somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ফেরা না ফেরার গল্প

০৯ ই ডিসেম্বর, ২০১৭ সকাল ১১:২৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


এখন সাকুল্যে দশ বারো জন ছাত্র আছে হলে। একা ঘরে থাকতে ভয় করে তাই ফিলোসফির রকিব রাতে তার ঘরে ঘুমোতে আসে। খানদের সাথে যুদ্ধ করে দেশকে মুক্ত করা যাদের উদ্দেশ্য তাদের এতো ভয় পেলে চলে না। তবু ভয় তো কোন ফর্মুলা মেনে আসে না! শাহাদাত বুঝতে পারে না সে কি করে। শেখ সাহেব যেন অন্তহীন আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন ইয়াহিয়া খানের সাথে। তিনি কি অখন্ড পাকিস্তান এখনো আশা করেন? অস্থিরতা, উত্তেজনায় দিন কাটছে, রাত কাটছে আশংকায়। বাইশে মার্চ হল ছাড়ল শাহাদত। নারায়ণগঞ্জ শহরে এসে শাহাদত দেখে তার বয়সী ছেলেদের মধ্যে সমান উত্তেজনা। ছোট ভাই আশফাক এসএসসি পরীক্ষা দেবে এবার কিন্তু বই খাতা পড়ে আছে এক কোনে অবহেলায়। বন্ধ‍ুদের সাথে সারা বিকাল হৈ হৈ করে বেড়াচ্ছে। তার ধারণা দেশ স্বাধীন হলে একবারেই পরীক্ষা দেবে। সব ছোট ইশফাকের দেশের স্বাধীনতা নিয়ে এত ভাবনা নেই, এক সময় হলেই হল। সে একটা ম্যাজিকের বই কিনে ম্যাজিক শিখছে, বড় হলে ম্যাজিশিয়ান হওয়ার ইচ্ছে। সমস্যা হল আব্বাকে নিয়ে। পাটের ব্যবসায় মোটামুটি ভালই লাভ করছিলেন, অনিশ্চিত অবস্থায় ব্যবসায় ভাঁটা পড়েছে তার। সামনে কী যে হয়! পাকিস্তানের অবিনশ্বরতায় তার বিশ্বাসে চিঁড় ধরেছে, তবু ফচকে ছোঁড়াদের লাফালাফি, "বীর বাঙালী অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর", শ্লোগানে তার বুকে খিঁচ ধরে।
- হলে থাকা আর পোষাল না?
- হলে আর দুই পারসেন্ট ছাত্রও নেই বাবা। ক্যান্টিন বন্ধ হয়ে গেছে, ছাত্ররা সবাই যারযার বাড়ি চলে গেছে।
- তা হলে কি করে থাকবি। তবে আমি সাফ বলে দিচ্ছি ঐ সব বীর বাঙালী শ্লোগান আর গাঁদা বন্দুক নিয়ে মার্চ করা ছেলেদের সাথে মিশবে না।
- মিশব কি? তারা আমাকে সঙ্গে নিলেতো!
রাগ করে বলল শাহাদাত। বিকালে সে আর আশফাক বেরোল রেকী করতে, মানে আর কি, কে কোথায় কি করছে দেখতে আর শহরের ছেলেপিলেদের আগামী কালের প্ল্যান কি জানতে। কেমন একটা ছুটি ছুটি ভাব শহরে। এটা অবশ্য মাসের প্রায় প্রথম থেকেই চলছে। ৭ই মার্চ থেকে তো বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে দেশ চলছে। সরকার নেই বললেই হয়। সবকিছু ঢিলে ঢালা চলছে তবে আইনশৃঙ্খলা ঠিক আছে। অনেক বাড়িতে কালো ফ্ল্যাগ উড়ছে। আগামী কাল ২৩ শে মার্চ পাকিস্তান দিবসে সকল বাড়িতে সবুজ লাল বৃত্তের মাঝখানে সোনালী ম্যাপ নিয়ে বাংলাদেশের পতাকা উড়বে।
- ফ্ল্যাগ জোগাড় করছস্?
জানতে চাইল মুস্তাফিজ। সে এঞ্জিনীয়ারিং ইউনিভার্সিটির হল ছেড়ে আপাতত: নারায়ণগঞ্জে ঠাঁই নিয়েছে।
- না। তোর কাছে আছে?
- একটা স্পেয়ার আছে, তোরে দিতে পারি।
মুস্তাফিজের চাষাড়ার বাসায় শাহাদত আর আশফাক গেল। মুস্তাফিজ বের করল দুই ফুটি একটা পতাকা। ম্যাপটা সোনালী নয় হলুদ, বাংলাদেশের মানচিত্র ও কেমন যেন থ্যাবড়া, তবু থাবড়া মেরে পতাকাটা নিল আশফাক। এই মূহুর্তে এটাই তো আমাদের প্রাণের পতাকা।
বাসায় ব্যাপারটা এত সহজ হল না। ভেবেছিলএখন তাদের ঘরে লুকিয়ে রেখে দেবে, কাল সকালে ছাদে কালো পতাকার পাশে আরেকটা বাঁশ বেঁধে টাঙ্গিয়ে দেবে। গাধা আশফাকের জন্যে ফাঁস হয়ে গেল সব কিছু। সে আম্মাকে দেখাতে গেল, "আম্মা দেখ, কি সুন্দর বাংলাদেশের ফ্ল্যাগ!" আম্মা কিছু বলার আগেই আব্বা ঘরে ঢুকে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। তক্কে তক্কে ছিলেন মনে হয়। ছেলেদের মতি গতি ইদানিং তার সুবিধার মনে হচ্ছিল না। চেঁচামেচি শুরু করলেন তিনি, "কি আরম্ভ করছস্ তোরা? কালো ফ্ল্যাগ টাঙ্গালি টাঙ্গালি, এখন পাকিস্তান দিবসে স্বাধীন পূর্ব পাকি¯তানের ম্যাপ টাঙ্গাতে চাস? "
- স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের ম্যাপ না বাবা, স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা।
- ঐ হইল। শেখ সাহেব তো বলছে কনফেডারেশন করবে। ইয়াহিয়া মেনে ও নিতে পারে। না, না, এখন বাংলাদেশের ফ্ল্যাগ টাঙ্গানো যাবে না। এইটা বেশী বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে।
"আশার ছলনে ভুলি কী ফল লভিনু হায়," মনে মনে ভাবল শাহাদাত। আব্বা এখনো আশা করে আছে পাকিস্তান টিকে যাবে! একদিন "লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান" করেছেল সে স্মৃতি ভুলতে পারেনি। বাবাকে শান্ত করার জন্যে সে বলল, ”ফ্ল্যাগে কি অসুবিধা, বাবা? কনফেডারেশন হলেও তো ষ্টেটের ফ্ল্যাগ থাকতে পারে।”
- হ্যাঁ, পারে, সে রকম রাষ্ট্রীয় স্বিদ্ধান্ত যদি নে’য়া হয়।
আম্মা এত কুট কচালীর মধ্যে গেলেন না, এক কথায় মামলা নিস্পত্তি করে দিলেন।
- টাঙ্গাবি। সুন্দর পতাকা।
- কী বলছ তুমি শাহাদতের মা? আমাদের এ্যারেস্ট করে নিয়ে যাবে।
- কে এ্যরেস্ট করবে? কালো পতাকাতো টাঙ্গালো এর আগে, কেউ কিছু করল?
গণভোটে আব্বা পরাস্ত হলেন। পরদিন সকালে পত পত করে ৬৭নং আমলাপাড়ার ছাদে বাংলাদেশের পতাকা উড়ল। আরো অনেক বাসার ছাদেও কালো পতাকার পাশে আজ বাংলাদেশের পতাকা উড়ছে। একটু আপত্তি করলেন প্রতিবেশী শরিফ চাচা। শাহাদাতদের বাড়ির লাগোয়া নতুন বাড়ি বানিয়েছেন ভদ্রলোক, বড় মায়া বাড়ির প্রতি। রোজ সকালে ঘুরে ঘুরে চারপাশ দেখেন।
- পতাকাতো উড়াইলা ভাতিজারা এক্কেবারে আমার বাড়ি বরাবর। গাছের জন্য তোমাদের বাড়ি দেখা যায় না, মনে হয় আমার বাড়িতেই পতাকা উড়তেছে।
- অসুবিধা কি চাচা? এক ঢিলে দুই পাখী মারা হল। কথাটা খুব সুপ্রযুক্ত হল তা নয়, তবুও বলল শাহাদাত।
- না, না, অসুবিধা না, তবে পরে আবার রাষ্ট্রদ্রোহীতার মামলা না কইরা দেয়।
কথাটা আব্বার খুব পছন্দ হল।
- আমি এই জন্যে বলছিলাম পতাকা না টাঙাতে। ছয় দফা ঠিক আছে, স্বাধীন বাংলাদেশ আবার কি? তোরা না নামালে আমি গিয়ে ফ্ল্যাগ নামাবো।
- এখন উপরে গিয়ে পতাকা নামালে সবাই তোমাকে ভূট্টো-ইয়াহিয়ার চর বলবে। আশফাক বলল,
- বলুক। চিৎকার করে উঠলেন আব্বা, শরীফ সাহেব পর্যন্ত চমকে গেলেন। চিৎকারে আব্বার উষ্মা ছাড়া পেল, শেষ পর্যন্ত ফ্ল্যাগ নামাতে তিনি ছাদে উঠলেন না।
শহরে কিছু লোকের উৎকণ্ঠা সত্বেও তরুনদের মধ্যে পতাকা উড়াতে উৎসাহের কমতি নেই। আরেকটা দিন কেটে গেল, রাতে রেডিওর খবরে শোনা গেল ইয়াহিয়ার সাথে শেখ মুজিবের আলোচনা কোন সমাধানে পৌঁছুতে পারেনি।
- সমাধানে না পৌঁছানো তো ভালই, কি কস্? এখন বঙ্গবন্ধু মুক্তির ডাক দিতে পারে। পরদিন বন্ধু মুস্তাফিজ বলল।
- এতো সোজা না! মাউড়ারা প্লেনে কইরা অস্ত্র আনতেছে। বলল দুলাল।
- তা হলেতো এখনই স্বাধীনতা ঘোষণা করতে হয়।
এমন ভাবে বলল শাহদাত যেন যুদ্ধ ঘোষণাটা তার দায়িত্ব। বেকার সময় কেটে গেল যুদ্ধের স্ট্রাটেজী কি হবে তার আলোচনায়। এখন তো অন্তহীন ছুটি, কি আর করার আছে?
পঁচিশ তারিখ দিনটা কেটে গেল রাইফেল ক্লাব আর ব্যক্তিগত সংগ্রহের অস্ত্র নিয়ে মার্চপাস্ট দেখে আর গুজব শুনে। রাতে ঘুম ভাল হল না। সারা সাত একটা অস্বস্তিতে এ পাশ ও পাশ করল শাহাদত। সকাল অন্যদিনের মত হল না, শরীর ম্যাজ ম্যাজ করছে। ডিম পোচ আর পাঁউরুটি দিয়ে নাস্তা সারলো শাহাদত, তারপর রেডিও ধরল । গান হচ্ছিল রেডিওতে, "পলাশ ঢাকা, কোকিল ডাকা আমার এ দেশ ভাইরে।" সাতটার খবরের সময় এখন, অথচ খবরের নাম নেই। ঘুরে ফিরে শুধু "পলাশ ঢাকা, কোকিল ডাকা।" গান ভাল, কিন্তু এত ভাল ভাল না। ঠিক তাই। একটু পর এক অবাঙালী গলা বলল, "আভি আপ এক জরুরী এলান সুনিয়ে", তারপর গড় গড় করে সামরিক আইনের ধারা বলে গেল। শহরে কারফিউ জারী করা হয়েছে। সকল পতাকা সরিয়ে ফেলতে বলা হল। পথে কোন প্রতিবন্ধকতা থাকলে সরিয়ে ফেলতে নির্দেশ দে’য়া হল, না হলে পার্শ্ববর্তী অবকাঠামো সহ ধ্বংস করে দে’য়া হবে, ইত্যাদি ইত্যাদি। সর্বনাশ নতুন করে মার্শাল ল’ জারী হল না কি? বাসায় জটলা বসল। আব্বা বললেন, "নিশ্চয়ই সাংঘাতিক কিছু হয়েছে। আমি তখনই বলেছিলাম এত বাড়াবাড়ি করো না, সবার সাথে হাতাহাতি, তা বলে দারোগার সাথে হাতাহাতি?"
- শেখ সাহেব তা হলে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন? জানতে চাইল আশফাক।
- আমি কি করে বলব? ঢাকায় থাকলে জানা যেতো। বলল শাহাদাত।
- রেডিওতে ঘোষণা করবে না? জানতে চাইল ইশফাক। কি বোকার মত প্রশ্ন!
- আরে আহাম্মক, রেডিও তে ঘোষণা করার অবস্থা হলে তো ঢাকা শহরই দখলে থাকত।
অবস্থা ভাল না, আরো কিছুক্ষণ পর টেলিফোনে না না বার্তা আসতে লাগল। ঢাকা শহরের সাথে টেলিফোন যোগাযোগ নেই, কিন্তু এই শহরের ম্যানুয়েল টেলিফোন লাইন এখনও আছে। মুস্তাফিজ জানালো ইকবাল হল, জগন্নাথ হলে অসংখ্য ছাত্রকে মিলিটারীরা হত্যা করেছে। রোকেয়া হলেও তারা ঢুকেছিল এবং মেয়েদের মেরেছে। পুরানো রেললাইনের পাশে বাবুপুরা বস্তি পুড়িয়ে দিয়েছে। ঢাকা থেকে পালানো লোকদের মুখে তার একথা শোনা। অন্য যাদের সাথে কথা হল তারা একই কথা বলল। আটটার খবরে ভারতীয় আকাশবাণী থেকে ঘোষণা করা হল, "পূর্ব বাংলায় গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছে"। যুদ্ধ তাহলে শুরু হয়েছে?
- এখন দেখ সব ঠিক হয়ে যাবে। সুড় সুড় করে সবাই আলোচনার টেবিলে বসবে। গোলমাল ঠান্ডা হলে দেখিস ইয়াহিয়া শেখ সাহেবের হাতেই ক্ষমতা হস্তান্তর করবে।
- তুমি বলছ কি আব্বা, এতোগুলি নিরিহ ছাত্রকে মেরে ফেলল, ঘরবাড়ি পুড়িয়ে ফেলল, তারপরও পাকিস্তান এক থাকবে? আব্বার কথার প্রতিবাদ না করে পারল না শাহাদাত । অসহ্য লাগল তার আব্বার পাকিস্তান ভক্তি।
- হলে ঢুকে ছাত্র মারতে কে দেখেছে? যারা পালিয়ে আসছে তারা ভয়ে পিছন ফিরে তাকায়নি। ভয় দেখানোর জন্যে আর্মি হয়তো গোলাগুলি করছে, রেললাইনের ধারে কিছ খোড়ো ঘরে আগুন দিয়েছে। একটা সভ্য আর্মি ঘরে ঢুকে নিরিহ মানুষ মারতে পারে না।
নারায়ণগঞ্জ শহরে লোক চলাচল মোটামুটী স্বাভাবিক। এখানে কারফিউ নেই। রাইফেল ক্লাবের মাঠে অস্ত্রের মহড়া হল। ভয়াবহ খবর শোনা যেতে লাগল বিকেল নাগাদ। ঢাকা থেকে পালিয়ে আসা লোকের সংখ্যা অনেক। শহরের রাস্তায় এমনিতে লোক চলাচল কম, কিন্তু এই অল্প লোক চলাচলও নিরস্ত করতে পারল না শাহাদত আর আশফাককে। পথে মুস্তাফিজকে ও নিল। ইশফাক এসবের মধ্যে নেই। তার ভয় বেশী। কিছু লোক শীতালক্ষ্যা পাড়ি দিয়ে গ্র্রামের দিকে চলে যাচ্ছে। জাহাজঘাটে লঞ্চ বা জাহাজ নেই, নৌকায়ই যাচ্ছে তারা। তাদের একজন, পটুয়াটুলীর এক মাঝ বয়সী কাপড় ব্যবসায়ী জানালেন সারা রাত পায়ে হেঁটে তিনি এই শহরে এসেছেন। ভাগ্যিস পরিবার সাথে নেই। তার বাড়ি বিক্রমপূরের শ্র্রীনগর।
- ঢাকা শহরের অবস্থা কেমন, চাচা?
- আমার মনে হয় শহরের লাখ খানেক মানুষ মাইরা ফালাইছে। শাখাঁরী বাজার শেষ!
- না: এতো হইবে না। দশ বারো হাজার হইবার পারে। অন্য এক দোকানী বললেন।
সংখ্যা এবং ব্যপকতা সম্মন্ধে মত পার্থক্য থাকলেও পাকিস্তানী সৈন্যদের তান্ডবলীলা এবং নৃশংসতা সম্মন্ধে সবাই একমত। তাদের একজন বলল,
- আপনেরাও ভাগেন। শহরে থাইকেন না। হার্ম্মাদরা এই দিকে আসতেছে।
হার্ম্মাদ মানে পাক আর্মি। ভাল নাম দিয়েছে। কথাটা আব্বাকে এসে বলল আশফাক। আব্বা বললেন,
- পর্ত্তুগীজ জলদস্যুদের হার্ম্মাদ বলতো। তারা মানুষ মারতো, লুটতরাজ করতো। এরা আইন-শৃংখলার নামে যদিও কিছু মানুষ মেরেছে তবু এখনো হার্ম্মাদ বলা যায় না।
- কখন বলা যাবে আব্বা? আশফাক জানতে চায়। আব্বা কোন উত্তর দেন না।
পরদিন শহরের বিপুল সংখ্যক লোক শহর ত্যাগ করা শুরু করল। শাহাদতদের প্রতিবেশী কয়েকজন চলে গেলেন কাছাকাছি গ্রামে। আব্বা প্রতিবেশীদের ভয়ের বহর দেখে তাজ্জব।
- ভীতুর ডিম কোথাকার! নিজের ঘরে শান্তিতে বসে থাক্, তা না আর্মিরা ঘরে এসে মেরে ফেলবে এই ভয়ে পালাল। নিরিহ গেরস্থ মানুষ, তোদের মারতে যাবে কেন?
আব্বাকে বোঝানো গেল না যে এবারের ব্যাপারটা এত সোজা না। এটা '৫২-র ভাষা আন্দোলন বা '৬৯-এর গণ আন্দোলন না। ছেলে ছোকরারা শহরের প্রবেশ পথে আলকাতরার ড্রাম, রেলের ওয়াগন, ইটের স্তুপ দিয়ে ব্যারিকেড দিয়েছে। এক তরুন নেতা বললেন,
- এই শহর আমাদের দূর্গ।
দু:খের বিষয়, চতুর্থ দিনে দূর্গ ভেঙ্গে পড়ল, আর্মি কলাম শহরে ঢুকলো। শহরের নব্বুই ভাগ লোক শহর ছেড়ে পালিয়েছে। ট্যাঙ্ক দিয়ে ব্যারিকেড ভেঙ্গেছে আর্মিরা।

