somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ধূসর প্রতিচ্ছবি

১১ ই মে, ২০১৮ সন্ধ্যা ৭:২৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


নির্জন নিরিবিলি পিচ ঢালা পথে একাকী  চলেছে এক পথিক।মাথার উপর চাঁদ।জ্যোন্সার মায়াময়ী আলোতে করিম আলীর রিকসা টেনে নিতে খারাপ লাগছে না।সারাদিনের কর্মক্লান্তি যেন কোথায় মিলিয়ে গেল এই মুহূর্তে।রাস্তার পাশে পত্রপুষ্পহীন এক বৃক্ষ দেখে কিছুটা অবাক হলো সে।গাছটা এমন কেনো ভেবে পেল না করিম আলী।এত রাতে একা যেতে ভয়ও লাগছে না তার।ছিনতাইকারীকে ভয় পেয়ে ঘরে বসে থাকলে তার চলবে না।কষ্টে উপার্জিত অল্প কিছু টাকা যে নিতে চায় তাকে সে নির্ধিদ্বায় দিয়ে দিবে।একা যেতে যেতে কত কি ভাবনা আসে তার।দুই মেয়েকে নিয়ে ভাবে।সংসার নিয়ে ভাবে।তার জগৎ জুড়ে দুই মেয়ে বউ আর এই রিকসা ছাড়া আর কিছু নেই।এত কিছু ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘরের কাছে পৌঁছে গেল করিম আলী টের পেল না।রিকসার টুংটাং শব্দে দুই মেয়ে দৌড়ে আসাতে বুঝতে পারল।বড় মেয়ে ময়না আর ছোট মেয়ে খুকি।
বাবা,তুমি আইছো!আইজকা এত রাইত হইলো কেন?
করিম আলী কিছু না বলে ঘরে ঢুকল।
ময়না ও খুকি উত্তর না পেয়ে অগত্যা পিছু নিল।
মরিয়ম গরম ভাত, গরম গরম ডিম ভাজি আর পাঁচ ফোঁড়নের ডাল বেড়ে সানকিতে রেখে দিয়েছিল।এটা করিমের পছন্দের খাবার।যখনই সে দেরী করে ঘরে ফেরে মরিয়ম বড় যতন করে ডিম ডাল রাঁধে।

ঘরে ফেরে করিম ভাত চেয়ে বসল।বউ,"ভাত দে।"
মরিয়ম যেনো এই কথার জন্যই অপেক্ষা করে ছিল।
তড়িঘরি করে সানকিটা আর এক পেয়ালা ডাল এনে দিল করিমের সামনে।
করিম কিছুক্ষণ তাকিয়ে দেখল মৌরিকে।আজকে বড়ই সুন্দর লাগছে দেখতে।চোখে কাজল পড়েছে।কিন্তু কিছু বলল না করিম।খেটে খাওয়া মানুষের আবেগ দেখাতে নেই।সেটা থাকুক নিরবে নিভৃতে।যার জীবন চলে পেটের জন্য তার মন খোঁজার সময় কোথায় !মনের অস্তিত্ব থাকুক গহীনে।

মরিয়মকে ছোট করে মৌরি ডাকে করিম।নিঃশব্দে ভাতগুলো খেয়ে নিল সে।
আজকে সে বড় চুপচাপ থাকল।যদিও আজকে তার মেজাজ ফুরফুরে ছিল।করিমে স্বভাব উল্টা।মন মেজাজ ভালো থাকলে কারো সাথে কথা বলে না।নিজের সাথেই সময় কাটায়।আপনমনে কথা বলে।দুনিয়ার সবকিছু ভেবে কুল কিনারা করে।

আর যেদিন মন খারাপ থাকে সেদিনই বেশি পাইচারী করে।বাইরের মানুষের সাথে কথা বলে মন হালকা করে।ভিতর বাহিরের ভারসাম্য যেন উলট পালট হয়ে যায় মাঝে মাঝে।
মৌরি আর তার মেয়েরা করিমের স্বভাব বুঝে।তাই কেউ কিছু বলে না।
মৌরি নামটা করিমের মাথায় আসত না।একদিন রিকসায় এক পুরুষ যাত্রী তার বান্ধবীর সাথে ফোনে কথা বলছিল।কথায় কথায় লোকটা মৌরি নামটা বলছিল।তখনই করিমের মাথায় মৌরি নামটা আটকে গেল।সে সাথে সাথেই ভেবে নিল মরিয়মকে মৌরি ডাকবে।সেই থেকেই মরিয়মের মৌরি নামে পথ চলা।
কাক ডাকা ভোরে করিম রিকসা নিয়ে বের হয়ে গেল।এত ভোরে যাত্রী পাওয়া যায় না।শুধুমাত্র ভোর দেখার জন্যই করিম ভোরে বের হয়ে যায়।
প্রভাতের শীতল হাওয়া পাখপাখালীর কিচিরমিচির করিম বড় ভালবাসে।
জীবনের প্রতি একঘেঁয়েমি আসে না তার।একই কাজ প্রতিদিন প্রতিনিয়ত করে চলছে।কর্মক্লান্ত খেটে খাওয়া জীবন।

