somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্প: হাল ছেড়ো না।

১১ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ রাত ৮:২৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



আত্মবিশ্বাস বা লেগে থাকাটাই হলো মূল কথা। তুমি কোন কিছু অর্জন করতে চাও কিংবা পৌঁছাতে চাও সাফল্যের শিখড়ে, তবে কাজটির প্রতি আন্তরিক আর সৎ হও। পারবে না, হবে না, হচ্ছে না বলে, হাল ছেড়ে দিও না। একবার হাল ছেড়ে দিলে আর হালের হদিস পাওয়া যাবে না। এই দেখো, ঈশ্বরচন্দ্র বাবু যদি হাল ছেড়ে দিত তবে কি সতীদাহ প্রথা বন্ধ হতো কিংবা বিধবাদের বিবাহের আইন চালু হতো ! হতো না। আমি অবশ্য ভাল কাজে উৎসাহ দিচ্ছি। খারাপ বা নোংরা কাজের জন্য লেগে থাকা নয়, চাই পরিত্যাগ। তাহলে যদি দেশ আর সমাজে একটু শান্তি আসে।

এই যেমন, সাঁতার শিখতে বার বার জল খেতে হয়। আঁটকে যায় দম জলের তলে। তারপর না তুমি, ভাসাতে পারবে তোমার দেহ জলের উপর। তেমনি ভাবে নানা ঘাত-প্রতিঘাত, বাঁধা-বিপত্তি, ঝড়-ঝঞ্চালের সাথে অবিরাম যুদ্ধ করে সমাজের বুকে মাথা তুলে দাঁড়াতে হবে। তাহলে কেউ আর তোমাকে অবজ্ঞা-অবহেলা করবে না।

জন্মসূত্রে, বা পায়ে একটু সমস্যা হিমেলের। একটু বললে কম হবে। তার বা পা’টা হাঁটুর নিচ থেকে ভীষণ সরু এবং পায়ের পাতাটা সোজা করে ফেলতে পারে না। অর্থাৎ বাঁকা করে ফেলে হাঁটুতে হাত দিয়ে কোমড় গুজে ধীরে ধীরে হাঁটতে হয়। সমস্যা হয় না। অভ্যাস হয়ে গেছে। সহ্য হয়ে গেছে সকল উৎসুক চোখের নীরব ভাষা।

হাঁটি-হাঁটি পা-পা করতে বেশ সময় লেগেছে তার। পরিবারের সকল সদস্যের সহযোগিতা আর আন্তরিকতার কারণে নিজেকে কখনো প্রতিবন্ধী বা অসহায় মনে হয়নি। কষ্ট ছিল বুকের আড়ালে। যে সময় ছেলেরা ফুটবল-ক্রিকেট নিয়ে মাঠে দৌড়ে বেড়ায় আর নীলাকাশে রঙিন ঘুড়ি উড়িয়ে হারিয়ে যাবার স্বপ্ন বুঁনে, তখন সে ঘরে বসে মনের ক্যানভাস ড্রয়িং খাতায় ফুঁটিয়ে তুলে কিংবা খোলা বইয়ে মুখ গুজে শুয়ে থাকে। কিন্তু তার মনটা কি আদৌ ঘরে থাকতে চায় !

ছোটবেলা থেকেই লেখাপড়ায় ভাল। প্রথম দিকে বেশ কয়েক বার ক্লাসে ফাস্ট বয় ছিল। এরপর আস্তে আস্তে চিন্তার শাখা-প্রশাখাগুলো মনের জানালায় উঁকি দেবার কারণে কিছুটা পিছিয়ে পড়ে। তবে সবসময় প্রথম সারির ছাত্রই থাকত। বাবা প্রতিদিন স্কুলে পৌঁছে দিয়ে তারপর অফিস যেত। ছুটির পর মার সাথে রিকশা করে বাড়ি ফিরত। প্রতিদিন মাকে একই কথা বলা, আমি বড় হয়েছি। আমি এখন একা বাড়ি ফিরতে পারবো। তাছাড়া, এখন আমার অনেক ভাল বন্ধু হয়েছে। তারা আমাকে ক্ষ্যাপায় না। বরং, আমাকে তারা আমার মতো করে হাঁটতে সাহায্য করে। মা মুখে কাপড় দিয়ে নীরবে কাঁদে আর বলে, ও'রে আমার ছোট্ট বাবু অনেক বড় হয়ে গেছে।