পরদিন সকালে এসে হাজির হলেন প্রতিবেশী শরীফ চাচা।
- অমি গ্রামে চইলা যাইতাছি। তোমার চাচী আর ছেলে মেয়েদের গতকাল পাঠায়া দিছি।
শাহাদতকে সামনে দেখে তার উদ্দেশ্যে বললেন শরীফ চাচা।
- ভালই করেছেন, চাচা। বলল শাহাদাত।
- তা তোমরা এখনো পইড়া আছ ক্যান?
কথাটা বলেই শরীফ সাহেব খেয়াল করলেন শাহাদতের আব্বা পিছনে দাঁড়িয়ে আছেন। মিন মিন করে তিনি বললেন,
- ভাই সাহেব, শহরে থাকন এখন ঠিক না। সব স্ট্রাটেজিক পয়েন্টে ওরা দাঁড়াইয়া আছে। শুনলাম যে কোন সময় হাউজ টু হাউজ সার্চ করব।
- করলে করবে। আমার বাসায়তো অস্ত্র-শস্ত্র, গোলা-বারুদ নাই।
আব্বা কষ্টে হাসার চেষ্টা করলেন।
- আপনার বাড়িতে তিনখান জোয়ান পোলা আছে।
- খামকা আর্মি ওদের ধরবে কেন? ওরাতো রাজনীতি করে না।
- সময় খুব খারাপ ভাইসাব, শুনছি আর্মি ব্যাটারা আগে মানুষ মারে তারপর জানতে চায় কে কি করে। এবার আব্বা সত্যি সত্যি হাসলেন।
- শরীফ সাহেব, শোনা কথায় বিশ্বাস করবেন না। কোন সভ্য দেশের আর্মি বাড়িতে ঢুকে নিরীহ নাগরিকদের মারে না।
- আব্বা, পাকিস্তান আর্মি কি সভ্যদেশের নিয়ম জানে? শাহাদত জানতে চাইল।
- জানার কথা, পাকিস্তান আর্মি একটা ডিসিপ্লিন্ড আর্মি।
- জানে না, ভাইসাব। আমাদের শহরে ঢুকার মুখে আমিন সাহেব, সবুর সাহেব আর আহমদ সাহেবের বাড়িতে ঢুইকা পাঁচটা জোয়ান ছেলেরে মারছে। এবার কি বাবার টনক নড়ল? মুখ দেখে বোঝা যায় না। অন্য কথা পাড়লেন শরীফ চাচা। শাহাদাতকে বললেন,
- বাবারা, এইবার ছাদের উপর থাইকা নিশান নামাইয়া ফেল। মাউড়ারা এই বাড়ি টার্গেট করব, আমার বাড়িও বাঁচব না। ইতিমধ্যে আশফাক এসে তাদের সাথে যোগ দিয়েছে, শরীফ চাচার কথা শুনেই সে রেগে গেল, বলল,
- যে পতাকা একবার তুলেছি সেটা আর নামাতে পারব না, চাচা।
এটা বেয়াদবীর পর্য্যায়ে পড়ে। আব্বা মুখ লাল করে কি বলতে যাচ্ছিলেন, তার আগেই বড় রাস্তার দিক থেকে ব্রাশ ফায়ার এবং ভারী গাড়ি ঘষ্টে চলার শব্দ শোনা গেল। শরীফ চাচা বাড়ির পিছনে ঝোপের আড়ালে একটা আলপথে সুড়ুৎ করে হাওয়া হলেন। শব্দ থামলে আব্বা বললেন,
- পতাকা এখনো নামাও নি কেন?
- এত দূর থেকে কে ফ্ল্যাগ দেখবে, আব্বা? পাকিস্তান আর্মিতো আমাদের ঘর পর্যন্ত আসছে না। বলল আশফাক।
- চুপ, বেয়াদব।
এক ধমক দিলেন আব্বা। অতএব, ফ্ল্যাগ নামাতে ছাদে উঠল শাহাদাত। একা, কারণ আশফাকের এক কথা, যে পতাকা সে উঠিয়েছে সেটা সে নামাবে না। পাশা পাশি কালো আর লাল-সবুজ-সোনালী পতাকা। পূর্ব দিকে একটা বড় জারুল গাছে রাস্তা থেকে ঢাকা পড়েছে পতাকাটা। শাহাদাতদের বাসার বাউন্ডারীর পার হয়ে পাড়ার সরু রাস্তা, তারপর ছোট ঝিল, ঝিল পেরিয়ে সদর রাস্তা। সদর রাস্তায় এক উঁচু ভবনে আস্তানা নিয়েছে পাক আর্মি, জারুল গাছের আড়ালে দূর থেকে শাহাদাতকে দেখতে পারার কথা নয়. কিন্তু কালো পতাকা মাত্র নামানো মাত্রই শুরু হল গোলাগুলি। শাহাদাতকে লক্ষ্য করে নয়, তবু তার চারপাশে উড়তে লাগল গুলি, রকেট। ভয় জাগানিয়া বিচিত্র শব্দ শোনা যেতে লাগল। বাংলাদেশের পতাকা না নামিয়েই দ্রুত ছাদ থেকে নেমে এল শাহাদত। সন্ধ্যার পর দেখা যাবে। সন্ধ্যার আগে পাকিস্তান আর্মির সভ্যতা বোধের উপর আব্বার বিশ্বাস ভেঙ্গে পড়ল। বাসার সামনের রাস্তা দিয়ে পলায়নরত পরিবার গুলির কাছ থেকে পাক আর্মির নৃশংসতার প্রত্যক্ষ বর্ণনা শুনে মুখ কালো হয়ে গেল তার। মুর্ছিতা এক মাঝ বয়সী হিন্দু মহিলাকে বয়ে নিয়ে যাচ্ছিল তার পরিজনেরা। কলেজে পড়া তার দুই ছেলেকে তার সামনেই গুলি করেছে।
- এরা কী মানুষ! আব্বা বললেন।
- না, পাকিস্তান আর্মি। বলল শাহাদত।
সন্ধ্যায় পর ছাদে উঠা গেল না। বড় রাস্তার উপর বড় বাড়ির ছাদে সার্চ লাইট ফিট করেছে আর্মি। সেটা ঘুরে ঘুরে চারপাশে আলো ফেলছে, শাহাদাতদের বাসাও বাদ যাচ্ছে না। আব্বা বললেন,
- থাক্, রাতে ছাদে উঠতে হবে না। জারুল গাছ আছে কেউ দেখবে না।
মেঝেয় বিছানা ফেলে রাতে শোয়া হল। জানালা বরাবর শোয়ার ভরসা হল না। শুয়ে শুয়ে ফিস ফিস করল আশফাক,
- ছাদে উঠেছিলাম, ভাইয়া।
- ফ্ল্যাগ নামিয়েছিস?
এ কথার জবাব না দিয়ে অন্য কথা বলল আশফাক,
- একটা কাজ করেছি, চক দিয়ে ছাদের এ মাথা থেকে ও মাথায় লিখে এসেছি, "আবার ফিরে আসব।"
- কী সাংঘাতিক! যদি কেউ দেখতো?
আশফাক উত্তর দে’য়ার আগেই আব্বা ধমকে উঠলেন,
- এ্যাই, ঘুমা।
সারা রাতই মেশিন গানের শব্দ, রকেট ছাড়ার শব্দ, ট্যাঙ্কের গোলার শব্দ শোনা গেল। ছাড়া ছাড়া ঘুম হল। সকালে ঘুম থেকে উঠে শাদা খিঁচুড়ী দিয়ে নাস্তা সারতে হল। ডিম নেই। খাওয়ার পর আব্ব বললেন,
- এবার রওয়ানা দে’য়া যাক।
- জামা কাপড় গুছাতে হবে না? আম্মা বললেন।
- হ্যাঁ:, আমরা যেন সফরে যাচ্ছি! স্রেফ পালাচ্ছি, বুঝেছ? পালাচ্ছি। এদিকটা একটু ঠান্ডা হলেই ফিরে আসব। গায়ে ভদ্রসুরৎ জামা পরে নাও আর দুই সেট জামা কাপড়, তোয়ালে, সাবান, টুথব্র্রাশ, টুথপেস্ট এই সব নিয়ে নাও। চার পাঁচ দিনের মামলা, ইন্শাল্লাহ্।
চার পাঁচ দিন কথাটার উপর জোর দিলেন আব্বা, নিজের বিশ্বাসটাকে ফিরে পাওয়ার জন্যে কি না কে জানে।
- শ্রীনগর, মোহাম্মদ উল্লাহ্ বাড়ি। যাওয়ার সময় ঠিকানা দিয়ে গিয়েছে। আপাতত: সেখানেই উঠব।

আব্বার বিশ্বাস আর ফিরে এল না। চার পাঁচ দিনে ফেরা হল না, চার পাঁচ মাসেও না। অনেক পথ ঘুরে চৌদ্দগ্রামে নিজেদের বাড়িতে এল তারা। এসে খবর পেল তাদের শহরের বাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে পাক আর্মি। নিতাইগঞ্জে আব্বার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, মানে তেলের গোডাউন এবং লাগোয়া অফিস ঘরের মালামাল লুট হয়ে গেছে। তাঁর ছিল ভোজ্য তেল আমদানীর ব্যবসা। নতুন করে ব্যবসা শুরু করার সাধ্য আব্বার নেই, অন্তত: এই সময়ে। আব্বা তাই সব ‘ঠান্ডা হওয়া’র আগে পর্যন্ত নিজের বাড়িতে থাকা ঠিক করলেন। ঠান্ডা হলে আব্বা ফিরতেন কি না, শাহাদত জানে না। জানবেনই বা কি করে? আশফাক বাড়ি থেকে পালাল মে মাসে, জুনে পালাল শাহাদত। সে এক কান্ড! ঢাকা ইউনিভার্সিটির ফিজিক্স-এর নওশের আর এপ্লাইড কেমিস্ট্রির শাহজাহানের সাথে যোগাযোগ হয়ে গেল ফেনী বাজারে । নওশের নারায়ণগঞ্জের ছেলে, যদিও ইস্কুলে তার সাথে পড়েনি, পড়েছে একক্লাস নীচে। তিনজন একসাথে মিলে পরশুরাম-বেলুনিয়া হয়ে ত্রিপুরার মেলাঘরে মুক্তিবাহিনীর সাথে মিলল। সহজে কি ঢোকা যায়, তবু শেষ পর্যন্ত জায়গা পাওয়া গেল। একটু হতাশ হল শাহাদাত। আশফাক আছে অন্য সেক্টরে, তেলিয়াপাড়ার কাছে। তবু কষ্ট আর এডভেঞ্চার মিলে দিন কাটতে লাগল তার। পুরোটাকেই এডভেঞ্চার হিসাবে নিল সে, শারীরিক কষ্ট, খিদের কষ্ট, ঘুমের কষ্ট, সব, নইলে টেঁকা যেত না। বাড়ির জন্যে মন খারাপ হতো, মা’র কথা ভেবে মন খারাপ হত, তবু অভুক্ত অবস্থায় মাইলের পর মাইল হেঁটে নতুন এক সম্ভাবনার আশায় এবং অপারেশনের উত্তেজনায় সব কষ্ট সে ভুলে যেত । এ ভাবে আশফাকের সাথে একবার দেখা না হওয়াও সে ভুলে গেল। দিন গেল, যুদ্ধ ও এক সময় একটা দিক নিল বলে মনে হল। ঈদের দিন তারা জানল খুব শিগ্গিরই সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হবে। ভারতের সাথে যৌথ কমান্ড গঠিত হবে, দেশে যেতে আর বেশী বাকি নেই। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে একদিন নওশের বলল,
- জানো, সাঈদ’রা স্বাধীন দেশে ঢুকে গেছে। যশোরের নাভারণে।
- সত্যি! আনন্দে চিক চিক করে শাহাদতের চোখ।
- আর দু’টা দিন অপেক্ষা কর, আমরাও ঢুকছি।
সেই ঢোকা হল ডিসেম্বরের ১২ তারিখে। বাড়িতে ফিরল শাহাদত ডিসেম্বরের ১৫ তারিখে। গগণ বিদারী উল্লাস তখন চারদিকে। ১৬ তারিখটা শুধু সরকারী ভাবে বিজয় ঘোষণার জন্যে বাকি রইল।

তাকে দেখে মা কেঁদে কেটে একসা।
- আমার আশফাক কোথায়, বাবা।
"আশফাক ফেরেনি?" বলতে গিয়ে কথাটা গিলে ফেলল শাহাদত।
- আশফাক? ও আশফাক সিলেটে আছে। অন্য সেক্টরে যুদ্ধ করেছেতো, ফিরতে সময় লাগবে।
মা কি বুঝলেন কে জানে, চোখ মুছলেন।
আরো কিছু দিন কেটে গেল। আশফাক ফিরল না। কার কাছে খবর নেবে শাহাদত? তেলিয়াপাড়ায় যুদ্ধ করেছে এমন কাউকে সে চেনে না। তবু দিন থেমে থাকে না। আশফাককে দেখেছেন এমন এক জনের সাথে তার দেখা হয়ে গেল এক দিন চৌদ্দগ্রাম বাজারে। ইপিআর-এর এক জওয়ান ছিলেন।
- আশফাক? শ্যামলা, বড় বড় চোখ?
- হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমার ভাই। দেখেছেন তাকে?
- দ্যাখ্ছি মানে? আমার লগেইতো আছিল নভেম্বরের শেষ পর্যন্ত। সে ফিরে নাই?
এমন সর্বাত্মক যুদ্ধে আশফাক কি হারিয়ে গেল? আব্বা থম ধরে বসে রইলেন। চোখ লাল করে বসে থাকল ইশফাক। অপেক্ষা করা ছাড়া কি করার আছে তাদের? পুরো ডিসেম্বর বাড়িতে থাকল শাহাদাত। অনেক মুক্তিযোদ্ধার সাথে তার দেখা হল যারা আশফাক কে চেনে, কিন্তু তারা কেউই আশফাকের খবর দিতে পারল না। ডিসেম্বর গেল আশফাক ফিরলো না। কাঁহাতক আর স্তোক দিয়ে মা’কে ধরে রাখা যায়? এদিকে শাহাদাতকে ঢাকা যেতে দিচ্ছেন না মা। জানুয়ারীর মাঝামাঝি মা’কে বোঝাল শাহাদাত, ঢাকায় গিয়ে আশফাকের খবর বের করতে হবে। । এদিকে ইউনিভার্সিটিতে ক্লাস শুরু হয়ে যাচ্ছে। আব্বাও নারায়ণগঞ্জ যেতে চাচ্ছেন, বাড়ি ঠিক ঠাক করতে হবে, নতুন করে ব্যবসা শুরু করতে হবে।

