নির্যাতন-০১
কাজী সায়েমুজ্জামান : আসলে রিমান্ড বলতে কোন বিষয় নেই। আইনী ভাষায় এর নাম হচ্ছে পুলিশ হেফাজত। তবে পুলিশের আচরণের কারণেই এটি হেফাজত না হয়ে রিমান্ড নামে পরিচিতি পেয়েছে। রিমান্ড শুনলেই আতকে ওঠেন সবাই। রিমান্ডে নিয়ে আসামীকে কিভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় এ নিয়ে সবার মাঝেই কৌতুহল। এর আগে রিমান্ড থাকা অবস্থায় জুতার ফিতা গলায় পেচিয়ে আত্মহত্যার ঘটনাও সবার জানা। সচারচর রাজধানীর বিভিন্ন থানার বাইরে দেখা যায় আসামী রিমান্ডে থানার লকআপে। অথচ তার স্বজন থানার বাইরে বিনিদ্র রজনী কাটিয়ে দেন। সবার চোখে মুখে আতংক। এ নিয়েই সাপ্তাহিক বুধবারের জন্য আমি একটি প্রতিবেদন লিখেছি যা এ সপ্তাহে ছাপা হয়েছে। কয়েকটি কিস্তিতে এ রিপোর্টটি ব্লগে দেয়ার জন্যই আমার এ প্রয়াস।
কাউকে নির্যাতনের অধিকার কারো নেই
পৃথিবীর কোন দেশের আইনেই কোন ব্যক্তিকে নির্যাতন করার অধিকার দেয়া হয়নি। জাতিসংঘ ঘোষিত মানবাধিকার সার্বজনীন ঘোষণাপত্রের ব্যক্তির আইনগত অধিকার সংক্রান্ত ৫ নং ধারায় বলা হয়েছে- কেউকে নির্যাতন অথবা নিষ্ঠুর, অমানসিক অথবা অবমাননাকর আচরণ অথবা শাস্তি ভাগে বাধ্য করা যাবেনা। ধারা-০৯ এ বলা হয়েছে- কাউকে খেয়ালখুশী মতো গ্রেফতার, আটক অথবা নির্বাসনে দেয়া যাবেনা। ধারা-১১ এ বলা হয়েছে- দন্ডযোগ্য অপরাধ সংঘটনকালে যতটুকু শাস্তি প্রযোজ্য ছিল, তার চেয়ে অধিক শাস্তি প্রয়োগ করা যাবেনা।
কিন্তু আমাদের দেশে নির্যাতন চলছেই। পরিবার থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রের নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন নাগরিকরা। আমাদের বিচার ব্যবস্থার একটি বড় অংগ হলো গ্রেফতারের পর তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনার আগে পুলিশ হেফাজতে দেয়া হয়। তাকে দিয়ে অপরাধ স্বীকার করানো হয়। এরপর তার বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আনা হয়। কিন্তু পুলিশ হেফাজতের আসল রুপ আমাদের বিচার ব্যবস্থার জন্য সুখকর নয়।
অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে রিমান্ড মানেই নির্যাতন। এসময় রিমান্ডে যাওয়া ব্যক্তিরা শারিরিক, মানসিক ও আর্থিক নির্যাতনের শিকার হন। তিন কারণে আসামীরা রিমান্ডে নির্যাতনের শিকার হন। প্রথমত: রাজনৈতিক কারণে কোন অপরাধ ছাড়াই তাদের নির্যাতিত হতে হয়। দ্বিতীয়ত: অর্থ আদায়ের জন্য নির্যাতন করা হয়। আসামীকে একটু স্বচ্ছল মনে হলেই তাদের কাছ থেকে অর্থ আদায়ের জন্য চাপ দিতে নির্যাতন করা হয়। তৃতীয়ত: তথ্য আদায়ের জন্য তাদের ওপর অত্যাচার চলে। অস্ত্র উদ্ধার অথবা অপরাধের সঙ্গী গডফাদারদের নাম জানতে এ পন্থা নেন তদন্তকারী কর্মকর্তারা।
আইনে যা রয়েছে
