মেডিকেল সাইন্স বলে, একটি শিশুর ছয় থেকে আট বছর বয়সের মধ্যেই তার ব্যক্তিত্ত্বের মূল কাঠামোটি তৈরি হয়ে যায়। তার মানে দাঁড়াচ্ছে যে, হাই স্কুলে উঠার কিছুদিনের মধ্যেই ঠিক হয়ে যায় একটি শিশু মানুষ হিসেবে কেমন হবে। অর্থাৎ একটি শিশুকে আমরা কেমন মানুষ হিসেবে গড়ে তুলব সেটা আমাদের ঐ সময়ের সিদ্ধান্তের উপরই নির্ভর করে।
আমরা সবাই চাই আমাদের পরিবারের শিশুটি ঠিক মত বড় হোক / সুস্থ থাকুক / তার ভিতরে এইটা - ঐটা নানা রকম গুণ তৈরী হোক / পড়াশুনায় ভালো হোক সর্বপরি সে একজন "ভালো মানুষ হোক"।
"ভালো মানুষ"। আসলে ভালো মানুষ বলতে আমরা কি বুঝি? ছাত্র অবস্থায় ভালো মানুষের বোধহয় একটাই গুণ বিবেচনা করা হয়। সেটা হল সে কতটা ভালো Studen. ছাত্রত্ত্ব চলে গেলে, ভালো মানুষ হিসেবে বিবেচ্য হল সে কত বেতনের চাকরী করে।
যদি ভালো মানুষের সর্বজনীন সংজ্ঞা এই হয়, তাহলে আমার কিছু বলার নাই। কিন্তু যদি ভালো মানুষ বলতে সত্যিই একজন ভালো মানুষকে বুঝানো হয়, তাহলে আমার কিছু কথা থাকে।
আমরা যদি সত্যিই চাই আমাদের সন্তান খুব ভালো একজন মানুষ হবে, তাহলে আমরা কিভাবে তার থেকে তার শৈশবটি কড়ে নিই? কিভাবে তার খেলার সময়টি কেড়ে নিয়ে তাকে বই খাতাতে মুখ গুঁজে থাকতে বাধ্য করি? কিভাবে তার উপরে হোমওয়ার্কের পাহাড় চাপিয়ে দিয়ে তাকে বাধ্য করি এইটা ভুলে যেতে যে সে একটি শিশু? কার্য ক্ষেত্রের ব্যস্ততার অযুহাতে একটি শিশুকে কাজের মানুষের কাছে বড় হতে দিয়ে আমরা কখনই আশা করতে পারিনা যে বড় হয়ে সে একজন কর্তব্য পরায়ন মানুষ হবে। কিংবা শিশুটির জন্যে সুধুমাত্র স্যাটেলাইট চ্যানেল এবং কম্পিউটার গেম নির্ভর বিনোদনের ব্যবস্থা করে দিয়েই আমরা কখনই আশা করতে পারিনা যে সে বড় হয়ে ফ্যাসন সচেতনতার নামে সংক্ষিপ্ত পোশাক / আধুনিকতার নামে বিপরীত লিঙ্গের সাথে শারিরীক সংস্পর্শ / বিনোদন মূলক উত্তেজনার নামে ভায়োলেন্স / স্মার্টনেসের নামে বয়োজ্যেষ্ঠদেরকে অসম্মান করা এরকম আরও অসংখ্য চারিত্রিক সমস্যা দ্বারা আক্রান্ত হবেনা। প্রতিযোগিতা মূলোক বিশ্বব্যবস্থা আর অর্থনৈতিক মূল্যসূচকের দোহাই দিয়ে আমরা আমাদের শিশুদের নি:সঙ্গতার দায় থেকে নিজেদেরকে মুক্ত রাখতে পারি হ্য়ত কিন্তু এইটা কিছুতেই অস্বীকার করতে পারবোনা যে আমরা তাদের কে শিশু না ভেবে রেসের ঘোড়া হিসেবে বড় করছি। এমনকি আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাও একটা আজব ব্যাপার। সেই ছোট্টবেলা থেকে আমরা "সমাজিকশিক্ষা, "ধর্মশিক্ষা"র
মতন চমৎকার বিষয় গুলো পড়ে এলেও কি শিখেছি এই গুলো থেকে?
