somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্প:এ ভ্যালেনটাইনস ডে

১৪ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ রাত ১:৪৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

১'

ল্যাপটপের স্ক্রিন এর দিকে তাকিয়ে বিরক্তিতে ভুরু কু্ঁচকালো তমা। ফেব্রুয়ারি মাস আসতেই এই এক উপদ্রব শুরু হয়েছে। সঙ্গভুক ও সঙ্গদানেচ্ছুক নারীপুরুষ নির্বিশেষে ছবি ও অফারের অ্যাড বিনা আমন্ত্রনে অনাহুত অতিথির মতো উপদ্রব করছে ওকে। বিশেষত মেয়েগুলোর ছবির দিকে তো তাকানোই যায় না -এত অশালীন। না , ওর কোন সঙ্গীর দরকার নেই , নির্মম হাতে ক্রস বাটনে চাপ দেয় তমা। কাজের সময় কার না এসব বিরক্তিকর লাগবে? কিন্তু ব্যাপার শুধু এটুকুই তো নয়।


এসব ওর এখন আর ভালোই লাগে না। স্বপ্নিল স্কুল -কলেজ - বিশ্ববিদ্যালয়ের দিনগুলোতে অন্যদের জোড়ায় জোড়ায় দেখে ঈর্ষা -আক্ষেপ ও প্রশ্রয় মেশানো দৃষ্টিতে যা দেখতো ,এখন, তা থেকে অনেকটা পথ পেরিয়ে ওসব ওর মধ্যে কেবল বিরক্তি জাগায়।অনেকটা 'আঙুর ফল টক' -এর মত ব্যাপার ।


একটা কারন হয়তো এই যে , ও এখনো এই দিনটি কাটানোর মত যোগ্য কাউকে খুঁজে নিতে পারেনি। অথবা হয়তো একারনে ,যে কাউকে না পাওয়ায় এখন তমার মা-বাবার চোখে ওর সবটুকু উচ্চশিক্ষা, সুন্দর মন , বিতর্কে , খেলায় ,আবৃতিতে পারদর্শিতার একদার গৌরববর্ধক স্বারকগুলো মূল্যহীন হয়ে যেতে বসেছে।


একসময় মাবাবারা নিজেরা পছন্দ করে ছেলেমেয়েদের বিয়ে দিতে পারাটাকে বিশাল গর্বের ব্যাপার বলে মনে করতেন। এখন ছেলেমেয়ে নিজেরা নিজেরা শিক্ষা, পদ, অর্থ, জাতকুল মিলিয়ে উপযুক্ত কাউকে ধরে আনলে গৌরব বলে মানেন।

সাদাসিদে চালের ''ভালো মেয়ে'' থেকে তমার এখন ডিগ্রেডেশন হয়েছে। ওর মায়ের ভাষায়, 'আমার মেয়ে হয়ে তুই এত বোকা হলি কিভাবে?আজকাল মানুষ কত নিজের বোঝ বুঝে, কত সেয়ানা একেকজন। এত মানুষের সাথে তোর ওঠাবসা , ভার্সিটিতে , অফিসে, কাউকে দেখেশুনে জুটিয়ে নিতে পারলি না? তোর কাছ থেকে এরকম আমরা আশা করি নি।'

এহেন অভিযোগে তমা বিস্ময়ের চেয়ে বেশী ব্যাথিত হয়। কেননা-

''আমার মেয়ে এমন নয় , মানে কিনা এইসব প্রেমপিরিতি করে কোন কান্ড করে না , কত মানুষের পোলাপান তো শুনি কত কুকীর্তি করে.... '' বলে একদা তার এই মাকেই সে গর্ব করতে শুনতো।

এবং- যথেষ্ট রক্ষনশীল মনোভাব নিয়ে তাকে ছেলেদের সাথে মিশতে দেয়া তো দূর, কালেভদ্রে অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে কারো ফোন আসলেও পরিবারে কেমন বাঁকাচোখে দেখা হতো।

