যেকোনো শিল্পের বিকাশে বা বিলয়ে কালচারাল কনজুমারদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অনেক ক্ষেত্রে উন্মার্গগামী শিল্পকে সঠিক পথে আনতে একদল রুচিশীল পাঠক/শ্রোতা/দর্শক অকল্পনীয় ভূমিকা রাখেন। আবার কোন কোন ক্ষেত্রে ঠিক তার উল্টোটাও ঘটে,যেমন রুচিশীল ভোক্তার অভাবে শিল্পের নিয়ন্ত্রকরা অখাদ্যকে উচুমানের কোনকিছু হিসেবে সবার সামনে উপস্থাপন করেন আর শিল্পের প্রকৃত স্বাদ না জানা একশ্রেণির ভোক্তারা ওই অখাদ্যকেই হাপুসহুপুস করে গিলতে থাকে যার মধ্য দিয়ে একটি শিল্পের কফিনে পেরেক ঠোকা শুরু হয়।
আমি সব সময় বলি বাংলাদেশ সংগীত আর সাহিত্যে বিশ্বের যেকোনো দেশের সাথে (আই রিপিট যেকোনো দেশের সাথে) প্রতিযোগিতা করার সক্ষমতা এবং যোগ্যতা রাখে,আমি সাহিত্য বিশারদ কিংবা সংগীতজ্ঞ নই তবে গত কয়েক বছরের বাংলা সাহিত্য এবং মিউজিকের কথা যদি বলি তাহলে আমার এই বুক ফুলিয়ে দেওয়া স্টেটমেন্ট নিয়ে নিজের কাছে নিজেই লজ্জিত হই।
আশ্বিন কার্তিকে কুকুরের যেমন বাচ্চা দেওয়ার হিড়িক পরে তেমনি ফেসবুক ইউটিউব সেলেব্রিটিরাও ইদানিং বইমেলা আসলেই বই প্রকাশের জন্য উতলা হয়ে উঠেন। সেলেব্রিটি হওয়ার দায়বদ্ধতা থেকে বইমেলায় তাদের একটি নতুন বই ছাপানোকে তারা তাদের নৈতিক দায়িত্ব বলে মনে করেন। দিশেহারা এই জাতি তাদের এই বই না পড়লে দিশা খুঁজে পাবেনা বলে তাদের মনে যে 'অশ্লীল' ধারণার জন্ম হয় সেই ধারণার আগুনে ঘি ঢালতে একদল 'সস্তা' পাঠক তাদের বই কিনে ফেসবুকে ছবি দিয়ে নিজেকে 'বইপোকা' 'সাহিত্যানুরাগী' ইত্যাদি প্রমাণ করতে উঠেপড়ে লাগে আর এতে তাদের বইয়ের বিপুল কাটতি'র ফলে তারা একেকজন সাহিত্যিক বনে যান।
কেউ একজন বলেছিলেন যে, কোন জাতিগোষ্ঠী সম্পর্কে জানতে হলে তাদের লাইব্রেরিতে আর বাজারে যেও,তারা কি পড়ে আর কি খায় তা দেখেই তুমি সেই জাতিগোষ্ঠী সম্পর্কে একটা ধারণা পাবে। আমি এটাকে একটু ইম্প্রুভ করে তারা গুগলে কি সার্চ দেয়, ইউটিউবে কি দেখে এগুলোও ফলো করি। এই সুত্র অনুসরণে কেউ অগ্রগামী হয়ে বর্তমান বাংলাদেশ সম্পর্কে ধারণা নিতে গেলে তা যে আমাদের সম্পর্কে ভালো ধারণা দিবেনা তা নিশ্চিত করেই বলা যায়।
