somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

নোভা

২৭ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ বিকাল ৩:১৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

(১)
ব্যাপারটা এতদিনে নোভা ভুলে গেছে !
ভুলে তো যাবেই । এসব ব্যাপার মনে রাখলে কি চলে ? হয়ত চলে । ঠেলাগাড়ির মত ঠক্কর ঠক্কর করে কোনমতে চলে যায় । কিন্তু জীবনের কংক্রিটময় রাস্তায় তুফান গতিতে কেবল সামনে এগিয়ে যেতে চাইলে এসব ভুলে যাওয়া একান্ত আবশ্যক ।
যাইহোক । এবার ব্যাপারটা কী, তাই জেনে নেয়া যাক ।
নোভাকে কিছু জিজ্ঞেস করে লাভ নেই । নোভা সব ভুলে গেছে ।
তয়লে কার কাছ থেকে জানব ? ছেলেটার কাছ থেকে ? কিন্তু ছেলেটাকে পাব কোথায় ? সেদিনের পর থেকে তো ওর হদিস কেউ জানে না ! এমনকি নোভাও না ।
কিন্তু সময়... হ্যাঁ, সময় মনে রেখেছে ।
সময় তো থমকে দাঁড়ায় না, শুধু সামনে এগিয়ে যায় । তবুও সময় মনে রাখে । মানুষ ভুলে যায় । সময়কে পিছনে ফেলে সামনে এগিয়ে যাওয়ার দুর্বার মোহে ভুলে যায় । উন্নতির চূড়ান্ত চূড়ায় উঠবার নেশায় ভুলে যায় ।
তয়লে চলুন, সেই সময়টার দিকেই ফিরে তাকানো যাক ।

(২)
সকালের শান্ত রোদ দুপুরে এসে যখন তেজ ছড়াতে থাকল কলেজমাঠে । তখন নীল রঙের ফিজিক্স বইটা খুলে ওরা সবাই স্যারের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করল । কিন্তু আমজাদ স্যার আজ তাপবিদ্যা চ্যাপ্টার শুরু করার বদলে উত্তপ্ত  গলায় তীব্র ধমক শুরু করল— ‘এই মেয়ে, এদিকে আসো... দ্রুত উঠো... দাঁড়াও, এখানে দাঁড়াও, সোজা হয়ে দাঁড়াও...’
নোভা থর থর করে কাঁপতে কাঁপতে এগিয়ে যায় । দাঁত মুখ খিঁচে পাথরমূর্তির মত অনড় হয়ে দাঁড়ায় ।
বাকি সবাই অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে । কেউ কিছু বুঝে উঠতে পারছে না !
‘খুব বড় বড় পাখনা গজিয়ে গ্যাছে, না ! তোর মত ইতর ক্যারেক্টারলেস্‌ ফালতু মেয়ের আমার ক্লাসে কোনো জায়গা নেই ! বের হ, এক্ষুনি ব্যাগ নিয়ে আমার ক্লাস থেকে বের হয়ে যা !’
অপমানের তীব্র নীলদংশনে নোভা লাল হয়ে উঠে ! লাল হতে হতে লজ্জায় যেন মাটির সঙ্গে মিশে যেতে চাইছে ওর সমগ্র অস্তিত্ব ! ঘামতে শুরু করে নোভা ! প্রতিবাদ তো দূরের কথা, এ-আদেশ একবিন্দু লঙ্ঘন করার মত সাহস তার ভয়ার্ত কম্পিত বুকে জাগে না । বেঞ্চ থেকে ব্যাগটা কাঁধে তুলে সোজা বেরুনোর দরজার দিকে হাঁটা ধরে । ক্লাসরুমের বাইরে এক পা না ফেলতেই একটা তীব্র শব্দ— তীব্র আঘাতের শব্দ !
নোভা পিছন ফিরে তাকায় । আমজাদ স্যারের নাক থেকে টপটপ রক্ত ঝরছে ! স্টিলের স্কেল-রুলারের আঘাতে কেটে গেছে ! কিন্তু কে ? আঘাতটা করল কে ?
কে আবার ? সে ! কেউ কিছু বুঝে না উঠলেও সে সব বুঝে ফেলেছে । এটা ঈর্ষা ! তার ভালোবাসার প্রতি ঈর্ষা ! ঈর্ষার আগুনে পুড়তে থাকা আমজাদ স্যারের ভিতরের ভয়ানক জন্তুটাকে সে দেখতে পাচ্ছে । তার সামনে জন্তুটা তার ভালোবাসাকে চিরে চিরে খাবে— আর সে কাপুরুষের মত নীরবে চেয়ে চেয়ে দেখবে, তা হয় নাকি !  সে সহ্য করতে পারে নি । হাতের কাছে যা ছিল তাই ছুঁড়ে মেরেছে । নাক কেটে গিয়েছে ! বেশ হয়েছে ! সে শোধ তুলেছে । নোভার উপর করা সমস্ত অপমানের শোধ মুহূর্তেই সে তুলে ফেলেছে । মাত্র কয়েক সেকেন্ডেই ।
কিন্তু... কিন্তু বিনিময়ে কী পেল সে ?
কিছুই না । পড়াশোনাটা তো গেলই, সাথে সাথে যে মানুষটার জন্য— গুরুজনের নাক থেকে রক্ত ছুটিয়েছে— সেই মানুষটা— তার ভালোবাসার মানুষটা— শেষ পর্যন্ত তাকে নাকি অস্বীকার করল ! ছুঁড়ে ফেলে দিল ! হ্যাঁ, একাডেমির ডিসিপ্লিন বডির মতন নোভাও তাকে ছুঁড়ে ফেলে দিল !
অভদ্র! বেয়াদপ! জানোয়ার! তাছাড়া ক্যারিয়ার-ট্যারিয়ার বলে যা ছিল তা তো নিজ হাতেই জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাই করে দিল!  এমন ছেলের হাত থেকে যতদ্রুত কেটে পড়া সম্ভব, তত দ্রুত কেটে পড়ে দারুণ বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছিল নোভা ।
ফলাফল—
নোভা ক্যারিয়ার গড়েছে । ভালো জব পেয়েছে । প্রতিষ্ঠিত পাত্রের সঙ্গে সংসার পেতেছে ! ওসব মনে রাখলে সে কি পারত এত উপরে উঠতে ?
তারপরও... তারপরও যেন নীচে কোথাও একটা পতনের শব্দ আজো বেজে চলেছে । অত্যন্ত গোপনে সফলতার সংসারে একটা ব্যথার সুর বেজে আবার থেমে যাচ্ছে ।

