somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মধ্যবিত্তনামা

২৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৫ রাত ১২:৫১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

চারপাশটা দেখতে দেখতে রায়হান গাঢ় নিঃশ্বাস ফেললো। এই জায়গাটা বুঝি আর কখনোই নির্মল দেখাবেনা। সেই পুরনো প্যাচপ্যাচে কাঁদা, রাস্তার ধারে ধারে কোরবানী দেওয়া গরুর লাশের উৎকট গন্ধ, ধুলোতে বালির সাথে সাথে রাস্তার এদিক ওদিকে থাকা খোলা চিপসের প্যাকেট, পরিত্যক্ত সিগারেটের প্যাকেট, আধপঁচা পাতার গন্ধ, মুড়ির ব্যবহৃত ঠোঙ্গা যার উল্টাপিঠে হিসাববিজ্ঞানের কথা লেখা ইত্যাদির উঠে যাওয়া- এই দৃশ্য যেন কোনদিন বদলাবার নয়। শহরে এখন মানুষজনের উপস্থিতি নেই বললেই চলে। ঈদপরবর্তী সময়ের ছুটি এখনো শেষ হয়নি। তারপরেও কিছুই বদলায়না। আরেকবার নিঃশ্বাস ফেলতে যাবে তার আগেই আটকে গেলো। অপরপাশ থেকে সৌম্য কলকল করতে শুরু করেছে,

“রায়হান ভাই, আপনার সাথে কতোদিন পরে দেখা হইলো। বেশ মন খুলে কথা বলতে পারতেছি।”
“আরে না না কি বলো এইসব? এগুলা হুদাই ফর্মালিটি করতেছো সৌম্য। আমি খুবই এমব্যারাসড ফিল করি কেউ সরাসরি এসব কথা বললে।” এই জায়গার পরিবেশঘটিত এমব্যারাসমেন্ট ভুলে থাকবার সুযোগ পাওয়া যাচ্ছিলোনা। সৌম্যর উপরে কৃতজ্ঞবোধ চলে আসে।

“না রায়হান ভাই সত্যি। আমি একেবারে মন থেকে কথাগুলা বলতেছি। এখন সময়টা এতো খারাপ, কাউকেই বিশ্বাস করতে পারিনা। কারো সাথে মন খুলে কথা বলা যায়না।” চারপাশের কোথাও না তাকিয়ে সৌম্য গড়গড় করে নিজের কথা বলে যায়।

মাস্টারী করার সুযোগ চলে এসেছে। বিরল সুযোগ। রায়হানের জিভ সুড়সুড় করে। আজকাল কি যে হয়েছে মানুষের, কেউই অন্য কারো কাছ থেকে ভালো কোন কথা শুনতে চায়না। তেমন কোন কথা বললেই সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকায়। মনে মনে হয়তো আঁতেল বলেও গালি দেয় কেউ কেউ। যাক গে এসব কথা, সৌম্য ছেলেটা তো নিজেই সুযোগ করে দিলো মনের মতো করে মাপা কথা বলবার। রায়হানের মুখ অটোমেটিক সেট হয়ে যায়,

“সেটা তো অবশ্যই সৌম্য। এখনকার সময়টা আমরা যতোটা খারাপ ভাবি তার চাইতেও বেশী খারাপ। চারপাশে এতো এতো জটিলতা, এতো কুটিলতা। প্রত্যেকেই আছে কেবল নিজের ধান্দায়। তাও আবার কারণে - অকারণে অপরের সবটুকু কেড়ে নিজের করে নিতেও বেশীরভাগ মানুষ দ্বিতীয়বার চিন্তা করেনা। এতোটাই নির্লজ্জ হয়ে গেছে সবাই। খুবই সাফোকেটিং একটা সময়ের মধ্যে দিয়ে আমরা যাচ্ছি সৌম্য বুঝলা? মানুষ এখন নিজেই কল্পনাতীত ধূর্ত তো তাই অপর কাউকেই বিশ্বাস করতে পারেনা। অথচ এটা তো মানুষের সহজাত প্রবণতা না। মানুষের সহজাত প্রবণতা হইলো নিজেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রকাশ করা। আমরা এখন সেটাই করতে পারতেছিনা। এটা যে কি ট্র্যাজিক বলেও বুঝানো যাবেনা। যাই হোক তুমি যেন কি বলতে চাইতেছিলা? সরি সরি তোমাকে ঠিকভাবে পুরাটা বলতেই দিলাম না। মুখের প্রতিটি রেখায় দুঃখিত ভাব আনতে রায়হানের বেশ কষ্ট করতে হয়।

