতরেরই তার আত্মজীবনির বাকি অংশের খোজ করব।
হাবিব তানভীর জীবতাবস্থায়ই সরকারি-বেসরকারি নানা খেতাব পেয়েছেন। ১৯৬৯ সালে তিনি পান সঙ্গিত নাটক একাডেমী অ্যাওয়ার্ড। ১৯৮৩ সালে পান পদ্মশ্রী, ১৯৯০ সালে কালীদাস সম্মান, ১৯৯৬ সালে সঙ্গি নাটক একাডেমী ফেলোশীপ এবং সবশেষে ২০০২ সালে পদ্মভূষণ। তিনি ভারতীয় পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভার মেম্বার ছিলেন। গত ৮ তারিখে আমরা এই নাট্যকার, নাট্যনির্দেশক, একজন কবি ও অভিনেতাকে হারালাম। তিনি পৃথিবীতে অনেক কিছু দিয়েছেন, বেচে থাকলে হয়ত আরও বেশিকিছু দিতে পারতেন। এই অতৃপ্তির টানই বারবার তার কাছে আমাদের নিয়ে যাবে।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই জুন, ২০০৯ দুপুর ১:০১

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