মা, বেশী দিন হিমেলকে নিয়ে স্কুল থেকে বাড়ি ফেরেনি। কারণ, কিছুদিন পর মা নিজেই চলে যান, না ফেরার পৃথিবীতে। হিমেলের জন্যই বাবা আর দ্বিতীয় বিয়ে করেন নি। এরপর থেকে সে অনেকটা স্বনির্ভর হয়ে উঠে। একা একা সব জায়গায় যাওয়া-আসা। স্কুল-কলেজের কিছু সহপাঠি তাকে বেশ অনুপ্রেরণা দিয়েছিল। বাঁড়িয়ে দিয়েছিল সাহায্যের হাত। কখনো করুণার চোখে দেখেনি। হিমেল তাঁদের কাছে আজ কৃতজ্ঞ।

তাই বলে, ছোটবেলার দুষ্ট সহপাঠিদের বঞ্চনা আর কারণে-অকারণে ফেলে দেয়া কিংবা বড় হয়ে সবুজ ঘাসের বুকে অবিরাম হেঁটে না যাবার কষ্ট কিংবা ছুটে না যাবার বেদনা তাকে বহু পীড়া দিয়েছে। কিন্তু সে হাল ছেড়ে দেয়নি। সে লড়তে শিখেছে। যুদ্ধ করতে পেরেছে নিজের সাথে। নিজের সাথে যুদ্ধ করাটাই বেশী কঠিন। একা যুদ্ধ করতে হয়। কাউকে সাথে নেয়া যায় না। এ যেন, নিজেকে বারবার ভেঙে, নতুন করে গড়া।

ভাগ্য সুপ্রসন্ন। কলেজ জীবনের এক বন্ধুকে পেয়েছিল তার বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনে। মুনির। খুব সাধারণ আর চমৎকার মনের মানুষ। বলতে গেলে, বড় ভাইয়ের মতো কলেজে আগলে রেখেছিল। মুনির পাশে থাকলে হিমেলেরও যেন আত্মবিশ্বাস অনেকটা বেড়ে যায়। আর মুনিরও অন্য বন্ধুদের থেকে হিমেলকে সময় বেশী দিত। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরাট চত্বরে মুনিরকে পেয়ে হিমেলের ভাল লাগে।

বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে হিমেল বুঝলো, না পৃথিবীর মানুষের মধ্যে এখনো সংকীর্ণতা ভর করেনি। তবে প্রথম প্রথম বাঁকা বাঁকা চোখে সবাই হিমেলের বা পা’টা দেখতো। এখন আর না। সবাই বেশ বন্ধুসুলভ। সবচেয়ে বেশী ভাল লেগেছে, এখানকার শিক্ষক-শিক্ষিকার সংস্পর্শ। তাঁরা তাকে নতুনভাবে উজ্জীবিত করেছে। শিখিয়েছে জীবনের মানে। কিন্তু হিমেল নিজেই নিজেকে লুকিয়ে রাখত। একা চলতেই পছন্দ করে। একা লড়বে। একা এগিয়ে যাবে। কিছুদিন পর জড়তা কাঁটিয়ে, মুনির ছাড়া আরো বেশ কিছু বন্ধুর সাথে ঘনিষ্ঠ হয়েছিল। গড়ে তুলেছিল এক বন্ধু-সার্কেল। যারা জীবনের কঠিন থেকে কঠিনতর সময় পাশে ছিল।

যৌবনের উতলা হাওয়া তাকেও করেছিল এলোমেলো। কোথায় জানি পড়েছিলাম, যুবকরা রাস্তায় যে কোন সুন্দরী মেয়ে দেখলে, রাতে স্বপ্নে সে রমনীকে বউ বানিয়ে ফেলে। না, সে কখনো এমনটি করেনি। সাধ আর সাধ্যের গণ্ডি জানা ছিল তার। তাই কোন সুন্দরীর স্বপ্নে বিভোর হয়ে থাকার বিলাসিতা তাকে চেপে বসেনি। সে চেয়েছিল এমন একজন মানুষকে, যে তার পথের সাথী হবে। বহুদূর যেতে সাহস দিবে। পুরোটা না পারুক, অন্তত তাকে বোঝার চেষ্টা করবে। দু’জন মিলে একটি ছোট্ট নীড়ে ছোট সংসার বাঁধবে। হ্যা, অর্পিতাকে খুঁজে পেয়েছিল সে। আসলে অর্পিতাই এসেছিল, তার জীবনে আলো হয়ে। একসাথেই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা আর পরিচয়। একই বিভাগের ছাত্রী। এক বছরের জুনিয়র। কিভাবে যেন, সেমিনার থেকে সর্ম্পকের যাত্রা। সে থেকে, দু’জনার বেশ বোঝাপড়া। নেই কোন মিথ্যে ভদ্রতা ও আশ্বাস। যেখানে সর্ম্পকগুলো চোরাবালি নয়। সামান্য ভুলে অতলে হারিয়ে যাবার নয়।

