পৃথিবীর বৃহত্তম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ভারতের সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে বিভিন্ন মহলে। মোদী ও তার ডানপন্থী ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) প্রশাসনের বিরুদ্ধে সংবাদমাধ্যমকে ভয় দেখানো, বাকস্বাধীনতা রুদ্ধ করা এবং স্বাধীন সংবাদ সংস্থাগুলোকে সেন্সর করার অভিযোগ অনেক পুরানো।কৃষকদের বিক্ষোভের সময়, বেশ কয়েকজন সিনিয়র ভারতীয় সাংবাদিককে তাদের প্রতিবেদনের জন্য ঔপনিবেশিক যুগের রাষ্ট্রদ্রোহ আইনে অভিযুক্ত করা হয়েছিল। মোদী সরকার প্রধান হিসাবে নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে, রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা দায়েরের সংখ্যা প্রায় ৩০% বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৪ সালের বিশ্ব প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্স এর সূচকে ১৮০ টি দেশের মাঝে ভারতের অবস্থান ছিল ১৪০ তম স্থানে অথচ বর্তমান সূচকে ভারতের অবস্থান ১৬১ তম স্থানে।প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্সে এর সূচকে ভারতের অবস্থান প্রতিবেশী রাষ্ট্র পাকিস্তানের বা আফগানিস্তানের তুলনায় খারাপ।
বিরোধী মতের সংবাদ সংস্থা গুলোকে নিয়ন্ত্রনের চেষ্টায় মোদী প্রশাসন নতুন কৌশল অবলম্বন করেছে। তারা বিরোধী মতের সংবাদ সংস্থাগুলোর বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ এনেছে। তাদের অভিযোগ এই সংবাদ সংস্থাগুলো চীনের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করছে এবং উদ্দেশ প্রনোদিত চীনা ভাষ্য প্রচার করছে। অভিযোগ তুলেই ক্ষান্ত হয়নি মোদী প্রশাসন, তারা দিল্লি পুলিশের সন্ত্রাস বিরোধী ইউনিটকে সংবাদ সংস্থাগুলোর বিরুদ্ধে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে।ইতিমধ্যে দিল্লি পুলিশের সন্ত্রাস বিরোধী ইউনিট বিভিন্ন সংবাদসংস্থার অফিসে ও বিভিন্ন সাংবাদিক এর বাসায় অভিযান পরিচালনা করছে।
অভিযানে প্রথমে টার্গেট নিউজক্লিক নামের একটি স্বাধীন সংবাদ সাইট। নিউজক্লিক ২০০৯ সাল থেকে ভারতে তাদের কার্যক্রম শুরু করেছে। নিউজক্লিক প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির হিন্দু জাতীয়তাবাদী নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে। অভিযানে নিউজক্লিকের প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক, কর্মী, প্রাক্তন কর্মী, এবং ফ্রিল্যান্স লেখকদের পাশাপাশি অ-সাংবাদিক অবদানকারী যেমন অ্যাক্টিভিস্ট, ইতিহাসবিদ এবং স্ট্যান্ড-আপ কমেডিয়ান সহ মোট ৪৬ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। বিতর্কিত নাগরিকত্ব আইন ,কৃষকদের ধর্মঘট সহ সাম্প্রতিক সরকার বিরোধী আন্দোলন নিয়ে নিউজক্লিক সিরিজ প্রতিবেদন প্রকাশ করে । এই সিরিজ প্রতিবেদনের সাথে করা সংশ্লিষ্ট রয়েছে তা জানার জন্য বার বার প্রশ্ন করা হয়। অভিযানের সময় তাদের কাছ থেকে কম্পিউটার, মোবাইল ফোন ও কাগজপত্র জব্দ করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে সবাইকে ছেড়ে দিলেও নিউজক্লিকের প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক ও মানবসম্পদ প্রধানকে "সন্ত্রাস বিরোধী আইন" এর জামিন অযোগ্য মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়। নিউজক্লিকের নয়াদিল্লি অফিসটি বন্ধ করে সিলগালা করে দেওয়া হয়েছে।