অবশেষে-এখন তার ধারনা হয়েছে ''ভালো'' মেয়েদের জন্য প্রেম বিষয়টা নয়। কেননা অতীব অসুন্দর কিন্তু চমৎকার করে ছেলেদের সাথে ছলাকলায় পারদর্শী , সাজগোজে নিজের আদিগাত্রবর্ণ কে চওড়া প্রলেপে ঢেকে ফেলা, ফ্রিগোয়িং মেয়েগুলোর তো প্রেমীর অভাব হয় না।


মনে পড়ে দেশে থাকতে অফিসের সুন্দরী কলিগ রোমানা সুতীব্র অহম নিয়ে বলেছিল, জীবনে কত যে প্রেমের চিঠি পেয়েছি, সেই বাচ্চা বয়স থেকে, ...... তা আপনাকে কয়জন প্রপোজ করেছে?

না , আজ পর্যন্ত ওকে কেউ একটিমাত্র নীল খামে সুবাসিত চিঠি দুরে থাক, একটা সাদা চিরকুট পর্যন্ত পাঠায় নি।এই পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষের ভিড়ে তাকে আলাদা করে একটি মানুষও দেখে নি আজতক।

শুনে চৌকস কর্মী , সবদিকেই ওর চেয়ে উৎকৃষ্ট -তমার প্রতি একটা বক্র তাচ্ছিল্যের হাসি হেসেছিল রোমানা।

তমা হয়েছিল বিব্রত। আশেপাশে যে লোক ছিল বিস্তর।যে মেয়ের ছেলেদের কাছে কোন দাম নেই বিয়ের বাজারে -সেটা প্রকাশ পাওয়া তার জন্যে বড় অযোগ্যতা সমাজের চোখে।

তমা এখনও সিঙ্গেল । কিন্তু বিবাহযোগ্য বয়সের চৌকাঠ-টাও যে ডিঙাই ডিঙাই করছে, পাত্রের সন্ধানে রাতে বাবা-মায়ের ঘুম হারাম হয়েছে। অফিসেও তো শান্তি নেই। অবিবাহিত বিবাহযোগ্য মেয়েদের বিবাহ বিষয়ক আলোচনা ও ভাবি বর নিয়ে জল্পনা' - না চাইতেও এড়ানো যাবেনা এমন একটা বিষয়। বাড়িতে ফিরলেই পাত্রের ছবি হাতে মায়ের নক করা, বন্ধ দুয়ারও দেয় না স্বস্তির আধার।


তা সমস্যাটা কি? বিয়ে কি করতে চায় না তমা? আসলে ওর কল্পনাবিলাসী মনে যাকে রূপকথার রাজপুত্র মনে হয় তার সাথে মেলে না কেউ-উ। আপাত গম্ভীর তমার বাইরের খোলসের ভিতরে উল্টোপনা রোমান্টিক এক সত্ত্বার বিপ্রতীপ বসবাস।

না চেহারা নয়,এর বাইরের অবোধগম্য কিছু আছে একটা প্রখর আপত্তি তুলে।

একপলকের পরিচয়ে সে কিভাবে বুঝবে মানুষটা কেমন?

মা-বাবার খাড়া করা স্বচ্ছল পাত্রের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বোঝা যায়, স্যালারি জানা যায়, মানুষটাকে জানা যায় না। বাড়ি, গাড়িকে তো মানুষ বিয়ে করে না , তাই না? আর সামাজিক কারন? সে কি এক সোশ্যাল বডিগার্ড চায়, না একজন সাথী? এহেন নির্ভরশীলতায় ''হাসবেন্ড'' শব্দটা মেয়েদের সবকিছু হয়ে ওঠে, কিন্তু সে 'স্বামী'ত্ব পদটাই আসলে সব, মানুষটা আলাদাভাবে কিছু না।


যাকে তাকে সে আসনে বসিয়ে দেওয়া হয়, মেয়েরা বটবৃক্ষকে লতার আশ্রয় করার মতো করে জড়িয়ে ধরে। স্বামীটি ভাবে বউটি তাকে খুব ভালোবাসে , বউটিও তাই। আসলে সে ভালোবাসা নিজেকে- ছিন্নপত্র হয়ে যাবার ভয়ে সে বন্ধন কেবল দাতা গ্রহীতার।নিপাট টিকে থাকার স্বার্থপরতা।সে 'ভালোবাসার' ভ্রান্তিবিলাসের করুণা দুপক্ষেরই।