ষ্টেশনের কাছে স্টার হোটেল -এ লাঞ্চ সেরে তারা দু’জন শহরে ঢুকল । বড় রাস্তার দু’পাশের বাড়ি ঘর আগের মতই আছে। কালীর বাজারের কাছে দু’একটা দোকান নতুন মনে হল। লোকের মধ্যে উচ্ছাস কি একটু বেশী, না শৃংখলার অভাব? ঠিক বুঝতে পারে না শাহাদত। পথে আব্বার এক পরিচিত লোকের সাথে দেখা। রিকশা থামিয়ে তাকে ডাকলেন আব্বা।
- আসগর সাহেব,কোথায় যাচ্ছেন?
ভদ্রলোক থামলেন।
- আরে হামিদ সাহেব যে! ছিলেন কোথায় এতদিন? মুক্তিযুদ্ধে?
- না, বাড়িতে। আমার ছেলেরা মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিল।
আব্বার মুখে ঈষৎ গর্বের ছোঁয়া। ভদ্রলোক শাহাদতের দিকে তাকালেন।
- এটি আপনার ছেলে বুঝি? মুক্তিযোদ্ধা? বা: বা:। সময় থাকতে কিছু বাগিয়ে নাও হে। এত বড় একটা কাজ করেছ!
শাহাদতের রাগ হল। মুখের উপর একটা জবাব দিকে চাইছিল, আব্বার মুখের দিকে তাকিয়ে কোন জবাব দিল না। পাড়ায় ঢুকে ধ্বংসলীলা চোখে পড়ল। প্রথম বাড়িটা ভাল আছে। তারপর কয়েকটা বাড়ি যেন ছাড়া বাড়ি। লোক আছে কি না বোঝা যায় না। তাদের পাশে শরীফ সাহেবের বাড়িটা আস্ত আছে, কিন্তু দরজা জানালা নেই। নিজেদের বাড়িটা দেখে ধ্বক করে উঠল শাহদাতের বুক। দরজা জানালা সহ বিল্ডিং যদিও অটুট আছে কিন্তু কেমন যেন পোড়োবাড়ি পোড়োবাড়ি ভাব। গেইটটা হাট খোলা, মাঠ জঙ্গলে ভরে গেছে। পোর্টিকো দিয়ে উঠেই ড্রয়িং রুমের দরজা, সেটাই বাড়ির একমাত্র এন্ট্রি পয়েন্ট। দরজা ধাক্কা দিতেই খুলে গেল। ধুলি ধুসর দুটো কাঠের চেয়ার পড়ে আছে, শাহাদতদের সোফাসেটের চিহ্ন পর্যন্ত নেই। দেয়ালের গোলাপী ডিস্টেম্পার ধোঁয়ায় কালো হয়ে গেছে। ছাদের দিকে তাকালো তারা। সিলিং ফ্যানটা কালো বাদুড়ের মত ঝুলছে। আগুনের তাপে কুকড়ে গেছে ডানা গুলি। অন্য ঘরগুলির অবস্থা একই। আব্বা শুধু বললেন, ‘হার্ম্মাদ’!
রান্নাঘর এবং ভিতরের ঘর দুটি দেখে মনে হল, এ গুলি ব্যবহার হতো। ফ্রিজ পুড়ে গেছে। টিভি নেই, আলমিরা নেই, খাটের জায়গায় এক ঘরে দুটো চৌকি। রান্নাঘরে গ্যাসের চুলা ব্যবহার হতো মনে হয়। তার মানে কেউ এখানে ছিল। সম্প্রতি চলে গেছে। টেলিফোন সেট আছে, লাইন নেই। আব্বা বললেন,
- আমি যাই, কিছু লোক নিয়ে আসি।
আব্বা বেরিয়ে যেতেই পিছনের দে’য়ালে গাঁথা লোহার সিঁড়ি বেয়ে শাহাদাত তর তর করে ছাদে উঠলো। আশফাকের ছেলেমানুষীর চিহ্ন এখনো ছাদে আছে কি না সে দেখতে চায়। চক দিয়ে সে লিখে গিয়েছিল, "আবার ফিরে আসবো।" কোথায় সে লেখা? শ্যাওলা জমেছে ছাদে, লেখাটা নেই। শেষ পৌষের মৃদু বাতাসে শির শির করে কাঁপছে জারুলের পাতা, দুলছে তার ডাল। আরে! ডালের গায়ে হেলে পড়া, ফেটে যাওয়া পঁচা বাঁশের ডগায় পড়ন্ত রৌদ্রের সোনালী আলোয় ঝিকমিক করছে কে? দ্বিতীয়বার চমকাল শাহাদাত। রৌদ্রে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে সবুজ রং এখন বিবর্ণ, লাল বৃত্ত এখন কমলা, সোনালী ম্যাপে সোনা ঝরছে না, তবু উড়ছে। আশফাক ফিরে এসেছে! চীৎকার করে বলতে ইচ্ছা হল তার, ”আশফাক ফিরে এসেছে!” ১
এখন সাকুল্যে দশ বারো জন ছাত্র আছে হলে। একা ঘরে থাকতে ভয় করে তাই ফিলোসফির রকিব রাতে তার ঘরে ঘুমোতে আসে। খানদের সাথে যুদ্ধ করে দেশকে মুক্ত করা যাদের উদ্দেশ্য তাদের এতো ভয় পেলে চলে না। তবু ভয় তো কোন ফর্মুলা মেনে আসে না! শাহাদাত বুঝতে পারে না সে কি করে। শেখ সাহেব যেন অন্তহীন আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন ইয়াহিয়া খানের সাথে। তিনি কি অখন্ড পাকিস্তান এখনো আশা করেন? অস্থিরতা, উত্তেজনায় দিন কাটছে, রাত কাটছে আশংকায়। বাইশে মার্চ হল ছাড়ল শাহাদত। নারায়ণগঞ্জ শহরে এসে শাহাদত দেখে তার বয়সী ছেলেদের মধ্যে সমান উত্তেজনা। ছোট ভাই আশফাক এসএসসি পরীক্ষা দেবে এবার কিন্তু বই খাতা পড়ে আছে এক কোনে অবহেলায়। বন্ধ‍ুদের সাথে সারা বিকাল হৈ হৈ করে বেড়াচ্ছে। তার ধারণা দেশ স্বাধীন হলে একবারেই পরীক্ষা দেবে। সব ছোট ইশফাকের দেশের স্বাধীনতা নিয়ে এত ভাবনা নেই, এক সময় হলেই হল। সে একটা ম্যাজিকের বই কিনে ম্যাজিক শিখছে, বড় হলে ম্যাজিশিয়ান হওয়ার ইচ্ছে। সমস্যা হল আব্বাকে নিয়ে। পাটের ব্যবসায় মোটামুটি ভালই লাভ করছিলেন, অনিশ্চিত অবস্থায় ব্যবসায় ভাঁটা পড়েছে তার। সামনে কী যে হয়! পাকিস্তানের অবিনশ্বরতায় তার বিশ্বাসে চিঁড় ধরেছে, তবু ফচকে ছোঁড়াদের লাফালাফি, "বীর বাঙালী অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর", শ্লোগানে তার বুকে খিঁচ ধরে।
- হলে থাকা আর পোষাল না?
- হলে আর দুই পারসেন্ট ছাত্রও নেই বাবা। ক্যান্টিন বন্ধ হয়ে গেছে, ছাত্ররা সবাই যারযার বাড়ি চলে গেছে।
- তা হলে কি করে থাকবি। তবে আমি সাফ বলে দিচ্ছি ঐ সব বীর বাঙালী শ্লোগান আর গাঁদা বন্দুক নিয়ে মার্চ করা ছেলেদের সাথে মিশবে না।
- মিশব কি? তারা আমাকে সঙ্গে নিলেতো!
রাগ করে বলল শাহাদাত। বিকালে সে আর আশফাক বেরোল রেকী করতে, মানে আর কি, কে কোথায় কি করছে দেখতে আর শহরের ছেলেপিলেদের আগামী কালের প্ল্যান কি জানতে। কেমন একটা ছুটি ছুটি ভাব শহরে। এটা অবশ্য মাসের প্রায় প্রথম থেকেই চলছে। ৭ই মার্চ থেকে তো বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে দেশ চলছে। সরকার নেই বললেই হয়। সবকিছু ঢিলে ঢালা চলছে তবে আইনশৃঙ্খলা ঠিক আছে। অনেক বাড়িতে কালো ফ্ল্যাগ উড়ছে। আগামী কাল ২৩ শে মার্চ পাকিস্তান দিবসে সকল বাড়িতে সবুজ লাল বৃত্তের মাঝখানে সোনালী ম্যাপ নিয়ে বাংলাদেশের পতাকা উড়বে।
- ফ্ল্যাগ জোগাড় করছস্?
জানতে চাইল মুস্তাফিজ। সে এঞ্জিনীয়ারিং ইউনিভার্সিটির হল ছেড়ে আপাতত: নারায়ণগঞ্জে ঠাঁই নিয়েছে।
- না। তোর কাছে আছে?
- একটা স্পেয়ার আছে, তোরে দিতে পারি।
মুস্তাফিজের চাষাড়ার বাসায় শাহাদত আর আশফাক গেল। মুস্তাফিজ বের করল দুই ফুটি একটা পতাকা। ম্যাপটা সোনালী নয় হলুদ, বাংলাদেশের মানচিত্র ও কেমন যেন থ্যাবড়া, তবু থাবড়া মেরে পতাকাটা নিল আশফাক। এই মূহুর্তে এটাই তো আমাদের প্রাণের পতাকা।
বাসায় ব্যাপারটা এত সহজ হল না। ভেবেছিলএখন তাদের ঘরে লুকিয়ে রেখে দেবে, কাল সকালে ছাদে কালো পতাকার পাশে আরেকটা বাঁশ বেঁধে টাঙ্গিয়ে দেবে। গাধা আশফাকের জন্যে ফাঁস হয়ে গেল সব কিছু। সে আম্মাকে দেখাতে গেল, "আম্মা দেখ, কি সুন্দর বাংলাদেশের ফ্ল্যাগ!" আম্মা কিছু বলার আগেই আব্বা ঘরে ঢুকে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। তক্কে তক্কে ছিলেন মনে হয়। ছেলেদের মতি গতি ইদানিং তার সুবিধার মনে হচ্ছিল না। চেঁচামেচি শুরু করলেন তিনি, "কি আরম্ভ করছস্ তোরা? কালো ফ্ল্যাগ টাঙ্গালি টাঙ্গালি, এখন পাকিস্তান দিবসে স্বাধীন পূর্ব পাকি¯তানের ম্যাপ টাঙ্গাতে চাস? "
- স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের ম্যাপ না বাবা, স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা।
- ঐ হইল। শেখ সাহেব তো বলছে কনফেডারেশন করবে। ইয়াহিয়া মেনে ও নিতে পারে। না, না, এখন বাংলাদেশের ফ্ল্যাগ টাঙ্গানো যাবে না। এইটা বেশী বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে।
"আশার ছলনে ভুলি কী ফল লভিনু হায়," মনে মনে ভাবল শাহাদাত। আব্বা এখনো আশা করে আছে পাকিস্তান টিকে যাবে! একদিন "লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান" করেছেল সে স্মৃতি ভুলতে পারেনি। বাবাকে শান্ত করার জন্যে সে বলল, ”ফ্ল্যাগে কি অসুবিধা, বাবা? কনফেডারেশন হলেও তো ষ্টেটের ফ্ল্যাগ থাকতে পারে।”
- হ্যাঁ, পারে, সে রকম রাষ্ট্রীয় স্বিদ্ধান্ত যদি নে’য়া হয়।
আম্মা এত কুট কচালীর মধ্যে গেলেন না, এক কথায় মামলা নিস্পত্তি করে দিলেন।
- টাঙ্গাবি। সুন্দর পতাকা।
- কী বলছ তুমি শাহাদতের মা? আমাদের এ্যারেস্ট করে নিয়ে যাবে।
- কে এ্যরেস্ট করবে? কালো পতাকাতো টাঙ্গালো এর আগে, কেউ কিছু করল?
গণভোটে আব্বা পরাস্ত হলেন। পরদিন সকালে পত পত করে ৬৭নং আমলাপাড়ার ছাদে বাংলাদেশের পতাকা উড়ল। আরো অনেক বাসার ছাদেও কালো পতাকার পাশে আজ বাংলাদেশের পতাকা উড়ছে। একটু আপত্তি করলেন প্রতিবেশী শরিফ চাচা। শাহাদাতদের বাড়ির লাগোয়া নতুন বাড়ি বানিয়েছেন ভদ্রলোক, বড় মায়া বাড়ির প্রতি। রোজ সকালে ঘুরে ঘুরে চারপাশ দেখেন।
- পতাকাতো উড়াইলা ভাতিজারা এক্কেবারে আমার বাড়ি বরাবর। গাছের জন্য তোমাদের বাড়ি দেখা যায় না, মনে হয় আমার বাড়িতেই পতাকা উড়তেছে।
- অসুবিধা কি চাচা? এক ঢিলে দুই পাখী মারা হল। কথাটা খুব সুপ্রযুক্ত হল তা নয়, তবুও বলল শাহাদাত।
- না, না, অসুবিধা না, তবে পরে আবার রাষ্ট্রদ্রোহীতার মামলা না কইরা দেয়।
কথাটা আব্বার খুব পছন্দ হল।
- আমি এই জন্যে বলছিলাম পতাকা না টাঙাতে। ছয় দফা ঠিক আছে, স্বাধীন বাংলাদেশ আবার কি? তোরা না নামালে আমি গিয়ে ফ্ল্যাগ নামাবো।
- এখন উপরে গিয়ে পতাকা নামালে সবাই তোমাকে ভূট্টো-ইয়াহিয়ার চর বলবে। আশফাক বলল,
- বলুক। চিৎকার করে উঠলেন আব্বা, শরীফ সাহেব পর্যন্ত চমকে গেলেন। চিৎকারে আব্বার উষ্মা ছাড়া পেল, শেষ পর্যন্ত ফ্ল্যাগ নামাতে তিনি ছাদে উঠলেন না।
শহরে কিছু লোকের উৎকণ্ঠা সত্বেও তরুনদের মধ্যে পতাকা উড়াতে উৎসাহের কমতি নেই। আরেকটা দিন কেটে গেল, রাতে রেডিওর খবরে শোনা গেল ইয়াহিয়ার সাথে শেখ মুজিবের আলোচনা কোন সমাধানে পৌঁছুতে পারেনি।
- সমাধানে না পৌঁছানো তো ভালই, কি কস্? এখন বঙ্গবন্ধু মুক্তির ডাক দিতে পারে। পরদিন বন্ধু মুস্তাফিজ বলল।
- এতো সোজা না! মাউড়ারা প্লেনে কইরা অস্ত্র আনতেছে। বলল দুলাল।
- তা হলেতো এখনই স্বাধীনতা ঘোষণা করতে হয়।
এমন ভাবে বলল শাহদাত যেন যুদ্ধ ঘোষণাটা তার দায়িত্ব। বেকার সময় কেটে গেল যুদ্ধের স্ট্রাটেজী কি হবে তার আলোচনায়। এখন তো অন্তহীন ছুটি, কি আর করার আছে?
পঁচিশ তারিখ দিনটা কেটে গেল রাইফেল ক্লাব আর ব্যক্তিগত সংগ্রহের অস্ত্র নিয়ে মার্চপাস্ট দেখে আর গুজব শুনে। রাতে ঘুম ভাল হল না। সারা সাত একটা অস্বস্তিতে এ পাশ ও পাশ করল শাহাদত। সকাল অন্যদিনের মত হল না, শরীর ম্যাজ ম্যাজ করছে। ডিম পোচ আর পাঁউরুটি দিয়ে নাস্তা সারলো শাহাদত, তারপর রেডিও ধরল । গান হচ্ছিল রেডিওতে, "পলাশ ঢাকা, কোকিল ডাকা আমার এ দেশ ভাইরে।" সাতটার খবরের সময় এখন, অথচ খবরের নাম নেই। ঘুরে ফিরে শুধু "পলাশ ঢাকা, কোকিল ডাকা।" গান ভাল, কিন্তু এত ভাল ভাল না। ঠিক তাই। একটু পর এক অবাঙালী গলা বলল, "আভি আপ এক জরুরী এলান সুনিয়ে", তারপর গড় গড় করে সামরিক আইনের ধারা বলে গেল। শহরে কারফিউ জারী করা হয়েছে। সকল পতাকা সরিয়ে ফেলতে বলা হল। পথে কোন প্রতিবন্ধকতা থাকলে সরিয়ে ফেলতে নির্দেশ দে’য়া হল, না হলে পার্শ্ববর্তী অবকাঠামো সহ ধ্বংস করে দে’য়া হবে, ইত্যাদি ইত্যাদি। সর্বনাশ নতুন করে মার্শাল ল’ জারী হল না কি? বাসায় জটলা বসল। আব্বা বললেন, "নিশ্চয়ই সাংঘাতিক কিছু হয়েছে। আমি তখনই বলেছিলাম এত বাড়াবাড়ি করো না, সবার সাথে হাতাহাতি, তা বলে দারোগার সাথে হাতাহাতি?"
- শেখ সাহেব তা হলে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন? জানতে চাইল আশফাক।
- আমি কি করে বলব? ঢাকায় থাকলে জানা যেতো। বলল শাহাদাত।
- রেডিওতে ঘোষণা করবে না? জানতে চাইল ইশফাক। কি বোকার মত প্রশ্ন!
- আরে আহাম্মক, রেডিও তে ঘোষণা করার অবস্থা হলে তো ঢাকা শহরই দখলে থাকত।
অবস্থা ভাল না, আরো কিছুক্ষণ পর টেলিফোনে না না বার্তা আসতে লাগল। ঢাকা শহরের সাথে টেলিফোন যোগাযোগ নেই, কিন্তু এই শহরের ম্যানুয়েল টেলিফোন লাইন এখনও আছে। মুস্তাফিজ জানালো ইকবাল হল, জগন্নাথ হলে অসংখ্য ছাত্রকে মিলিটারীরা হত্যা করেছে। রোকেয়া হলেও তারা ঢুকেছিল এবং মেয়েদের মেরেছে। পুরানো রেললাইনের পাশে বাবুপুরা বস্তি পুড়িয়ে দিয়েছে। ঢাকা থেকে পালানো লোকদের মুখে তার একথা শোনা। অন্য যাদের সাথে কথা হল তারা একই কথা বলল। আটটার খবরে ভারতীয় আকাশবাণী থেকে ঘোষণা করা হল, "পূর্ব বাংলায় গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছে"। যুদ্ধ তাহলে শুরু হয়েছে?
- এখন দেখ সব ঠিক হয়ে যাবে। সুড় সুড় করে সবাই আলোচনার টেবিলে বসবে। গোলমাল ঠান্ডা হলে দেখিস ইয়াহিয়া শেখ সাহেবের হাতেই ক্ষমতা হস্তান্তর করবে।
- তুমি বলছ কি আব্বা, এতোগুলি নিরিহ ছাত্রকে মেরে ফেলল, ঘরবাড়ি পুড়িয়ে ফেলল, তারপরও পাকিস্তান এক থাকবে? আব্বার কথার প্রতিবাদ না করে পারল না শাহাদাত । অসহ্য লাগল তার আব্বার পাকিস্তান ভক্তি।
- হলে ঢুকে ছাত্র মারতে কে দেখেছে? যারা পালিয়ে আসছে তারা ভয়ে পিছন ফিরে তাকায়নি। ভয় দেখানোর জন্যে আর্মি হয়তো গোলাগুলি করছে, রেললাইনের ধারে কিছ খোড়ো ঘরে আগুন দিয়েছে। একটা সভ্য আর্মি ঘরে ঢুকে নিরিহ মানুষ মারতে পারে না।
নারায়ণগঞ্জ শহরে লোক চলাচল মোটামুটী স্বাভাবিক। এখানে কারফিউ নেই। রাইফেল ক্লাবের মাঠে অস্ত্রের মহড়া হল। ভয়াবহ খবর শোনা যেতে লাগল বিকেল নাগাদ। ঢাকা থেকে পালিয়ে আসা লোকের সংখ্যা অনেক। শহরের রাস্তায় এমনিতে লোক চলাচল কম, কিন্তু এই অল্প লোক চলাচলও নিরস্ত করতে পারল না শাহাদত আর আশফাককে। পথে মুস্তাফিজকে ও নিল। ইশফাক এসবের মধ্যে নেই। তার ভয় বেশী। কিছু লোক শীতালক্ষ্যা পাড়ি দিয়ে গ্র্রামের দিকে চলে যাচ্ছে। জাহাজঘাটে লঞ্চ বা জাহাজ নেই, নৌকায়ই যাচ্ছে তারা। তাদের একজন, পটুয়াটুলীর এক মাঝ বয়সী কাপড় ব্যবসায়ী জানালেন সারা রাত পায়ে হেঁটে তিনি এই শহরে এসেছেন। ভাগ্যিস পরিবার সাথে নেই। তার বাড়ি বিক্রমপূরের শ্র্রীনগর।
- ঢাকা শহরের অবস্থা কেমন, চাচা?
- আমার মনে হয় শহরের লাখ খানেক মানুষ মাইরা ফালাইছে। শাখাঁরী বাজার শেষ!
- না: এতো হইবে না। দশ বারো হাজার হইবার পারে। অন্য এক দোকানী বললেন।
সংখ্যা এবং ব্যপকতা সম্মন্ধে মত পার্থক্য থাকলেও পাকিস্তানী সৈন্যদের তান্ডবলীলা এবং নৃশংসতা সম্মন্ধে সবাই একমত। তাদের একজন বলল,
- আপনেরাও ভাগেন। শহরে থাইকেন না। হার্ম্মাদরা এই দিকে আসতেছে।
হার্ম্মাদ মানে পাক আর্মি। ভাল নাম দিয়েছে। কথাটা আব্বাকে এসে বলল আশফাক। আব্বা বললেন,
- পর্ত্তুগীজ জলদস্যুদের হার্ম্মাদ বলতো। তারা মানুষ মারতো, লুটতরাজ করতো। এরা আইন-শৃংখলার নামে যদিও কিছু মানুষ মেরেছে তবু এখনো হার্ম্মাদ বলা যায় না।
- কখন বলা যাবে আব্বা? আশফাক জানতে চায়। আব্বা কোন উত্তর দেন না।
পরদিন শহরের বিপুল সংখ্যক লোক শহর ত্যাগ করা শুরু করল। শাহাদতদের প্রতিবেশী কয়েকজন চলে গেলেন কাছাকাছি গ্রামে। আব্বা প্রতিবেশীদের ভয়ের বহর দেখে তাজ্জব।
- ভীতুর ডিম কোথাকার! নিজের ঘরে শান্তিতে বসে থাক্, তা না আর্মিরা ঘরে এসে মেরে ফেলবে এই ভয়ে পালাল। নিরিহ গেরস্থ মানুষ, তোদের মারতে যাবে কেন?
আব্বাকে বোঝানো গেল না যে এবারের ব্যাপারটা এত সোজা না। এটা '৫২-র ভাষা আন্দোলন বা '৬৯-এর গণ আন্দোলন না। ছেলে ছোকরারা শহরের প্রবেশ পথে আলকাতরার ড্রাম, রেলের ওয়াগন, ইটের স্তুপ দিয়ে ব্যারিকেড দিয়েছে। এক তরুন নেতা বললেন,
- এই শহর আমাদের দূর্গ।
দু:খের বিষয়, চতুর্থ দিনে দূর্গ ভেঙ্গে পড়ল, আর্মি কলাম শহরে ঢুকলো। শহরের নব্বুই ভাগ লোক শহর ছেড়ে পালিয়েছে। ট্যাঙ্ক দিয়ে ব্যারিকেড ভেঙ্গেছে আর্মিরা।

