অনেক দিন ধরে চেপে রাখলাম, মন খারাপের অবিশ্বাস্য সত্যটা । লিখলে কিছুটা হলেও স্বস্তি পাব।নজরুল সাহায্য প্রসঙ্গেই আজকের এই ব্লগ পোস্ট। নজরুল ইসলাম যখন জীবন যুদ্ধে হেরে যাবার সন্ধিক্ষণে সেই সময়কার ঘটনা । শরৎ ও রবীন্দ্রনাথের অবর্তমানে নজরুল হতে পারতো সকলের জীবিত অন্ধের যষ্টি ।কিন্তু গণমানুষের মানবতার কবির সেসব অবহেলিত জনের কপালে জুটে নি ।আমরা তাঁর প্রাপ্য সম্মানটাও দিই নি ,অঞ্জলি দেওয়াটা তো বহুত দূর।
কাজী নজরুল ইসলামের বন্ধু সূফি জুলফিকার হায়দার সাহেব ,নজরুলের অসুস্থতার সময়টাই ছায়ার মতো সব সময় পাশে ছিলেন । সেই সুবাধে তিনি সে সময়ের অনেক কিছু খুব কাছ থেকে দেখেছেন ,অনুধাবন করেছেন এবং মহাকালের বুকে লিখে গেছেন এক অবহেলার অপ্রকাশিত ,অসহনীয় সত্য ।
প্রিয় কবির মানসিক অবস্থা চরমে । চিকিৎসা ও সাহায্য প্রসঙ্গে আলাপ করতে সূফি জুলফিকার সাহেব ,হক সাহেবের বাসায় গেলেন । জানালেন সব কিছু । সব শুনে বললেন
‘‘নজরুল কে রাঁচী পাঠিয়ে দাও ।পাগলের জন্য রাঁচীতে সরকার সুন্দর ব্যবস্থা করে রেখেছেন ।
সাড়া দিলেন না সূফি জুলফিকার । তারপর ফজলুন হক আবার বললেন ‘‘বাইরে গেলে পাগলের চিকিৎসা কি তুমি করাবে ?তাঁকে রাঁচী পাঠিয়ে দাও ।
মাওলানা আকরাম খাঁ’র কাছে গেলেন । তিনি নিজ বাস ভবনে স্বাস্থ্যগত কারণে বিশ্রামে ছিলেন ।
সূফি জুলফিকার সাহেব সার সংক্ষেপ বলার পর তিনি বললেন-
‘‘ হ্যাঁ তাঁর অসুখের খবর তো কাগজে দেখেছি ।তুমিই তো খবর দিয়েছো দেখলাম কাগজে।নজরুলের চিকিৎসার ব্যবস্থা যাতে ভালো হয় ,আমিও চাই । কিন্তু আমার শরীরটা অসুস্থ,এ সময়ে তো আমার দ্বারা কিছু হবার নয় ।তুমি চেষ্টা করে যাও। ব্যবস্থা একটা হবেই ।
দিগবিদিক ছুটে বেড়াচ্ছেন প্রিয় নজরুলের এতটুকু সাহায্যের জন্য । সেটার অংশ হিসাবে তমিজ উদ্দিন সাহেবের বাসায় গেলেন । সেখানে গিয়ে বলতেই ,তমিজ উদ্দিন কিছু বলার আগেই শফিকুল ইসলাম বলে উঠলেন-
‘‘নজরুল ইসলামের অসুখ এখানে কেন ? মুসলিম স্বার্থের বিরুদ্ধে যে ‘নবযুগ লিখছে ,সেই কবি কে কেন মুসলমান সাাহায্য করবে ? ...এভাবে কথা কাটাকাটি হয় । অনেক । সূফি জুলফিকার সাহেব তমিজ উদ্দিন কে কিছু বলতে অনুরোধ করলেন ,তিনি বললেন ‘‘ আমি কি করবো ?