আইন অনুযায়ী গ্রেফতারের পর কোন ব্যক্তিকে পুলিশ হেফাজতে দেয়া হয়। গ্রেফতারের পর পুলিশ কোন ব্যক্তিকে সর্বোচ্চ ২৪ ঘন্টা থানায় রাখতে পারেন। তারপর তাকে ম্যাজিষ্ট্রেটের সামনে হাজির করতে হয়। এটি ফৌজদারী কার্যবিধির ৬১ ধারায় রয়েছে। যখনই কোন ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে হেফাজতে আটকে রাখা হয় এবং দেখা যায় যে, ৬১ ধারায় নির্ধারিত ২৪ ঘন্টা সময়ের মধ্যে তদন্ত সমাপ্ত করা যাবেনা, সেক্ষেত্রে ফৌজদারী কার্যবিধির ১৬৭ ধারার বিধান মোতাবেক ম্যাজিষ্ট্রেট তার বিবেচনা মতো তাকে হেফাজতে দিতে পারেন। এ আটক সবোর্চ্চ ১৫ দিন হতে পারে।
তবে ১৫ দিন এটা আইনী কেতাবেই রয়েছে। বিভিন্নভাবে ১৫ দিনকে বাড়ানোর কৌশল পুলিশ জানে। রাজনৈতিক কারণে আসামীকে আরও কিছু দিন রিমান্ডে রাখতে হলে তখন অন্য পন্থা নেয়া হয়। তাকে বিভিন্ন মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে আলাদা আলাদা মামলায় রিমান্ড নেয়া হয়। ফলে একই ব্যক্তির মাসের পর মাস রিমান্ডে থাকারও নজীর রয়েছে। পুলিশ হেফাজত সংক্রন্ত বিভিন্ন আদালতের সিদ্ধান্তগুলো পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, কোন ব্যক্তির বিরুদ্ধে থানায় কোন মামলা নথিভুক্ত না করে থানায় আটকে রাখা বা তার গ্রেফতার নিয়ে থানায় কোন এন্ট্রি লেখা না হলে তা হবে বেআইনী। আর বেআইনি রিমান্ড আদেশের সংজ্ঞাও দেয়া হয়েছে। তা হলো- এমন বিধানের অধীন আটকাদেশ দেয়া হয় যা মামলার ঘটনার সাথে প্রযোজ্য নয় সেক্ষেত্রে উক্ত আটকাদেশকে অসৎ বিশ্বাসে করা হয়েছে বলে বলে গন্য করা যায় এবং তা বেআইনী। তবে এমন কিছু আইন রয়েছে যার মামলায় নিম্ন আদালতে জামিন দেয়া যায়না। তাকে পুলিশের আবেদন অনুযায়ী রিমান্ডে দিতে হয়। এর মধ্যে রয়েছে মাদক ও ছিনতাই মামলা। অনেক নিরাপরাধকেও পুলিশ তাই এ দুটো মামলায় আটক দেখায় যাতে রিমান্ডে নিতে কোন সমস্যা না হয়।
পুলিশি রিমান্ডে বিভিন্ন থেরাপি
অপরাধ সনাক্তকরণে স্বীকারোক্তি আদায়ে পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদের নাম রিমান্ড। কিন্তু রিমান্ডে নিয়ে পুলিশ কি করে ? কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে এসব কৌশলের বর্ণনা দিয়েছেন। তারা বলেছেন, ছিনতাই শেষে ধরা পড়া আসামীও পুলিশের কাছে নিজেকে নির্দোষ বলে দাবী করে। এ কারনেই কিছু থেরাপি দিতে হয়। ছিনতাই, চুরি, মলম পার্টি, পকেটমার, দাঙ্গা ও মারামারির মামলায় গ্রেফতারের ২৪ ঘন্টা পুলিমী হেফাজতে রাখার সময়েই প্রথম থেরাপি দেয়া হয়। এ থেরাপীর নাম হচ্ছে লাঠি থেরাপি। দুই পায়ের পাতায় এ থেরাপি প্রয়োগ করা হয়। আদালতকে তদন্তকারী কর্মকর্তা বলেন, এরা জনতার রুদ্ররোষের শিকার হয়েছিল। এ থেরাপি দেয়ার সময়ই তদন্তকারী কর্মকর্তা বলে দেন ঘটনা স্বীকার না করলে রিমান্ডে নিয়ে এর চেয়ে কঠিন থেরাপি দেয়া হবে। ফলে এ লাঠি থেরাপিতেই কাজ হয়ে যায়। লাঠি থেরাপির পরের ধাপ জয়েন্টথেরাপি। লাঠি থেরাপির পর কাজ না হলে রিমান্ডে নিয়ে এ ধরনের আসামীকে জয়েন্ট থেরাপি দেয়া হয়। এসময় দুই হাতের কনুই, পায়ের গোড়ালি, হাটুতে লাঠি দিয়ে আঘাত করা হয। এসময় পাশের রুমে অন্য আসামীকে রাখা হয়। তাদের জয়েন্ট থেরাপিপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের চিৎকার শুনেই কাজ হয়ে যায়। এটা সাইকোলজিকাল থেরাপি।
