ভিন্ন ভিন্ন ওয়েদারের উপর কি মানুষের মনের ভালো মন্দ অনুভূতির পরিবর্তন হয়! মন হু হু করে ওঠে কোন কারন ছাড়াই! বিষণ্ণ রোদ মিষ্টি মোলায়েম সূর্যের আলো গাছে গাছে উঁচু বিল্ডিঙে, বারান্দায় ঝুলন্ত মানি প্লান্টে।
বাসা থেকে বের হবার সময় শায়লা রহমান সাংসারিক নানান চিন্তা মাথায় নিয়ে সেগুলো একের পর এক কি করে সম্পন্ন করা যায় সেই কথা ঘুরে ফিরে ভাবতে ভাবতে মাথায় করে বের হয়েছে একা একা।
স্বপনের বাবা নাস্তা শেষ করে অফিসের উদ্দেশ্যে যেতে যেতে বলল; আজ তার ফিরতে দেরি হবে গাজীপুরে যেখানে ছয় বন্ধু মিলে ছয় তলা ভবন নির্মাণ করছে তারা সবাই মিলে মিটিঙে বসবে; ভবনে কোথায় কোথায় আর কি কি প্রয়োজন কি পরিমান খরচ হল আর কত পরিমান খরচ হবে কোন মিস্ত্রি কাজ করতে গিয়ে উপর থেকে পড়ে গিয়ে হাত ভেঙ্গে ফেলছে তার হসপিটাল খরচ ইত্যাদি নানা বিষয়াদি নিয়ে তাদের আলোচনা।
শায়লা রহমানের এক ছেলে ও এক মেয়ে স্বপন ও নুসরাত, ছেলে স্বপন এবার কলেজে ভর্তি হয়েছে আর নুসরাত স্কুলে পড়ে ক্লাস সেভেনে।
সে ফুটপাত দিয়ে হেঁটে হেঁটে সুপারশপের দিকে যেতে যেতে ভাবছে স্বপনের বাবার গত রাতের আচরন; যে জন্য সে মনে মনে খানিকটা ডিস্টার্ব, উনি খাবারের পর এক কাপ কফি খেতে চেয়েছিল; শায়লা রহমান একা হাতেই ঘরের সব কাজ করেন যে কারনে বাকী অন্যান্য কাজ গুছিয়ে কফি বানাতে দেরি করেছিলেন ঘড়ির টাইম অনুযায়ী ঠিক ৯:৩০ টায় উনি কফি চেয়েছিলেন শায়লা তাকে সোয়া দশটায় কফি দিয়ে আসায় কেন এত বেশিক্ষন দেরি হলো! এই রকম মন্দ এক্সকিউজে হাত থেকে মগটা নিয়ে আছাড় দিয়ে ভেঙ্গে ফেললেন।
কাঁচের মগের ভাঙা টুকরা গুলো সারা ঘড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ার পর শায়লার মনে হল এই কাঁচ পরিস্কার করতে গিয়ে অবশ্যই তার হাতের ভেতর কাঁচ ঢুকে যাবে, সে সাথে সাথে বেলচা আর ঝাড়ু এনে ওগুলো ক্লিন করতে করতে চোখের পানি আসি আসি করেও শেষ পর্যন্ত না আনায় সফল হলেন শায়লা।
হাতেও কাঁচ ঢোকেনি, এর থেকেও কত রকম কত আচরন করে এসেছে সে এই সতেরো বছরের বিবাহিত জীবনে, এটা তো মামলি ঘটনা, বিয়ের ১৫ দিনের মাথায় যখন স্বপ্ননের বাবা এরকমই একটা তুচ্ছ কারনে প্রথম থাপ্পড় মেরেছিল তাকে সেদিন সারা পৃথিবী যেন শায়লার ওলট-পালট হয়ে গিয়েছিল, এরপর সময়ের সাথে সাথে কম বেশি এই সমস্ত ঘটনা তো ডাল ভাতের মতই স্বাভাবিক, এসব থেকে শুরুতেই যে বেরিয়ে আসতে একদম চেষ্টা করেনি সে তা নয়; প্রথমেই বাবার বাড়ি; সেখান থেকে শুনতে হয়েছিল তোমাকে বিয়ে দিয়েছি এখন আমাদের মান সম্মান নষ্ট করতে এসো না যেভাবেই হোক মানিয়ে চলো।
তারপর ছেলে মেয়ে হলো, ওদের জীবনে নিরাপত্তার কথা ভেবেই আর কিছুই করার সাহস রইলোনা শায়লার ধৈর্য ধরে সহ্য করা ছাড়া।
সময় মানুষকে আবেগহীন করে দিতে না পারলেও সহ্য করার ক্ষমতা তৈরি করে দেয় সারভাইভ করার জন্য।
যখন প্রথম প্রথম স্বপনের বাবা এরকম মারধোর দুর্ব্যবহার করতো কত যে কেঁদেছে, কখনো লুকিয়ে, কখনো বারান্দায় অথবা ওয়াশ রুমে কখনো কিচেনে খুব গোপনে।