পরদিন সকালে এসে হাজির হলেন প্রতিবেশী শরীফ চাচা।
- অমি গ্রামে চইলা যাইতাছি। তোমার চাচী আর ছেলে মেয়েদের গতকাল পাঠায়া দিছি।
শাহাদতকে সামনে দেখে তার উদ্দেশ্যে বললেন শরীফ চাচা।
- ভালই করেছেন, চাচা। বলল শাহাদাত।
- তা তোমরা এখনো পইড়া আছ ক্যান?
কথাটা বলেই শরীফ সাহেব খেয়াল করলেন শাহাদতের আব্বা পিছনে দাঁড়িয়ে আছেন। মিন মিন করে তিনি বললেন,
- ভাই সাহেব, শহরে থাকন এখন ঠিক না। সব স্ট্রাটেজিক পয়েন্টে ওরা দাঁড়াইয়া আছে। শুনলাম যে কোন সময় হাউজ টু হাউজ সার্চ করব।
- করলে করবে। আমার বাসায়তো অস্ত্র-শস্ত্র, গোলা-বারুদ নাই।
আব্বা কষ্টে হাসার চেষ্টা করলেন।
- আপনার বাড়িতে তিনখান জোয়ান পোলা আছে।
- খামকা আর্মি ওদের ধরবে কেন? ওরাতো রাজনীতি করে না।
- সময় খুব খারাপ ভাইসাব, শুনছি আর্মি ব্যাটারা আগে মানুষ মারে তারপর জানতে চায় কে কি করে। এবার আব্বা সত্যি সত্যি হাসলেন।
- শরীফ সাহেব, শোনা কথায় বিশ্বাস করবেন না। কোন সভ্য দেশের আর্মি বাড়িতে ঢুকে নিরীহ নাগরিকদের মারে না।
- আব্বা, পাকিস্তান আর্মি কি সভ্যদেশের নিয়ম জানে? শাহাদত জানতে চাইল।
- জানার কথা, পাকিস্তান আর্মি একটা ডিসিপ্লিন্ড আর্মি।
- জানে না, ভাইসাব। আমাদের শহরে ঢুকার মুখে আমিন সাহেব, সবুর সাহেব আর আহমদ সাহেবের বাড়িতে ঢুইকা পাঁচটা জোয়ান ছেলেরে মারছে। এবার কি বাবার টনক নড়ল? মুখ দেখে বোঝা যায় না। অন্য কথা পাড়লেন শরীফ চাচা। শাহাদাতকে বললেন,
- বাবারা, এইবার ছাদের উপর থাইকা নিশান নামাইয়া ফেল। মাউড়ারা এই বাড়ি টার্গেট করব, আমার বাড়িও বাঁচব না। ইতিমধ্যে আশফাক এসে তাদের সাথে যোগ দিয়েছে, শরীফ চাচার কথা শুনেই সে রেগে গেল, বলল,
- যে পতাকা একবার তুলেছি সেটা আর নামাতে পারব না, চাচা।
এটা বেয়াদবীর পর্য্যায়ে পড়ে। আব্বা মুখ লাল করে কি বলতে যাচ্ছিলেন, তার আগেই বড় রাস্তার দিক থেকে ব্রাশ ফায়ার এবং ভারী গাড়ি ঘষ্টে চলার শব্দ শোনা গেল। শরীফ চাচা বাড়ির পিছনে ঝোপের আড়ালে একটা আলপথে সুড়ুৎ করে হাওয়া হলেন। শব্দ থামলে আব্বা বললেন,
- পতাকা এখনো নামাও নি কেন?
- এত দূর থেকে কে ফ্ল্যাগ দেখবে, আব্বা? পাকিস্তান আর্মিতো আমাদের ঘর পর্যন্ত আসছে না। বলল আশফাক।
- চুপ, বেয়াদব।
এক ধমক দিলেন আব্বা। অতএব, ফ্ল্যাগ নামাতে ছাদে উঠল শাহাদাত। একা, কারণ আশফাকের এক কথা, যে পতাকা সে উঠিয়েছে সেটা সে নামাবে না। পাশা পাশি কালো আর লাল-সবুজ-সোনালী পতাকা। পূর্ব দিকে একটা বড় জারুল গাছে রাস্তা থেকে ঢাকা পড়েছে পতাকাটা। শাহাদাতদের বাসার বাউন্ডারীর পার হয়ে পাড়ার সরু রাস্তা, তারপর ছোট ঝিল, ঝিল পেরিয়ে সদর রাস্তা। সদর রাস্তায় এক উঁচু ভবনে আস্তানা নিয়েছে পাক আর্মি, জারুল গাছের আড়ালে দূর থেকে শাহাদাতকে দেখতে পারার কথা নয়. কিন্তু কালো পতাকা মাত্র নামানো মাত্রই শুরু হল গোলাগুলি। শাহাদাতকে লক্ষ্য করে নয়, তবু তার চারপাশে উড়তে লাগল গুলি, রকেট। ভয় জাগানিয়া বিচিত্র শব্দ শোনা যেতে লাগল। বাংলাদেশের পতাকা না নামিয়েই দ্রুত ছাদ থেকে নেমে এল শাহাদত। সন্ধ্যার পর দেখা যাবে। সন্ধ্যার আগে পাকিস্তান আর্মির সভ্যতা বোধের উপর আব্বার বিশ্বাস ভেঙ্গে পড়ল। বাসার সামনের রাস্তা দিয়ে পলায়নরত পরিবার গুলির কাছ থেকে পাক আর্মির নৃশংসতার প্রত্যক্ষ বর্ণনা শুনে মুখ কালো হয়ে গেল তার। মুর্ছিতা এক মাঝ বয়সী হিন্দু মহিলাকে বয়ে নিয়ে যাচ্ছিল তার পরিজনেরা। কলেজে পড়া তার দুই ছেলেকে তার সামনেই গুলি করেছে।
- এরা কী মানুষ! আব্বা বললেন।
- না, পাকিস্তান আর্মি। বলল শাহাদত।
সন্ধ্যায় পর ছাদে উঠা গেল না। বড় রাস্তার উপর বড় বাড়ির ছাদে সার্চ লাইট ফিট করেছে আর্মি। সেটা ঘুরে ঘুরে চারপাশে আলো ফেলছে, শাহাদাতদের বাসাও বাদ যাচ্ছে না। আব্বা বললেন,
- থাক্, রাতে ছাদে উঠতে হবে না। জারুল গাছ আছে কেউ দেখবে না।
মেঝেয় বিছানা ফেলে রাতে শোয়া হল। জানালা বরাবর শোয়ার ভরসা হল না। শুয়ে শুয়ে ফিস ফিস করল আশফাক,
- ছাদে উঠেছিলাম, ভাইয়া।
- ফ্ল্যাগ নামিয়েছিস?
এ কথার জবাব না দিয়ে অন্য কথা বলল আশফাক,
- একটা কাজ করেছি, চক দিয়ে ছাদের এ মাথা থেকে ও মাথায় লিখে এসেছি, "আবার ফিরে আসব।"
- কী সাংঘাতিক! যদি কেউ দেখতো?
আশফাক উত্তর দে’য়ার আগেই আব্বা ধমকে উঠলেন,
- এ্যাই, ঘুমা।
সারা রাতই মেশিন গানের শব্দ, রকেট ছাড়ার শব্দ, ট্যাঙ্কের গোলার শব্দ শোনা গেল। ছাড়া ছাড়া ঘুম হল। সকালে ঘুম থেকে উঠে শাদা খিঁচুড়ী দিয়ে নাস্তা সারতে হল। ডিম নেই। খাওয়ার পর আব্ব বললেন,
- এবার রওয়ানা দে’য়া যাক।
- জামা কাপড় গুছাতে হবে না? আম্মা বললেন।
- হ্যাঁ:, আমরা যেন সফরে যাচ্ছি! স্রেফ পালাচ্ছি, বুঝেছ? পালাচ্ছি। এদিকটা একটু ঠান্ডা হলেই ফিরে আসব। গায়ে ভদ্রসুরৎ জামা পরে নাও আর দুই সেট জামা কাপড়, তোয়ালে, সাবান, টুথব্র্রাশ, টুথপেস্ট এই সব নিয়ে নাও। চার পাঁচ দিনের মামলা, ইন্শাল্লাহ্।
চার পাঁচ দিন কথাটার উপর জোর দিলেন আব্বা, নিজের বিশ্বাসটাকে ফিরে পাওয়ার জন্যে কি না কে জানে।
- শ্রীনগর, মোহাম্মদ উল্লাহ্ বাড়ি। যাওয়ার সময় ঠিকানা দিয়ে গিয়েছে। আপাতত: সেখানেই উঠব।

আব্বার বিশ্বাস আর ফিরে এল না। চার পাঁচ দিনে ফেরা হল না, চার পাঁচ মাসেও না। অনেক পথ ঘুরে চৌদ্দগ্রামে নিজেদের বাড়িতে এল তারা। এসে খবর পেল তাদের শহরের বাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে পাক আর্মি। নিতাইগঞ্জে আব্বার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, মানে তেলের গোডাউন এবং লাগোয়া অফিস ঘরের মালামাল লুট হয়ে গেছে। তাঁর ছিল ভোজ্য তেল আমদানীর ব্যবসা। নতুন করে ব্যবসা শুরু করার সাধ্য আব্বার নেই, অন্তত: এই সময়ে। আব্বা তাই সব ‘ঠান্ডা হওয়া’র আগে পর্যন্ত নিজের বাড়িতে থাকা ঠিক করলেন। ঠান্ডা হলে আব্বা ফিরতেন কি না, শাহাদত জানে না। জানবেনই বা কি করে? আশফাক বাড়ি থেকে পালাল মে মাসে, জুনে পালাল শাহাদত। সে এক কান্ড! ঢাকা ইউনিভার্সিটির ফিজিক্স-এর নওশের আর এপ্লাইড কেমিস্ট্রির শাহজাহানের সাথে যোগাযোগ হয়ে গেল ফেনী বাজারে । নওশের নারায়ণগঞ্জের ছেলে, যদিও ইস্কুলে তার সাথে পড়েনি, পড়েছে একক্লাস নীচে। তিনজন একসাথে মিলে পরশুরাম-বেলুনিয়া হয়ে ত্রিপুরার মেলাঘরে মুক্তিবাহিনীর সাথে মিলল। সহজে কি ঢোকা যায়, তবু শেষ পর্যন্ত জায়গা পাওয়া গেল। একটু হতাশ হল শাহাদাত। আশফাক আছে অন্য সেক্টরে, তেলিয়াপাড়ার কাছে। তবু কষ্ট আর এডভেঞ্চার মিলে দিন কাটতে লাগল তার। পুরোটাকেই এডভেঞ্চার হিসাবে নিল সে, শারীরিক কষ্ট, খিদের কষ্ট, ঘুমের কষ্ট, সব, নইলে টেঁকা যেত না। বাড়ির জন্যে মন খারাপ হতো, মা’র কথা ভেবে মন খারাপ হত, তবু অভুক্ত অবস্থায় মাইলের পর মাইল হেঁটে নতুন এক সম্ভাবনার আশায় এবং অপারেশনের উত্তেজনায় সব কষ্ট সে ভুলে যেত । এ ভাবে আশফাকের সাথে একবার দেখা না হওয়াও সে ভুলে গেল। দিন গেল, যুদ্ধ ও এক সময় একটা দিক নিল বলে মনে হল। ঈদের দিন তারা জানল খুব শিগ্গিরই সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হবে। ভারতের সাথে যৌথ কমান্ড গঠিত হবে, দেশে যেতে আর বেশী বাকি নেই। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে একদিন নওশের বলল,
- জানো, সাঈদ’রা স্বাধীন দেশে ঢুকে গেছে। যশোরের নাভারণে।
- সত্যি! আনন্দে চিক চিক করে শাহাদতের চোখ।
- আর দু’টা দিন অপেক্ষা কর, আমরাও ঢুকছি।
সেই ঢোকা হল ডিসেম্বরের ১২ তারিখে। বাড়িতে ফিরল শাহাদত ডিসেম্বরের ১৫ তারিখে। গগণ বিদারী উল্লাস তখন চারদিকে। ১৬ তারিখটা শুধু সরকারী ভাবে বিজয় ঘোষণার জন্যে বাকি রইল।

তাকে দেখে মা কেঁদে কেটে একসা।
- আমার আশফাক কোথায়, বাবা।
"আশফাক ফেরেনি?" বলতে গিয়ে কথাটা গিলে ফেলল শাহাদত।
- আশফাক? ও আশফাক সিলেটে আছে। অন্য সেক্টরে যুদ্ধ করেছেতো, ফিরতে সময় লাগবে।
মা কি বুঝলেন কে জানে, চোখ মুছলেন।
আরো কিছু দিন কেটে গেল। আশফাক ফিরল না। কার কাছে খবর নেবে শাহাদত? তেলিয়াপাড়ায় যুদ্ধ করেছে এমন কাউকে সে চেনে না। তবু দিন থেমে থাকে না। আশফাককে দেখেছেন এমন এক জনের সাথে তার দেখা হয়ে গেল এক দিন চৌদ্দগ্রাম বাজারে। ইপিআর-এর এক জওয়ান ছিলেন।
- আশফাক? শ্যামলা, বড় বড় চোখ?
- হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমার ভাই। দেখেছেন তাকে?
- দ্যাখ্ছি মানে? আমার লগেইতো আছিল নভেম্বরের শেষ পর্যন্ত। সে ফিরে নাই?
এমন সর্বাত্মক যুদ্ধে আশফাক কি হারিয়ে গেল? আব্বা থম ধরে বসে রইলেন। চোখ লাল করে বসে থাকল ইশফাক। অপেক্ষা করা ছাড়া কি করার আছে তাদের? পুরো ডিসেম্বর বাড়িতে থাকল শাহাদাত। অনেক মুক্তিযোদ্ধার সাথে তার দেখা হল যারা আশফাক কে চেনে, কিন্তু তারা কেউই আশফাকের খবর দিতে পারল না। ডিসেম্বর গেল আশফাক ফিরলো না। কাঁহাতক আর স্তোক দিয়ে মা’কে ধরে রাখা যায়? এদিকে শাহাদাতকে ঢাকা যেতে দিচ্ছেন না মা। জানুয়ারীর মাঝামাঝি মা’কে বোঝাল শাহাদাত, ঢাকায় গিয়ে আশফাকের খবর বের করতে হবে। । এদিকে ইউনিভার্সিটিতে ক্লাস শুরু হয়ে যাচ্ছে। আব্বাও নারায়ণগঞ্জ যেতে চাচ্ছেন, বাড়ি ঠিক ঠাক করতে হবে, নতুন করে ব্যবসা শুরু করতে হবে।