সে সময়কার গুরুত্বপূর্ণ রাজনীতিবিদ ফজলুল হক সাহেবের বাসায় আবারও হাজির জনাব হায়দার । চিকিৎসা করানোর ব্যাপারে বললেন এবং অনুরোধ রাখলেন দেখতে যেতে । বাংলার বাঘ খ্যাত ফজলুল হক সাহেব সুন্দর উত্তর দিলেন-
‘‘আমার সময় কোথায় ?তাঁকে ভালো ডাক্তার দেখাও ।
তিনি আরও কিছু পরামর্শ করার বা বলার ছিল । কিন্তু কোনো গুরুত্ব না দেওয়ায় সে বিষয়ে আর কথা বললেন না ।
এর পর দিন প্রভাবশালী নেতা নাজিম উদ্দিন সাহেবের সাথে দেখা হয়, সূফি জুলফিকার সাহেবের । যথারীতি চিকিৎসার ব্যাপারে আলাপ শুরু করলেন । সব কিছু শুনলেন ,শুনে শান্ত গলায় বললেন-
‘‘অসুখ হয়েছে ডাক্তার দেখান । আল্লাহ্ ভালো করবে । ভালো ডাক্তার দেখাবেন।’’
এরপর, দেখা করেন বাংলার বিখ্যাত, গনতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী সাহবের সাথে । উনার জবাব ছিল-
‘‘‘নবযুগ সম্মাদক কাজী নজরুল ইসলামের অসুখ কিংবা আর্থিক দুরাবস্থা,সে জন্য আমার কাছে কেন ? তোমাদের ফজলুল হক সাহেব তো আছেন ,তাঁর কাছে যাও ।
আরেক দিনের ঘটনা ।
হক সাহেব ব্যস্ত তখন নিজ কামরায় । যখন দেখলেন সূফি জুলফিকার সাহেব রুমে প্রবেশ করলেন তখনই তিনি বুঝতে পারলেন সাহায্যের বিষয়ে কথা বলতে এসেছেন। কপালে বিরক্তির ভাব নিয়ে তাঁদের রেখেই বেরিয়ে গেলেন তিনি । কোন কথা বলার প্রয়োজনবোধ করেন নি ।
নজরুল সাহায্য কমিটি থেকে মাসে দু’শো টাকা পাঠানো হতো । যা পর্যাপ্ত ছিল না । এক মাসে টাকা ঠিক মত না আসায় জুলফিকার হায়দার সাহেব সজীনকান্ত ‘র (‘নজরুল সাহায্য কমিটি’র গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন ) কাছে গেলেন । তিনি বললেন এ মাসের টাকাটা এখনও পাওয়া যায়নি ,সে কথা জানাতে আসলাম । সজনীদা জুলফিকার হায়দারের কথা শেষ হওয়ার আগেই তেলে বেগুনে রেগে গেলেন ।তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বললেন-
‘‘রেখে দাও ,যে ক’মাস দেওয়া হয়েছে ওঠাই দেওয়া উচিত হয় নি । । আমি ডক্টর মুখার্জিকে ফোনে বলে দিয়েছি ,নজরুলের ব্যাপারে যেন আর কারো কাছ থেকে টাকা চেয়ে নিয়ে পাঠাবার চেষ্টা না করেন ।(বি.দ্র-কেন এমন করেছে সজনীদা ,সেটার পেছনে একটি কারণ আছে ,সেটা নিয়ে আরেক দিন বলবো )
একদিন হায়দার সাহেব সাহায্যের জন্য মুর্খাজির কামরায় গেলেন। তাঁকে দেখেই চিৎকার করে উঠলেন তার সচিব ,বললেন-
‘এখান কি ? আমার কামরায় আপনার দরকার কি ? আপনি ডক্টর মুখার্জির কাছে এসেছেন তো ? তা’হলে আর পাঁচ জন যেমন তার বৈঠকখানায় বসে দেখা করেন ,আপনিও সেখানে গিয়ে বসুন।’’
-ব্যক্তিগত সচিবের বক্তব্য
অথচ ডক্টর মুখার্জি সহ সবাই আন্তরিক ছিলেন । মুখার্জির কামরার হল রুমে প্রবেশ করে জানালেন এ মাসের টাকার কথা । তিনি বললেন
‘‘ আর টাকা দেওয়া হবে না ,যা শুনলাম তা সাহায্য করার মতো ব্যাপার নয় ।’’
সজনীদারা দাবী করছে পুরো টাকাই দেওয়া হয়েছে । কবি পত্নী বলছে তিন মাসে দু’শো করে টাকা দিয়েছে মাত্র ,দু’মাস যাবত টাকা আসছে না । এসব নিয়েই আলোচনা করতে কবি জসীম উদ্দিনের সাথে দেখা করে বিষয়টা বললেন । পল্লি কবিও সজনীদাদের পক্ষে বললেন । বাকী টাকাও যে দেওয়া হয়েছে তার প্রমাণ কবি পত্নির স্বাক্ষর । জনাব জুলফিকার বুঝাতে চেষ্টা করলেন এই স্বাক্ষর আসল না, নকল । কিন্তু ব্যর্থ হলেন। এক পর্যায়ে পল্লি কবি বললেন
তা’হলে কি বলতে চাচ্ছ তারা মিথ্যে বলছে ?এক কথা দুই কথা কঠোর কণ্ঠে জসীম উদ্দিন বলে উঠলেন
‘‘তুমি কোথা থেকে এখানে এসে কেন আমাদের কথার মাঝখানে অযাচিত বির্তকের সৃষ্টি করছো । তুমি চুপ করো ।
সূফি জুলফিকার মেজাজ হারালেন ,বললেন
তুমি চুপ করো জসীম।
-হায়দার চটছো কেন?
