somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

অতঃপর সে (গল্প)

০৬ ই মার্চ, ২০১৩ রাত ১০:৫১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


জানোয়ার গুলো কাছে চলে এসেছে। কিছুক্ষণ আগে একটু দূরে গর্জন শোনা যাচ্ছিল। এখন একদম আজাদের ঘরের দরজার পাশেই। অন্য দরজাগুলো যখন ভেঙে ফেলেছে তখন এটা আর বেশিক্ষণ টিকবে না। আজাদ কাঠের টুকরাটা নিয়ে প্রস্তুত হয়ে দাঁড়ায়। দরজার উপর আঘাত বাড়ছে ক্রমাগত। আজাদের মেরুদণ্ড টান টান, নিঃশ্বাস নিতে ভুলে গেছে ও।

দরজা ভেঙে প্রথমে একটা ভিতরে ঢোকে। ধীরস্থির ভাবেই ঢোকে, যেন কোন তাড়াহুড়া নেই। শরীরটা দেখতে মানুষের মতোই, কিন্তু গরিলার মতো লোমশ, আর মুখটা হায়েনার মতো। মুখে শব্দও করছে হায়েনার মতো। হাতের নখগুলো যেন তরবারির ফলা।

প্রথমটার পিছনে ঢোকে আরেকটা, তারপর আরেকটা, তারপর আরো অনেক। আজাদকে ঘিরে ফেলে চারপাশ থেকে। ঝাপিয়ে পড়ে ওর উপর। আজাদের তীব্র আর্তনাদে চারপাশ ভারি হয়ে ওঠে। নখের আঘাতে এফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে যায় আজাদের বুক। একটা জানোয়ার নখ ধুকিয়ে দেয় চোখ বরাবর, খুলির আরেকপাশ দিয়ে নখটা বেরিয়ে আসে।

একটা চাপা আর্ত শব্দ করে আজাদের ঘুম ভেঙে যায়। প্রচণ্ড জোরে হাঁফাচ্ছে। জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে যেন যথেষ্ট পরিমান অক্সিজেন পাচ্ছে না। এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না যে ওটা স্বপ্ন ছিল। হাত-পা কাঁপছে এখনও। সারা গা ঘামে ভিজে গেছে। পাশে রাখা পানির গ্লাসটা নিয়ে ঢকঢক করে পুরোটা খেয়ে ফেলে। যেন কতকাল ধরে তৃষ্ণার্ত। কাঁপা হাতে সিগারেট ধরালো। মাসখানেক ধরে মাঝে মাঝেই এই দুঃস্বপ্ন দেখছে আজাদ। জানোয়ারগুলো কখনো খাটের তলে থাকে, কখনো বা সামনের চেয়ারটায় চুপচাপ বসে থাকে।

দুই হাত দিয়ে কপালের দুপাশটা চেপে ধরে আজাদ। সেই অসহ্য মাথা যন্ত্রণাটা আবার শুরু হয়েছে।


পরের দিনের সকাল। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর একষট্টি নম্বর সকাল।

বাথরুমের আয়নার সামনে খালি গায়ে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখে আজাদ। একটা শক্তিশালী অবয়ব। নিজের শরীর নিয়ে একটু গর্ব আছে ওর। যুদ্ধের এ নয় মাসেও শরীর খুব একটা খারাপ হয় নি। নিজের হাতদুটোর দিকে তাকায়। স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী। যুদ্ধ শুরুর আগে নিয়মিত ব্যায়াম করত। শখ করে মার্শাল আর্ট শিখত। ব্লাকবেল্ট। যুদ্ধের শুরুর দিকে ট্রেনিং এর সময় আনআর্মড কমব্যাটে এক ইন্ডিয়ান মেজরকে হারিয়ে দিয়েছিল।

গালে মাসখানেকের শেভ না করা দাড়ি। মাধবপুর ফ্রন্টে যুদ্ধের সময় একটা বুলেট ওর গাল ছুঁয়ে যায়, সাথে গালের হাড়ের কিছু অংশ। ব্যাথায় মনে হচ্ছিল গালের চামড়া কেউ ছিলে নিয়ে যাচ্ছে। সেই দাগটা এখনো রয়ে গেছে। একটু দাড়ি রাখলে আর দেখা যায় না। তাই এটুকু দাড়ি রাখা। তার বেশি না।

মিরপুর রোডের পাশে আজাদদের বাড়িটা দেড়তলা। দোতলায় শুধু একটা ঘর আর তার সাথের বাথরুম। বাকিটা ছাদ। এই ঘরটাই এখন আজাদের দখলে। ছোটবেলায় এই ঘরে থাকার জন্যে আজাদের অনেক আগ্রহ ছিল। তখন এটাতে থাকত ছোট চাচা। মঞ্চ নাটকে অভিনয়ের নেশা ছিল লোকটার। প্রচুর পড়াশোনা করতেন। ঘর ভর্তি রাজ্যের বই। রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিম থেকে শুরু করে কবিরাজী, হোমিওপ্যাথী এমনকি ব্ল্যাক ম্যাজিকেরও কিছু বই আছে। যুদ্ধ শেষে আর ফেরেন নি। যা শোনা যাচ্ছে তাতে ফেরার কোন সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না।

কিছুদিন আগে যেদিন আজাদ ওর কিছু জিনিস নিয়ে এই ঘরে ওঠে তখন মা আহত স্বরে বলেছিলেন, 'কবিরের ঘরে উঠছিস কেন? ও এসে দেখলে কষ্ট পাবে। তোর কি ঘরের অভাব পড়েছে?' না, আজাদ কোন জবাব দেয় নি। মাকে কীভাবে বোঝাবে যে যুদ্ধ শেষে সবাই ফিরে আসে না।

