শ্বশুরের পরিবার থেকে পালিয়ে এসে গুলসোমার ঠাই হয়েছে কাবুলের এক এতিমখানায়। সেখানেই ফৃ ল্যান্স ফটোগ্রাফার কেভিন সাইটসের সঙ্গে গুলসোমার পরিচয়। গুলসোমার মুখে তার নারকীয় অভিজ্ঞতার বর্ণনা শুনে আর সবার মতো কেভিনও শিউরে উঠেছিলেন। কেভিনের জবানিতেই শুনুন সেই আফগান বালিকাবধূর করম্নণ কাহিনী।
...গুলসোমার বয়স এখন 12। কিন্তু বয়সের তুলনায় অনেক বেশি পরিণত হয়ে উঠেছে সে। মাত্র চার বছর বয়সে আফগান রীতিতে বধূবেশে ঘোড়ায় চেপে স্বামীর ঘরে যেতে হয়েছিল তাকে। মা ভেবেছিলেন, মেয়েটি তার নেহাতই শিশু। তিনি আশা করেছিলেন, অনত্দত এখনই তার মেয়েকে স্বামীর জৈবিক তৃপ্তির উপকরণ হতে হবে না। কিন্তু শ্বশুর বাড়িতে আসার এক বছরের মধ্যে গুলসোমাকে বুঝিয়ে দেয়া হয়েছিল তার এ অপরিপক্বতার মাশুল তাকে কড়ায় গ-ায় মেটাতে হবে।
পাচ বছর বয়সেই শ্বশুরের পরিবারের 12 সদস্যের প্রত্যেকের দাসীর ভূমিকা নিতে হলো গুলসোমাকে। বিনিময়ে তার গায়ে হাত তুলতে কসুর করতো না কেউ। তবে নির্মমতায় সবচেয়ে এগিয়ে ছিল তার শ্বশুর। কাপড় ধোয়া, ঘর পরিষ্কার করা থেকে শুরম্ন করে ঘরের প্রতিটি কাজ করতে হতো গুলসোমাকেই। সারা দিনের হাড়ভাঙা খাটুনির পর তাকে শুতে হতো ঘরের বাইরে খোলা জায়গায় এক টুকরো কার্পেটের ওপর। গ্রীষ্মকালটা কোনোক্রমে কেটে যেতো। কিন্তু প্রচ- শীতেও তাকে ঘরের বাইরে কম্বল ছাড়াই ঘুমাতে হতো। গুলসোমার কষ্ট দেখে প্রতিবেশীদের কারো দয়া হলে তারাই হয়তো কেউ এসে প্রচ- শীতে কম্পমান গুলসোমার গায়ে একখ- গড়ম কাপড় দিয়ে যেতো। মাঝেমধ্যে সামান্য কিছু খাবার হয়তো জুটতো। কিন্তু ধরা পড়লে তার জন্য জুটতো বাড়তি পিটুনি।
গুলসোমাকে পেটানোর জন্য তার শ্বশুরের প্রিয় অস্ত্র ছিল ইলেক্টৃক তার। বেশিরভাগ ঝড়টা যেতো তার পায়ের ওপর দিয়ে। শ্বশুর তার সনত্দানদের বলতেন _ মেরে ওর পা ভেঙে দাও কিন্তু মুখে মেরো না। পায়ের ৰত লুকানো সহজ, মুখের দাগ মানুষের চোখে পড়ে যেতে পারে। নির্যাতনের বহু নতুন পদ্ধতি তারা আবিষ্কার করেছিল। কখনো গুলসোমাকে হতে হতো মানব টেবিল। তাকে উল্টো করে শুতে বাধ্য করা হতো এবং নগ্ন পিঠের ওপর ছুরি দিয়ে চলতো তরকারি কাটা।