“রায়হান ভাই আমি আসলে বলতে চাইতেছিলাম যে আমি অফিসে হোক কি অন্য কোথাও যাদের সাথেই কথা বলতে হয় তাদের কারো সাথেই মন খুলে কথা বলতে পারিনা। সবাইকেই অকারণে সন্দেহ হয়। অরুণিমার সাথেও নিজের এই সমস্যাটা নিয়ে কথা বলছিলাম। বলতে গিয়ে দেখি সেও একই সমস্যায় ভুগতেছে। আচ্ছা রায়হান ভাই, আপনিও কি একই সমস্যায় পড়েন মানুষের সাথে কথা বলতে গেলে?”

বন্ধুবান্ধবেরা সবাই ছুটিতে দেশের বাড়ি গেছে। আরো বেশ কিছুক্ষণ এই ছেলের সাথে থাকলে এই সময়টায় একলা থাকবার ব্যাপারটা এড়াতে পারা যাবে। এই মুহূর্তে কথোপকথনে নৈকট্যের ভাবটা বজায় রাখা জরুরী। রায়হানের মুখের পেশীসমূহ ফের গতিশীল হয়, “হ্যা সৌম্য, তোমাকে তো বললাম যে এই ধরণের সমস্যায় আমরা প্রত্যেকেই কমবেশী সাফার করি। আমিও অবশ্যই সাফার করি। আমি তো মানুষ, মেশিন না। তবে একটা সময় এই সমস্যায় এতটাই বিপর্যস্ত ছিলাম যে একসময় ভিতরে ভিতরে রাগ জন্মে গেছিলো। তারপরে চিন্তা করলাম যে মানুষের প্রতি অবিশ্বাসের কারণে নিজেকে সব জায়গায় গুটাইয়া রাখলে খারাপ বাদে ভালো কিছু হবেনা। তারপর থেকে যতোটা সম্ভব আসলেই যা মনে করি তাই বলার ট্রাই করি। কেউ যদি এই স্পষ্টতার সুযোগ নেয় তো দেখা যাবে। এভাবে ভেবে সেই অনুযায়ী কথা বলা শুরু করার পর থেকে মোটামুটি স্বস্তিতে থাকতে পারি।” দূরবর্তী কোন জায়গা থেকে একটি বয়োঃবৃদ্ধ কুকুরের করুণ আর্তনাদের তীক্ষ্ণ শব্দের কারণে শেষেরদিকে রায়হানকে বাচনভঙ্গীর ব্যাপারে বিশেষ সচেতন থাকতে হয়না।

“ঠিক বলছেন রায়হান ভাই। আমরা, মানে এই মধ্যবিত্তদের এতো এতো সমস্যা। কয়েকদিন আগে ফার্মগেটে একটা দৃশ্য দেখছিলাম। খুবই সামান্য একটা দৃশ্য, কিন্তু দেখে এতো খারাপ লাগছে আমার। এখনো ভুলতেই পারতেছিনা।”

“কি দৃশ্য বলোতো?” যেভাবে প্রশ্নটা করলো তাতে কি আগ্রহ একটু কম বলে মনে হলো সৌম্যর কাছে? রায়হান নিজের উপরে বিরক্ত হয়।

“খুব আহামরি কোন দৃশ্য না রায়হান ভাই। ফার্মগেটের দিকে সেই ওভারব্রিজটা আছে না?”