ষ্টেশনের কাছে স্টার হোটেল -এ লাঞ্চ সেরে তারা দু’জন শহরে ঢুকল । বড় রাস্তার দু’পাশের বাড়ি ঘর আগের মতই আছে। কালীর বাজারের কাছে দু’একটা দোকান নতুন মনে হল। লোকের মধ্যে উচ্ছাস কি একটু বেশী, না শৃংখলার অভাব? ঠিক বুঝতে পারে না শাহাদত। পথে আব্বার এক পরিচিত লোকের সাথে দেখা। রিকশা থামিয়ে তাকে ডাকলেন আব্বা।
- আসগর সাহেব,কোথায় যাচ্ছেন?
ভদ্রলোক থামলেন।
- আরে হামিদ সাহেব যে! ছিলেন কোথায় এতদিন? মুক্তিযুদ্ধে?
- না, বাড়িতে। আমার ছেলেরা মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিল।
আব্বার মুখে ঈষৎ গর্বের ছোঁয়া। ভদ্রলোক শাহাদতের দিকে তাকালেন।
- এটি আপনার ছেলে বুঝি? মুক্তিযোদ্ধা? বা: বা:। সময় থাকতে কিছু বাগিয়ে নাও হে। এত বড় একটা কাজ করেছ!
শাহাদতের রাগ হল। মুখের উপর একটা জবাব দিকে চাইছিল, আব্বার মুখের দিকে তাকিয়ে কোন জবাব দিল না। পাড়ায় ঢুকে ধ্বংসলীলা চোখে পড়ল। প্রথম বাড়িটা ভাল আছে। তারপর কয়েকটা বাড়ি যেন ছাড়া বাড়ি। লোক আছে কি না বোঝা যায় না। তাদের পাশে শরীফ সাহেবের বাড়িটা আস্ত আছে, কিন্তু দরজা জানালা নেই। নিজেদের বাড়িটা দেখে ধ্বক করে উঠল শাহদাতের বুক। দরজা জানালা সহ বিল্ডিং যদিও অটুট আছে কিন্তু কেমন যেন পোড়োবাড়ি পোড়োবাড়ি ভাব। গেইটটা হাট খোলা, মাঠ জঙ্গলে ভরে গেছে। পোর্টিকো দিয়ে উঠেই ড্রয়িং রুমের দরজা, সেটাই বাড়ির একমাত্র এন্ট্রি পয়েন্ট। দরজা ধাক্কা দিতেই খুলে গেল। ধুলি ধুসর দুটো কাঠের চেয়ার পড়ে আছে, শাহাদতদের সোফাসেটের চিহ্ন পর্যন্ত নেই। দেয়ালের গোলাপী ডিস্টেম্পার ধোঁয়ায় কালো হয়ে গেছে। ছাদের দিকে তাকালো তারা। সিলিং ফ্যানটা কালো বাদুড়ের মত ঝুলছে। আগুনের তাপে কুকড়ে গেছে ডানা গুলি। অন্য ঘরগুলির অবস্থা একই। আব্বা শুধু বললেন, ‘হার্ম্মাদ’!
রান্নাঘর এবং ভিতরের ঘর দুটি দেখে মনে হল, এ গুলি ব্যবহার হতো। ফ্রিজ পুড়ে গেছে। টিভি নেই, আলমিরা নেই, খাটের জায়গায় এক ঘরে দুটো চৌকি। রান্নাঘরে গ্যাসের চুলা ব্যবহার হতো মনে হয়। তার মানে কেউ এখানে ছিল। সম্প্রতি চলে গেছে। টেলিফোন সেট আছে, লাইন নেই। আব্বা বললেন,
- আমি যাই, কিছু লোক নিয়ে আসি।
আব্বা বেরিয়ে যেতেই পিছনের দে’য়ালে গাঁথা লোহার সিঁড়ি বেয়ে শাহাদাত তর তর করে ছাদে উঠলো। আশফাকের ছেলেমানুষীর চিহ্ন এখনো ছাদে আছে কি না সে দেখতে চায়। চক দিয়ে সে লিখে গিয়েছিল, "আবার ফিরে আসবো।" কোথায় সে লেখা? শ্যাওলা জমেছে ছাদে, লেখাটা নেই। শেষ পৌষের মৃদু বাতাসে শির শির করে কাঁপছে জারুলের পাতা, দুলছে তার ডাল। আরে! ডালের গায়ে হেলে পড়া, ফেটে যাওয়া পঁচা বাঁশের ডগায় পড়ন্ত রৌদ্রের সোনালী আলোয় ঝিকমিক করছে কে? দ্বিতীয়বার চমকাল শাহাদাত। রৌদ্রে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে সবুজ রং এখন বিবর্ণ, লাল বৃত্ত এখন কমলা, সোনালী ম্যাপে সোনা ঝরছে না, তবু উড়ছে। আশফাক ফিরে এসেছে! চীৎকার করে বলতে ইচ্ছা হল তার, ”আশফাক ফিরে এসেছে!” এখন সাকুল্যে দশ বারো জন ছাত্র আছে হলে। একা ঘরে থাকতে ভয় করে তাই ফিলোসফির রকিব রাতে তার ঘরে ঘুমোতে আসে। খানদের সাথে যুদ্ধ করে দেশকে মুক্ত করা যাদের উদ্দেশ্য তাদের এতো ভয় পেলে চলে না। তবু ভয় তো কোন ফর্মুলা মেনে আসে না! শাহাদাত বুঝতে পারে না সে কি করে। শেখ সাহেব যেন অন্তহীন আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন ইয়াহিয়া খানের সাথে। তিনি কি অখন্ড পাকিস্তান এখনো আশা করেন? অস্থিরতা, উত্তেজনায় দিন কাটছে, রাত কাটছে আশংকায়। বাইশে মার্চ হল ছাড়ল শাহাদত। নারায়ণগঞ্জ শহরে এসে শাহাদত দেখে তার বয়সী ছেলেদের মধ্যে সমান উত্তেজনা। ছোট ভাই আশফাক এসএসসি পরীক্ষা দেবে এবার কিন্তু বই খাতা পড়ে আছে এক কোনে অবহেলায়। বন্ধ‍ুদের সাথে সারা বিকাল হৈ হৈ করে বেড়াচ্ছে। তার ধারণা দেশ স্বাধীন হলে একবারেই পরীক্ষা দেবে। সব ছোট ইশফাকের দেশের স্বাধীনতা নিয়ে এত ভাবনা নেই, এক সময় হলেই হল। সে একটা ম্যাজিকের বই কিনে ম্যাজিক শিখছে, বড় হলে ম্যাজিশিয়ান হওয়ার ইচ্ছে। সমস্যা হল আব্বাকে নিয়ে। পাটের ব্যবসায় মোটামুটি ভালই লাভ করছিলেন, অনিশ্চিত অবস্থায় ব্যবসায় ভাঁটা পড়েছে তার। সামনে কী যে হয়! পাকিস্তানের অবিনশ্বরতায় তার বিশ্বাসে চিঁড় ধরেছে, তবু ফচকে ছোঁড়াদের লাফালাফি, "বীর বাঙালী অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর", শ্লোগানে তার বুকে খিঁচ ধরে।
- হলে থাকা আর পোষাল না?
- হলে আর দুই পারসেন্ট ছাত্রও নেই বাবা। ক্যান্টিন বন্ধ হয়ে গেছে, ছাত্ররা সবাই যারযার বাড়ি চলে গেছে।
- তা হলে কি করে থাকবি। তবে আমি সাফ বলে দিচ্ছি ঐ সব বীর বাঙালী শ্লোগান আর গাঁদা বন্দুক নিয়ে মার্চ করা ছেলেদের সাথে মিশবে না।
- মিশব কি? তারা আমাকে সঙ্গে নিলেতো!
রাগ করে বলল শাহাদাত। বিকালে সে আর আশফাক বেরোল রেকী করতে, মানে আর কি, কে কোথায় কি করছে দেখতে আর শহরের ছেলেপিলেদের আগামী কালের প্ল্যান কি জানতে। কেমন একটা ছুটি ছুটি ভাব শহরে। এটা অবশ্য মাসের প্রায় প্রথম থেকেই চলছে। ৭ই মার্চ থেকে তো বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে দেশ চলছে। সরকার নেই বললেই হয়। সবকিছু ঢিলে ঢালা চলছে তবে আইনশৃঙ্খলা ঠিক আছে। অনেক বাড়িতে কালো ফ্ল্যাগ উড়ছে। আগামী কাল ২৩ শে মার্চ পাকিস্তান দিবসে সকল বাড়িতে সবুজ লাল বৃত্তের মাঝখানে সোনালী ম্যাপ নিয়ে বাংলাদেশের পতাকা উড়বে।
- ফ্ল্যাগ জোগাড় করছস্?
জানতে চাইল মুস্তাফিজ। সে এঞ্জিনীয়ারিং ইউনিভার্সিটির হল ছেড়ে আপাতত: নারায়ণগঞ্জে ঠাঁই নিয়েছে।
- না। তোর কাছে আছে?
- একটা স্পেয়ার আছে, তোরে দিতে পারি।
মুস্তাফিজের চাষাড়ার বাসায় শাহাদত আর আশফাক গেল। মুস্তাফিজ বের করল দুই ফুটি একটা পতাকা। ম্যাপটা সোনালী নয় হলুদ, বাংলাদেশের মানচিত্র ও কেমন যেন থ্যাবড়া, তবু থাবড়া মেরে পতাকাটা নিল আশফাক। এই মূহুর্তে এটাই তো আমাদের প্রাণের পতাকা।
বাসায় ব্যাপারটা এত সহজ হল না। ভেবেছিলএখন তাদের ঘরে লুকিয়ে রেখে দেবে, কাল সকালে ছাদে কালো পতাকার পাশে আরেকটা বাঁশ বেঁধে টাঙ্গিয়ে দেবে। গাধা আশফাকের জন্যে ফাঁস হয়ে গেল সব কিছু। সে আম্মাকে দেখাতে গেল, "আম্মা দেখ, কি সুন্দর বাংলাদেশের ফ্ল্যাগ!" আম্মা কিছু বলার আগেই আব্বা ঘরে ঢুকে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। তক্কে তক্কে ছিলেন মনে হয়। ছেলেদের মতি গতি ইদানিং তার সুবিধার মনে হচ্ছিল না। চেঁচামেচি শুরু করলেন তিনি, "কি আরম্ভ করছস্ তোরা? কালো ফ্ল্যাগ টাঙ্গালি টাঙ্গালি, এখন পাকিস্তান দিবসে স্বাধীন পূর্ব পাকি¯তানের ম্যাপ টাঙ্গাতে চাস? "
- স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের ম্যাপ না বাবা, স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা।
- ঐ হইল। শেখ সাহেব তো বলছে কনফেডারেশন করবে। ইয়াহিয়া মেনে ও নিতে পারে। না, না, এখন বাংলাদেশের ফ্ল্যাগ টাঙ্গানো যাবে না। এইটা বেশী বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে।
"আশার ছলনে ভুলি কী ফল লভিনু হায়," মনে মনে ভাবল শাহাদাত। আব্বা এখনো আশা করে আছে পাকিস্তান টিকে যাবে! একদিন "লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান" করেছেল সে স্মৃতি ভুলতে পারেনি। বাবাকে শান্ত করার জন্যে সে বলল, ”ফ্ল্যাগে কি অসুবিধা, বাবা? কনফেডারেশন হলেও তো ষ্টেটের ফ্ল্যাগ থাকতে পারে।”
- হ্যাঁ, পারে, সে রকম রাষ্ট্রীয় স্বিদ্ধান্ত যদি নে’য়া হয়।
আম্মা এত কুট কচালীর মধ্যে গেলেন না, এক কথায় মামলা নিস্পত্তি করে দিলেন।
- টাঙ্গাবি। সুন্দর পতাকা।
- কী বলছ তুমি শাহাদতের মা? আমাদের এ্যারেস্ট করে নিয়ে যাবে।
- কে এ্যরেস্ট করবে? কালো পতাকাতো টাঙ্গালো এর আগে, কেউ কিছু করল?
গণভোটে আব্বা পরাস্ত হলেন। পরদিন সকালে পত পত করে ৬৭নং আমলাপাড়ার ছাদে বাংলাদেশের পতাকা উড়ল। আরো অনেক বাসার ছাদেও কালো পতাকার পাশে আজ বাংলাদেশের পতাকা উড়ছে। একটু আপত্তি করলেন প্রতিবেশী শরিফ চাচা। শাহাদাতদের বাড়ির লাগোয়া নতুন বাড়ি বানিয়েছেন ভদ্রলোক, বড় মায়া বাড়ির প্রতি। রোজ সকালে ঘুরে ঘুরে চারপাশ দেখেন।
- পতাকাতো উড়াইলা ভাতিজারা এক্কেবারে আমার বাড়ি বরাবর। গাছের জন্য তোমাদের বাড়ি দেখা যায় না, মনে হয় আমার বাড়িতেই পতাকা উড়তেছে।
- অসুবিধা কি চাচা? এক ঢিলে দুই পাখী মারা হল। কথাটা খুব সুপ্রযুক্ত হল তা নয়, তবুও বলল শাহাদাত।
- না, না, অসুবিধা না, তবে পরে আবার রাষ্ট্রদ্রোহীতার মামলা না কইরা দেয়।
কথাটা আব্বার খুব পছন্দ হল।
- আমি এই জন্যে বলছিলাম পতাকা না টাঙাতে। ছয় দফা ঠিক আছে, স্বাধীন বাংলাদেশ আবার কি? তোরা না নামালে আমি গিয়ে ফ্ল্যাগ নামাবো।
- এখন উপরে গিয়ে পতাকা নামালে সবাই তোমাকে ভূট্টো-ইয়াহিয়ার চর বলবে। আশফাক বলল,
- বলুক। চিৎকার করে উঠলেন আব্বা, শরীফ সাহেব পর্যন্ত চমকে গেলেন। চিৎকারে আব্বার উষ্মা ছাড়া পেল, শেষ পর্যন্ত ফ্ল্যাগ নামাতে তিনি ছাদে উঠলেন না।
শহরে কিছু লোকের উৎকণ্ঠা সত্বেও তরুনদের মধ্যে পতাকা উড়াতে উৎসাহের কমতি নেই। আরেকটা দিন কেটে গেল, রাতে রেডিওর খবরে শোনা গেল ইয়াহিয়ার সাথে শেখ মুজিবের আলোচনা কোন সমাধানে পৌঁছুতে পারেনি।
- সমাধানে না পৌঁছানো তো ভালই, কি কস্? এখন বঙ্গবন্ধু মুক্তির ডাক দিতে পারে। পরদিন বন্ধু মুস্তাফিজ বলল।
- এতো সোজা না! মাউড়ারা প্লেনে কইরা অস্ত্র আনতেছে। বলল দুলাল।
- তা হলেতো এখনই স্বাধীনতা ঘোষণা করতে হয়।
এমন ভাবে বলল শাহদাত যেন যুদ্ধ ঘোষণাটা তার দায়িত্ব। বেকার সময় কেটে গেল যুদ্ধের স্ট্রাটেজী কি হবে তার আলোচনায়। এখন তো অন্তহীন ছুটি, কি আর করার আছে?
পঁচিশ তারিখ দিনটা কেটে গেল রাইফেল ক্লাব আর ব্যক্তিগত সংগ্রহের অস্ত্র নিয়ে মার্চপাস্ট দেখে আর গুজব শুনে। রাতে ঘুম ভাল হল না। সারা সাত একটা অস্বস্তিতে এ পাশ ও পাশ করল শাহাদত। সকাল অন্যদিনের মত হল না, শরীর ম্যাজ ম্যাজ করছে। ডিম পোচ আর পাঁউরুটি দিয়ে নাস্তা সারলো শাহাদত, তারপর রেডিও ধরল । গান হচ্ছিল রেডিওতে, "পলাশ ঢাকা, কোকিল ডাকা আমার এ দেশ ভাইরে।" সাতটার খবরের সময় এখন, অথচ খবরের নাম নেই। ঘুরে ফিরে শুধু "পলাশ ঢাকা, কোকিল ডাকা।" গান ভাল, কিন্তু এত ভাল ভাল না। ঠিক তাই। একটু পর এক অবাঙালী গলা বলল, "আভি আপ এক জরুরী এলান সুনিয়ে", তারপর গড় গড় করে সামরিক আইনের ধারা বলে গেল। শহরে কারফিউ জারী করা হয়েছে। সকল পতাকা সরিয়ে ফেলতে বলা হল। পথে কোন প্রতিবন্ধকতা থাকলে সরিয়ে ফেলতে নির্দেশ দে’য়া হল, না হলে পার্শ্ববর্তী অবকাঠামো সহ ধ্বংস করে দে’য়া হবে, ইত্যাদি ইত্যাদি। সর্বনাশ নতুন করে মার্শাল ল’ জারী হল না কি? বাসায় জটলা বসল। আব্বা বললেন, "নিশ্চয়ই সাংঘাতিক কিছু হয়েছে। আমি তখনই বলেছিলাম এত বাড়াবাড়ি করো না, সবার সাথে হাতাহাতি, তা বলে দারোগার সাথে হাতাহাতি?"
- শেখ সাহেব তা হলে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন? জানতে চাইল আশফাক।
- আমি কি করে বলব? ঢাকায় থাকলে জানা যেতো। বলল শাহাদাত।
- রেডিওতে ঘোষণা করবে না? জানতে চাইল ইশফাক। কি বোকার মত প্রশ্ন!
- আরে আহাম্মক, রেডিও তে ঘোষণা করার অবস্থা হলে তো ঢাকা শহরই দখলে থাকত।
অবস্থা ভাল না, আরো কিছুক্ষণ পর টেলিফোনে না না বার্তা আসতে লাগল। ঢাকা শহরের সাথে টেলিফোন যোগাযোগ নেই, কিন্তু এই শহরের ম্যানুয়েল টেলিফোন লাইন এখনও আছে। মুস্তাফিজ জানালো ইকবাল হল, জগন্নাথ হলে অসংখ্য ছাত্রকে মিলিটারীরা হত্যা করেছে। রোকেয়া হলেও তারা ঢুকেছিল এবং মেয়েদের মেরেছে। পুরানো রেললাইনের পাশে বাবুপুরা বস্তি পুড়িয়ে দিয়েছে। ঢাকা থেকে পালানো লোকদের মুখে তার একথা শোনা। অন্য যাদের সাথে কথা হল তারা একই কথা বলল। আটটার খবরে ভারতীয় আকাশবাণী থেকে ঘোষণা করা হল, "পূর্ব বাংলায় গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছে"। যুদ্ধ তাহলে শুরু হয়েছে?
- এখন দেখ সব ঠিক হয়ে যাবে। সুড় সুড় করে সবাই আলোচনার টেবিলে বসবে। গোলমাল ঠান্ডা হলে দেখিস ইয়াহিয়া শেখ সাহেবের হাতেই ক্ষমতা হস্তান্তর করবে।
- তুমি বলছ কি আব্বা, এতোগুলি নিরিহ ছাত্রকে মেরে ফেলল, ঘরবাড়ি পুড়িয়ে ফেলল, তারপরও পাকিস্তান এক থাকবে? আব্বার কথার প্রতিবাদ না করে পারল না শাহাদাত । অসহ্য লাগল তার আব্বার পাকিস্তান ভক্তি।
- হলে ঢুকে ছাত্র মারতে কে দেখেছে? যারা পালিয়ে আসছে তারা ভয়ে পিছন ফিরে তাকায়নি। ভয় দেখানোর জন্যে আর্মি হয়তো গোলাগুলি করছে, রেললাইনের ধারে কিছ খোড়ো ঘরে আগুন দিয়েছে। একটা সভ্য আর্মি ঘরে ঢুকে নিরিহ মানুষ মারতে পারে না।
নারায়ণগঞ্জ শহরে লোক চলাচল মোটামুটী স্বাভাবিক। এখানে কারফিউ নেই। রাইফেল ক্লাবের মাঠে অস্ত্রের মহড়া হল। ভয়াবহ খবর শোনা যেতে লাগল বিকেল নাগাদ। ঢাকা থেকে পালিয়ে আসা লোকের সংখ্যা অনেক। শহরের রাস্তায় এমনিতে লোক চলাচল কম, কিন্তু এই অল্প লোক চলাচলও নিরস্ত করতে পারল না শাহাদত আর আশফাককে। পথে মুস্তাফিজকে ও নিল। ইশফাক এসবের মধ্যে নেই। তার ভয় বেশী। কিছু লোক শীতালক্ষ্যা পাড়ি দিয়ে গ্র্রামের দিকে চলে যাচ্ছে। জাহাজঘাটে লঞ্চ বা জাহাজ নেই, নৌকায়ই যাচ্ছে তারা। তাদের একজন, পটুয়াটুলীর এক মাঝ বয়সী কাপড় ব্যবসায়ী জানালেন সারা রাত পায়ে হেঁটে তিনি এই শহরে এসেছেন। ভাগ্যিস পরিবার সাথে নেই। তার বাড়ি বিক্রমপূরের শ্র্রীনগর।
- ঢাকা শহরের অবস্থা কেমন, চাচা?
- আমার মনে হয় শহরের লাখ খানেক মানুষ মাইরা ফালাইছে। শাখাঁরী বাজার শেষ!
- না: এতো হইবে না। দশ বারো হাজার হইবার পারে। অন্য এক দোকানী বললেন।
সংখ্যা এবং ব্যপকতা সম্মন্ধে মত পার্থক্য থাকলেও পাকিস্তানী সৈন্যদের তান্ডবলীলা এবং নৃশংসতা সম্মন্ধে সবাই একমত। তাদের একজন বলল,
- আপনেরাও ভাগেন। শহরে থাইকেন না। হার্ম্মাদরা এই দিকে আসতেছে।
হার্ম্মাদ মানে পাক আর্মি। ভাল নাম দিয়েছে। কথাটা আব্বাকে এসে বলল আশফাক। আব্বা বললেন,
- পর্ত্তুগীজ জলদস্যুদের হার্ম্মাদ বলতো। তারা মানুষ মারতো, লুটতরাজ করতো। এরা আইন-শৃংখলার নামে যদিও কিছু মানুষ মেরেছে তবু এখনো হার্ম্মাদ বলা যায় না।
- কখন বলা যাবে আব্বা? আশফাক জানতে চায়। আব্বা কোন উত্তর দেন না।
পরদিন শহরের বিপুল সংখ্যক লোক শহর ত্যাগ করা শুরু করল। শাহাদতদের প্রতিবেশী কয়েকজন চলে গেলেন কাছাকাছি গ্রামে। আব্বা প্রতিবেশীদের ভয়ের বহর দেখে তাজ্জব।
- ভীতুর ডিম কোথাকার! নিজের ঘরে শান্তিতে বসে থাক্, তা না আর্মিরা ঘরে এসে মেরে ফেলবে এই ভয়ে পালাল। নিরিহ গেরস্থ মানুষ, তোদের মারতে যাবে কেন?
আব্বাকে বোঝানো গেল না যে এবারের ব্যাপারটা এত সোজা না। এটা '৫২-র ভাষা আন্দোলন বা '৬৯-এর গণ আন্দোলন না। ছেলে ছোকরারা শহরের প্রবেশ পথে আলকাতরার ড্রাম, রেলের ওয়াগন, ইটের স্তুপ দিয়ে ব্যারিকেড দিয়েছে। এক তরুন নেতা বললেন,
- এই শহর আমাদের দূর্গ।
দু:খের বিষয়, চতুর্থ দিনে দূর্গ ভেঙ্গে পড়ল, আর্মি কলাম শহরে ঢুকলো। শহরের নব্বুই ভাগ লোক শহর ছেড়ে পালিয়েছে। ট্যাঙ্ক দিয়ে ব্যারিকেড ভেঙ্গেছে আর্মিরা।