এর চেয়ে কঠিন মামলা হলে চলে পানি থেরাপি। ডাকাতি, ধর্ষন, অপহরণ, খুন, চাদাবাজিসহ এ মাত্রার অন্যান্য মামলার আসামীদের পানি থেরাপি দেয়া হয়। এদের টুল অথবা চেয়ারে বসিয়ে বিরতিহীনভাবে মুখে পানি ঢালা হয়। শীতের সময় ঠান্ডা পানি ব্যবহার করা হলেও কখনো গরম পানি ব্যবহার করা হয়না। এ থেরাপিতে কাজ না হলে দেয়া হয় ব্যাটারিচালিত শক থেরাপি। দুই হাত ও দুই পায়ের বুড়ো আঙ্গুলে তার বেধে প্রতি মিনিটে চার থেকে পাঁচ সেকেন্ড করে বৈদ্যুতিক শক দেয়া হয়। পরবর্তী থেরাপির নাম বরফ থেরাপি। এক কেজি ওজনের দুই টুকরো ররফ দুই হাতের তালুতে দেওয়া হয়। জঙ্গীদের জন্য ব্যবহার করা হয় ইলেকট্রিক লাইটিং চেয়ার থেরাপি। একটি করে মধ্যে চেয়ারে বসিয়ে হাত পা বাঁধা হয়। মুখ উর্দ্ধমুখী করে রাখা হয়। এসময় করে চারদিকে বিভিন্ন রংয়ের বাতি জ্বালিয়ে দেয়া হয়। নানা রঙ্গের এ আলো চোখে হিট করলে আসামী আর সহ্য করতে পারেনা। তার মাথার কোন সেন্স তখন কাজ করেনা। কোন কিছু লুকিয়ে সাজিয়ে গুছিয়ে মিথা বলার মতা সে হারিয়ে ফেলে।
ভিআইপিদের ক্ষেত্রে এসব থেরাপি দেয়া হয়না। তাদের দেয়া থেরাপির নাম নির্ঘুম থেরাপি। একজন পর একজন কর্মকর্তা রাতে ভিআইপির কাছে যেতে থাকেন। তারা তাকে না ঘুমাতে দেয়ার কৌশল নেন। এসময় গল্পের নামে রাত পার করে দেয়া হয়। আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিল তাকে নির্যাতনের এ কৌশল নেয়া হয়েছিল বলে আমাকে জানিয়েছেন। কর্মকর্তারা বলছেন, থেরাপি হচ্ছে মামলা নিষ্পত্তির একটি কৌশল। রহস্য উদঘাটন ও জড়িতদের চিহ্নিত করে করেত এসব থেরাপির দরকার। এ ছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি বিচার পাবেনা।
আসলেই কি তাই। আমার মনে হয় পুলিশের এসব ব্যাখ্যা নির্যাতনের বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার অপযুক্তি ছাড়া আর কিছু নয়। কারণ তদন্ত কাজে অলসতা করে খুব সহজেই তথ্য পেতেই নির্যাতন করা হয়। এতে অসুবিধার দিক হলো অনেক নিরাপরাধ এর শিকার হন।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা সুলতানা কামাল এ প্রতিবেদককে বলেন, রিমান্ড একটি ভদ্র ব্যবস্থা হওয়ার কথা। যেখানে ম্যাজিষ্ট্রেটের সামনে হেফাজতে নেয়া ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। অথচ এখন রিমান্ড আর নির্যাতনকে সমর্থক করে ফেলা হয়েছে। রিমান্ড শুনলেই মনে করি নির্যাতন। আমরা গণমাধ্যমে দেখি একজন সুস্থ ব্যক্তি হেটে পুলিশের হেফাজতে যান। অথচ রিমান্ড শেষ হলে একই ব্যক্তি আর হাটতে পারেননা। এ বিষয়ে আদালতের নির্দেশনাও রয়েছে। পুলিশের জন্য নির্দেশনাও রয়েছে। বলা হয়েছে, কিভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে। তিনিবলেন, ব্যাপক তথ্য অনুসন্ধানের পর জিজ্ঞাসাবাদ করলে নির্যাতনের দরকার হয়না। তথ্য থাকলে আসামী স্বীকারোক্তি দিতে বাধ্য হবে।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