(৩)
এসবের কিছুই ঘটত না । যদি মায়ের কথামতো সেই ক্লাস নাইনে ছোট্ট কিশোরীটি থাকতে গলায়-কানে-নাকে সোনার গয়না পরে বউ সেজে অন্যের কাঁধে ঝুলে পড়ত নোভা ।
‘কী বলিস তোরা ! এত্ত তাড়াতাড়ি ওসব ক্যামনে ভাবিস তোরা ! আমার মা কয়েকদিন ধইরা ব্যাপক ঘ্যান ঘ্যান করছিল । খুব ভালা প্রস্তাব নাকি !  আমি কিন্তু ধমক দিছি— বিয়ার কতা আরেকবার উচ্চারণ করলে না... সোজা যেদিকে দুচোখ যায়, হাঁটা ধরমু ।’
লাঞ্চটাইমে বান্ধবীদের আড্ডায় ভবিষ্যত জীবন নিয়ে যখন আলাপ ওঠে, এভাবেই বলে নোভা ।
বাকি সবাই তাজ্জব ভঙ্গীতে দৃষ্টি মেলে শোনে নোভার কথা । কথাগুলো কেমন জানি খুব শক্ত । কানে ঢুকলেও কারো মাথায় ঢুকছে না ঠিকঠাক ।
‘জানিস ! আমার খালাতো ভাই মাহতাব শহরে পড়ে । ভার্সিটিতে । সেবার আমাগো বাড়ি বেড়াইতে আইছিল । ম্যালা গল্প হইছিল ভাইয়ার লগে । ভাইয়া কইছিল, ভালো পাস কইত্তে পাইল্লে আমিও নাকি পড়তে পারুম । আমার না খুব শখ, ভার্সিটিতে পড়ুম ।’
এমনই স্বপ্ন ঝিলমিল করে জ্বলত নোভার চোখে ।