শায়লা ভেবে পেতো না বিয়ের পর কি সব মেয়েকেই তাদের হাজবেন্ডরা এরকম দোষ ধরে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে গায়ে হাত উঠায়! নাকি শুধু ওর সাথেই এমনটা হচ্ছে।
এই রকম ভাবনা গুলো ভাবতে ভাবতে একরকম মন খারাপ করে কাছেই একটা সুপারশপে পৌঁছায়, কিছু প্রয়োজনীয় বাজার করে, বাসায় ফিরে দুপুরের রান্না করতে হবে।
বাজার শেষ করে সুপার শপ থেকে বেরিয়ে রিক্সার খোঁজে দাঁড়িয়ে থাকে মন ভার ভার ভাব নিয়ে। রাস্তাঘাট ফাঁকা খানিকটা দূরে একটা রিক্সা এসে দাঁড়ায় সেটার যাত্রী নেমে ভাড়া দিয়ে চলে যাওয়ার পর শায়লার হাতে বাজার করা ভারী ব্যাগগুলো একসাথে নিয়ে একটু থেমে ওড়নার আঁচল ভালো করে মাথায় পেঁচিয়ে রিক্সায় উঠে বসে।
বাসায় ফিরে তাড়াতাড়ি সব গুছিয়ে রাখে মাছ গুলো ব্যাগ থেকে বের করে কাটতে বসে ঝটপট; মাছ কাটতে কাটতেই চোখে পড়ে তার ডান হাতের অনামিকার আংটিটা নেই যেটা বিয়ের সময় স্বপনের পরিবার থেকে দিয়েছিল।
১৭ বছরের পুরোনো জিনিসটা, শ্বশুর বাড়ি থেকে ওটা দেয়ার সময় শায়লাকে শর্ত দিয়েছিল বিয়ের সময় হয় ডায়মন্ডের আংটি নয়তো স্বর্ণের গহনা যে কোন একটা তাকে দেয়া হবে, শায়লার ডায়মন্ড বেশি পছন্দের হওয়ায় সে আংটি নিতেই রাজি হয়েছিল। হোয়াইট গোল্ডের উপরে অসাধারণ ডিজাইনের আংটি ছিল ওটা, পরে অবশ্য একটা নেকলেস কিনে দিয়েছিল স্বপনের বাবা।
কিন্তু এ কি হলো! আংটি হারানোর আকস্মিয়তায় কিছুক্ষন স্ট্যাচু অব লিবার্টির মতন একভাবে দাঁড়িয়ে রইলো শায়লা, যেন প্রাণের ভিতরে হাত পড়েছে , এখন সে কি করবে! আংটি কোথায় হারাতে পারে নিমগ্ন হয়ে চিন্তা করতে থাকে, স্বপনের বাবা যদি শোনে আংটিটা হারিয়েছে ভাবতেই গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায়! সামান্য কফি দিতে দেরি হওয়ায় যে বিয়ের এত বছর পর ও মগ ভেঙ্গে ফেলতে পারে! সে কি করবে! দেখা যাবে এই অপরাধে শায়লার গলা টিপে মেরে ফেলল তারপর পুলিশের কাছে গিয়ে বলবে আংটি হারানোর জন্য আমি আমার স্ত্রীকে হত্যা করেছি! এরকম তো কতই হয়।
এদেশে তুচ্ছ থেকে তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে বউকে হত্যা করে স্বামীরা, রান্না করতে দেরি করায় মারতে মারতে খুন, প্রবাসী দেশে ফিরে নববধূর টিকটকে একাউণ্ট আছে জেনে গলা কেটে খুন, বাপের বাড়ি যেতে চাওয়ায় খুন, মুখে মুখে তর্ক করায় খুন, এই সব চিন্তা করতে করতে শায়লা রহমান যেন দুনিয়ায় নেই এইভাবে মাছ কেটে ধুয়ে ফ্রিজে গুছিয়ে রেখে রাইস কুকারে ভাত বসিয়ে দিয়ে মেয়ে নুসরাত আসার অপেক্ষা করতে থাকলো।
বেলা প্রায় ১১ টা মেয়ের ছুটি হই হই করছে, স্কুল থেকে বাসায় আসতে ১০ মিনিট লাগে, নুসরাত বাসায় আসার পরেই শায়লা বাসা থেকে বের হবে, মেয়ের জন্য হালকা একটু নাস্তা রেডি করতে করতে ভেউ ভেউ করে কাঁদতে থাকে একা; হায় আল্লাহ! এ কি হয়ে গেল!