পরদিন সকালে এসে হাজির হলেন প্রতিবেশী শরীফ চাচা।
- অমি গ্রামে চইলা যাইতাছি। তোমার চাচী আর ছেলে মেয়েদের গতকাল পাঠায়া দিছি।
শাহাদতকে সামনে দেখে তার উদ্দেশ্যে বললেন শরীফ চাচা।
- ভালই করেছেন, চাচা। বলল শাহাদাত।
- তা তোমরা এখনো পইড়া আছ ক্যান?
কথাটা বলেই শরীফ সাহেব খেয়াল করলেন শাহাদতের আব্বা পিছনে দাঁড়িয়ে আছেন। মিন মিন করে তিনি বললেন,
- ভাই সাহেব, শহরে থাকন এখন ঠিক না। সব স্ট্রাটেজিক পয়েন্টে ওরা দাঁড়াইয়া আছে। শুনলাম যে কোন সময় হাউজ টু হাউজ সার্চ করব।
- করলে করবে। আমার বাসায়তো অস্ত্র-শস্ত্র, গোলা-বারুদ নাই।
আব্বা কষ্টে হাসার চেষ্টা করলেন।
- আপনার বাড়িতে তিনখান জোয়ান পোলা আছে।
- খামকা আর্মি ওদের ধরবে কেন? ওরাতো রাজনীতি করে না।
- সময় খুব খারাপ ভাইসাব, শুনছি আর্মি ব্যাটারা আগে মানুষ মারে তারপর জানতে চায় কে কি করে। এবার আব্বা সত্যি সত্যি হাসলেন।
- শরীফ সাহেব, শোনা কথায় বিশ্বাস করবেন না। কোন সভ্য দেশের আর্মি বাড়িতে ঢুকে নিরীহ নাগরিকদের মারে না।
- আব্বা, পাকিস্তান আর্মি কি সভ্যদেশের নিয়ম জানে? শাহাদত জানতে চাইল।
- জানার কথা, পাকিস্তান আর্মি একটা ডিসিপ্লিন্ড আর্মি।
- জানে না, ভাইসাব। আমাদের শহরে ঢুকার মুখে আমিন সাহেব, সবুর সাহেব আর আহমদ সাহেবের বাড়িতে ঢুইকা পাঁচটা জোয়ান ছেলেরে মারছে। এবার কি বাবার টনক নড়ল? মুখ দেখে বোঝা যায় না। অন্য কথা পাড়লেন শরীফ চাচা। শাহাদাতকে বললেন,
- বাবারা, এইবার ছাদের উপর থাইকা নিশান নামাইয়া ফেল। মাউড়ারা এই বাড়ি টার্গেট করব, আমার বাড়িও বাঁচব না। ইতিমধ্যে আশফাক এসে তাদের সাথে যোগ দিয়েছে, শরীফ চাচার কথা শুনেই সে রেগে গেল, বলল,
- যে পতাকা একবার তুলেছি সেটা আর নামাতে পারব না, চাচা।
এটা বেয়াদবীর পর্য্যায়ে পড়ে। আব্বা মুখ লাল করে কি বলতে যাচ্ছিলেন, তার আগেই বড় রাস্তার দিক থেকে ব্রাশ ফায়ার এবং ভারী গাড়ি ঘষ্টে চলার শব্দ শোনা গেল। শরীফ চাচা বাড়ির পিছনে ঝোপের আড়ালে একটা আলপথে সুড়ুৎ করে হাওয়া হলেন। শব্দ থামলে আব্বা বললেন,
- পতাকা এখনো নামাও নি কেন?
- এত দূর থেকে কে ফ্ল্যাগ দেখবে, আব্বা? পাকিস্তান আর্মিতো আমাদের ঘর পর্যন্ত আসছে না। বলল আশফাক।
- চুপ, বেয়াদব।
এক ধমক দিলেন আব্বা। অতএব, ফ্ল্যাগ নামাতে ছাদে উঠল শাহাদাত। একা, কারণ আশফাকের এক কথা, যে পতাকা সে উঠিয়েছে সেটা সে নামাবে না। পাশা পাশি কালো আর লাল-সবুজ-সোনালী পতাকা। পূর্ব দিকে একটা বড় জারুল গাছে রাস্তা থেকে ঢাকা পড়েছে পতাকাটা। শাহাদাতদের বাসার বাউন্ডারীর পার হয়ে পাড়ার সরু রাস্তা, তারপর ছোট ঝিল, ঝিল পেরিয়ে সদর রাস্তা। সদর রাস্তায় এক উঁচু ভবনে আস্তানা নিয়েছে পাক আর্মি, জারুল গাছের আড়ালে দূর থেকে শাহাদাতকে দেখতে পারার কথা নয়. কিন্তু কালো পতাকা মাত্র নামানো মাত্রই শুরু হল গোলাগুলি। শাহাদাতকে লক্ষ্য করে নয়, তবু তার চারপাশে উড়তে লাগল গুলি, রকেট। ভয় জাগানিয়া বিচিত্র শব্দ শোনা যেতে লাগল। বাংলাদেশের পতাকা না নামিয়েই দ্রুত ছাদ থেকে নেমে এল শাহাদত। সন্ধ্যার পর দেখা যাবে। সন্ধ্যার আগে পাকিস্তান আর্মির সভ্যতা বোধের উপর আব্বার বিশ্বাস ভেঙ্গে পড়ল। বাসার সামনের রাস্তা দিয়ে পলায়নরত পরিবার গুলির কাছ থেকে পাক আর্মির নৃশংসতার প্রত্যক্ষ বর্ণনা শুনে মুখ কালো হয়ে গেল তার। মুর্ছিতা এক মাঝ বয়সী হিন্দু মহিলাকে বয়ে নিয়ে যাচ্ছিল তার পরিজনেরা। কলেজে পড়া তার দুই ছেলেকে তার সামনেই গুলি করেছে।
- এরা কী মানুষ! আব্বা বললেন।
- না, পাকিস্তান আর্মি। বলল শাহাদত।
সন্ধ্যায় পর ছাদে উঠা গেল না। বড় রাস্তার উপর বড় বাড়ির ছাদে সার্চ লাইট ফিট করেছে আর্মি। সেটা ঘুরে ঘুরে চারপাশে আলো ফেলছে, শাহাদাতদের বাসাও বাদ যাচ্ছে না। আব্বা বললেন,
- থাক্, রাতে ছাদে উঠতে হবে না। জারুল গাছ আছে কেউ দেখবে না।
মেঝেয় বিছানা ফেলে রাতে শোয়া হল। জানালা বরাবর শোয়ার ভরসা হল না। শুয়ে শুয়ে ফিস ফিস করল আশফাক,
- ছাদে উঠেছিলাম, ভাইয়া।
- ফ্ল্যাগ নামিয়েছিস?
এ কথার জবাব না দিয়ে অন্য কথা বলল আশফাক,
- একটা কাজ করেছি, চক দিয়ে ছাদের এ মাথা থেকে ও মাথায় লিখে এসেছি, "আবার ফিরে আসব।"
- কী সাংঘাতিক! যদি কেউ দেখতো?
আশফাক উত্তর দে’য়ার আগেই আব্বা ধমকে উঠলেন,
- এ্যাই, ঘুমা।
সারা রাতই মেশিন গানের শব্দ, রকেট ছাড়ার শব্দ, ট্যাঙ্কের গোলার শব্দ শোনা গেল। ছাড়া ছাড়া ঘুম হল। সকালে ঘুম থেকে উঠে শাদা খিঁচুড়ী দিয়ে নাস্তা সারতে হল। ডিম নেই। খাওয়ার পর আব্ব বললেন,
- এবার রওয়ানা দে’য়া যাক।
- জামা কাপড় গুছাতে হবে না? আম্মা বললেন।
- হ্যাঁ:, আমরা যেন সফরে যাচ্ছি! স্রেফ পালাচ্ছি, বুঝেছ? পালাচ্ছি। এদিকটা একটু ঠান্ডা হলেই ফিরে আসব। গায়ে ভদ্রসুরৎ জামা পরে নাও আর দুই সেট জামা কাপড়, তোয়ালে, সাবান, টুথব্র্রাশ, টুথপেস্ট এই সব নিয়ে নাও। চার পাঁচ দিনের মামলা, ইন্শাল্লাহ্।
চার পাঁচ দিন কথাটার উপর জোর দিলেন আব্বা, নিজের বিশ্বাসটাকে ফিরে পাওয়ার জন্যে কি না কে জানে।
- শ্রীনগর, মোহাম্মদ উল্লাহ্ বাড়ি। যাওয়ার সময় ঠিকানা দিয়ে গিয়েছে। আপাতত: সেখানেই উঠব।

আব্বার বিশ্বাস আর ফিরে এল না। চার পাঁচ দিনে ফেরা হল না, চার পাঁচ মাসেও না। অনেক পথ ঘুরে চৌদ্দগ্রামে নিজেদের বাড়িতে এল তারা। এসে খবর পেল তাদের শহরের বাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে পাক আর্মি। নিতাইগঞ্জে আব্বার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, মানে তেলের গোডাউন এবং লাগোয়া অফিস ঘরের মালামাল লুট হয়ে গেছে। তাঁর ছিল ভোজ্য তেল আমদানীর ব্যবসা। নতুন করে ব্যবসা শুরু করার সাধ্য আব্বার নেই, অন্তত: এই সময়ে। আব্বা তাই সব ‘ঠান্ডা হওয়া’র আগে পর্যন্ত নিজের বাড়িতে থাকা ঠিক করলেন। ঠান্ডা হলে আব্বা ফিরতেন কি না, শাহাদত জানে না। জানবেনই বা কি করে? আশফাক বাড়ি থেকে পালাল মে মাসে, জুনে পালাল শাহাদত। সে এক কান্ড! ঢাকা ইউনিভার্সিটির ফিজিক্স-এর নওশের আর এপ্লাইড কেমিস্ট্রির শাহজাহানের সাথে যোগাযোগ হয়ে গেল ফেনী বাজারে । নওশের নারায়ণগঞ্জের ছেলে, যদিও ইস্কুলে তার সাথে পড়েনি, পড়েছে একক্লাস নীচে। তিনজন একসাথে মিলে পরশুরাম-বেলুনিয়া হয়ে ত্রিপুরার মেলাঘরে মুক্তিবাহিনীর সাথে মিলল। সহজে কি ঢোকা যায়, তবু শেষ পর্যন্ত জায়গা পাওয়া গেল। একটু হতাশ হল শাহাদাত। আশফাক আছে অন্য সেক্টরে, তেলিয়াপাড়ার কাছে। তবু কষ্ট আর এডভেঞ্চার মিলে দিন কাটতে লাগল তার। পুরোটাকেই এডভেঞ্চার হিসাবে নিল সে, শারীরিক কষ্ট, খিদের কষ্ট, ঘুমের কষ্ট, সব, নইলে টেঁকা যেত না। বাড়ির জন্যে মন খারাপ হতো, মা’র কথা ভেবে মন খারাপ হত, তবু অভুক্ত অবস্থায় মাইলের পর মাইল হেঁটে নতুন এক সম্ভাবনার আশায় এবং অপারেশনের উত্তেজনায় সব কষ্ট সে ভুলে যেত । এ ভাবে আশফাকের সাথে একবার দেখা না হওয়াও সে ভুলে গেল। দিন গেল, যুদ্ধ ও এক সময় একটা দিক নিল বলে মনে হল। ঈদের দিন তারা জানল খুব শিগ্গিরই সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হবে। ভারতের সাথে যৌথ কমান্ড গঠিত হবে, দেশে যেতে আর বেশী বাকি নেই। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে একদিন নওশের বলল,
- জানো, সাঈদ’রা স্বাধীন দেশে ঢুকে গেছে। যশোরের নাভারণে।
- সত্যি! আনন্দে চিক চিক করে শাহাদতের চোখ।
- আর দু’টা দিন অপেক্ষা কর, আমরাও ঢুকছি।
সেই ঢোকা হল ডিসেম্বরের ১২ তারিখে। বাড়িতে ফিরল শাহাদত ডিসেম্বরের ১৫ তারিখে। গগণ বিদারী উল্লাস তখন চারদিকে। ১৬ তারিখটা শুধু সরকারী ভাবে বিজয় ঘোষণার জন্যে বাকি রইল।

তাকে দেখে মা কেঁদে কেটে একসা।
- আমার আশফাক কোথায়, বাবা।
"আশফাক ফেরেনি?" বলতে গিয়ে কথাটা গিলে ফেলল শাহাদত।
- আশফাক? ও আশফাক সিলেটে আছে। অন্য সেক্টরে যুদ্ধ করেছেতো, ফিরতে সময় লাগবে।
মা কি বুঝলেন কে জানে, চোখ মুছলেন।
আরো কিছু দিন কেটে গেল। আশফাক ফিরল না। কার কাছে খবর নেবে শাহাদত? তেলিয়াপাড়ায় যুদ্ধ করেছে এমন কাউকে সে চেনে না। তবু দিন থেমে থাকে না। আশফাককে দেখেছেন এমন এক জনের সাথে তার দেখা হয়ে গেল এক দিন চৌদ্দগ্রাম বাজারে। ইপিআর-এর এক জওয়ান ছিলেন।
- আশফাক? শ্যামলা, বড় বড় চোখ?
- হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমার ভাই। দেখেছেন তাকে?
- দ্যাখ্ছি মানে? আমার লগেইতো আছিল নভেম্বরের শেষ পর্যন্ত। সে ফিরে নাই?
এমন সর্বাত্মক যুদ্ধে আশফাক কি হারিয়ে গেল? আব্বা থম ধরে বসে রইলেন। চোখ লাল করে বসে থাকল ইশফাক। অপেক্ষা করা ছাড়া কি করার আছে তাদের? পুরো ডিসেম্বর বাড়িতে থাকল শাহাদাত। অনেক মুক্তিযোদ্ধার সাথে তার দেখা হল যারা আশফাক কে চেনে, কিন্তু তারা কেউই আশফাকের খবর দিতে পারল না। ডিসেম্বর গেল আশফাক ফিরলো না। কাঁহাতক আর স্তোক দিয়ে মা’কে ধরে রাখা যায়? এদিকে শাহাদাতকে ঢাকা যেতে দিচ্ছেন না মা। জানুয়ারীর মাঝামাঝি মা’কে বোঝাল শাহাদাত, ঢাকায় গিয়ে আশফাকের খবর বের করতে হবে। । এদিকে ইউনিভার্সিটিতে ক্লাস শুরু হয়ে যাচ্ছে। আব্বাও নারায়ণগঞ্জ যেতে চাচ্ছেন, বাড়ি ঠিক ঠাক করতে হবে, নতুন করে ব্যবসা শুরু করতে হবে।