(৪)
স্বপ্ন চোখে জ্বললেই হয় না, বুকেও জ্বলা লাগে ।
স্বপ্নের মতই পরম আপন বই-খাতাগুলো বুকে জড়িয়ে স্কুলটা শেষ করে দু’মাস হল কলেজে পা ফেলেছে নোভা ।
এখন আর বই-খাতা বুকে জড়িয়ে ধরে না । লজ্জা লাগে । প্রকৃতির ডাকে তার বুকের লাবণ্য যেন একটু একটু বাড়ছে ! যতই দিন গড়াচ্ছে, তার দিকে আশপাশের মানুষগুলার দৃষ্টিরও পরিবর্তন ঘটছে । আগে যা ছিল শুধুই চাহনি । এখন সেখানে অন্য ইঙ্গিত । টের পায় নোভা । ভাল্লাগে না তার ! তারপরও কি ঘরে বসে থাকলে চলে ? সকালে উঠেই সে বাজারে গিয়ে সিএনজি ধরে । তারপর সোজা কলেজের গেইটে গিয়ে থামে সিএনজি । হুটহাট নেমে পড়ে নোভা । সবার আগে গিয়ে ক্লাসরুমে ঢুকে ফার্স্ট বেঞ্চের পছন্দের জায়গাটা তার দখল করা চাই-ই চাই ।

