এক
২০২৩ সালের ৯ জুলাই তারিখের ঘটনা। রাশিয়ার ক্রেমলিনের প্রাসাদে এক অভূতপূর্ব ঘটনার অবতারণা হয়। আট বছরের এক কিশোরি ক্রেমলিনে পুতিনের সাথে দেখা করে। ওই রুশ কিশোরির নাম রাসিয়াত আকিপোভা। সে জন্মান্ধ। কিছুদিন আগে রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের সাথে দেখা করার জন্য তার কান্না ভাইরাল হয়। রুশ প্রেসিডেন্ট তাকে ক্রেমলিনে ডেকে পাঠান। মস্কোর ক্রেমলিনের আলিশান প্রাসাদে হাজির হয় আকিপোভা। রুশ প্রেসিডেন্ট তাকে একরাশ ফুল দিয়ে স্বাগত জানান। হাটু গেড়ে বসে কিশোরিকে কোলে তুলে নেন। সবচেয়ে অবাক করার বিষয়টা হলো তাকে নিজের চেয়ারে বসতে দেন। বর্তমান বিশ্বের অন্যতম ক্ষমতাবানের চেয়ারে বসে পড়ে এক অন্ধ কিশোরী।
দুই
এবারের ঘটনা ভারতের। ভারতের বিহার রাজ্যের গেহলৌর গ্রামের দশরথ মাঝি নামের একজনের গল্প বলবো। এর আগেও তাকে নিয়ে লিখেছিলাম। তিনি একজন গরিব শ্রমিক ছিলেন। তার স্ত্রী ফাল্গুনী তার জন্য মাঠে দুপুরের খাবার নিয়ে যাওয়ার সময় গেহলৌর পাহাড় থেকে পিছলে যান ও গুরুতর আহত হন। তাকে হাসপাতালে নেয়ার প্রয়োজন হয়। তবে পাশের হাসপাতালে নিতে হলেও বাড়িরে পাশের পাহাড় ঘুরে আসতেই ৫৫ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হবে। তারপর ওয়াজিগঞ্জ ব্লকে হাসপাতাল। বিলম্বের কারণে দশরথের স্ত্রীর মৃত্যু হয়।
এই ঘটনায় মাঝি ওই রাতে গেহলৌর পাহাড়ের মধ্য দিয়ে পথ তৈরি করার সিদ্ধান্ত নেন, যাতে তার গ্রামের অন্যদের সহজেই চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে নিতে পারেন। যেই ভাবা সেই কাজ। একটি লোহার ছেনি ও একটি হাতুড়ি নিয়ে নেমে পড়েন দশরথ মাঝি। এলাকার লোকজন তাকে নিয়ে উপহাস করতে শুরু করেন। বলতে থাকেন স্ত্রী হারিয়ে তিনি পাগল হয়ে গেছেন। এতেও দমে যাননি মাঝি। একটানা ২২ বছর কাজ করে তিনি গেহলৌর পাথুরে পাহাড়ের মধ্য দিয়ে ১১০ মিটার লম্বা, ৭.৭ মিটার গভীর এবং ৯.১ মিটার প্রশস্ত পথ তৈরি করেন। মাঝির বানানো সড়কের ফলে আতরি ও ওয়াজিগঞ্জ ব্লকের (আমাদের দেশের উপজেলা) দূরত্ব ৫৫ কিমি থেকে কমে মাত্র ১৫ কিলোমিটারে পরিণত হয়।
