কক্সবাজারের রামুতে গত শনিবার রাতে বৌদ্ধপল্লিতে হামলা-অগ্নিসংযোগের তিন দিন পরও জানা গেল না, কে বা কারা এ ঘটনা ঘটিয়েছে। তবে রাজনৈতিক নেতাদের সামনেই যে একের পর এক বৌদ্ধমন্দির, বসতবাড়ি ও দোকানপাট জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে, তা সবাই বলছেন। এমনকি স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তারাও এ দৃশ্য নীরবে দেখেছেন।
ঘটনার শিকার বৌদ্ধরা অভিযোগ করেছেন, হামলা প্রতিহত করতে রাজনৈতিক দলের স্থানীয় নেতা ও পুলিশসহ প্রশাসনের কর্মকর্তারা আন্তরিক ছিলেন না। তাঁরা আন্তরিক হলে এ ঘটনা প্রতিহত করা যেত। কেউ কেউ এ জন্য রামু থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকেও (ওসি) অভিযুক্ত করেন।
স্থানীয় লোকজন ও তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, গান পাউডার ব্যবহার করে বুদ্ধমূর্তিগুলো জ্বালিয়ে দেওয়া হয়, পেট্রল ছিটিয়ে বসতবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়। ঢিল ছোড়ার জন্য চার কোনা কংক্রিটের ব্লক জোগাড় করা হয়, যেগুলো রামুতে পাওয়া যায় না। ট্রাক-বাস-পিকআপে করে গ্রাম থেকে লোক আনা হয়। আবার পবিত্র কোরআন অবমাননার ছবিসংবলিত ফেস্টুনও তৈরি করা হয়েছে। রাতারাতি এত পরিকল্পিত হামলা কীভাবে ঘটানো হলো, কারা করল, টাকার জোগান দিল কারা এসব প্রশ্নের উত্তর এখনো মেলেনি।
পুলিশ সুপার সেলিম মো. জাহাঙ্গীর বলেন, এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজা হচ্ছে, পাওয়া গেলে সবকিছু পরিষ্কার হয়ে যাবে।
ঘটনার বর্ণনা: সেদিনের ভয়ংকর হামলায় ঘরহারা মানুষ গতকালও খোলা আকাশের নিচেই বসবাস করছিল। রাতে বৃষ্টি হলে তারা আরও বিপাকে পড়ে। এরপর সেনাবাহিনীর সদস্যরা তাঁদের থাকার জন্য তাঁবু গেড়ে দেন।
হামলায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১৭০৬ সালে স্থাপিত রামু কেন্দ্রীয় সীমাবিহার। মঙ্গলবার সকালে সেখানে যাওয়ার পর সাংবাদিক পরিচয় পেয়েই বিহারের লোকজন ভিড় করেন। তাঁরা সেদিনের ঘটনার মর্মস্পর্শী বিবরণ দেন। হামলার সময় দুর্বৃত্তরা বৌদ্ধদের ইতিহাসের সংগ্রহশালাও জ্বালিয়ে দেয়। এতে সেখানকার কম্পিউটার ও অন্যান্য জিনিসপত্র পুড়ে যায়। এসব দেখাশোনার দায়িত্ব পালন করতেন ববিতা বড়ুয়া। কথা বলতেই চোখের পানি মুছে বললেন, ‘সারা জীবন আমরা দুই হাতে মানুষকে দান করে এসেছি। এখন আগুনে নিঃস্ব হয়ে মানুষের কাছেই হাত পেতেছি। এর চেয়ে লজ্জার আর কী হতে পারে?’ কারা আগুন দিয়েছিল? প্রশ্ন করতেই পাশে দাঁড়ানো মন্দিরের সহকারী পরিচালক প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু বললেন, ‘শুরু করেছে এলাকার ছেলেরা। পরে ওদের সঙ্গে হাজার হাজার লোক জড়ো হয়েছিল। ওরা ট্রাকে করে, বাসে করে রামুতে আসে। তারা আমাদের মন্দিরের দানের টাকা ও খাবার পর্যন্ত লুট করেছে।’
সহকারী পরিচালক মন্দিরের পুড়ে যাওয়া বুদ্ধমূর্তিগুলো দেখান। সবচেয়ে বড় মূর্তিটি আট মাসে আগে থাইল্যান্ড থেকে আনা হয়। আট মণ ওজনের এ মূর্তিটির এক চোখ তুলে নিয়েছে হামলাকারীরা। আগুনে তার পা জ্বলে গেছে। পাশেই শোয়ানো অবস্থায় আরেকটি বড় মূর্তি। ওই মূর্তির নাকও ভেঙে ফেলা হয়েছে। আগুনে জ্বালিয়ে দেওয়া হয় পুরো মন্দিরটি।