যেসব নিয়ে নোভার আগে কখনো ভাবনা হত না । যেসব ভাবনাকে মন বার বার নিষিদ্ধ ঘোষণা করে চলেছে । ইদানিং সেসব নিয়েই বেশি ভাবে নোভা ।
এখন কি শুধু ওই চোখগুলো তাকে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে দেখে ? সেও তো সুযোগ পেলে চুপেচুপে তাকায় । ওদের মধ্যেও যেন কী এক অনুপম সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে ।
একদিন মনের অজান্তেই ছেলেটার প্রতি তার ভালোলাগা জন্মে যায় ।
কার প্রতি ? ওই যে, তার প্রতি ।  প্রতিদিন একটা সাদা ময়লা শার্ট পরে আসে । লাস্ট বেঞ্চে বসে । পরনে ঢিলেঢালা প্যান্ট । দারিদ্র্যের চিহ্ন তার পোশাকের পরতে পরতে । তবুও কী অদ্ভুত মায়া লাগে ! কী এক দুর্বার আকর্ষণ তার শ্যামবর্ণের মুখখানির মধ্যে । চোখ ফেরাতেই মন চায় না, তবুও ফেরাতে হয়, ভদ্রতা বলে কিছু তো আছে !
আর কতদিন চোখাচোখি— এবার মুখ ফুটে কিছু তো বলো— না, ওই-ই বলবে, ও-কেই প্রথম হাত বাড়াতে হবে নোভার দিকে । তারপর বাকি-যা...
সন্ধ্যা নামে, ইলেক্ট্রিক বাতিটা জ্বেলে বই সামনে নিয়ে বসে নোভা । বইয়ের পাতা ওল্টায় । কিন্তু কালো রঙের অক্ষরমালায় তার মনটাকে কিছুতেই বসিয়ে রাখতে পারছে না । তবুও তাকিয়ে থাকে সে । আর ভাবে— এমন কেন তুমি ? এত লজ্জা তোমার ! চোখে চোখ পড়তেই কেমন থতমত খাও, মুখ সরিয়ে নাও । তোমার চোখের ভাষা, মুখের ভঙ্গি, তোমার প্রতিটা বাক্য, প্রতিটা শব্দ আমি বুঝি । ওভাবে তাকিয়ে কিছুই হবে না । মুখ ফুটে বলতে হবে যে ! কবে একটু সাহসী হয়ে উঠবে...  তুমিও কি এখন আমার কথা ভাবছো ? আমাকে শীঘ্রই মনের কথাটা জানিয়ে দিবে ভাবছো ? কিন্তু হৃৎপিণ্ডটা তোমার ভয়ে ধুক ধুক করে কাঁপছে, না? বড় ভয় তোমার, প্রত্যাখ্যাত হওয়ার ভয় ! কিন্তু বিশ্বাস কোরো, আমি রাজী । কোনো আপত্তি নেই । জানো কি তুমি— তোমার প্রতিটা শান্ত সরল চাহনীতে কী এক অশান্ত জটিল অনুভবে আমি আক্রান্ত হই !
ধ্যেত্তেরি ! পড়া বাদ দিয়ে কীসব ভাবছি... আজেবাজে, সব আজেবাজে... কুচিন্তায় ইদানিং জীবনটা ত্যানা ত্যানা হয়ে উঠছে যে । না । বাদ দিতে হবে । এসব থেকে বের হয়ে আসতে হবে । যে করেই হোক ।
কিন্তু পারে না নোভা । কী দুর্নিবার মোহ যে এটা ! যতই চাপা দিয়ে রাখতে যায়, ততই মাথা উঁচিয়ে দাঁড়ায় ।
অবশেষে এই মোহের টানে টানে একদিন তাকে গিয়ে প্রপোজ করে নোভা ।
সরাসরি । তার প্রত্যাখ্যাত হওয়ার কোনো ভয়ই নেই ।
তার ডাগর ডাগর চোখ, গোলগাল ফর্সা মুখ, আর যৌবনের আগমনে ফুলে ওঠা মোহনীয় বুক— আয়নায় ভেসে ওঠা নিজের রূপ দেখে নিজেই কতবার চমকে উঠেছে নোভা !
কিন্তু এ কী ! শান্ত সরল গলায় ও বলল— ‘ভেবে দেখব ।’
লজ্জায় অপমানে কুঁকড়ে যায় নোভা । একটা মেয়ে হয়েও জীবনে যেই প্রথম কাউকে প্রপোজ করল— আর এমন উপেক্ষা ! সেদিন আর ক্লাস না করেই বাড়ি ফিরে যায় নোভা ।
যাবে না সে ! অন্তত সপ্তাহখানেক চেহারা দেখাবে না কলেজের কাউকে । ছেলে হয়েও এত ভাব কেন তার ? কীসের এত অহংকার ? ভালো ছেলে সাজবার অভিনয় ? জাহান্নামে যাক !
না, নোভাকে সপ্তাহখানেক অপেক্ষা করতে হয় না । দিনখানেকও না । সেই সন্ধ্যায় অচেনা মোবাইল নাম্বারটা ভেসে ওঠে তার মোবাইলের স্ক্রিনে ।
‘হ্যালো, আমি তোহা...’
আনন্দে দুলে ওঠে নোভার মন । তবুও বেশ কঠিন স্বরে জিজ্ঞেস করে—
‘কী চাই ?’
‘আরে আশ্চর্য ! আপনি এভাবে কেন বলছেন... আচ্ছা তয়লে রাখি ।’
‘না না... প্লিজ... এমনিতেই দুষ্টামি করছিলাম ’
টিকল না ! নোভার ভাব নেওয়ার চেষ্টাটা টিকল না !

ওদের হৃদয়ের লেনাদেনার আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হতে বেশি সময় লাগে না ।
তারা এখন প্রায়ই এখানে-ওখানে ঘুরে বেড়ায়, কখনো কখনো ক্লাস ফাঁকি দিয়ে ।  একে অপরের হাতে হাত রাখে, পাশাপাশি হাঁটে । প্রথম প্রথম নোভাই টেনে নিত । এখন অবশ্য হাত ধরাধরিতে তোহারই বেশি আগ্রহ ।