এ ঘটনা যখন সবার গোচরে আসে, ভারতে তাকে নিয়ে হুরস্থুল শুরু হয়। তিনি 'মাউন্টেন ম্যান' নামে পরিচিতি পান। সরকার তাকে এক খন্ড জমি উপহার দেয়। তিনি ওই জমি হাসপাতাল নির্মাণের জন্য দান করেন। ২০০৭ সালের আগস্টে মারা যান দশরথ মাঝি। এর আগে জুলাই মাসে তিনি বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতিশ কুমারের সাথে দেখা করতে জনতা দরবারে যান। নীতিশ কুমার তাকে দেখে দাড়িয়ে যান। এগিয়ে এসে তাকে নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারে বসান।
তিন
মাঝে মাঝেই সংবাদে দেখা যায়, এক দিনের জন্য অথবা এক ঘন্টার জন্য উপজেলা চেয়ারম্যান হলেন একজন স্কুল ছাত্রী। কয়েকটা উদাহরণ দেই। ২০২০ সালে ২৭ অক্টোবর পঞ্চগর উপজেলা পরিষদে ১ ঘন্টার জন্য প্রতীকী উপজেলা চেয়ারম্যান হয় হাসনে হেনা মন নামের এক স্কুল ছাত্রী। ১২ অক্টোবর ২০২২ তারিখে জামালপুর সদর উপজেলায় সৃষ্টি রানী দে নামের এক স্কুল শিক্ষার্থী এক ঘন্টার জন্য প্রতীকী উপজেলা চেয়ারম্যান হয়। একই দিন শ্যামনগরে এক ঘন্টার জন্য মহিলা ভাইস চেয়ারম্যানের চেয়ারে বসে দশন শ্রেণীর ছাত্রী হিরা। এভাবে অসংখ্য উদাহরণ দেয়া যায়। আমার কাছে এ কাজগুলো প্রশংসনীয়। আমার কাছে এর চেয়ে বড় সৌন্দর্য আর নেই। তবে প্রশ্ন উঠেবে এই যে নির্বাচিত রাজনৈতিক ব্যক্তিরা তাদের চেয়ার ছেড়ে আরেকজনকে বসতে দিচ্ছেন এটা কোন দৃষ্টিতে প্রশংসনীয়! কেন, সেটা বলছি।
অন্যদিকে এক ঘন্টার জন্য ইউএনও হলেন অমুক শিক্ষার্থী- এধরণের সংবাদও দেখা যায়। দায়িত্ব হস্তান্তরও করা হয়ে থাকে৷ আবার অনেক সরকারি কর্মকর্তা নিজের দাপ্তরিক চেয়ারে বাবা, মা বা স্বজনদের বসিয়ে ফেসবুকে ছবি দেন-এটাও দেখা যায়। আমি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে এটুআইর ন্যাশনাল কনসালটেন্ট থাকাকালীন সরকারি কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দিতাম। এর মধ্যে একটি বিষয় অফিসার সুলভ সামাজিক মাধ্যমের ব্যবহার। আমি ক্লাসে কর্মকর্তাদের দেখানোর জন্য এসব ছবি সংগ্রহ করেছিলাম। আমার কাছে প্রচুর ছবি রয়েছে। ছবির বিষয়ে আর কী বলবো- সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অফিসারেরা বেডরুমের ছবি দিতেও কার্পণ্যবোধ করেন নি। রাস্তা থেকে একজনকে তুলে এনে নিজের চেয়ারে বসিয়ে ছবি তুলে ফেসবুকে দেয়ার ছবিও রয়েছে। এই সরকারি কর্মকর্তারা সবাই জনতুষ্টিবাদে আক্রান্ত। এসব ছবিতে হাজার হাজার লাইক বা কমেন্টের বন্যা বয়ে যায়। লোকজনের বাহাবা পাওয়া যায়৷ এতে আরেকজন কর্মকর্তাও উৎসাহিত হন। আর আমার কাছে একজন সরকারি কর্মচারির এ ধরণের আচরণ বালখিল্য ছাড়া কিছুই নয়। কেন সেটাও বলছি!