তাইতো ওর চাচাতো বোন মিলির হররোজ বউপেটানো হাজবেন্ডটা মারা যাওয়ার পরেও ওর যে অঝোর কান্না, সে মানুষ স্বামীটির প্রতি মমতা থেকে না, সামাজিক অরক্ষনীয়তা থেকে ।একে সতীত্ব বলেও ব্যাখা করা বড় মুশকিল।বাইরে থেকে যাই মনে হোক না কেন।

এরকম অনেক হাবিজাবি চিন্তা ওর মনে আসে।

ওর মনতো সে নিজেই বোঝে না, কাউকে বোঝাবে কিভাবে?

মাবাবার উৎকন্ঠা আশঙ্কায় রূপ নিচ্ছে দিনকে দিন, হোপলেস বোধ করছিল তমা। এই অবস্থায় শান্তির বারি হয়ে এসেছে ওর ফুল- ফ্রি অভিজাত স্কলারশিপটা।


২'


দিনের পর দিন ডেটিং অ্যাড গুলো দেখতে দেখতে এই তমা, শান্ত ভালোমানুষী লক্ষী মেয়ে তমা কখন যেন দু্ঃসাহসী হয়ে ওঠে। এর আগে কখনো ভাগ্যে হয়ে ওঠে নি, আর পরেও কখনো হবে না। এই-ই শেষ সুযোগ ওর জীবনে।এক অশুভ বিদ্রোহের। কেন কিসের জন্য ওকে একেবারে সতীসাধ্বীর নীরস জীবন যাপন করতে হবে? কেন এই আলগা ভেক ধরে থাকা? কেন, কোন অযোগ্যতায় সে কারো কাছ থেকে একটিমাত্র ভালোবাসার সুরভিত লাল গোলাপ পেল না জীবনে?

আগামী বছর এই সময়ে সে থাকবে দেশে, এই তার স্বাধীন বাধাহীন নিশ্চিন্ত জীবন- শেষ হবে চিরতরে। মাবাবার আয়োজনে এক অপরিচিত কায়াহীন বিত্তবানের সাথে তার এক গৎবাঁধা জীবনের গাঁট বাঁধা হয়ে যাবে।

সে আপাদমস্তক অজানা লোকটি ওকে এবং ওর সবকিছুকে নেবে ''টেকেন ফর গ্রান্টেড '' দৃষ্টিভঙ্গিতে।


কোনদিনও আবেগভরে বলবে না , ''ভালোবাসি''।

ওর মন জয়ের জন্য হাস্যকর কিন্তু মধুর কোন চেষ্টা করবে না কখনো, কেননা , বিবাহিতা স্ত্রী তো অবধারিতভাবে কায় -মনে তার সম্পত্তি হয়েই রয়েছে।

তাকে বলা লাগে না কোন অশ্রুত বিরহী কাব্য।

তাকে নিয়ে ভিজতে ইচ্ছে হয় না এক অঝোর বৃষ্টির রাতে।

ধবধপে জ্যোৎস্না ছড়ানো পূর্ণিমার চাঁদ নির্ঘুম চোখে দেখা লাগে না অতন্দ্র , বরং আলো জানালা গলে চোরা পথে অনাকাঙ্খিত ঢুকলে পর্দাটা আরেকটু টেনে দেয়া হয়, যাতে চোখে পড়ে ঘুমের ব্যাঘাত না ঘটে।

স্ত্রী হল নিজ মালিকানাভুক্ত জিনিস, নিজের অধিকারের পরিধেয়ের মত , মন চাইলে তুলে নাও, , নাহলে ফেলে রাখো আলমারীর এক অবহেলিত কোনে। সে তো তোমারই থাকবে,সব সময়, থাকতে সে বাধ্য।

এই সব চিন্তাই তমাকে সহসা বেহিসেবী ডেয়ারিং করে তোলে।

দ্রুত হাতে কিবোর্ডে আঙ্গুল চালায় সে।



৩'