বিন্দু বিন্দু ঘাম করিমের কপাল জুড়ে জমা হয়েছে।গ্রীষ্মের দুপুরের তাপদাহে করিম বড় ক্লান্ত হয়ে পড়েছে।মনে মনে ভাবছে যদি এক গেলাস বরফ পানির শরবত পাইতাম।কিছুক্ষণ পর সামনে সে দেখতে পেল ফুটপাতে একজন শরবত বিক্রি করছে।মন ভরে ঠাণ্ডা পানির শরবত খেয়ে নিল করিম।আজকে কয়েকটা ট্রিপ দিয়ে করিম বড়ই ক্লান্ত।শরবতটা খেয়ে প্রানটা জুড়ালো।
দুপুরের সময় করিম বাসায় চলে আসে।একা একা খেতে তার ভালো লাগে না।ঢুলিপাড়া গলিতে টিনশেড একটা ছোট বাসায় ভাড়া থাকে।বাসা ভাড়া সংসার খরচ মেয়েদের পড়াশুনা খরচ জোগাতে করিম হাঁপিয়ে উঠে।
দুপুরে খাওয়ার সময় করিম উচ্ছ্বাস করে বলতে লাগল,
"জানিস ত বউ,আইজকে অনেকগুলা টিপ মাইরা ভালো টেহাই রোজগার করলাম।"
মৌরি কিছু না বলে শুধু একটু হাসল।
করিম মরিয়ম আর খুকি ভাত খেতে লাগল মনের আনন্দে।
ময়না আইজকে একটু দেরী কইরা আইব,মরিয়ম বলে উঠল।
-কেন,দেরী করব কেন!
-ইসকুলে নাহি কি অনুষ্ঠান আছে।
-ও।

খেয়ে দেয়ে করিম আলী রিকসা নিয়ে বেরিয়ে গেল তার স্বাভাবিক রোজগারের পথে।
ময়না কুমিল্লা ইবনে তাইমিয়া স্কুলে ক্লাশ নাইনে পড়ে।খুকি ও এই স্কুলেই কিন্ডার গার্ডেন শাখায় পড়ে।ইবনে তাইমিয়ার মতো প্রাইবেট স্কুলে পড়ানোর টাকা জোগাড় করতে করিমের হিমশিম খেতে হয়।রিকসাটা তার নিজের বলে রক্ষে।প্রতিমাসের রিকসা ভাড়ার টাকাটা গুনতে হচ্ছে না।

করিমকে ইদানীং বেশ অন্যমনস্ক দেখাচ্ছে।মরিয়ম ব্যপারটা ভাল করেই লক্ষ করছে।করিম আর পছন্দের খাবার খায় না।যা তার পছন্দ নয় তাই যেন খেতে চায়।দৈনন্দিন চলাফেরার ছন্দপতন ঘটতে লাগল।সবার থেকে কেমন  দূরে সরে যেতে লাগল যেন মায়া কাটাতে চাইছে।মরিয়মকে আর মৌরি বলেও ডাকে না।
একদিন ঘুমানোর সময় সাহস করে মরিয়ম জিজ্ঞেস করেই বসল,"তোমার কিছু হইছে?শরীল খারাপ করে নাই ত?"
মুখ গম্ভীর করে করিম বলে উঠল,"আমার কিছু হয় নাই।"এই কথা বলেই পাশ ফিরে শুয়ে পড়ল।

মরিয়ম ঠিক বুঝতে পারছিল করিম দিন দিন দূরে সরে যাচ্ছে।যে যেতে চায় তাকে সে বাধা দিবে না।

করিমের সাথেই রিকসা চালায় মনির মিয়া।মনির মাস কয়েক যাবত করিমের কাছে ঘেষার চেষ্টা করছিল।অপ্রয়োজনীয় কথাবার্তা বলে ভাব জমাল করিমের সাথে গত এক সপ্তাহ হবে।
মানুষের স্বাভাবিক জীবনের ছন্দপতন ঘটানোর জন্য দুএকটা প্রভাবকই যথেষ্ট।
করিমের ছন্দপতন ঘটল।সে এখন উচ্চবিত্ত জীবনের মোহে আচ্ছন্ন।তার মনের কুলষিত লোভী মনোভাবকে জাগিয়ে তুলল মনির।যে লোভী চেতনা এতদিন চেপে ছিল নৈতিকতার জালে।
মনির তাকে উচ্চবিত্ত জীবনের সন্ধান দিবে বলে আশ্বাস দিয়েছে।যে জীবনে নেই কোন গ্লানি,নেই কোন পরিশ্রম।
কাজটা যে দুনম্বরি সেটা করিম জানে।প্রথমদিকে মনিরকে সে প্রশ্রয় দিত না।মনিরের ফিসফিসে ফোঁসলানো কথা হয়তো তার এক সময় মনে ধরে যায়।খেটে খাওয়া জীবনের তিক্ততা থেকেই সে মোহগ্রস্থ হয়ে পড়ে।মনের ভেতর চেপে থাকা উচ্চাকাংখা যেন আজ মাথাচারা দিয়ে উঠেছে।