ষ্টেশনের কাছে স্টার হোটেল -এ লাঞ্চ সেরে তারা দু’জন শহরে ঢুকল । বড় রাস্তার দু’পাশের বাড়ি ঘর আগের মতই আছে। কালীর বাজারের কাছে দু’একটা দোকান নতুন মনে হল। লোকের মধ্যে উচ্ছাস কি একটু বেশী, না শৃংখলার অভাব? ঠিক বুঝতে পারে না শাহাদত। পথে আব্বার এক পরিচিত লোকের সাথে দেখা। রিকশা থামিয়ে তাকে ডাকলেন আব্বা।
- আসগর সাহেব,কোথায় যাচ্ছেন?
ভদ্রলোক থামলেন।
- আরে হামিদ সাহেব যে! ছিলেন কোথায় এতদিন? মুক্তিযুদ্ধে?
- না, বাড়িতে। আমার ছেলেরা মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিল।
আব্বার মুখে ঈষৎ গর্বের ছোঁয়া। ভদ্রলোক শাহাদতের দিকে তাকালেন।
- এটি আপনার ছেলে বুঝি? মুক্তিযোদ্ধা? বা: বা:। সময় থাকতে কিছু বাগিয়ে নাও হে। এত বড় একটা কাজ করেছ!
শাহাদতের রাগ হল। মুখের উপর একটা জবাব দিকে চাইছিল, আব্বার মুখের দিকে তাকিয়ে কোন জবাব দিল না। পাড়ায় ঢুকে ধ্বংসলীলা চোখে পড়ল। প্রথম বাড়িটা ভাল আছে। তারপর কয়েকটা বাড়ি যেন ছাড়া বাড়ি। লোক আছে কি না বোঝা যায় না। তাদের পাশে শরীফ সাহেবের বাড়িটা আস্ত আছে, কিন্তু দরজা জানালা নেই। নিজেদের বাড়িটা দেখে ধ্বক করে উঠল শাহদাতের বুক। দরজা জানালা সহ বিল্ডিং যদিও অটুট আছে কিন্তু কেমন যেন পোড়োবাড়ি পোড়োবাড়ি ভাব। গেইটটা হাট খোলা, মাঠ জঙ্গলে ভরে গেছে। পোর্টিকো দিয়ে উঠেই ড্রয়িং রুমের দরজা, সেটাই বাড়ির একমাত্র এন্ট্রি পয়েন্ট। দরজা ধাক্কা দিতেই খুলে গেল। ধুলি ধুসর দুটো কাঠের চেয়ার পড়ে আছে, শাহাদতদের সোফাসেটের চিহ্ন পর্যন্ত নেই। দেয়ালের গোলাপী ডিস্টেম্পার ধোঁয়ায় কালো হয়ে গেছে। ছাদের দিকে তাকালো তারা। সিলিং ফ্যানটা কালো বাদুড়ের মত ঝুলছে। আগুনের তাপে কুকড়ে গেছে ডানা গুলি। অন্য ঘরগুলির অবস্থা একই। আব্বা শুধু বললেন, ‘হার্ম্মাদ’!
রান্নাঘর এবং ভিতরের ঘর দুটি দেখে মনে হল, এ গুলি ব্যবহার হতো। ফ্রিজ পুড়ে গেছে। টিভি নেই, আলমিরা নেই, খাটের জায়গায় এক ঘরে দুটো চৌকি। রান্নাঘরে গ্যাসের চুলা ব্যবহার হতো মনে হয়। তার মানে কেউ এখানে ছিল। সম্প্রতি চলে গেছে। টেলিফোন সেট আছে, লাইন নেই। আব্বা বললেন,
- আমি যাই, কিছু লোক নিয়ে আসি।
আব্বা বেরিয়ে যেতেই পিছনের দে’য়ালে গাঁথা লোহার সিঁড়ি বেয়ে শাহাদাত তর তর করে ছাদে উঠলো। আশফাকের ছেলেমানুষীর চিহ্ন এখনো ছাদে আছে কি না সে দেখতে চায়। চক দিয়ে সে লিখে গিয়েছিল, "আবার ফিরে আসবো।" কোথায় সে লেখা? শ্যাওলা জমেছে ছাদে, লেখাটা নেই। শেষ পৌষের মৃদু বাতাসে শির শির করে কাঁপছে জারুলের পাতা, দুলছে তার ডাল। আরে! ডালের গায়ে হেলে পড়া, ফেটে যাওয়া পঁচা বাঁশের ডগায় পড়ন্ত রৌদ্রের সোনালী আলোয় ঝিকমিক করছে কে? দ্বিতীয়বার চমকাল শাহাদাত। রৌদ্রে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে সবুজ রং এখন বিবর্ণ, লাল বৃত্ত এখন কমলা, সোনালী ম্যাপে সোনা ঝরছে না, তবু উড়ছে। আশফাক ফিরে এসেছে! চীৎকার করে বলতে ইচ্ছা হল তার, ”আশফাক ফিরে এসেছে!” ১
এখন সাকুল্যে দশ বারো জন ছাত্র আছে হলে। একা ঘরে থাকতে ভয় করে তাই ফিলোসফির রকিব রাতে তার ঘরে ঘুমোতে আসে। খানদের সাথে যুদ্ধ করে দেশকে মুক্ত করা যাদের উদ্দেশ্য তাদের এতো ভয় পেলে চলে না। তবু ভয় তো কোন ফর্মুলা মেনে আসে না! শাহাদাত বুঝতে পারে না সে কি করে। শেখ সাহেব যেন অন্তহীন আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন ইয়াহিয়া খানের সাথে। তিনি কি অখন্ড পাকিস্তান এখনো আশা করেন? অস্থিরতা, উত্তেজনায় দিন কাটছে, রাত কাটছে আশংকায়। বাইশে মার্চ হল ছাড়ল শাহাদত। নারায়ণগঞ্জ শহরে এসে শাহাদত দেখে তার বয়সী ছেলেদের মধ্যে সমান উত্তেজনা। ছোট ভাই আশফাক এসএসসি পরীক্ষা দেবে এবার কিন্তু বই খাতা পড়ে আছে এক কোনে অবহেলায়। বন্ধ‍ুদের সাথে সারা বিকাল হৈ হৈ করে বেড়াচ্ছে। তার ধারণা দেশ স্বাধীন হলে একবারেই পরীক্ষা দেবে। সব ছোট ইশফাকের দেশের স্বাধীনতা নিয়ে এত ভাবনা নেই, এক সময় হলেই হল। সে একটা ম্যাজিকের বই কিনে ম্যাজিক শিখছে, বড় হলে ম্যাজিশিয়ান হওয়ার ইচ্ছে। সমস্যা হল আব্বাকে নিয়ে। পাটের ব্যবসায় মোটামুটি ভালই লাভ করছিলেন, অনিশ্চিত অবস্থায় ব্যবসায় ভাঁটা পড়েছে তার। সামনে কী যে হয়! পাকিস্তানের অবিনশ্বরতায় তার বিশ্বাসে চিঁড় ধরেছে, তবু ফচকে ছোঁড়াদের লাফালাফি, "বীর বাঙালী অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর", শ্লোগানে তার বুকে খিঁচ ধরে।
- হলে থাকা আর পোষাল না?
- হলে আর দুই পারসেন্ট ছাত্রও নেই বাবা। ক্যান্টিন বন্ধ হয়ে গেছে, ছাত্ররা সবাই যারযার বাড়ি চলে গেছে।
- তা হলে কি করে থাকবি। তবে আমি সাফ বলে দিচ্ছি ঐ সব বীর বাঙালী শ্লোগান আর গাঁদা বন্দুক নিয়ে মার্চ করা ছেলেদের সাথে মিশবে না।
- মিশব কি? তারা আমাকে সঙ্গে নিলেতো!
রাগ করে বলল শাহাদাত। বিকালে সে আর আশফাক বেরোল রেকী করতে, মানে আর কি, কে কোথায় কি করছে দেখতে আর শহরের ছেলেপিলেদের আগামী কালের প্ল্যান কি জানতে। কেমন একটা ছুটি ছুটি ভাব শহরে। এটা অবশ্য মাসের প্রায় প্রথম থেকেই চলছে। ৭ই মার্চ থেকে তো বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে দেশ চলছে। সরকার নেই বললেই হয়। সবকিছু ঢিলে ঢালা চলছে তবে আইনশৃঙ্খলা ঠিক আছে। অনেক বাড়িতে কালো ফ্ল্যাগ উড়ছে। আগামী কাল ২৩ শে মার্চ পাকিস্তান দিবসে সকল বাড়িতে সবুজ লাল বৃত্তের মাঝখানে সোনালী ম্যাপ নিয়ে বাংলাদেশের পতাকা উড়বে।
- ফ্ল্যাগ জোগাড় করছস্?
জানতে চাইল মুস্তাফিজ। সে এঞ্জিনীয়ারিং ইউনিভার্সিটির হল ছেড়ে আপাতত: নারায়ণগঞ্জে ঠাঁই নিয়েছে।
- না। তোর কাছে আছে?
- একটা স্পেয়ার আছে, তোরে দিতে পারি।
মুস্তাফিজের চাষাড়ার বাসায় শাহাদত আর আশফাক গেল। মুস্তাফিজ বের করল দুই ফুটি একটা পতাকা। ম্যাপটা সোনালী নয় হলুদ, বাংলাদেশের মানচিত্র ও কেমন যেন থ্যাবড়া, তবু থাবড়া মেরে পতাকাটা নিল আশফাক। এই মূহুর্তে এটাই তো আমাদের প্রাণের পতাকা।
বাসায় ব্যাপারটা এত সহজ হল না। ভেবেছিলএখন তাদের ঘরে লুকিয়ে রেখে দেবে, কাল সকালে ছাদে কালো পতাকার পাশে আরেকটা বাঁশ বেঁধে টাঙ্গিয়ে দেবে। গাধা আশফাকের জন্যে ফাঁস হয়ে গেল সব কিছু। সে আম্মাকে দেখাতে গেল, "আম্মা দেখ, কি সুন্দর বাংলাদেশের ফ্ল্যাগ!" আম্মা কিছু বলার আগেই আব্বা ঘরে ঢুকে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। তক্কে তক্কে ছিলেন মনে হয়। ছেলেদের মতি গতি ইদানিং তার সুবিধার মনে হচ্ছিল না। চেঁচামেচি শুরু করলেন তিনি, "কি আরম্ভ করছস্ তোরা? কালো ফ্ল্যাগ টাঙ্গালি টাঙ্গালি, এখন পাকিস্তান দিবসে স্বাধীন পূর্ব পাকি¯তানের ম্যাপ টাঙ্গাতে চাস? "
- স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের ম্যাপ না বাবা, স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা।
- ঐ হইল। শেখ সাহেব তো বলছে কনফেডারেশন করবে। ইয়াহিয়া মেনে ও নিতে পারে। না, না, এখন বাংলাদেশের ফ্ল্যাগ টাঙ্গানো যাবে না। এইটা বেশী বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে।
"আশার ছলনে ভুলি কী ফল লভিনু হায়," মনে মনে ভাবল শাহাদাত। আব্বা এখনো আশা করে আছে পাকিস্তান টিকে যাবে! একদিন "লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান" করেছেল সে স্মৃতি ভুলতে পারেনি। বাবাকে শান্ত করার জন্যে সে বলল, ”ফ্ল্যাগে কি অসুবিধা, বাবা? কনফেডারেশন হলেও তো ষ্টেটের ফ্ল্যাগ থাকতে পারে।”
- হ্যাঁ, পারে, সে রকম রাষ্ট্রীয় স্বিদ্ধান্ত যদি নে’য়া হয়।
আম্মা এত কুট কচালীর মধ্যে গেলেন না, এক কথায় মামলা নিস্পত্তি করে দিলেন।
- টাঙ্গাবি। সুন্দর পতাকা।
- কী বলছ তুমি শাহাদতের মা? আমাদের এ্যারেস্ট করে নিয়ে যাবে।
- কে এ্যরেস্ট করবে? কালো পতাকাতো টাঙ্গালো এর আগে, কেউ কিছু করল?
গণভোটে আব্বা পরাস্ত হলেন। পরদিন সকালে পত পত করে ৬৭নং আমলাপাড়ার ছাদে বাংলাদেশের পতাকা উড়ল। আরো অনেক বাসার ছাদেও কালো পতাকার পাশে আজ বাংলাদেশের পতাকা উড়ছে। একটু আপত্তি করলেন প্রতিবেশী শরিফ চাচা। শাহাদাতদের বাড়ির লাগোয়া নতুন বাড়ি বানিয়েছেন ভদ্রলোক, বড় মায়া বাড়ির প্রতি। রোজ সকালে ঘুরে ঘুরে চারপাশ দেখেন।
- পতাকাতো উড়াইলা ভাতিজারা এক্কেবারে আমার বাড়ি বরাবর। গাছের জন্য তোমাদের বাড়ি দেখা যায় না, মনে হয় আমার বাড়িতেই পতাকা উড়তেছে।
- অসুবিধা কি চাচা? এক ঢিলে দুই পাখী মারা হল। কথাটা খুব সুপ্রযুক্ত হল তা নয়, তবুও বলল শাহাদাত।
- না, না, অসুবিধা না, তবে পরে আবার রাষ্ট্রদ্রোহীতার মামলা না কইরা দেয়।
কথাটা আব্বার খুব পছন্দ হল।
- আমি এই জন্যে বলছিলাম পতাকা না টাঙাতে। ছয় দফা ঠিক আছে, স্বাধীন বাংলাদেশ আবার কি? তোরা না নামালে আমি গিয়ে ফ্ল্যাগ নামাবো।
- এখন উপরে গিয়ে পতাকা নামালে সবাই তোমাকে ভূট্টো-ইয়াহিয়ার চর বলবে। আশফাক বলল,
- বলুক। চিৎকার করে উঠলেন আব্বা, শরীফ সাহেব পর্যন্ত চমকে গেলেন। চিৎকারে আব্বার উষ্মা ছাড়া পেল, শেষ পর্যন্ত ফ্ল্যাগ নামাতে তিনি ছাদে উঠলেন না।
শহরে কিছু লোকের উৎকণ্ঠা সত্বেও তরুনদের মধ্যে পতাকা উড়াতে উৎসাহের কমতি নেই। আরেকটা দিন কেটে গেল, রাতে রেডিওর খবরে শোনা গেল ইয়াহিয়ার সাথে শেখ মুজিবের আলোচনা কোন সমাধানে পৌঁছুতে পারেনি।
- সমাধানে না পৌঁছানো তো ভালই, কি কস্? এখন বঙ্গবন্ধু মুক্তির ডাক দিতে পারে। পরদিন বন্ধু মুস্তাফিজ বলল।
- এতো সোজা না! মাউড়ারা প্লেনে কইরা অস্ত্র আনতেছে। বলল দুলাল।
- তা হলেতো এখনই স্বাধীনতা ঘোষণা করতে হয়।
এমন ভাবে বলল শাহদাত যেন যুদ্ধ ঘোষণাটা তার দায়িত্ব। বেকার সময় কেটে গেল যুদ্ধের স্ট্রাটেজী কি হবে তার আলোচনায়। এখন তো অন্তহীন ছুটি, কি আর করার আছে?
পঁচিশ তারিখ দিনটা কেটে গেল রাইফেল ক্লাব আর ব্যক্তিগত সংগ্রহের অস্ত্র নিয়ে মার্চপাস্ট দেখে আর গুজব শুনে। রাতে ঘুম ভাল হল না। সারা সাত একটা অস্বস্তিতে এ পাশ ও পাশ করল শাহাদত। সকাল অন্যদিনের মত হল না, শরীর ম্যাজ ম্যাজ করছে। ডিম পোচ আর পাঁউরুটি দিয়ে নাস্তা সারলো শাহাদত, তারপর রেডিও ধরল । গান হচ্ছিল রেডিওতে, "পলাশ ঢাকা, কোকিল ডাকা আমার এ দেশ ভাইরে।" সাতটার খবরের সময় এখন, অথচ খবরের নাম নেই। ঘুরে ফিরে শুধু "পলাশ ঢাকা, কোকিল ডাকা।" গান ভাল, কিন্তু এত ভাল ভাল না। ঠিক তাই। একটু পর এক অবাঙালী গলা বলল, "আভি আপ এক জরুরী এলান সুনিয়ে", তারপর গড় গড় করে সামরিক আইনের ধারা বলে গেল। শহরে কারফিউ জারী করা হয়েছে। সকল পতাকা সরিয়ে ফেলতে বলা হল। পথে কোন প্রতিবন্ধকতা থাকলে সরিয়ে ফেলতে নির্দেশ দে’য়া হল, না হলে পার্শ্ববর্তী অবকাঠামো সহ ধ্বংস করে দে’য়া হবে, ইত্যাদি ইত্যাদি। সর্বনাশ নতুন করে মার্শাল ল’ জারী হল না কি? বাসায় জটলা বসল। আব্বা বললেন, "নিশ্চয়ই সাংঘাতিক কিছু হয়েছে। আমি তখনই বলেছিলাম এত বাড়াবাড়ি করো না, সবার সাথে হাতাহাতি, তা বলে দারোগার সাথে হাতাহাতি?"
- শেখ সাহেব তা হলে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন? জানতে চাইল আশফাক।
- আমি কি করে বলব? ঢাকায় থাকলে জানা যেতো। বলল শাহাদাত।
- রেডিওতে ঘোষণা করবে না? জানতে চাইল ইশফাক। কি বোকার মত প্রশ্ন!
- আরে আহাম্মক, রেডিও তে ঘোষণা করার অবস্থা হলে তো ঢাকা শহরই দখলে থাকত।
অবস্থা ভাল না, আরো কিছুক্ষণ পর টেলিফোনে না না বার্তা আসতে লাগল। ঢাকা শহরের সাথে টেলিফোন যোগাযোগ নেই, কিন্তু এই শহরের ম্যানুয়েল টেলিফোন লাইন এখনও আছে। মুস্তাফিজ জানালো ইকবাল হল, জগন্নাথ হলে অসংখ্য ছাত্রকে মিলিটারীরা হত্যা করেছে। রোকেয়া হলেও তারা ঢুকেছিল এবং মেয়েদের মেরেছে। পুরানো রেললাইনের পাশে বাবুপুরা বস্তি পুড়িয়ে দিয়েছে। ঢাকা থেকে পালানো লোকদের মুখে তার একথা শোনা। অন্য যাদের সাথে কথা হল তারা একই কথা বলল। আটটার খবরে ভারতীয় আকাশবাণী থেকে ঘোষণা করা হল, "পূর্ব বাংলায় গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছে"। যুদ্ধ তাহলে শুরু হয়েছে?
- এখন দেখ সব ঠিক হয়ে যাবে। সুড় সুড় করে সবাই আলোচনার টেবিলে বসবে। গোলমাল ঠান্ডা হলে দেখিস ইয়াহিয়া শেখ সাহেবের হাতেই ক্ষমতা হস্তান্তর করবে।
- তুমি বলছ কি আব্বা, এতোগুলি নিরিহ ছাত্রকে মেরে ফেলল, ঘরবাড়ি পুড়িয়ে ফেলল, তারপরও পাকিস্তান এক থাকবে? আব্বার কথার প্রতিবাদ না করে পারল না শাহাদাত । অসহ্য লাগল তার আব্বার পাকিস্তান ভক্তি।
- হলে ঢুকে ছাত্র মারতে কে দেখেছে? যারা পালিয়ে আসছে তারা ভয়ে পিছন ফিরে তাকায়নি। ভয় দেখানোর জন্যে আর্মি হয়তো গোলাগুলি করছে, রেললাইনের ধারে কিছ খোড়ো ঘরে আগুন দিয়েছে। একটা সভ্য আর্মি ঘরে ঢুকে নিরিহ মানুষ মারতে পারে না।
নারায়ণগঞ্জ শহরে লোক চলাচল মোটামুটী স্বাভাবিক। এখানে কারফিউ নেই। রাইফেল ক্লাবের মাঠে অস্ত্রের মহড়া হল। ভয়াবহ খবর শোনা যেতে লাগল বিকেল নাগাদ। ঢাকা থেকে পালিয়ে আসা লোকের সংখ্যা অনেক। শহরের রাস্তায় এমনিতে লোক চলাচল কম, কিন্তু এই অল্প লোক চলাচলও নিরস্ত করতে পারল না শাহাদত আর আশফাককে। পথে মুস্তাফিজকে ও নিল। ইশফাক এসবের মধ্যে নেই। তার ভয় বেশী। কিছু লোক শীতালক্ষ্যা পাড়ি দিয়ে গ্র্রামের দিকে চলে যাচ্ছে। জাহাজঘাটে লঞ্চ বা জাহাজ নেই, নৌকায়ই যাচ্ছে তারা। তাদের একজন, পটুয়াটুলীর এক মাঝ বয়সী কাপড় ব্যবসায়ী জানালেন সারা রাত পায়ে হেঁটে তিনি এই শহরে এসেছেন। ভাগ্যিস পরিবার সাথে নেই। তার বাড়ি বিক্রমপূরের শ্র্রীনগর।
- ঢাকা শহরের অবস্থা কেমন, চাচা?
- আমার মনে হয় শহরের লাখ খানেক মানুষ মাইরা ফালাইছে। শাখাঁরী বাজার শেষ!
- না: এতো হইবে না। দশ বারো হাজার হইবার পারে। অন্য এক দোকানী বললেন।
সংখ্যা এবং ব্যপকতা সম্মন্ধে মত পার্থক্য থাকলেও পাকিস্তানী সৈন্যদের তান্ডবলীলা এবং নৃশংসতা সম্মন্ধে সবাই একমত। তাদের একজন বলল,
- আপনেরাও ভাগেন। শহরে থাইকেন না। হার্ম্মাদরা এই দিকে আসতেছে।
হার্ম্মাদ মানে পাক আর্মি। ভাল নাম দিয়েছে। কথাটা আব্বাকে এসে বলল আশফাক। আব্বা বললেন,
- পর্ত্তুগীজ জলদস্যুদের হার্ম্মাদ বলতো। তারা মানুষ মারতো, লুটতরাজ করতো। এরা আইন-শৃংখলার নামে যদিও কিছু মানুষ মেরেছে তবু এখনো হার্ম্মাদ বলা যায় না।
- কখন বলা যাবে আব্বা? আশফাক জানতে চায়। আব্বা কোন উত্তর দেন না।
পরদিন শহরের বিপুল সংখ্যক লোক শহর ত্যাগ করা শুরু করল। শাহাদতদের প্রতিবেশী কয়েকজন চলে গেলেন কাছাকাছি গ্রামে। আব্বা প্রতিবেশীদের ভয়ের বহর দেখে তাজ্জব।
- ভীতুর ডিম কোথাকার! নিজের ঘরে শান্তিতে বসে থাক্, তা না আর্মিরা ঘরে এসে মেরে ফেলবে এই ভয়ে পালাল। নিরিহ গেরস্থ মানুষ, তোদের মারতে যাবে কেন?
আব্বাকে বোঝানো গেল না যে এবারের ব্যাপারটা এত সোজা না। এটা '৫২-র ভাষা আন্দোলন বা '৬৯-এর গণ আন্দোলন না। ছেলে ছোকরারা শহরের প্রবেশ পথে আলকাতরার ড্রাম, রেলের ওয়াগন, ইটের স্তুপ দিয়ে ব্যারিকেড দিয়েছে। এক তরুন নেতা বললেন,
- এই শহর আমাদের দূর্গ।
দু:খের বিষয়, চতুর্থ দিনে দূর্গ ভেঙ্গে পড়ল, আর্মি কলাম শহরে ঢুকলো। শহরের নব্বুই ভাগ লোক শহর ছেড়ে পালিয়েছে। ট্যাঙ্ক দিয়ে ব্যারিকেড ভেঙ্গেছে আর্মিরা।