কোনো এক শীতল রাতে প্রতিবেশীদের কেউ হয়তো এসে গুলসোমার গায়ে একটি কম্বল বিছিয়ে দিয়েছিল। এবারের ঘটনাটা তার শ্বশুর কোনোভাবেই মেনে নিতে পারলো না। তাকে নির্মমভাবে পেটানো হলো এবং ছোট্ট একটা খুপড়িতে আটকে রাখা হলো টানা দুই মাস। প্রতি রাতে একবার টয়লেটে যাওয়ার সুযোগ পেতো সে। দিনে খাবার জুটতো একবার। খাবার বলতে শুকনো রম্নটি আর কখনো সেদ্ধ শিম। শ্বশুর এসে মাঝে মধ্যে জানতে চাইতো গুলসোমা এখনো কেন মরছে না।
অবশেষে একদিন গুলসোমার শ্বশুরের ধৈর্যের বাধ ভেঙে গেল। তাকে খুপড়ি থেকে বের করে এনে মারতে মারতে অজ্ঞান করে ফেলা হলো। জ্ঞান ফেরাতে মাথায় আর পিঠে ঢেলে দেয়া হলো ফাস্ক ভর্তি গরম পানি। সে যে কি যন্ত্রণা ... সেই কথা মনে পড়লে এখনো চোখ মোছে গুলসোমা।
পাচ দিন পর বাড়ি থেকে একটা ঘড়ি হারিয়ে গেল। যথারীতি দোষটা গিয়ে পড়লো গুলসোমার ঘাড়ে। আগাপাছতলা পিটিয়ে গুলসোমার ডান হাত আর ডান পায়ের পাতা ভেঙে দেয়ার পর শ্বশুর তাকে জানিয়ে দিল পরদিন সকালের মধ্যে যদি ঘড়ির খোজ না পাওয়া যায় তাহলে গুলসোমাকে স্রেফ খুন করে ফেলা হবে। গুলসোমা বুঝতে পেরেছিল তাকে খুন করতে পারলে তার শ্বশুর খুশিই হবে। বেচে থাকার শেষ চেষ্টা হিসেবে গুলসোমা বাড়ি থেকে পালালো এবং রাসত্দার পাশে এক রিকশার নিচে আশ্রয় নিল।
দয়ালু রিকশাওয়ালা যখন তার রিকশার নিচে গুলসোমাকে আবিষ্কার করলেন, তখনো তার সারা শরীর থেকে রক্ত ঝরছে। তিনি মন দিয়ে গুলসোমার কথা শুনলেন, তারপর পুলিশের কাছে নিয়ে গেলেন। গুলসোমাকে হাসপাতালে ভর্তির করার পর তার শ্বশুর ও স্বামীকে গ্রেফতার করে পুলিশ। শ্বশুর প্রথমটায় গুলসোমাকে মৃগী রোগী বানিয়ে দিতে চাইলেও প্রতিবেশীদের মুখ বন্ধ থাকেনি। ফলে সুযোগ্য পুত্রকে সঙ্গে নিয়ে আপাতত তিনি জেলখানায় দিন গুনছেন।
হাসপাতালে মাসখানেক কাটিয়ে গুলসোমা এখন অনেকটাই সুস্থ। কাবুল এতিমখানাই এখন তার ঠিকানা। সদাহাস্যমুখের গুলসোমা কারো দয়া চায় না। শ্বশুরবাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে সে জেনেছে, এ পৃথিবীর সবাই তার শ্বশুরের মতো অমানুষ নয়। রিকশাওয়ালা, পুলিশ কিংবা ডাক্তারদের ভালো মানুষেরা এ পৃথিবীরই বাসিন্দা। তার মতো আরো অনেক ভাগ্যহত গুলসোমা হয়তো কাবুলের বাড়িতে বাড়িতে নির্যাতন সইতে না পেরে মৃতু্যর জন্য অপেৰা করছে। গুলসোমা তা জানে। তাই সে মানবাধিকার নিয়ে পড়ালেখা করতে চায়। বড় হয়ে সে দাড়াতে চায় আফগানিসত্দানের নির্যাতিত, নিপিড়িত নারীদের পাশে।
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে ডিসেম্বর, ১৯৬৯ সন্ধ্যা ৭:০০

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