চার
আমি লোক প্রশাসনের শিক্ষার্থী। ম্যাক্স ওয়েবার লিডারশিপ বা নেতৃত্বের ধারণায় কর্তৃত্ব বা অথরিটি বলে একটি বিষয়ের অবতারণা করেছেন। এই কর্তৃত্ব তিন প্রকারের। প্রথমটি ট্রাডিশনাল অথরিটি। রাজার পুত্র রাজা হবেন। তিনি উত্তারাধিকার সূত্রে যে কর্তৃত্ব লাভ করেন সেটাই ট্রাডিশনাল অথরিটি। সেই অথরিটি বলে তিনি রাজ্য পরিচালনা বা ক্ষমতার প্রয়োগ করেন। এরা যা খুশী করেন৷ তাদের ইচ্ছাটাই আইন৷
দ্বিতীয় প্রকারের অথরিটি হলো- ক্যারিশমাটিক অথরিটি। এটা উত্তারাধিকার সূত্রে নয়। নিজের নেতৃত্বগুণে এই কর্তৃত্ব অর্জন করতে হয়। যেমন আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বা আমেরিকার আব্রাহাম লিঙ্কন এ ধরণের কর্তৃত্বের অধিকারী। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এ ধরণের কর্তৃত্ব অর্জন করে থাকেন। এ ধরণের কর্তৃত্ব অর্জনের মূল ভিত্তি হলো জনগণ। জনসন্তুষ্টি আসল বিষয়। জনগণ যাতে সন্তুষ্ট থাকেন সেই কাজ করা দরকার। এ কারণে একজন জনপ্রতিনিধি সরকারি গাড়িতে ড্রাইভারের পাশের সীটে বসতে পারেন।জনগণকে নিজের চেয়ারে বসাতে পারেন৷ এত জনগণের ক্ষমতায়ন হয়৷
তৃতীয় ধরণের কর্তৃত্ব হলো- লিগ্যাল রেশনাল অথরিটি বা আইনগত যৌক্তিক কর্তৃত্ব। সরকারি কর্মচারিরা এই কর্তৃত্ব পেয়ে থাকেন। ম্যাক্স ওয়েবার বলেছেন, ''যৌক্তিক আইনী কর্তৃত্ব হলো-আইনত প্রতিষ্ঠিত নৈর্ব্যক্তিক আদেশের প্রতি আনুগত্য ও দায়বদ্ধতা।'' এই কর্তৃত্ব ফরমাল বা আনুষ্ঠানিক। তার পদ পদবীর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ যৌক্তিক আচরণ। এটি আবেগ বর্জিত। এখানে আবেগ দিয়ে কর্তৃত্ব নয়, বরং সরকারি লিখিত বিধি বিধান দিয়ে আচরণ সীমাবদ্ধ।
আমি প্রশিক্ষণে বলতাম, ইউএনওর চেয়ারে তার ঊর্ধ্বতনরা বসতে পারেন। এর বাইরে অন্য কাউকে চেয়ার ছেড়ে দেয়ার কোন সুযোগ নেই। এছাড়া সম্মানিত ব্যক্তিদের বসার জন্য প্রয়োজনে ইউএনওর চেয়ে বড় একটি চেয়ারের ব্যবস্থা রাখার পরামর্শ দিতাম। তাকে সেই চেয়ার দিলে তিনি সম্মানিত বোধ করবেন নিশ্চয়ই। একজন সরকারি কর্মকর্তার অন্য কোন কারণ না থাকলে ড্রাইভারের পাশের সিটে বসার কোন সুযোগ নেই। এক ঘন্টা এক দিনের জন্য কাউকে প্রতীকী দায়িত্ব হস্তান্তরও যৌক্তিক আচরণ নয়৷ যেসব এনজিও জনতুষ্টিবাদের আঙ্গিকে এ ধরণের ধারণার ভিত্তিতে প্রকল্প নিয়ে মাঠে নেমেছেন- তারাও বিষয়টি ভেবে দেখবেন৷ তারা জেনে না জেনে জনপ্রশাসনের ক্ষতি করছেন।
সবশেষ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগে আমাদের একজন প্রফেসর ছিলেন৷ অধ্যাপক লুৎফুল হক চৌধুরী স্যার৷ তিনি দশটা বাক্য বললে পাঁচবার রেশনাল শব্দটা বলতেন৷ তিনি লেকচার দিলে আমরা খাতা কলম নিয়ে বসে যেতাম৷ কতবার রেশনাল শব্দটা বলেছেন সেটা ক্লাস শেষে হিসাব মিলাতাম৷ একারণে পেছনে তাকে রেশনাল স্যার ডাকতাম৷ স্যার নিজেও শিক্ষার্থীদের দেয়া নামটা জানতেন৷ তারপরেও রেশনাল শব্দটা গুরুত্ব সহকারে বলতেন৷ তখন এই শব্দটির মাহাত্ম্য বুঝিনি৷ এখন কর্মজীবনে টের পাচ্ছি৷ কেন রেশনাল হওয়া দরকার৷
লেখাটা বড় করতে চাইনা। এ বিষয়ে আরো একদিন লিখবো৷ আবারও বলছি, লিগ্যাল রেশনাল অথরিটির ভিত্তিতে একজন সরকারি কর্মচারি আচরণ নির্ধারিত হয়৷ নিজের চেয়ার ছেড়ে দিয়ে জনতুষ্টিবাদের মহামারিতে আক্রান্ত হওয়ার কোন সুযোগ নেই৷
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা জুন, ২০২৪ সকাল ১০:১৭