সবকিছুর পরেও সেই বিশেষ ১৪ তারিখটাতে একটা অনভ্যস্ত পশ্চিমা পোশাকে সুসজ্জিত হয়ে মার্কের জন্য অপেক্ষা করতে করতে তমা যে একটু নার্ভাস, একটু বিচলিত ছিল না তা কিন্তু নয়।

কাছের কেউ দেখলে, কেউ জানতে পেলে কি হবে?দ্বিধা শঙ্কা আর ঘোচে না ওর।

আমেরিকা ফ্রি কান্ট্রি , এখানের অভিনব অভিনব সব ব্যবসায়িক আইডিয়ারও অভাব নেই।

এখানেই মানায় এসব।

মার্ককে ছবিতে দেখেই তার যথেষ্ট ভালো লেগেছিল। তার স্বপ্নের ধবল-রাজকুমার। চ্যাট করে করে ওর মুগ্ধতা আরও বেড়েছে।জানা কথা - এ রাজপুত্র 'ভাড়াটে' তাও কথার মায়াজাল যথেষ্ট শক্তিশালী , হয়তো ভাড়াটে বলেই। কথার জাদু জানে,জানতে হয় তাকে।এ এক নিপুন ব্যবসা।


তা-ছাড়া ভার্চুয়াল দুনিয়াকে কাউকে কতটুকুই বা বিশ্বাস করা যায় এমনিতেও?

এসব নিয়ে এখন আর না ভাবাই ভালো, ভাবার সময়ও নেই। নিজেকে বোঝায় তমা।

সুবেশী দামী স্যুটে সজ্জিত মার্ককে দেখে ওর তাক লেগে গেল । ছবির চেয়েও ও বাস্তবে ও অনেক বেশী সুদর্শন। কে বলে সৌন্দর্য শুধু মেয়েদের সম্পত্তি?

ও-র জন্যে যেন হুবহু সিনডারেলার 'প্রিন্স চার্মিং' ,একেবারে বইয়ের পাতা থেকে উঠে এসেছে।

ওর দিকে তাকিয়ে একবার হাসলো মার্ক। আন্তরিক ঝকঝকে হাসি। সাথে বাড়িয়ে ধরলো কার্ড এবং একশো একটা লাল গোলাপের তোড়া। কার্ডে লেখা আই লাভ ইয়্যু'র ম্যাজিক শব্দগুলো। ওর মতো নিঃসঙ্গ অভাগাদের জন্য নিজের পার্টটাইমের কষ্টর্জিত অর্থে এই মেকি আয়োজন, তাও তমার খাঁটি বলে মনে হতে থাকে। আজ , একদিনের জন্য, মার্ক ওর আদর্শ প্রেমিক পুরুষ,' না না স্রেফ বন্ধু,মার্কের সাথেতো এরকমই কথা ছিল'- নিজেকে শাসন করে তমা মনে মনে।

ইতি উতি বাধহীন ঘুরে বেড়ায় ওরা, আজকের দিনটি এক বিশেষ দিন। আর দশজন কপোত-কপোতীর মতো , উদ্দেশ্যহীন কথামালা, রেস্টুরেন্টে ক্যান্ডেললাইট ডিনারের সময় পর্যন্ত যেতে যেতে ওর মনে হয় মার্ক যেন ওর বহুদিনের চেনা মানুষ , অকপটে নিজের সব কথা বলে ফেলতেও ওর বাধে না।

কি আশ্চর্য , তোমাকে আজ পর্যন্ত কেউ প্রোপোজ পর্যন্ত করে নি?তুমি এখনও ভার্জিন?