ঘরের নানান জায়গায় খুঁজতে খুঁজে হয়রান; পেলোনা। এগারোটা পনেরোতে কলিং বেলের শব্দে প্রান প্রায় উড়ে যায় অবস্থা; মেয়ে মায়ের চেহারা দেখে অবাক হয়ে বলে মা কি হয়েছে! অমন ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে কেন তোমায়! শায়লা প্রসংগ এড়িয়ে ওকে ফ্রেশ হয়ে নাস্তা খেতে বলে একটু কাজ আছে বলে বাসা থেকে বের হয় ততক্ষণাৎ।
যে রাস্তা দিয়ে বাসায় ফিরেছিল রিক্সায়; সেই রাস্তা এখন পায়ে হেঁটে হেঁটে এগোচ্ছে, চোখ দুটোকে অনুবীক্ষণ যন্ত্র বানিয়ে; কেউ কেউ ব্যাপারটা লক্ষ্য করে আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইছে কি খুঁজছে, শায়লার তেমন মনোযোগ না পেয়ে কথা না বাড়িয়ে চলে যাচ্ছে লোকজন।
প্রচন্ড রোদে মাথা চিনচিন করে ব্যথা করছে, হাঁটতে হাঁটতে সেই সুপার শপের সামনে পর্যন্ত পৌঁছে গিয়ে অবাক হয় সে! এতদুর চলে এসেছে! নাহ আর কিছু করার নেই, শেষবারের মত চারপাশে অনিশ্চিত তাকায়।
একটা ডায়মন্ডের আংটি রাস্তায় পড়ে থাকবে আর কেউ সেটা তুলে নিবে না সে তো হয়ই না; এমনিতেই মানুষ চুরি ছিনতাইয়ের উপরে থাকে, শায়লা যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল সেখানে পাশেই একটা হোটেল মানুষজনের যাওয়া আসা বেশ, সে হোটেলে গিয়ে কি জিজ্ঞেস করবে?কেউ কি পেয়েছে তার আংটিটা! কেউ পেয়েছে এটার সম্ভাবনা নাই জেনেও সেদিকে পা বাড়ায় শায়লা খুব অনিশ্চিতভাবে সামনে, সে আসলে কি করছে না করছে বুঝতে পারছেনা।
হোটেলের একটি লোক সেখানে শিকের ভেতরে গ্রিলের কাবাব সেট করছে গ্রিল মেশিনে, শায়লা প্রচুর কনফিউশন নিয়ে তাকে বলে যে এখানে কোন আংটি কি কেউ দেখেছে পড়ে থাকতে? একটা বোকা বোকা প্রশ্ন করে বিব্রতকর অথচ অসুস্থ চিন্তিত কান্না আটকে রাখা চেহারা করে দাঁড়িয়ে থাকে সে, লোকটা কিছু না বলে ভিতরে চলে যায়।
কয়েক মিনিটের ভেতর সাথে করে নিয়ে আসে একটা তেইশ অথবা চব্বিশ বছর বয়সের ছেলেকে, ছেলেটি সামনে দাঁড়িয়ে একটা আনন্দিত হাসি দেয়, তারপর হাসি হাসি মুখে বলে আংটিটা দেখতে কি রকম? জবাবের অপেক্ষা না করে অলৌকিক ভাবে নানা কসরত করে প্যাচানো লুঙ্গির দীর্ঘ ভাঁজ খুলে বের করে আংটি! এইটাই তো??