“কোন ওভারব্রিজ? যেটায় সন্ধ্যাবেলা কি রাতেরবেলাতে উঠলে গুয়ের গন্ধ পাওয়া আর ব্যবহৃত কনডম পড়ে থাকতে দেখাটা মাস্ট?” নিজের হিউমারে রায়হান নিজেই মুগ্ধ হয়ে গেলো। সৌম্য হো হো করে একচোট হেসে নেয়।

“হ্যা হ্যা ওইটাই। তো সেদিন আমি বিকালবেলাতে, সন্ধ্যা হয়ে আসতেছে তখন। অফিস থেকে ফিরতেছিলাম, ওভারব্রিজের নিচে মানুষজনের বেশ ভিড় ছিলো তখন। টায়ার্ড ছিলাম তো তাই ভিড় এড়াইতে ওভারব্রিজে উঠছিলাম। তো উঠে দেখি কি একটা পাগলী, পোশাকআশাক পুরাই নোংরা উবু হয়ে ছোট একটা বাচ্চা নিয়ে বসে আছে। আর মানুষজন যারাই সেখানে উঠতেছে সবাই পাগলীটার নোংরা পোশাকের দিকে একবার তাকাইলে সাথে সাথেই কেমন ঘৃণা নিয়ে তাড়াতাড়ি জায়গাটা পার হচ্ছে। আমার দৃশ্যটা দেখে খুব খারাপ লাগছিলো রায়হান ভাই। আমার মনে হয় এই সমস্যাটা খালি মধ্যবিত্তেরই আছে। গরীব কারো পোশাক নোংরা দেখলেই কেমন নাক সিঁটকায়। আপনার কি মনে হয় এই ব্যাপারে?”

“আমারও অনেকটা তোমার মতোই মনে হয় সৌম্য। মধ্যবিত্তের এতো এতো সমস্যা। এই ধরণের সমস্যা তো আরো বেশী। খেয়াল করে দেখবা যে এই সমস্যাগুলা কিন্তু সহজে চোঁখে পড়েনা। মানে দাঁড়াইলো যে মধ্যবিত্তরা নিজেদের এই প্রবণতাগুলা গোপন করতে বেশ সতর্ক থাকে। কি আর করবা বলো? এইসব নিয়েই আমাদের জীবন।” রায়হান মুখ থেকে আফসোসমাখা একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়তে গিয়ে ব্যর্থ হয়।

“রায়হান ভাই আইসক্রিম খাবেন? গলাটা শুকায়ে আসছে, চলেন আইসক্রিম খাই। বিল কিন্তু আমি পে করবো।”

আজকে সকালেই ধুমসে বৃষ্টি হয়েছে। কোনভাবেই আজকে গরম পড়েছে বলা যায়না। সারা শহর বলতে গেলে খালিই। মানুষজনের কোন ভীড়ও নেই। এই অবস্থায় গলা শুকায় কিভাবে কে জানে। যাক গে, এইসব নিয়ে অযথা এতো ভেবে কাজ কি?

হাতে চকবার নিয়ে এবারে প্রধান সড়কের বাম দিক ঘেঁষে দুইজনে হাঁটতে শুরু করে। সন্ধ্যা বলতে গেলে চলেই এসেছে। বলতে গেলে নিকট দূরত্বের জায়গাকেও স্পষ্ট দেখা যায়না। “রায়হান ভাই” সৌম্য কথা শেষ করতে পারেনা। সামনে থেকে উজবুক ধরণের দেখতে এক সাইকেলওয়ালা সৌম্যর ডান পা ঘেঁষে নিজের সাইকেল নিয়ে অতিক্রম করে গেলে সৌম্যর কালো রঙের প্যান্টটা সামান্য একটু ময়লা হয়। “রায়হান ভাই আপনার কাছে টিস্যু হবে?” সৌম্যের কন্ঠে সাইকেলওয়ালার প্রতি স্পষ্ট বিরক্তি। “হ্যা হ্যা, আমার কাছে পকেট টিস্যু আছে নাও।” এবারে সেটা নিতে নিতে সৌম্যর হাত থেকে চকবারের একটা ছোট অংশ তার প্যান্ট বরাবর পড়লো। সাইকেলের ময়লা আর চকবারের দাগটা এমন দৃশ্যমান কিছু নয়। তবু সেটা পরিষ্কার করতে সৌম্যের মিনিট দুয়েক লাগে।

“সৌম্য তুমি তখন যেন মধ্যবিত্তদের সমস্যা নিয়ে কি জিজ্ঞেস করছিলা?”