বিভিন্ন সময়ে নিজের ফেসবুকে পোস্ট দেওয়া বিভিন্ন লেখালেখি সহ হাজার বিশেক টাকা কোন প্রকাশকের হাতে ধরিয়ে দিয়ে এসব সেলেব্রিটিরা লেখক বনে যান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষকের ফেসবুক স্টেটাসে কখন বই প্রকাশ করতে হবে তার একটা উদাহরণ দিতে গিয়ে বলেছেন যে, প্রসবের ব্যাথার মতো লেখকও বই প্রকাশের জন্য ব্যাথা অনুভব করবেন, সময়ের আগে যেমন প্রসব ঘটানো যায়না তেমনি বইও সময়ের আগে প্রকাশ করা উচিত নয়, লেখক নিজেই তার বই প্রকাশের সঠিক সময় এলে ব্যাথা অনুভব করবেন, কিন্তু এখন আমরা আছি সিজারিয়ানের যুগে, ব্যাথা উঠুক না উঠুক পেট কেটে বাচ্চা বের করে দেয়। ফেসবুক সেলেব্রিটি লেখকদের হচ্ছে এই অবস্থা।
এইসব সেলেব্রিটিদের অনেক ফলোয়ার থাকার কারণে তাদের বইয়ের বিক্রি ভালই হয়, পক্ষান্তরে সত্যিকারের সাহিত্য যারা রচনা করেন তারা প্রচারের অবিদ্যমানতায় প্রসার ঘটাতে পারেন না, ফলে অনেক তরুণ কবি সাহিত্যিক এইসব ফেবু সেলেবদের নিচে (বই বিক্রির দিক দিয়ে) চাপা পড়ে যান।
রকমারি'র বই বিক্রির দিক দিয়ে টপে থাকা এক লেখকের ফেসবুকে বিরাট খ্যাতি রয়েছে দেখে উনার দুয়েকটা লেখা পড়ে দেখলাম। লুতুপুতু প্রেমের সস্তা আবেগ ভরা উনার গল্প আর কবিতা পড়ার পরে উনার বই যে মানুষ টাকা দিয়ে কিনে এটাই বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিলো।নাম বলতে চাচ্ছিনা, হয়তো আমার এই লেখা যারা পড়ছেন তাদের অনেকেই সেই লেখকের ভক্ত থাকতে পারেন, তাদের মনে কষ্ট দিয়ে তাদের বিরাগভাজন হতে চাই না।
তরুণদের মধ্যে ভালো লেখকদের কারো কারো বইয়ের বিক্রি ভালো হলেও সেখানেও কারণ সেই ফেসবুক , যেমন মারজুক রাসেলের বই নিয়ে এবার একটা ক্রেজ তৈরি হয়েছে তা উনার সেলেব্রিটি পরিচয়ের কারণেই.যারা উনার বই কিনছেন তাদের মধ্যে কতজন এই বইমেলার আগে জানতেন যে মারজুক অভিনেতা'র পাশাপাশি একজন ভালো কবিও বটে তা নিয়ে সন্দেহ আছে। নাহলে কামরুজ্জামান কামু'র বই মারজুকের মতো বিক্রি হচ্ছেনা কেনো? এসময়ের অন্যতম প্রতিভাবান কবি আখতারুজ্জামান আজাদ ভাইরাল হচ্ছেন না কেনো? কারণ ফেসবুকে তাদের অতো ফ্যান ফলোয়ার নাই৷
যা দিয়ে শুরু করেছিলাম তা দিয়েই শেষ করি,আসল কথা হচ্ছে পাঠক যা চায় এইসব সেলেব্রিটিরা তাই লেখে, আর সত্যিকারের কবি সাহিত্যিকেরা লেখেন নিজের জন্য। আর সেই লেখায় সত্যিকারের পাঠকেরা নিজেকে খুজে পায়৷ এখন সেইসব পাঠকের বড় অভাব।
বি. দ্র. উদাহরণ দিতে গিয়ে যে দুয়েকজনের নাম নিলাম তাদের নিয়ে মন্তব্য না করলেই খুশি হবো, লেখার উদ্যেশ্য তাদের প্রচার করা না, উদাহরণ দিতে গিয়ে শুধু তাদের নাম ব্যাবহার করলাম।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২০ বিকাল ৫:১৩