উভয় পরিবারে সম্মতিতে তারা লেখাপড়া শেষে কিছু একটা করে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেয়। যথারীতি গ্যাজুয়েশন শেষ করে হিমেল একটি কর্পোরেট অফিসে এবং অর্পিতা একটি বেসরকারি ব্যাংকে জয়েন করে। এরপর শুরু হয় নতুন জীবন। একসাথে পথ চলা। নতুনভাবে তাদের নিজস্ব পৃথিবী সাজানো।

৬/৭ বছর পর। কোন এক বিকেলে।

হিমেল তার বাবাকে দেখতে পায়, নাতি-নাতনি নিয়ে বাড়ির বাগানে খেলা করছে। দৌড়-ঝাঁপ করছে। এ যেন পরিপূর্ণ সুখ। সকল প্রাপ্তির পুরষ্কার। আর কোন চাওয়া-পাওয়া নেই। শুধু ছেলে-মেয়ে দু’টো যেন সত্যিকারের মানুষ হতে পারে। এখন পৃথিবীতে আসল মানুষের সত্যি, বড় অভাব। কিছুক্ষণ পর, অর্পিতাও এসে হিমেলের পাশে বসে।



৩২/৩৩ বছর পর। আজ। কোন এক রাতে।

জীবন সায়াহ্নে এসে হিমেল দেখতে পায়, জীবনের খাতায় কোন গড়মিল নেই। নেই কোন চাহিদা বা অপূর্ণতা। বাবা-মা'র চেষ্টা ও আন্তরিকতা, সৃষ্টিকর্তার কৃপা আর নিজের উপর বিশ্বাস তাকে পিছিয়ে পড়তে দেয়নি। থেমে যাবার জন্য পৃথিবীতে আসা নয়। সে হাল ছেড়ে দেয়নি। উঠে দাঁড়িয়েছে সব বাঁধাকে অতিক্রম করে। সামনে এগিয়ে চলেছে। যতটা পারা যায়। আর, পিছনে রেখে এসেছে ধূসর অতীত।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ দুপুর ১:১৬
৫৪টি মন্তব্য ৫২টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

স্মৃতিপুড়া ঘরে

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৩০



বাড়ির সামনে লম্বা বাঁধ
তবু চোখের কান্না থামেনি
বালিশ ভেজা নীরব রাত;
ওরা বুঝতেই পারেনি-
মা গো তোমার কথা, মনে পরেছে
এই কাঠফাটা বৈশাখে।

দাবদাহে পুড়ে যাচ্ছে
মা গো এই সময়ের ঘরে
তালপাতার পাখাটাও আজ ভিন্নসুর
খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

গরমান্ত দুপুরের আলাপ

লিখেছেন কালো যাদুকর, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৫৯




মাঝে মাঝে মনে হয় ব্লগে কেন আসি? সোজা উত্তর- আড্ডা দেয়ার জন্য। এই যে ২০/২৫ জন ব্লগারদের নাম দেখা যাচ্ছে, অথচ একজন আরেক জনের সাথে সরাসরি কথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজীব নূর কোথায়?

লিখেছেন অধীতি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:২৪

আমি ব্লগে আসার পর প্রথম যাদের মন্তব্য পাই এবং যাদেরকে ব্লগে নিয়মিত দেখি তাদের মধ্যে রাজীব নূর অন্যতম। ব্যস্ততার মধ্যে ব্লগে কম আসা হয় তাই খোঁজ-খবর জানিনা। হঠাৎ দু'একদিন ধরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তে চায়।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৮



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়বে তার অনুমতি নিতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটির অনুমতি দেয়নি, যার জন্য তারা সোশ্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=তুমি সুলতান সুলেমান-আমি হুররাম=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৩৬



©কাজী ফাতেমা ছবি

মন প্রাসাদের রাজা তুমি, রাণী তোমার আমি
সোনার প্রাসাদ নাই বা গড়লে, প্রেমের প্রাসাদ দামী।

হও সুলেমান তুমি আমার , হুররাম আমি হবো
মন হেরেমে সংগোপনে, তুমি আমি রবো।

ছোট্ট প্রাসাদ দেবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×