(৫)
তোহা ছেলেটার মনটা যে ফিজিক্স বইয়ের মতই জটিল— অল্প কয়েকদিনই টের পেয়ে যায় নোভা ।
মাঝে মাঝে গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে কী যেন ভাবে তোহা !
এপাশে একনাগাড়ে নোভা বলে যায়, বলেই যায়... ওপাশে তোহা নির্বাক ।
‘ধ্যেৎ ! এমন কেন তুমি ! এটা আমার একদমই ভাল্লাগে না, আমরা এত পাশাপাশি, অথচ তুমি কোন্‌ দুনিয়ায় হাবুডুবু খাচ্ছো ? আমি চললাম ।’
রেগেমেগে হাত ছাড়িয়ে নেয় নোভা । দ্রুত পায়ে হাঁটা ধরে । চলে যায় । বাঁধা দেয় না তোহা । বরং ওর চলে যাওয়ার দিকে দৃষ্টি মেলে নিঃশব্দে হাসে ।
একদিন নোভা জেনে যায়— তোহা কবিতা লেখে ।
তার লেখা একটা কবিতার কয়েকটা লাইন একটা চিরকুটে লিখে দিয়েছে তোহা ।
চিরকুটটা হাতে নিয়ে সেইরাতে কতবার যে পড়েছে লাইনগুলো— নোভা তা কাউকে বলে বিশ্বাস করাতে পারবে না  । সমস্ত রাত নির্ঘুম । বিছানায় ওপাশ-এপাশ করে অক্ষরমালাগুলো বার বার পড়তে পড়তে ভোর হয়ে যায় ।

(৬)
না— এভাবে বেশিদিন চলে না । একটু একটু করে নিবিড় হতে থাকা ওদের অন্তরের নীড়ে কে যেন হঠাৎ ঢিল ছুঁড়ে মারে !
সেদিন আধঘণ্টা তোহা চুপচাপ । মনের মাধুরী মিশিয়ে কত রসালো রসালো কথা বলে যাচ্ছে নোভা । কিন্তু কিছুতেই ভাঙছে না তোহার নিস্তব্ধতা । তোহা চুপচাপই থাকে ম্যাক্সিমাম সময়ে । তবে একবারই এতটা চুপচাপ ! টু শব্দও উচ্চারিত হচ্ছে না মুখ থেকে ! একবিন্দু হাসিও ফুটছে না ! সন্দেহ হয় নোভার ।
তোহার চেহারাটা ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে এক ধরণের চাপা জমাট অভিমান টের পায় নোভা । কিন্তু কেন ?
স্পেসেফিক কোনো কারণ খুঁজে পায় না । যতই চাপাচাপি করছে কিছুই বলছে না তোহা । দীর্ঘক্ষণ নীরবতার পর শুধু বলে উঠল— ‘ভাল্লাগছে না !’
‘কিন্তু কেন ? কারণ তো আছে নিশ্চয়ই একটা । বল আমাকে , বল ...’
নোভা ওর হাতটাকে আরো নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরে ।
‘আমজাদ স্যাররে কেমন লাগে তোমার ?’
শান্ত ভঙ্গীতে বলতে বলতে হাতটা আস্তে আস্তে ছাড়িয়ে নেয় তোহা ।
হৃৎপিণ্ডটা মোচড় দিয়ে ওঠে নোভার । কোথায় যেন একটা চরম বেসুরা বীণ বেজে ওঠে !
আমজাদ স্যার— ওদের ফিজিক্স স্যার । ক্লাসে কেমন জানি নিষ্প্রভ । কিন্তু সকাল আটটায় ওরা যখন স্যারের বাসায় প্রাইভেট পড়তে যায়, মুগ্ধ হয়ে শুধু স্যারের স্কিল লক্ষ করে । থিওরিতে যেমন, প্র্যাক্টেক্যালিও সেইম । নোভা শুধু এই একটা সাবজেক্টই প্রাইভেট পড়ে, আমজাদ স্যারের কাছে । সত্যিই স্যারের বুঝানোর দক্ষতা অসাধরণ । কিন্তু স্যারের দৃষ্টিটা ? উফ্‌ ! চোখ দুটি কি মানুষের না শকুনের— এত ড্যাবড্যাবিয়ে তাকিয়ে থাকে !
‘কেন, ভালোই তো ।’ নোভা হাসিমুখে জবাব দেয় ।
‘বুঝেছি... তয়লে জাহাঙ্গীর যা বলে গেল কিছুক্ষণ আগে, তাই সত্য ।’
কী বলে গেল জাহাঙ্গীর ? কী সেই সত্য ? কিছুই জানে না নোভা । তোহাকে কেমন বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে । কপাল-নাক-চিবুক সব ঘেমে উঠেছে । নিঃশ্বাসের গতি বেপরোয়া হয়ে উঠছে ।
‘তুমি এমন করছো কেন— কী বলে গেল জাহাঙ্গীর ? আমি কিছুই বুঝতেছি না !’
‘ কি আর ! আমাকে সাবধান হতে বলল । আমি নাকি আগুনে হাত দিছি, আর আগুনে হাত দিলে নাকি হাত পুড়ে যায় !’
‘সত্যিই আমি বুঝতেছি না ! খুলে বল ।’
‘ন্যাকামো রাখো ! তুমি আমাকে আগে বলতে পারতে... একদিকে স্যারের সাথে সম্পর্ক... অন্যদিকে...’ থেমে যায় তোহা । তার কণ্ঠনালী কে যেন চেপে ধরেছে ! আর কিছু বলতে পারে না ।
সম্পর্ক ! স্যারের সঙ্গে ! নোভা যেন আকাশ থেকে পড়ল !
‘ঐ জাহাঙ্গীর বজ্জাতটার কথাই তুমি বিশ্বাস করলে ! ও তো আমজাদের একনম্বর ছ্যালা । তবে যা সত্য তাই বলি— ওই টিচারের ভদ্র মুখোশ পরে থাকা ব্যাটা আমার দিকে কুনজর দেয় ! আমি বুঝেছি, এটা ওরই ফাঁদ । তুমি তাতে না বুঝেই পা দিলে ! যাক, এত অবিশ্বাস নিয়ে থাকা যায় না । ভুল বুঝলে আমাকে তুমি, ভুল...’
তোহা চুপ মেরে যায় । দিনের আলোটা নিভে আসছে, আর একটু একটু করে নোভা অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে তার দৃষ্টির সীমানা থেকে । চলে যাচ্ছে নোভা ! না, ওকে ফেরাতে ইচ্ছে হয় না তোহার ।