প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু অভিযোগ করেন, আগুন দেওয়ার সময় জারে করে পেট্রল আর ব্যাগে করে গুঁড়াজাতীয় পাউডার আনা হয়। সেই পাউডার ছিটানোর পর এতে আগুন দেওয়া হয়। পাউডারের উচ্চ তাপে পিতলের মূর্তিও গলে যায়। আর জারে করে আনা পেট্রল ছিটিয়ে বাড়িঘরে আগুন দেওয়া হয়। সীমাবিহারে পোড়া মূর্তির দিকে অশ্রুসিক্ত হয়ে তাকিয়ে ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জিনবোধী ভিক্ষু। চার কোনা কংক্রিটের ব্লক হাতে ধরে তিনি বললেন, এসব চৌকোনা ব্লক বড় ধরনের কোনো উন্নয়নকাজের জন্য তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু এমন ব্লক রামুতে কেউ ব্যবহার করে না। হামলাকারীরা বস্তায় ভরে এসব ব্লক কোত্থেকে আনল, তা কেউ বলতে পারছে না। এই ব্লকগুলো বৌদ্ধদের বাড়িঘরে নিক্ষেপ করা হয়।
রামুর শ্রীকুলে পাশাপাশি দুটি বৌদ্ধমন্দির লাল চিং আর সাদা চিং। দুটি মন্দিরই জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। গতকাল দুপুরের সেই পোড়া মূর্তিকেই ভক্তি করছিলেন কয়েকজন নারী। সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে তাঁরা বললেন, মন্দিরের কাছে পাশাপাশি বৌদ্ধ ও মুসলমানদের বাড়ি। সেখানে এমনভাবে আগুন দেওয়া হয়, যাতে শুধু বৌদ্ধদের বাড়িটিই জ্বলে যায়।
লালচিংয়ে পাওয়া যায় কক্সবাজারের সংরক্ষিত নারী আসনের সাংসদ এ্যাথিন রাখাইনকে। তিনি বলেন, ‘কারা হামলা করেছে, জানি না। তবে এ ঘটনায় ছাত্রলীগের এক নেতাও আটক হয়েছেন বলে শুনেছি।’ রামুর উত্তর মিঠাছড়িতে টিলার ওপরে স্থাপন করা হয়েছে ১০০ ফুট লম্বা শোয়ানো বুদ্ধমূর্তি। করুণা শ্রী ভিক্ষু এটি স্থাপন করেছেন। সেদিনের হামলার প্রসঙ্গে তিনি বললেন, কংক্রিটের মূর্তিটি শাবল দিয়ে ভাঙার অনেক চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু তারা ভাঙতে পারেনি। তবে হামলার কারণে বৃহৎ আকারের মূর্তিটিতে ফাটল ধরেছে। সেখানে অতি মূল্যবান একটি ত্রিপিটক রাখা ছিল, সেটিও জ্বালিয়ে দেওয়া হয়।
ঘটনা নিজের চোখে দেখেন এমন বৌদ্ধ বাসিন্দা অমল বড়ুয়া বলেন, শনিবার রাত সাড়ে নয়টার দিকে এ ঘটনার প্রতিবাদে ছাত্রলীগের স্থানীয় নেতা সাদ্দাম হোসেন, আমজাদ হোসেন, জিন বাবু, রুস্তম আলীসহ কয়েকজন মিছিল বের করেন। মিছিলটি বৌদ্ধমন্দির ঘুরে উপজেলা সদরের চৌমুহনীতে আসার পর রামু নাগরিক কমিটির নেতা ছাত্রলীগের সাবেক নেতা নুরুল ইসলাম যোগ দেন। মিছিলটি রামু বাজারের মোড়ে আসার পর সেখানে আরও লোকজন জড়ো হয়। সমাবেশে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সোহেল সরওয়ার, উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান মুশরাত জাহান, জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি নুরুল ইসলাম, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা দেবী চন্দ ও থানার ওসি উপস্থিত হন। সাংসদ লুৎফর রহমান বক্তব্য শেষ করতে না-করতেই লাল চিং মন্দিরে আগুন জ্বলে ওঠে।