ভুলে গেল সব পিছুটান।প্রিয়সীর চোখের কাজল,মেয়েদের নিষ্পাপ মুখ,রাতের জ্যোন্সা আর কাক ডাকা প্রভাত।


একটা রাত ঠিকই আসল যেদিন করিম বাসায় ফেরেনি।এই রাত থেকেই শুরু হলো করিমের শেষ যাত্রা।আবার কোনদিন দেখা হলেও হতে পারে।হয়তবা নাও হতে পারে।মরিয়ম সকালেই জানত করিম আর ফিরবে না।একটা চিরকুট পেয়েছিল সে।করিম লিখে ছিলো,"বউ,আমারে খুঁজিস নে।"
মেয়েগুলাই শুধু আহাজারি করছে।দুইবোন মিলে অপেক্ষা করছে পাইচারী করছে।
কে জানে কবে আবার অবসান হবে এই অনিশ্চিত অপেক্ষার!আবার কবে শুনবে রিকসার টুংটাং শব্দ! করিম পত্রপুষ্পহীন বৃক্ষ দেখে আশ্চর্য হবে আর ভোরের শীতল হাওয়ায় প্রান জুড়াবে।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই মে, ২০১৮ সন্ধ্যা ৭:২৮
২টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

তীব্র তাপদাহ চলছে : আমরা কি মানবিক হতে পেরেছি ???

লিখেছেন স্বপ্নের শঙ্খচিল, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ২:১৯

তীব্র তাপদাহ চলছে : আমরা কি মানবিক হতে পেরেছি ???



আমরা জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকির মুখে আছি,
আমাদেরও যার যার অবস্হান থেকে করণীয় ছিল অনেক ।
বলা হয়ে থাকে গাছ না কেটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্যবহারে বংশের পরিচয় নয় ব্যক্তিক পরিচয়।

লিখেছেন এম ডি মুসা, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:১৫

১ম ধাপঃ

দৈনন্দিন জীবনে চলার পথে কত মানুষের সাথে দেখা হয়। মানুষের প্রকৃত বৈশিষ্ট্য আসলেই লুকিয়ে রাখে। এভাবেই চলাফেরা করে। মানুষের আভিজাত্য বৈশিষ্ট্য তার বৈশিষ্ট্য। সময়ের সাথে সাথে কেউ কেউ সম্পূর্ণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

মহিলা আম্পায়ার, কিছু খেলোয়ারদের নারী বিদ্বেষী মনোভাব লুকানো যায় নি

লিখেছেন হাসান কালবৈশাখী, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯



গত বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল প্রাইম ব্যাংক ও মোহামেডানের ম্যাচে আম্পায়ার হিসেবে ছিলেন সাথিরা জাকির জেসি। অভিযোগ উঠেছে, লিগে দুইয়ে থাকা মোহামেডান ও পাঁচে থাকা প্রাইমের মধ্যকার ম্যাচে নারী আম্পায়ার... ...বাকিটুকু পড়ুন

জানা আপুর আপডেট

লিখেছেন আরাফআহনাফ, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৫৭

জানা আপুর কোন আপডেট পাচ্ছি না অনেকদিন!
কেমন আছেন তিনি - জানলে কেউ কী জানবেন -প্লিজ?
প্রিয় আপুর জন্য অজস্র শুভ কামনা।



বি:দ্র:
নেটে খুঁজে পেলাম এই লিন্ক টা - সবার প্রোফাইল... ...বাকিটুকু পড়ুন

বন্ধুর বউ কে শাড়ি উপহার দিলেন ব্যারিস্টার সুমন। বাটার প্লাই এফেক্ট এর সুন্দর উদাহারন।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:০৭



এক দেশে ছিলো এক ছেলে। তিনি ছিলেন ব্যারিস্টার। তার নাম ব্যারিস্টার সুমন। তিনি একজন সম্মানিত আইনসভার সদস্য। তিনি সরকার কতৃক কিছু শাড়ি পায়, তার জনগণের মাঝে বিলি করার জন্য।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×