(৭)
সে কাকে বিশ্বাস করবে ? জাহাঙ্গীরকে নাকি নোভাকে ? জাহাঙ্গীর যা বলল, তার কতটুকু আসলে সত্য ? সে কি জাহাঙ্গীরের বানোয়াট গল্প শুনে অবিচার করল নোভার উপর ? মিথ্যে অপবাদ দিল ? ভুল বুঝল ? না ! ঠিক হয় নি । মোটেই উচিত হয় নি । হাতে ফোন তোলে তোহা । ডায়াল করে নোভাকে । কিন্তু...
ওপাশে ফোন বেজে যাচ্ছে, বেজেই যাচ্ছে... কেউ তুলছে না !
সত্যিই কষ্ট পেল নোভা ! না এভাবে বসে থাকলে চলবে না । জাহাঙ্গীরকে ধরতে হবে । গুটিবাজ শালা !
চৌরাস্তার ধারে গিয়ে জাহাঙ্গীরকে পেয়ে যায় তোহা ।
জাহাঙ্গীরই প্রথম চেঁচিয়ে বলে ওঠে—
‘কীরে দোস্ত ! এত দৌঁড়ে দৌঁড়ে কোথায় যাচ্ছিস । নোভার কাছে বুঝি ! ওর পিছে ঘুরাঘুরি এবার বাদ দে রে ভাই, বাদ দে ! খানকি একটা ! যাইয়া দেখ্‌ , আমজাদ স্যারের ফ্ল্যাটে গিয়ে ঠাপ খাইতাছে !’
নিজেকে আর ধরে রাখতে পারে না তোহা । তার মুষ্টিবদ্ধ হাত ছুটে যাচ্ছে জাহাঙ্গীরের দিকে । না, ঘুষির বদলে একটা ধাক্কা মারে সে জাহাঙ্গীরের বুকে । আর তর্জনী উঁচিয়ে বলে— ‘আমজাদের ছ্যালামি করতাছোস, কর্‌ ! তবে নোভাকে নিয়ে কোনো বাজে কথা বললে... আর হ্যাঁ, তোর গুরু আমজাদরে বলে দিস্‌, টিচার হইছে বইলা কিন্তু খোদা হয়া যায় নাই । মুখোশ খুলে ক্যামনে মুখ টেনে বের করতে হয় তা আমার ভালো জানা আছে...’