পরদিন সকালে এসে হাজির হলেন প্রতিবেশী শরীফ চাচা।
- অমি গ্রামে চইলা যাইতাছি। তোমার চাচী আর ছেলে মেয়েদের গতকাল পাঠায়া দিছি।
শাহাদতকে সামনে দেখে তার উদ্দেশ্যে বললেন শরীফ চাচা।
- ভালই করেছেন, চাচা। বলল শাহাদাত।
- তা তোমরা এখনো পইড়া আছ ক্যান?
কথাটা বলেই শরীফ সাহেব খেয়াল করলেন শাহাদতের আব্বা পিছনে দাঁড়িয়ে আছেন। মিন মিন করে তিনি বললেন,
- ভাই সাহেব, শহরে থাকন এখন ঠিক না। সব স্ট্রাটেজিক পয়েন্টে ওরা দাঁড়াইয়া আছে। শুনলাম যে কোন সময় হাউজ টু হাউজ সার্চ করব।
- করলে করবে। আমার বাসায়তো অস্ত্র-শস্ত্র, গোলা-বারুদ নাই।
আব্বা কষ্টে হাসার চেষ্টা করলেন।
- আপনার বাড়িতে তিনখান জোয়ান পোলা আছে।
- খামকা আর্মি ওদের ধরবে কেন? ওরাতো রাজনীতি করে না।
- সময় খুব খারাপ ভাইসাব, শুনছি আর্মি ব্যাটারা আগে মানুষ মারে তারপর জানতে চায় কে কি করে। এবার আব্বা সত্যি সত্যি হাসলেন।
- শরীফ সাহেব, শোনা কথায় বিশ্বাস করবেন না। কোন সভ্য দেশের আর্মি বাড়িতে ঢুকে নিরীহ নাগরিকদের মারে না।
- আব্বা, পাকিস্তান আর্মি কি সভ্যদেশের নিয়ম জানে? শাহাদত জানতে চাইল।
- জানার কথা, পাকিস্তান আর্মি একটা ডিসিপ্লিন্ড আর্মি।
- জানে না, ভাইসাব। আমাদের শহরে ঢুকার মুখে আমিন সাহেব, সবুর সাহেব আর আহমদ সাহেবের বাড়িতে ঢুইকা পাঁচটা জোয়ান ছেলেরে মারছে। এবার কি বাবার টনক নড়ল? মুখ দেখে বোঝা যায় না। অন্য কথা পাড়লেন শরীফ চাচা। শাহাদাতকে বললেন,
- বাবারা, এইবার ছাদের উপর থাইকা নিশান নামাইয়া ফেল। মাউড়ারা এই বাড়ি টার্গেট করব, আমার বাড়িও বাঁচব না। ইতিমধ্যে আশফাক এসে তাদের সাথে যোগ দিয়েছে, শরীফ চাচার কথা শুনেই সে রেগে গেল, বলল,
- যে পতাকা একবার তুলেছি সেটা আর নামাতে পারব না, চাচা।
এটা বেয়াদবীর পর্য্যায়ে পড়ে। আব্বা মুখ লাল করে কি বলতে যাচ্ছিলেন, তার আগেই বড় রাস্তার দিক থেকে ব্রাশ ফায়ার এবং ভারী গাড়ি ঘষ্টে চলার শব্দ শোনা গেল। শরীফ চাচা বাড়ির পিছনে ঝোপের আড়ালে একটা আলপথে সুড়ুৎ করে হাওয়া হলেন। শব্দ থামলে আব্বা বললেন,
- পতাকা এখনো নামাও নি কেন?
- এত দূর থেকে কে ফ্ল্যাগ দেখবে, আব্বা? পাকিস্তান আর্মিতো আমাদের ঘর পর্যন্ত আসছে না। বলল আশফাক।
- চুপ, বেয়াদব।
এক ধমক দিলেন আব্বা। অতএব, ফ্ল্যাগ নামাতে ছাদে উঠল শাহাদাত। একা, কারণ আশফাকের এক কথা, যে পতাকা সে উঠিয়েছে সেটা সে নামাবে না। পাশা পাশি কালো আর লাল-সবুজ-সোনালী পতাকা। পূর্ব দিকে একটা বড় জারুল গাছে রাস্তা থেকে ঢাকা পড়েছে পতাকাটা। শাহাদাতদের বাসার বাউন্ডারীর পার হয়ে পাড়ার সরু রাস্তা, তারপর ছোট ঝিল, ঝিল পেরিয়ে সদর রাস্তা। সদর রাস্তায় এক উঁচু ভবনে আস্তানা নিয়েছে পাক আর্মি, জারুল গাছের আড়ালে দূর থেকে শাহাদাতকে দেখতে পারার কথা নয়. কিন্তু কালো পতাকা মাত্র নামানো মাত্রই শুরু হল গোলাগুলি। শাহাদাতকে লক্ষ্য করে নয়, তবু তার চারপাশে উড়তে লাগল গুলি, রকেট। ভয় জাগানিয়া বিচিত্র শব্দ শোনা যেতে লাগল। বাংলাদেশের পতাকা না নামিয়েই দ্রুত ছাদ থেকে নেমে এল শাহাদত। সন্ধ্যার পর দেখা যাবে। সন্ধ্যার আগে পাকিস্তান আর্মির সভ্যতা বোধের উপর আব্বার বিশ্বাস ভেঙ্গে পড়ল। বাসার সামনের রাস্তা দিয়ে পলায়নরত পরিবার গুলির কাছ থেকে পাক আর্মির নৃশংসতার প্রত্যক্ষ বর্ণনা শুনে মুখ কালো হয়ে গেল তার। মুর্ছিতা এক মাঝ বয়সী হিন্দু মহিলাকে বয়ে নিয়ে যাচ্ছিল তার পরিজনেরা। কলেজে পড়া তার দুই ছেলেকে তার সামনেই গুলি করেছে।
- এরা কী মানুষ! আব্বা বললেন।
- না, পাকিস্তান আর্মি। বলল শাহাদত।
সন্ধ্যায় পর ছাদে উঠা গেল না। বড় রাস্তার উপর বড় বাড়ির ছাদে সার্চ লাইট ফিট করেছে আর্মি। সেটা ঘুরে ঘুরে চারপাশে আলো ফেলছে, শাহাদাতদের বাসাও বাদ যাচ্ছে না। আব্বা বললেন,
- থাক্, রাতে ছাদে উঠতে হবে না। জারুল গাছ আছে কেউ দেখবে না।
মেঝেয় বিছানা ফেলে রাতে শোয়া হল। জানালা বরাবর শোয়ার ভরসা হল না। শুয়ে শুয়ে ফিস ফিস করল আশফাক,
- ছাদে উঠেছিলাম, ভাইয়া।
- ফ্ল্যাগ নামিয়েছিস?
এ কথার জবাব না দিয়ে অন্য কথা বলল আশফাক,
- একটা কাজ করেছি, চক দিয়ে ছাদের এ মাথা থেকে ও মাথায় লিখে এসেছি, "আবার ফিরে আসব।"
- কী সাংঘাতিক! যদি কেউ দেখতো?
আশফাক উত্তর দে’য়ার আগেই আব্বা ধমকে উঠলেন,
- এ্যাই, ঘুমা।
সারা রাতই মেশিন গানের শব্দ, রকেট ছাড়ার শব্দ, ট্যাঙ্কের গোলার শব্দ শোনা গেল। ছাড়া ছাড়া ঘুম হল। সকালে ঘুম থেকে উঠে শাদা খিঁচুড়ী দিয়ে নাস্তা সারতে হল। ডিম নেই। খাওয়ার পর আব্ব বললেন,
- এবার রওয়ানা দে’য়া যাক।
- জামা কাপড় গুছাতে হবে না? আম্মা বললেন।
- হ্যাঁ:, আমরা যেন সফরে যাচ্ছি! স্রেফ পালাচ্ছি, বুঝেছ? পালাচ্ছি। এদিকটা একটু ঠান্ডা হলেই ফিরে আসব। গায়ে ভদ্রসুরৎ জামা পরে নাও আর দুই সেট জামা কাপড়, তোয়ালে, সাবান, টুথব্র্রাশ, টুথপেস্ট এই সব নিয়ে নাও। চার পাঁচ দিনের মামলা, ইন্শাল্লাহ্।
চার পাঁচ দিন কথাটার উপর জোর দিলেন আব্বা, নিজের বিশ্বাসটাকে ফিরে পাওয়ার জন্যে কি না কে জানে।
- শ্রীনগর, মোহাম্মদ উল্লাহ্ বাড়ি। যাওয়ার সময় ঠিকানা দিয়ে গিয়েছে। আপাতত: সেখানেই উঠব।

আব্বার বিশ্বাস আর ফিরে এল না। চার পাঁচ দিনে ফেরা হল না, চার পাঁচ মাসেও না। অনেক পথ ঘুরে চৌদ্দগ্রামে নিজেদের বাড়িতে এল তারা। এসে খবর পেল তাদের শহরের বাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে পাক আর্মি। নিতাইগঞ্জে আব্বার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, মানে তেলের গোডাউন এবং লাগোয়া অফিস ঘরের মালামাল লুট হয়ে গেছে। তাঁর ছিল ভোজ্য তেল আমদানীর ব্যবসা। নতুন করে ব্যবসা শুরু করার সাধ্য আব্বার নেই, অন্তত: এই সময়ে। আব্বা তাই সব ‘ঠান্ডা হওয়া’র আগে পর্যন্ত নিজের বাড়িতে থাকা ঠিক করলেন। ঠান্ডা হলে আব্বা ফিরতেন কি না, শাহাদত জানে না। জানবেনই বা কি করে? আশফাক বাড়ি থেকে পালাল মে মাসে, জুনে পালাল শাহাদত। সে এক কান্ড! ঢাকা ইউনিভার্সিটির ফিজিক্স-এর নওশের আর এপ্লাইড কেমিস্ট্রির শাহজাহানের সাথে যোগাযোগ হয়ে গেল ফেনী বাজারে । নওশের নারায়ণগঞ্জের ছেলে, যদিও ইস্কুলে তার সাথে পড়েনি, পড়েছে একক্লাস নীচে। তিনজন একসাথে মিলে পরশুরাম-বেলুনিয়া হয়ে ত্রিপুরার মেলাঘরে মুক্তিবাহিনীর সাথে মিলল। সহজে কি ঢোকা যায়, তবু শেষ পর্যন্ত জায়গা পাওয়া গেল। একটু হতাশ হল শাহাদাত। আশফাক আছে অন্য সেক্টরে, তেলিয়াপাড়ার কাছে। তবু কষ্ট আর এডভেঞ্চার মিলে দিন কাটতে লাগল তার। পুরোটাকেই এডভেঞ্চার হিসাবে নিল সে, শারীরিক কষ্ট, খিদের কষ্ট, ঘুমের কষ্ট, সব, নইলে টেঁকা যেত না। বাড়ির জন্যে মন খারাপ হতো, মা’র কথা ভেবে মন খারাপ হত, তবু অভুক্ত অবস্থায় মাইলের পর মাইল হেঁটে নতুন এক সম্ভাবনার আশায় এবং অপারেশনের উত্তেজনায় সব কষ্ট সে ভুলে যেত । এ ভাবে আশফাকের সাথে একবার দেখা না হওয়াও সে ভুলে গেল। দিন গেল, যুদ্ধ ও এক সময় একটা দিক নিল বলে মনে হল। ঈদের দিন তারা জানল খুব শিগ্গিরই সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হবে। ভারতের সাথে যৌথ কমান্ড গঠিত হবে, দেশে যেতে আর বেশী বাকি নেই। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে একদিন নওশের বলল,
- জানো, সাঈদ’রা স্বাধীন দেশে ঢুকে গেছে। যশোরের নাভারণে।
- সত্যি! আনন্দে চিক চিক করে শাহাদতের চোখ।
- আর দু’টা দিন অপেক্ষা কর, আমরাও ঢুকছি।
সেই ঢোকা হল ডিসেম্বরের ১২ তারিখে। বাড়িতে ফিরল শাহাদত ডিসেম্বরের ১৫ তারিখে। গগণ বিদারী উল্লাস তখন চারদিকে। ১৬ তারিখটা শুধু সরকারী ভাবে বিজয় ঘোষণার জন্যে বাকি রইল।

তাকে দেখে মা কেঁদে কেটে একসা।
- আমার আশফাক কোথায়, বাবা।
"আশফাক ফেরেনি?" বলতে গিয়ে কথাটা গিলে ফেলল শাহাদত।
- আশফাক? ও আশফাক সিলেটে আছে। অন্য সেক্টরে যুদ্ধ করেছেতো, ফিরতে সময় লাগবে।
মা কি বুঝলেন কে জানে, চোখ মুছলেন।
আরো কিছু দিন কেটে গেল। আশফাক ফিরল না। কার কাছে খবর নেবে শাহাদত? তেলিয়াপাড়ায় যুদ্ধ করেছে এমন কাউকে সে চেনে না। তবু দিন থেমে থাকে না। আশফাককে দেখেছেন এমন এক জনের সাথে তার দেখা হয়ে গেল এক দিন চৌদ্দগ্রাম বাজারে। ইপিআর-এর এক জওয়ান ছিলেন।
- আশফাক? শ্যামলা, বড় বড় চোখ?
- হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমার ভাই। দেখেছেন তাকে?
- দ্যাখ্ছি মানে? আমার লগেইতো আছিল নভেম্বরের শেষ পর্যন্ত। সে ফিরে নাই?
এমন সর্বাত্মক যুদ্ধে আশফাক কি হারিয়ে গেল? আব্বা থম ধরে বসে রইলেন। চোখ লাল করে বসে থাকল ইশফাক। অপেক্ষা করা ছাড়া কি করার আছে তাদের? পুরো ডিসেম্বর বাড়িতে থাকল শাহাদাত। অনেক মুক্তিযোদ্ধার সাথে তার দেখা হল যারা আশফাক কে চেনে, কিন্তু তারা কেউই আশফাকের খবর দিতে পারল না। ডিসেম্বর গেল আশফাক ফিরলো না। কাঁহাতক আর স্তোক দিয়ে মা’কে ধরে রাখা যায়? এদিকে শাহাদাতকে ঢাকা যেতে দিচ্ছেন না মা। জানুয়ারীর মাঝামাঝি মা’কে বোঝাল শাহাদাত, ঢাকায় গিয়ে আশফাকের খবর বের করতে হবে। । এদিকে ইউনিভার্সিটিতে ক্লাস শুরু হয়ে যাচ্ছে। আব্বাও নারায়ণগঞ্জ যেতে চাচ্ছেন, বাড়ি ঠিক ঠাক করতে হবে, নতুন করে ব্যবসা শুরু করতে হবে।

ষ্টেশনের কাছে স্টার হোটেল -এ লাঞ্চ সেরে তারা দু’জন শহরে ঢুকল । বড় রাস্তার দু’পাশের বাড়ি ঘর আগের মতই আছে। কালীর বাজারের কাছে দু’একটা দোকান নতুন মনে হল। লোকের মধ্যে উচ্ছাস কি একটু বেশী, না শৃংখলার অভাব? ঠিক বুঝতে পারে না শাহাদত। পথে আব্বার এক পরিচিত লোকের সাথে দেখা। রিকশা থামিয়ে তাকে ডাকলেন আব্বা।
- আসগর সাহেব,কোথায় যাচ্ছেন?
ভদ্রলোক থামলেন।
- আরে হামিদ সাহেব যে! ছিলেন কোথায় এতদিন? মুক্তিযুদ্ধে?
- না, বাড়িতে। আমার ছেলেরা মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিল।
আব্বার মুখে ঈষৎ গর্বের ছোঁয়া। ভদ্রলোক শাহাদতের দিকে তাকালেন।
- এটি আপনার ছেলে বুঝি? মুক্তিযোদ্ধা? বা: বা:। সময় থাকতে কিছু বাগিয়ে নাও হে। এত বড় একটা কাজ করেছ!
শাহাদতের রাগ হল। মুখের উপর একটা জবাব দিকে চাইছিল, আব্বার মুখের দিকে তাকিয়ে কোন জবাব দিল না। পাড়ায় ঢুকে ধ্বংসলীলা চোখে পড়ল। প্রথম বাড়িটা ভাল আছে। তারপর কয়েকটা বাড়ি যেন ছাড়া বাড়ি। লোক আছে কি না বোঝা যায় না। তাদের পাশে শরীফ সাহেবের বাড়িটা আস্ত আছে, কিন্তু দরজা জানালা নেই। নিজেদের বাড়িটা দেখে ধ্বক করে উঠল শাহদাতের বুক। দরজা জানালা সহ বিল্ডিং যদিও অটুট আছে কিন্তু কেমন যেন পোড়োবাড়ি পোড়োবাড়ি ভাব। গেইটটা হাট খোলা, মাঠ জঙ্গলে ভরে গেছে। পোর্টিকো দিয়ে উঠেই ড্রয়িং রুমের দরজা, সেটাই বাড়ির একমাত্র এন্ট্রি পয়েন্ট। দরজা ধাক্কা দিতেই খুলে গেল। ধুলি ধুসর দুটো কাঠের চেয়ার পড়ে আছে, শাহাদতদের সোফাসেটের চিহ্ন পর্যন্ত নেই। দেয়ালের গোলাপী ডিস্টেম্পার ধোঁয়ায় কালো হয়ে গেছে। ছাদের দিকে তাকালো তারা। সিলিং ফ্যানটা কালো বাদুড়ের মত ঝুলছে। আগুনের তাপে কুকড়ে গেছে ডানা গুলি। অন্য ঘরগুলির অবস্থা একই। আব্বা শুধু বললেন, ‘হার্ম্মাদ’!
রান্নাঘর এবং ভিতরের ঘর দুটি দেখে মনে হল, এ গুলি ব্যবহার হতো। ফ্রিজ পুড়ে গেছে। টিভি নেই, আলমিরা নেই, খাটের জায়গায় এক ঘরে দুটো চৌকি। রান্নাঘরে গ্যাসের চুলা ব্যবহার হতো মনে হয়। তার মানে কেউ এখানে ছিল। সম্প্রতি চলে গেছে। টেলিফোন সেট আছে, লাইন নেই। আব্বা বললেন,
- আমি যাই, কিছু লোক নিয়ে আসি।
আব্বা বেরিয়ে যেতেই পিছনের দে’য়ালে গাঁথা লোহার সিঁড়ি বেয়ে শাহাদাত তর তর করে ছাদে উঠলো। আশফাকের ছেলেমানুষীর চিহ্ন এখনো ছাদে আছে কি না সে দেখতে চায়। চক দিয়ে সে লিখে গিয়েছিল, "আবার ফিরে আসবো।" কোথায় সে লেখা? শ্যাওলা জমেছে ছাদে, লেখাটা নেই। শেষ পৌষের মৃদু বাতাসে শির শির করে কাঁপছে জারুলের পাতা, দুলছে তার ডাল। আরে! ডালের গায়ে হেলে পড়া, ফেটে যাওয়া পঁচা বাঁশের ডগায় পড়ন্ত রৌদ্রের সোনালী আলোয় ঝিকমিক করছে কে? দ্বিতীয়বার চমকাল শাহাদাত। রৌদ্রে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে সবুজ রং এখন বিবর্ণ, লাল বৃত্ত এখন কমলা, সোনালী ম্যাপে সোনা ঝরছে না, তবু উড়ছে। আশফাক ফিরে এসেছে! চীৎকার করে বলতে ইচ্ছা হল তার, ”আশফাক ফিরে এসেছে!”
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০১৭ সকাল ১০:০৯
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

যুক্তরাষ্ট্রে ইসরাইল বিরোধী প্রতিবাদ বিক্ষোভ

লিখেছেন হাসান কালবৈশাখী, ০৩ রা মে, ২০২৪ সকাল ৮:০২

গাজায় হামাস উচ্ছেদ অতি সন্নিকটে হওয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিউইয়র্ক ও লসএঞ্জেলসে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পরেছিল। আস্তে আস্তে নিউ ইয়র্ক ও অন্যান্ন ইউনিভার্সিটিতে বিক্ষোভকারীরা রীতিমত তাঁবু টানিয়ে সেখানে অবস্থান নিয়েছিল।


... ...বাকিটুকু পড়ুন

৫০১–এর মুক্তিতে অনেকেই আলহামদুলিল্লাহ বলছে…

লিখেছেন বিচার মানি তালগাছ আমার, ০৩ রা মে, ২০২৪ বিকাল ৩:০০



১. মামুনুল হক কোন সময় ৫০১-এ ধরা পড়েছিলেন? যে সময় অনেক মাদ্রাসা ছাত্র রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছিল। দেশ তখন উত্তাল। ঐ সময় তার মত পরিচিত একজন লোকের কীভাবে মাথায় আসলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

মেহেদীর পরিবার সংক্রান্ত আপডেট

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ৮:৪৯


মার্চ মাস থেকেই বিষয়টি নিয়ে ভাবছিলাম। ক'দিন আগেও খুলনায় যাওয়ার ইচ্ছের কথা জানিয়েও আমার বিগত লিখায় কিছু তথ্য চেয়েছিলাম। অনেক ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও মেহেদীর পরিবারকে দেখতে আমার খুলনা যাওয়া হয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

'চুরি তো চুরি, আবার সিনাজুরি'

লিখেছেন এমজেডএফ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৮


নীলসাধুকে চকলেট বিতরণের দায়িত্ব দিয়ে প্রবাসী ব্লগার সোহানীর যে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল তা বিলম্বে হলেও আমরা জেনেছি। যাদেরকে চকলেট দেওয়ার কথা ছিল তাদের একজনকেও তিনি চকলেট দেননি। এমতাবস্থায় প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বরাবর ব্লগ কর্তৃপক্ষ

লিখেছেন নীলসাধু, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২২

আমি ব্লগে নিয়মিত নই।
মাঝে মাঝে আসি। নিজের লেখা পোষ্ট করি আবার চলে যাই।
মাঝেমাঝে সহ ব্লগারদের পোষ্টে মন্তব্য করি
তাদের লেখা পড়ি।
এই ব্লগের কয়েকজন ব্লগার নিজ নিক ও ফেইক... ...বাকিটুকু পড়ুন

×