কেন্দ্রীয় বৌদ্ধবিহারে পাওয়া গেল এলাকার বিএনপিদলীয় সাংসদ লুৎফর রহমানকে। তিনি বলেন, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার ফোনে তিনি রামু বাজারে এসে দেখেন, শত শত মানুষ জড়ো হয়েছে। তিনি আবদুল হক নামের এক মাওলানাকেও ডাকেন। এ সময় সেখানে খালি গলায় তিনি এবং জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও উপজেলা চেয়ারম্যান সোহেল সরওয়ার বক্তৃতা করছিলেন। কিন্তু লোকজন কারও কথা শুনছিল না। তিনি বলেন, এ ঘটনায় আওয়ামী লীগের লোকজন জড়িত। মিছিলে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের অনেক লোক ছিলেন।
জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা সাইমুম সরওয়ার বলেন, রাত সাড়ে ১০টা থেকে ১২টা পর্যন্ত খণ্ড খণ্ড মিছিল করেছে বিএনপি ও যুবদল। এর পরই আগুনের ঘটনা ঘটে। সঞ্জীব বড়ুয়া নামের এক যুবক অভিযোগ করে বলেন, রামু মোড়ে যখন মিছিল চলছিল, তখন মন্দিরের পাশে কিছু বৌদ্ধ যুবক জড়ো হন। রামু থানার ওসি সেখানে এসে সবাইকে বাড়ি যেতে বলেন। তিনি বলেন, ‘কিছু হবে না, আপনারা চলে যান।’ এর পরই আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটে।
সঞ্জীব বড়ুয়া অভিযোগ করেন, ঘটনার সময় পিকআপ ও কক্সলাইন পরিবহনে করে শত শত লোক রামুতে আসে। তারা গান পাউডার ও জ্বালানি তেল নিয়ে আসে। ওসি নিজেও তা স্বীকার করেন। তিনি বলেন, কারা এসব গাড়ি ভাড়া দিল, তা খুঁজে দেখা হচ্ছে। কক্সলাইনের একটি বাস আটক করা হয়েছে। তবে কোনো পিকআপের মালিককে পাওয়া যায়নি।
জানতে চাইলে কক্সলাইন পরিবহনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক এম এ বারী বলেন, ‘হামলার ঘটনায় আমাদের কোনো গাড়ি ব্যবহার করা হয়নি। হেলপাররা কাউকে না বলে একটি গাড়ি নিয়ে গেছে। সেই গাড়িটি বিজিবির হাতে ধরা পড়ে।’
গ্রেপ্তার, মামলা: বৌদ্ধমন্দিরে হামলার ঘটনায় গতকাল পর্যন্ত ১৬৯ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আরও ১৯ জনকে আটক করা হয়েছে। এদের বেশির ভাগই ইসলামী ছাত্রশিবিরের কর্মী ও মাদ্রাসাছাত্র। জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে পুলিশ এদের আটক করে। এ ঘটনায় ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত, হামলা, লুটপাট, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের অভিযোগ এনে এ পর্যন্ত ১৪টি মামলা হয়েছে। যে তরুণের ফেসবুকে পবিত্র কোরআন শরিফ অবমাননার ছবি পাওয়া যায় বলে দাবি করা হয়, তাঁর নাম উত্তম কুমার বড়ুয়া। উত্তমের নামেও মামলা করেছে রামু থানার পুলিশ। উত্তমকে পুলিশ খুঁজে পায়নি। তাঁর মা ও বোন পুলিশ হেফাজতে আছে।
শনিবার রাতে হামলা করে ফিরে যাওয়ার সময় নাইক্ষ্যংছড়িতে কক্সলাইন নামের একটি পরিবহন কোম্পানির বাসসহ ৩০ জনকে আটক করে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। পরে এদের গ্রেপ্তার দেখানো হয়। দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে মঙ্গলবার সকালে রামু থানার ওসি এ কে নজিবুল ইসলামকে প্রত্যাহার করা হয়।
ওপারে উত্তেজনা: কক্সবাজারের ঘটনায় সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা-অধ্যুষিত এলাকাতেও উত্তেজনা দেখা দিয়েছে। বিজিবির ১৭ ব্যাটলিয়নের অধিনায়ক লে.কর্ণেল খালেকুজ্জামান বলেন, এ ঘটনা জানার পর গতকাল সকালে ঘুমধুম বিদ্যালয়ে বিজিবি ও মিয়ানমারের সীমান্তে নিয়োজিত নাসাকা বাহিনীর মধ্যে পতাকা বৈঠক হয়েছে।
BD News 24

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