(৮)
ব্যাপারটা এখানেই শেষ হতে পারত । কিন্তু তাঁকে উদ্দেশ্য করে ছাত্রের মুখে এমন ভয়ানক থ্রেট কিছুতেই মেনে নিত পারছেন না আমজাদ স্যার । কীভাবে এই থ্রেটের একটা উপযুক্ত জবাব দেয়া যায় তিনি তাই ভাবতে থাকলেন... হ্যাঁ, নোভা... শালীর ব্যাটিকে কালকেই ক্লাসে দাঁড় করিয়ে...
তারপর— যা ঘটার তাই ঘটল ।

শিক্ষার্থীদের সবার মুখে মুখে রটে বেড়াচ্ছে বীরত্বপূর্ণ খবরটা— স্টিলের স্কেল দিয়ে একদম নাকে... নাককাটা আমজাদ, হে হে... ওই শালা আসলেই জেনুইন লাভার... হিম্মত আছে শালার বুকে...
আর মাস্টারদের মুখে ছি ছি ! এতবড় বেয়াদপের কি আর এখানে এক মুহূর্ত থাকার অধিকার আছে !
সেদিনই কলেজের ডিসিপ্লিন বডির জরুরি মিটিংয়ে টি.সি দিয়ে দেয়া হল তোহাকে ! মেইন গেট দিয়ে বের হবার আগে নোভার সঙ্গে শুধু একবার চোখাচোখি হল ।
তারপর বহুদিন পর একবার তোহা ফোন দিয়েছিল নোভার নাম্বারে । কিন্তু আমজাদ স্যারের পাশে শুয়ে থাকা নোভার সেই ফোন চিৎকার করতে করতে থেমে গেল । নোভা কিছু শুনতে পায় নি !
সময় এগিয়ে চলল।

©️ সালমান মাহফুজ
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ বিকাল ৩:২২
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা ও পদ্মশ্রী পুরস্কার

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৫৬



এ বছরের পদ্মশ্রী (ভারতের চতুর্থ সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মাননা) পদকে ভূষিত করা হয়েছে, বাংলাদেশের রবীন্দ্র সংগীত এর কিংবদন্তি শিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যাকে।

আমরা গর্বিত বন্যাকে নিয়ে । ...বাকিটুকু পড়ুন

কষ্ট থেকে আত্মরক্ষা করতে চাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৯



দেহটা মনের সাথে দৌড়ে পারে না
মন উড়ে চলে যায় বহু দূর স্থানে
ক্লান্ত দেহ পড়ে থাকে বিশ্রামে
একরাশ হতাশায় মন দেহে ফিরে।

সময়ের চাকা ঘুরতে থাকে অবিরত
কি অর্জন হলো হিসাব... ...বাকিটুকু পড়ুন

রম্য : মদ্যপান !

লিখেছেন গেছো দাদা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫৩

প্রখ্যাত শায়র মীর্জা গালিব একদিন তাঁর বোতল নিয়ে মসজিদে বসে মদ্যপান করছিলেন। বেশ মৌতাতে রয়েছেন তিনি। এদিকে মুসল্লিদের নজরে পড়েছে এই ঘটনা। তখন মুসল্লীরা রে রে করে এসে তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

= নিরস জীবনের প্রতিচ্ছবি=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৪১



এখন সময় নেই আর ভালোবাসার
ব্যস্ততার ঘাড়ে পা ঝুলিয়ে নিথর বসেছি,
চাইলেও ফেরত আসা যাবে না এখানে
সময় অল্প, গুছাতে হবে জমে যাওয়া কাজ।

বাতাসে সময় কুঁড়িয়েছি মুঠো ভরে
অবসরের বুকে শুয়ে বসে... ...বাকিটুকু পড়ুন

Instrumentation & Control (INC) সাবজেক্ট বাংলাদেশে নেই

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৫




শিক্ষা ব্যবস্থার মান যে বাংলাদেশে এক্কেবারেই খারাপ তা বলার কোনো সুযোগ নেই। সারাদিন শিক্ষার মান নিয়ে চেঁচামেচি করলেও বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরাই বিশ্বের অনেক উন্নত দেশে সার্ভিস দিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×