শায়লা অবিশ্বাস্য দমবন্ধ চেহারা নিয়ে হাতে নেয় আংটিটা, মাথাটা কেমন হালকা লাগতে শুরু করে, কাঁদতে কাঁদতে বসে পড়ে হোটেলের কোন একজনের এগিয়ে দেয়া চেয়ারে।
তখনই পাইছিলাম যখন আপনার হাত থেকে খুলে পড়ছে, আমি আপনার পেছনেই ছিলাম, ডাকলাম কতবার শুনলেনই না। ছেলেটির কথা মনেহয় দূর থেকে ভেসে আসে কানে, শায়লা পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার রোগীদের মতন চোখে অন্ধকার দেখতে শুরু করে অনেকক্ষণ চোখ বন্ধ করে হেলান দিয়ে বসে থাকে চেয়ারের কিনারার পাশের দেয়ালে।
হোটেলের মালিক জানায় যে ওর নাম মাসুম, বাড়ি নীলফামারী, গত রাতে তার একটা মেয়ে হয়েছে, এত দূরে আছে বলে এখনো যেতে পারে নাই, আমি ছুটি দিয়েছি, বেতনের অর্ধেক ও দিয়ে দিয়েছি, ও সব গুছিয়ে রেখেছে, আপনার জন্য যায় নাই, বলে আংটিটা উনাকে বুঝিয়ে না দিয়ে কিভাবে যাই, উনি নিশ্চয়ই খুঁজতে আসবে।
শায়লা আংটিটা হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ নাড়াচাড়া করে; তারপর ধীরে ধীরে বাড়িয়ে দেয় মাসুমের দিকে এক ঝাঁক আনন্দ মিশ্রিত ভঙ্গিমায় বলে এটা তুমিই রাখো তোমার সদ্য জন্ম নেয়া নবজাতক মেয়ের জন্য আমার পক্ষ থেকে আশীর্বাদ তাকে যেন কখনো দুঃখ কষ্ট স্পর্শ করতে না পারে।
বিস্মিত মাসুম কিছুতেই সেটি নিতে চায়না। সে বলে, "আপনার এই আংটির সঙ্গে কত স্মৃতি, কত ভালোবাসা জড়িয়ে আছে, তাছাড়া কত দামী আংটি! আমি এটা নিতে পারবো না।"
শায়লা রহমান একটু হাসলেন। তার মনে হলো, এতদিন ধরে যে আংটি তার জীবনের অমূল্য ভেবে আসলে ভ্রান্তিতে ছিল, সেটা এখন সেই ভ্রান্তি ভেঙে আসলেই কারও জীবনে আনন্দ বয়ে আনুক।
তিনি বলেন, "মাসুম, জীবনের অনেক কিছুই আমাদের কাছে একসময় অমূল্য মনে হয়, কিন্তু সময়ের সাথে সাথে আমরা শিখি— ভালো থাকার চেয়ে মুল্যবান আর কিছুতে নেই ।
এই আংটিটা আমি ভালোবাসা ও আশীর্বাদ হিসেবে তোমার মেয়েকে দিতে চাই কারন তুমি যে সততা দেখিয়েছো তার পুরস্কার এটাই হওয়া উচিত।
মাসুম তখন আর কিছু বলতে পারে না। সে কৃতজ্ঞতা ও সম্মানের চোখে শায়লার দিকে তাকিয়ে থাকে। শেষে ধীরে ধীরে আংটিটা নিয়ে মাথা নিচু করে বলে, "আল্লাহ আপনাকে সুখী করুক।"
সুখী তো অবশ্যই করবে; আজকের পর আর কারো দুর্ব্যবহারে সে কষ্ট পাবে না, বলে; আংটিটার মেমোটা আমি তোমার মালিকের কাছে দিয়ে যাব তুমি বাড়ি থেকে ঘুরে এসে ওটা সংগ্রহ করে রেখো, ভবিষ্যতে দরকার হতে পারে তোমার।
হোটেলের মালিক স্ব-স্নেহে মাসুমের মাথায় হাত রাখে; বলে মাশাল্লাহ দোয়া করি তোর মেয়ে জীবনে অনেক বড় হোক দুনিয়াতে এসেই এত দামী উপহার । বড় ভাগ্য করে এসেছে তোর মেয়ে।
তাই যেনো হয়, সব মেয়েরাই যেন দুনিয়াতে বড় ভাগ্য করে আসে, অন্তত স্বামীর ঘরে যেন কষ্ট পেতে না হয়। তার নিজের মেয়ের ও যেন; যে কষ্ট সে নিজে করেছে সেই কষ্ট পেতে না হয় মনে মনে বলে শায়লা রহমান।
ধীরে ধীরে হোটেল থেকে বেরিয়ে আসে, বাইরে এসে তার চোখে রোদ পড়ে, কিন্তু এই মুহূর্তের রোদটা তার কাছে বিষণ্ণ নয় বরং মনেহয় এই রোদ তার নতুন শুরুর প্রতীক। কিছুক্ষণ আগেও যে আংটির চিন্তায় অস্থির এখন সেই আংটির ভার থেকে মুক্ত হয়ে নিজেকে হালকা লাগছে। শায়লা রহমান ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে; আসলে এ জীবনে কিছুই চিরস্থায়ী নয় না দুঃখ না দুঃশাসন না দামী জড়বস্তু।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০১