সামাজিকশিক্ষা আমাদেরকে শিখিয়েছে কিভাবে কিভাবে পরীক্ষার খাতায় হাতের লিখা দ্রুত করা যায় আর ধর্মশিক্ষা আমাদেরকে শিখিয়েছে আমার ধর্ম কোনটা আর অন্য ধর্মকে কিভাবে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতে হয়।
আর এই দুইটা বিষয়েরই প্রধানতম গুরুত্ত্ব ছিলো ভালো নাম্বার পাওয়ার রাস্তা হিসেবে।
কিন্তু এই সাবজেক্ট গুলো পড়ে আমরা কখনওই শিখতে পারিনি সমাজটা আসলে কি, সামাজিক জীব হিসেবে একজন মানুষের তার সমাজের প্রতি দায়িত্ত্বটা আসলে কি, ধর্ম কেনো এলো,মানুষের জীবনকে ধর্ম যে আবশ্যক দর্শণের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয় তার প্রয়োজনীয়তা কতটা।
শুধু শিক্ষা ব্যবস্থার দোষইবা কেনো দিই, আমরা নিজেরা কি কোনোদিন আমাদের পরিবারের শিশুদেরকে দর্শণের শিক্ষা দিই? অথচ এই দর্শণই মানুষের অনুভুতির সাথে তার বিবেকের বন্ধুত্ব তৈরী করে। একটি মানুষ যেকোনো কাজ তার অনুভুতির দ্বারা চালিত হয়েই করে। সূতরাং মানুষটির বিবেক যদি সর্বদা তার অনুভুতি গুলোর অনুকুলে থাকে, তাহলে মানুষটির পক্ষে কখনই অন্যায় করা সম্ভব নয়। কিন্তু বাস্তবে কি হচ্ছে? যখন একটি শিশুর দাদির কোলে মাথা রেখে রূপকথার গল্প শুনার কথা, বাবা মা'র মাঝখানে শুয়ে মা'র গলা জড়িয়ে ধরার কথা, বাবাকে ঘোড়া বানিয়ে কল্পলোকের রাজকুমার সাজবার কথা তখন শিশুটিকে জিজ্ঞাসা করা হচ্ছে সে আজ কয়টা ইংলিশ ওয়ার্ড শিখলো কিংবা তাকে বলা হচ্ছে, "আজ আমি অনেক ক্লান্ত", "ফাইলগুলো এখনই দেখে ফেলতে হবে", "কাল অফিসে অনেক কাজ, বিরক্ত কোরোনা, তুমি ঘুমাও" ইত্যাদি ইত্যাদি।
কিন্তু এরকম কি হওয়া উচিৎ? হারিয়ে যাবে বলে বাচ্চা গুলোকে আমরা ঘরের বাইরে যেতে মানা করতে পারি, কার না কার সাথে মিশবে এই ভয়তে বাইরের সঙ্গ থেকে তাদেরকে দুরে সরিয়ে রাখতে পারি, তারপরওতো ব্যস্ততাকে কিছুটা দুরে সরিয়ে রেখে ওদের সাথে মন খুলে গল্পটাতো অন্তত কোরতে পারি...
"খুব কঠিন বিষয়" এই অযুহাতে দর্শণের চর্চাকে এড়িয়ে না গিয়ে, আমরাতো নিজেদের দৈনন্দিন ভালো মন্দ ঘটনা গুলোর গল্প ওদেরকে বলতে পারি। নিজেদের ভালো-খারাপ দিক গুলো নিয়ে ওদের সাথে আলাপ করতে পারি। আমাদের যেগুলো খারাপ, সেগুলো কেনো খারাপ এবং কোন সীমাবদ্ধতার কারনে এই খারাপটুকু আমাদেরকে হতে হয়েছে তা ওদেরকে ব্যাখ্যা করতে পারি।
পরিবারের শিশুটির জন্যে ভালো ভালো প্রার্থণা করা অবশ্যই উচিৎ। তবে প্রার্থণার ভলো ভালো বিষয় গুলোকে নিজেরা নিজেদের জীবনে চর্চা করা অতি আবশ্যক কর্তব্য। যদি আমরা তা করতে পারি, তাহলেই আমরা পারবো এই শিশুদের জন্যে একটা সুন্দর পৃথিবী রেখে যেতে।
পৃথিবীর সব শিশুর জন্যে রইলো অনেক অনেক ভালোবাসা।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