“কোনটা নিয়ে রায়হান ভাই?”

“ওই যে কি একটা দৃশ্য দেখছিলা যে ফার্মগেটে। ও হ্যা হ্যা ফার্মগেটের ওভারব্রিজটায় পাগলীটার দিকে অন্যরা যেভাবে তাকাচ্ছিলো সেটা ধরে বলতেছিলা।” রায়হানের কথা সম্পূর্ণ না হতে সৌম্যের বাক্যাবলী পুনরায় শুরু হয়ে যায় “হ্যা হ্যা রায়হান ভাই, ওই যে বলতেছিলাম যে মধ্যবিত্তদের এই এতো শুঁচিবায়ুতার বাতিক। আমার কাছে পুরাই ফালতু লাগে। যেন নিজেরা কতো পাকপবিত্র এইসব আর কি।”
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৫ রাত ১২:৫১
৪টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

রাফসান দ্য ছোট ভাই এর এক আউডি গাড়ি আপনাদের হৃদয় অশান্ত কইরা ফেলল!

লিখেছেন ব্রাত্য রাইসু, ১৫ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৫২

রাফসান দ্য ছোট ভাইয়ের প্রতি আপনাদের ঈর্ষার কোনো কারণ দেখি না।

আউডি গাড়ি কিনছে ইনফ্লুয়েন্সার হইয়া, তো তার বাবা ঋণখেলাপী কিনা এই লইয়া এখন আপনারা নিজেদের অক্ষমতারে জাস্টিফাই করতে নামছেন!

এই... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঁচতে হয় নিজের কাছে!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৫ ই মে, ২০২৪ সকাল ১১:২৮

চলুন নৈতিকতা বিষয়ক দুইটি সমস্যা তুলে ধরি। দুটিই গল্প। প্রথম গল্পটি দি প্যারবল অব দ্যা সাধু।  লিখেছেন বোয়েন ম্যাককয়। এটি প্রথম প্রকাশিত হয় হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউ জার্নালের ১৯৮৩ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর সংখ্যায়। গল্পটা সংক্ষেপে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার অন্যরকম আমি এবং কিছু মুক্তকথা

লিখেছেন জানা, ১৫ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৬



২০১৯, ডিসেম্বরের একটি লেখা যা ড্রাফটে ছিল এতদিন। নানা কারণে যা পোস্ট করা হয়নি। আজ হঠাৎ চোখে পড়ায় প্রকাশ করতে ইচ্ছে হলো। আমার এই ভিডিওটাও ঐ বছরের মাঝামাঝি সময়ের।... ...বাকিটুকু পড়ুন

নিউ ইয়র্কের পথে.... ২

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০২


Almost at half distance, on flight CX830.

পূর্বের পর্ব এখানেঃ নিউ ইয়র্কের পথে.... ১

হংকং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্লেন থেকে বোর্ডিং ব্রীজে নেমেই কানেক্টিং ফ্লাইট ধরার জন্য যাত্রীদের মাঝে নাভিশ্বাস উঠে গেল।... ...বাকিটুকু পড়ুন

সামুতে আপনার হিট কত?

লিখেছেন অপু তানভীর, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০৩



প্রথমে মনে হল বর্তমান ব্লগাদের হিটের সংখ্যা নিয়ে একটা পোস্ট করা যাক । তারপর মনে পড়ল আমাদের ব্লগের পরিসংখ্যানবিদ ব্লগার আমি তুমি আমরা এমন পোস্ট আগেই দিয়ে দিয়েছেন ।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×