চোখ কপালে ওঠে ওর।

আই কান্ট বিলিভ ইউ। জানো এই নিউইয়র্কে শতাংশে একজনও তোমার মত পাওয়া যাবে না।

পারহেপস আই অ্যাম নট দ্যাট অ্যাট্রাকটিভ।

মুখে বিষন্নতা ফুটিয়ে বলে তমা।

ডোন্ট বি সিলি,তোমাদের দেশের ছেলেগুলোরই চোখ খারাপ।
হাসতে হাসতে বলে মার্ক।

নৈশক্লাবের মায়াবী মৃদু আলোয় কোমল পানীয়ের গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে তমার মার্কের কথা বিশ্বাস করতে ইচ্ছা হয়। কোন কমতি যেন ওর নেই। মার্ক আছে ওর পাশে, ওর উপস্থিতিকে এখানে এখন সাজানো মনে হয় না, আসল বলে ভ্রম হতে থাকে।

ঠিক বিদায় নেবার আগে মার্কের ওর কপালে ঠোঁটের আলতো পরশ ওকে মনে একটু অফ ব্যালেন্স করে দেয় বৈকি। কোন শারীরী ব্যাপার নয় , শুধুই কিছু সময়ের নিষ্কলুষ সঙ্গ ওদের আজকের ডেটের শর্ত ছিল - তমার তরফে। অবশ্যি ওদের কাছে এই সব ছুতমার্গের বিশেষ কোন মানে নেই- জানে সে। তাও, তাও আজন্মের সংস্কার ওর মনে এক অদ্ভূত ভাব তোলে, মার্ককে আন্তরিক বলে বিশ্বাস করতে মন যায়।

ফেরার পথে কোন কারন ছাড়া তমার কান্না পায়। পার্কের একটা বেঞ্চিতে বসে মুখ গুজে থাকে, কাঁদলে চলবে না তো।

ওকে এভাবে দেখে অপরিচিত একজন এগিয়ে এসে উদ্বিগ্নসুরে প্রশ্ন করে ,

আর ইউ সিক?

অবাধ্য অশ্রুকনাকে নিষ্ঠুর অস্বীকার করে তমা, নো নো আই অ্যাম ফাইন, জাস্ট ফাইন।

৪ '

রিয়াদের মাঝে এমন কিছু নেই যা ওর স্বপ্নের রাজপুত্তুরের সাথে যায়। ওর স্বপ্নের মানুষের লম্বা গড়নে শ্যামবরন দুষ্টু মিষ্টি চেহারাতে একরাশ কালোচুল দেয় কল্পনার পূর্ণতা, আর , অপরদিকে একদম বিপরীতে বেটে , একটু মোটা রিয়াদের মাথায় এই অল্পবয়সেই অসময়ের পাতাঝরার ইঙ্গিত ওর বিরল হয়ে আসা চুলগুলোয়।

এতো গেল বাইরের কথা-এক আমুদে হাসিখুশি 'ছেলে'র পরিবর্তে এ এক আজন্ম গম্ভীর 'লোক'।ঠাট্টা করে প্রথমবারের দেখায় টুম্পা ফোড়ন কেটে বলেছিল, 'রামগরুরের ছানা , হাসতে তাদের মানা'।

ও এক বন্ধু চেয়েছিল, যাকে সব কিছু বলা যায়, রিকশায় হাতে হাত রেখে ঘোরা যায় শহরময়, কাঁধে মাথা রেখে অর্থহীন বকে যাওয়া যায় অনর্গল। আইসক্রিমের গাড়ি দেখলে ছেলেমানুষী জেদ করে পাল্লা দিয়ে খেয়ে খেয়ে গলব্যাথা বানিয়ে ফেলা যায়। একে সে ভূমিকায় ভাবতে পারে না তমা, ভাবা অসম্ভব।রিয়াদকে দেখে ওর মনে হয়, এ হবে এক সামাজিক অভিভাবক, সাথী নয়।

না , মন খারাপের কোন বৃত্তে এবার বন্দী হবে না তমা। ও এতদিনে ওর সব স্বপ্নের তেপান্তরজোড়া রাজ্যকে বৈষয়িকতার পাল্লায় না-আমলযোগ্য বলে বুঝেছে।তাই এবারে ওর তরফে কোন আপত্তি নেই লেশমাত্র।