- ফের কথা বলতে চাও ত এখনই বেরিয়ে যাও
-কেন হায়দারের ভয়ে ?
এক সময় হায়দার সাহেব জসীম উদ্দিন সাহেব কে মারতে উদ্ধতহলেন ।
আমি আমার কথা কি রাখতে পেরেছি ? প্রাণের নজরুলের সাথে যা হয়েছে ,বিখ্যাতজনরা যা করেছে তা রীতিমত অপরাধের মতো । এসব ভাবলে তাঁদের প্রফেশনাল জীবনের পাশাপাশি মানুষ হিসাবে কেমন ছিলেন প্রশ্নটা এসে যায় । মানুষের প্রতি মানুষের মনুষ্যত্ববোধ যদি শ্রেষ্ঠ মানুষের মাপকাঠি হয় ,তাহলে তো বলতেই পারি ,তাঁদের মনুষত্বের ঘাটতি ছিল । নজরুল কোনো ভাবেই ইসলাম বিরোধী কবি হতে পারে না । নবযুগে ইসলাম বিরোধী কিছু প্রকাশ,প্রচার বা প্রসার করা হয় নি । ইসলামের কুসংস্কার দূরীকরণে কিছু লিখলে বা প্রকাশ করলে তা ইসলাম বিরোধী হতে পারে না ।নজরুলের মতো আবেশিত গজল বাংলা সাহিত্যে কেউ লিখতে পারি নি । তিনি তৎকালীন সময়ের মক্তব সাহিত্য নিয়েও লিখেছেন যা সকল মহলে প্রশংসিত হয়েছে । নজরুলের সাথে যদি উনারা এমন ব্যবহার করতে পারে তাহলে বাকীদের ক্ষেত্রে ! সে সব অজানা কিছু থাকলে কোনো দিন জানা হবে না । এসব জেনে আমার উনাদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ অনেক কমেছে । কেউ কে সাহায্য না করতে পারলে সেটা অন্যায় বা দোষের কিছু না ,কিন্তু তাচ্ছিল্য ,অবহেলা করাটা অন্যায় ।অনন্ত শান্ত্বনা দেওয়া বা অপারগতা প্রকাশের ভাষাতেও সাহায্যপ্রার্থী সন্তুষ্ট হতে পারে ।
সুফি জুলফিকার হায়দার রচিত ‘নজরুল জীবনের শেষ অধ্যায় অবলম্বনে লেখা।সকল তথ্যসূত্রও সেটাই ।
লেখাটি উৎসর্গ করলাম ব্লগের আমার বড় ভাই ,গল্পকার ,খুব বিনয়ী,সম্মান প্রার্থী পদাতিক ভাইয়াকে এবং উদীয়মান ব্লগার আরোগ্য ভাই কে । দুই জনই বাংলা সাহিত্য কে সমৃদ্ধ করবে সেই কামনা করি । ভালো সময় কাটুক ।
[/su
নজরুল বিষয়ক আমার লেখা
শেরে বাংলা কি নজরুলের পাওনা শোধ করতে পারবেন !
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই মার্চ, ২০১৯ বিকাল ৩:০৮