নিউজক্লিকের বিরুদ্ধে অভিযযোগের সূত্রপাত হয়েছে টাইমস মেগাজিনের একটি প্রতিবেদনের উপর ভিত্তি করে। প্রতিবেদনে দাবি করা হয় মার্কিন প্রযুক্তি বিলিয়নেয়ার নেভিল রয় সিংগাম একটি গ্লোবাল নেটওয়ার্ক তৈরী করেছেন । এই নেটওয়ার্ক বিশ্বব্যাপী চীনা ভাষ্য প্রচার ও প্রকাশে ব্যবহৃত হয়। এই গ্লোবাল নেটওয়ার্ক পরিচালিনার জন্য নিজস্ব তহবিল রয়েছে ।সেই তহবিল থেকে ভারতের সংবাদ সংস্থা নিউজক্লিক অনুদান সংগ্রহ করেছে। ২০২১ সালে টাইমস মেগাজিনের প্রতিবেদনে এই তথ্য প্রকাশ পাওয়ার পর থেকে অর্থ মন্তণালয়ের এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ED), দিল্লি পুলিশের অর্থনৈতিক অপরাধ শাখা এবং আয়কর বিভাগ সহ অসংখ্য সরকারী সংস্থার নিউজক্লিকের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করে। কিন্তু এরপর দুই বছরেরও বেশি সময় পার হলেও এখন পর্যন্ত কোনো এনফোর্সমেন্ট এজেন্সি নিউজক্লিকের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগ বা আইনি অভিযোগ দায়ের করেনি।সর্বশেষ মোদী প্রশাসন সন্ত্রাস বিরোধী আইন প্রয়োগের মাধ্যমে ছোট নিউজ সাইটিকে আইনিভাবে হয়রানি ও নীরব করার ক্ষমতা অর্জন করেছে ।
এটি প্রথম ঘটনা নয় এর আগেও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিয়ন্ত্রনে মোদী প্রশাসন বিভিন্ন বিতর্কিত কৌশল অবলম্বন করেছে। যেমন আট মাস আগে বিবিসি নিউস ২০০২ সালের দাঙ্গায় মোদির সমালোচনামূলক ভূমিকা নিয়ে একটি তথ্যচিত্র প্রচার করে এতে মোদী প্রশাসন বিবিসি সংবাদ সংস্থার উপর ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে এবং ভারতীয় কর কর্তৃপক্ষকে বিবিসির নয়াদিল্লি ও মুম্বাই অফিসে অভিযান পরিচালনার নির্দেশ দেয়। শুধু বিরোধী মতের সংবাদপত্র নয় মোদী প্রশাসনের ক্রোধের শিকার হয়েছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন। যেমন ২০২০ সালে ভারতের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এতে বিজেপি সমর্থিত সরকার ক্ষিপ্ত হয়ে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এর সকল ভারতীয় অফিসে অভিযান পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেয় এবং তাদের সকল কার্যক্রম স্থগিত করে।শুধু তাই নয় তারা এই অলাভজনক প্রতিষ্ঠানের সকল ভারতীয় ব্যাংক একাউন্ট জব্দ করে।
বাংলায় একটা প্রবাদ আছে “সাপও মরবে ,লাঠিও ভাঙবে না “মোদী ও বিজেপি সরকার অনেক দিন থেকেই বিরোধী মতের সংবাদ মাধ্যম গুলোর উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছিলো। কোন কারণ ছারা নিউজক্লিকের মতো একটা সংবাদ মাধ্যম বন্ধ ঘোষণা করা বেশ জটিল বিষয় এছাড়াও নাগরিক সমাজ তখন মোদী প্রশাসনের বিরুদ্ধে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা খর্বের অভিযোগ তুলতো। টাইমস মেগাজিনের প্রতিবেদন কাজটি সহজ করে দিয়েছে । এখন সব দোষ টাইমস মেগাজিনের। এখানে উল্লেখযোগ্য কিছু বিষয়ে লক্ষ করতে হবে, টাইমস মেগাজিন প্রতিবেদন ছাপানোর দুই বছর পর এখন এমন পদক্ষেপ নেওয়ার পিছনে মূল কারণ সামনের বছর ভারতের জাতীয় নির্বাচন। নির্বাচনের আগে বিরোধী মতের সংবাদ মাধ্যম গুলোকে সতর্কতা দেওয়া । প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদকের বিরুদ্ধে "সন্ত্রাস বিরোধী আইন" এর ব্যবহার করে জামিন অযোগ্য মামলা দেওয়ার পিছনেও একটি বার্তা রয়েছে তা হলো মোদী ও বিজেপি প্রশাসনের বিরুদ্ধে সংবাদ প্রচার করলে তা রাষ্ট্রদ্রহের সামিল হবে।
ভারতে সংবাদ মাধ্যম গুলোর স্বাধীনতা ক্রমে সংকীর্ণ হয়ে আসছে। বিজেপি সরকার সংবাদপত্রের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে না এটা তাদের বিভিন্ন কার্যক্রমে ইতিমধ্যে স্পষ্ট হয়েছে। এমনকি নরেন্দ্র মোদী ক্ষমতায় আসার পর থেকে এখন পর্যন্ত কোনো সাংবাদিক সম্মেলনের আয়োজন করে নি। বেশির ভাগ টেলিভিশন সংবাদ সংস্থার মালিক বিজেপি সমর্থিত ব্যাবসায়ী গোষ্ঠী। জাতীয় পত্রিকাগুলো বেশির ভাগ বিজেপির নিয়ন্ত্রণে। এখন বাকি আছে ছোট কিছু ডিজিটাল সংবাদ মাধ্যম সেগুলো এখন সরকারের পরবর্তী টার্গেটে পরিণত হয়েছে। বাস্তবতা হচ্ছে ভারতে এখন বিনোদন আর খেলার খবর ছাড়া বাকি সব খবর সেন্সর করা হয়। বিজেপি সরকার যেভাবে সংবাদ মাধ্যম গুলোতে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করছে তাতে মনে হচ্ছে ভবিষ্যতে ভারতের মিডিয়া নীতি আর চীনের মিডিয়া নীতি এক রকম হবে।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই অক্টোবর, ২০২৩ রাত ১০:৩৫