মাবাবার পছন্দ, সুতরাং সাংসারিক স্বাচ্ছন্দ্যে অর্থাৎ পাত্রের আসল যোগ্যতায় রিয়াদ সসম্মানে উত্তীর্ণ। তাছাড়া তমাটা যে আজন্মই বোকাই রয়ে গেল, এত কিছু দেখলো, এমনকি বিদেশও ঘুরে এলো , তাও তার কোন উন্নতি হলো না, সেই ভ্যাবলাকান্ত মেয়েটা এখনও কাউকে নিজে থেকে জুটিয়ে নিতে পারলো না, ওর এখন এত আপত্তি করবার মুখই নেই।

যতই অ্যারেঞ্জ হোক না কেন, তাও তমা ''ভালো মেয়ে, খাঁটি মেয়ে''।সংস্কার , ভালোমানুষী বোকামী সে আজও পুরোপুরি ঝেড়ে ফেলতে পারে নি। তাই রিয়াদকে বহু সঙ্কোচ কাটিয়ে ও মার্কের ঘটনাটা সে বলতে পেরেছে অবশেষে।

মার্ক আমার বন্ধু , এখনও , তবে শুধুই বন্ধু । ফেসবুকে এখনও আমাদের প্রায়ই যোগাযোগ হয়।

কিছুক্ষন অস্বস্তিকর নীরবতায় কাটে ওদের।

আপনি চাইলে এ বিয়ে ভেঙ্গে দিতে পারেন, বহু কষ্টে অবশেষে বলে তমা, মা-বাবার কথা ভেবে নিজেকে বড় নিকৃষ্ট নষ্ট মেয়ে, স্বার্থপর বলে মনে হতে থাকে ওর।মুহুর্তের ঝোঁকে কি ও একটা ক্ষমাহীন অনন্ত অনুতাপের কাজ করে ফেলেছে? কিংবা এত সৎ প্রকাশটা কি একটা বিশাল বড় ভালোমানুষী বোকামো হয়ে গেল নাকি? আজকের যুগে সম্ভবত এত যুধিষ্ঠির হওয়া কারো সাজে না।

আবারও অসহ্য নীরবতা।

শেষমেশ মুখ খোলে রিয়াদ।

বুঝলেন , এই অ্যারেঞ্জ ম্যারেজটা আমাকে বড় অস্বস্তিতে ফেলে, কাউকে আগে থেকে জানা-বোঝার কোন উপায় নেই, আবার লাভ ম্যারেজেও বিশ্বাস হয় না। কত চোখের সামনে দেখলাম , আজ যাকে পাওয়ার জন্য পাগল, উন্মত্ত, দুদিন বাদে বিয়ে হতেই সেই ঘোর ভঙ্গ।বছর বছরের চেনা শোনাও অর্থহীন হয়ে যায়।

প্রেমির রূপ একেবারে ষোলআনা বদলে এমন হয়..............., তারপর তুমি বিয়ের পরে কত বদলে গেছো, আমাকে আর ভালোবাসোনা আগের মত , হেন তেন বলে দাঙ্গা হাঙ্গামার শেষ নেই।
এই জন্যেই প্রেমে ভালোবাসার ধারে কাছে দিয়ে আমি যাই না।


যাক , আমার এই ভয়টা আজ দূর হলো।আমাদের বিয়েটা এই দুই ধরনের বাধাধরা পথের বাইরে হবে।

মানে? অবিশ্বাসী প্রশ্ন তমার।

মানেটা এই যে, আপনি রাজি থাকলে, এখনও , আমি আপনাকে-ই বিয়ে করতে চাই।তথাকথিত শরীরসর্বস্ব সতী না, আমি এক সৎ সঙ্গী চেয়েছিলাম, আপনি ঠিক তাই।

তমা অবাক চোখে রিয়াদের দিকে তাকায়, মার্কের চেয়ে এই মুহুর্তে রিয়াদকেই ওর কাছে অনেক বেশী সুদর্শন আকর্ষনীয় বলে মনে হয়। দারুন হ্যান্ডসাম মার্কের সাথে রিয়াদের কোন তুলনাই চলে না, চলা উচিত নয় তা-ও ওর রাজপুত্রের কায়াহীন অবয়ব জুড়ে বসে এই সাধারন এমনকি বিপরীতের মানুষটা।

৫'

একমাত্র মেয়ে বলে , বিয়েটা খুব ধুমধাম করে হয়েছিল ওদের, যথাসময়েই। বিয়ের ভিডিওটা খুব পছন্দ তমার, বারে বারে দেখে প্রায়ই। নেপথ্যে সঙ্গীত গুলো ওর বিশেষ প্রিয়, কারনও আছে, অভিনব কারন।

সবগুলো গানই যে রিয়াদের গাওয়া।রবীন্দ্রসঙ্গীত খুব সুন্দর গায় সে।ওরই আইডিয়া এটা , সবার বিয়েতে ঝাকানাকা হিন্দী গানে হৃদয়ের ছোঁয়া থাকে না, আমারটাতে নিজের স্রষ্টাদত্ত কন্ঠের উপযুক্ত সদ্ব-ব্যবহার হবে।রিয়াদের যেমন নাটকীয় ঘোষনা, তেমনি কাজ। সবাই-ই ব্যাপারটার প্রশংসা করেছে- দারুন আইডিয়া তো।

' আমার হিয়ার মাঝে ' গানটা সবচেয়ে আশ্চর্য খুলেছে ওর গলায়।বারে বারে বিশেষ করে এই জায়গাটা দেখে, নাকি শোনে তমা। শুনতে শুনতে ঘোর লাগে ওর, এত সুন্দরও হয় মানুষের গলা?' কিন্নর কন্ঠ' উপমাটা কি ছেলেদের সাথে যায় ?শোনে আর ভাবে সে।

আজও শুনছিল কাজের ফাঁকে ক্ষণিক অবসরে, তখনই হঠাৎ দ্বৈতগলায় প্রতিধ্বনি শুনে ভড়কে গেল, পেছন থেকে নবতম সুরটা এবার আসল জনের।

খালি গলায়ও তমার রাজপুত্র অপূর্ব গায়।


রেজওয়ানা আলী তনিমা

ফেব্রু ১৩, ২০১৪ইং।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ ভোর ৪:৩০
২২টি মন্তব্য ২২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সৎ মানুষ দেশে নেই,ব্লগে আছে তো?

লিখেছেন শূন্য সারমর্ম, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:৪৮








আশেপাশে সৎ মানুষ কেমন দেখা যায়? উনারা তো নাকি একা থাকে, সময় সুযোগে সৃষ্টিকর্তা নিজের কাছে তুলে নেয় যা আমাদের ডেফিনিশনে তাড়াতাড়ি চলে যাওয়া বলে। আপনি জীবনে যতগুলো বসন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

গরমান্ত দুপুরের আলাপ

লিখেছেন কালো যাদুকর, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৫৯




মাঝে মাঝে মনে হয় ব্লগে কেন আসি? সোজা উত্তর- আড্ডা দেয়ার জন্য। এই যে ২০/২৫ জন ব্লগারদের নাম দেখা যাচ্ছে, অথচ একজন আরেক জনের সাথে সরাসরি কথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজীব নূর কোথায়?

লিখেছেন অধীতি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:২৪

আমি ব্লগে আসার পর প্রথম যাদের মন্তব্য পাই এবং যাদেরকে ব্লগে নিয়মিত দেখি তাদের মধ্যে রাজীব নূর অন্যতম। ব্যস্ততার মধ্যে ব্লগে কম আসা হয় তাই খোঁজ-খবর জানিনা। হঠাৎ দু'একদিন ধরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তে চায়।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৮



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়বে তার অনুমতি নিতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটির অনুমতি দেয়নি, যার জন্য তারা সোশ্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=তুমি সুলতান সুলেমান-আমি হুররাম=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৩৬



©কাজী ফাতেমা ছবি

মন প্রাসাদের রাজা তুমি, রাণী তোমার আমি
সোনার প্রাসাদ নাই বা গড়লে, প্রেমের প্রাসাদ দামী।

হও সুলেমান তুমি আমার , হুররাম আমি হবো
মন হেরেমে সংগোপনে, তুমি আমি রবো।

ছোট্ট প্রাসাদ দেবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×