আজাদের অনুভূতিগুলো কেমন ভোঁতা হয়ে গেছে। যেন কিছুতেই কিছু এসে যায় না। বিজয়ের খবর পাওয়ার পর কি খুব খুশি হয়েছিল? আজাদ মনে করার চেষ্টা করে।

প্রথমে খবরটা শুনে ও ঠিক বুঝতে পারছিল না। খুব ক্লান্ত লাগছিল। মনে হচ্ছিল সেই অনন্তকাল ধরে পথ পথ চলতে চলতে ক্লান্ত। ধপ করে বসে পড়েছিল সিঁড়িতে। চারপাশে সহযোদ্ধাদের উল্লাস। আজাদ কাঁদতে শুরু করল। প্রথমে নিঃশব্দে, তারপর জোরে, হাউ-মাউ করে, ছোট বাচ্চাদের মতো। কাজল ভাই এগিয়ে এসে শান্ত করার চেষ্টা করছিলেন।

এই নয় মাসে ওর চোখে এক ফোঁটা পানিও দেখে নি কেউ। বরং একটু নিষ্ঠুর হিসেবেই সবাই জানত। যে কয়টা পাকিস্তানী সেনা বা রাজাকারকে ও হাতে পেয়েছিল তাদেরকে নৃশংস ভাবে হত্যা করে আজাদ। এতটাই যে উপর থেকে আজাদের উপর একটু খেয়াল রাখার কথাও বলে দেওয়া হয় ওদের লিডারকে।

আজাদ কাঁদতে থাকে। যেন এক জীবনের সব দুঃখ, সব অভিমান কান্না হয়ে ঝরতে থাকে।


যুদ্ধ শুরুর কয়েকমাস আগেও আজাদের মা পাশের বাসার ভাবীকে বলছিলেন, 'আমার আজাদের মতো ছেলে হয় না। নিজের ছেলে বলে বলছি না, সত্যিই তাই। ওকে মানুষ করতে আমার কোন কষ্ট হয় নি। ছোটবেলা থেকেই শান্ত, ভদ্র। যা বলতাম ঠিক তাই করত। একবার ওকে উঠোনে বসিয়ে রেখে বলেছিলাম যেন কোথাও না যায়, ওখানেই থাকে। এরপর আমি রান্না নিয়ে ব্যস্ত হয়ে আর খেয়াল করি নাই। অনেকক্ষণ পরে দেখি, হায় হায়, ছেলে আমার রোদে পুড়ে। বসার জায়গায় রোদ চলে আসছে তাও ছেলে আমার নড়েনি। জিজ্ঞেস করলে বলল, তুমি যে নড়তে নিষেধ করেছো!'
'বলেন কী!' পাশের বাসার ভাবীর বিস্ময়।
মা তৃপ্তির হাসি হাসেন। এটা আজাদকে নিয়ে মায়ের অনেক পছন্দের একটা গল্প।

আসলেই আজাদ অনেক বেশি ভাল ছেলে ছিল। কোন বাবা-মা তাদের ছেলেকে যতটা পারফেক্ট, যতটা ভালো হিসেবে কল্পনা করতে পারেন, আজাদ ছিল তার চেয়েও ভালো। ক্লাস ফাইভে ট্যালেণ্টপুলে, ক্লাস এইটে ট্যালেণ্টপুলে বৃত্তি, ম্যাট্রিকে বোর্ড স্ট্যান্ড, ইন্টারমিডিয়েটে বোর্ড স্ট্যান্ড এবং সারা পূর্ব পাকিস্তানে তৃতীয়, ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ফিজিক্সে সবগুলো পরীক্ষায় ফার্স্ট! খেলাধুলায় ভালো। মাকে রান্নাঘরে সাহায্য করে, বাবাকে তার কাজে, ছোট বোনকে পড়তে বসায়। পান সিগারেট কিচ্ছু না, এমনকি চা ও না।

বাবা-মায়ের কখনো অবাধ্য না হওয়া এই ছেলেটি ৭১ এর এপ্রিলে এক রাতে কাউকে কিছু না বলে বাড়ি থেকে চলে গেল।

(চলবে)
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কুরসি নাশিন

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৯ শে মে, ২০২৪ সকাল ১১:১৫


সুলতানি বা মোগল আমলে এদেশে মানুষকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছিল৷ আশরাফ ও আতরাফ৷ একমাত্র আশরাফরাই সুলতান বা মোগলদের সাথে উঠতে বসতে পারতেন৷ এই আশরাফ নির্ধারণ করা হতো উপাধি... ...বাকিটুকু পড়ুন

বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন আর আদর্শ কতটুকু বাস্তবায়ন হচ্ছে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৯ শে মে, ২০২৪ সকাল ১১:৩৭

তার বিশেষ কিছু উক্তিঃ

১)বঙ্গবন্ধু বলেছেন, সোনার মানুষ যদি পয়দা করতে পারি আমি দেখে না যেতে পারি, আমার এ দেশ সোনার বাংলা হবেই একদিন ইনশাল্লাহ।
২) স্বাধীনতা বৃথা হয়ে যাবে যদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

কৃষ্ণচূড়া আড্ডার কথা

লিখেছেন নীলসাধু, ১৯ শে মে, ২০২৪ দুপুর ১:০২



গতকাল পূর্ব নির্ধারিত কৃষ্ণচূড়ায় আড্ডায় মিলিত হয়েছিলাম আমরা।
বছরের একটি দিন আমরা গ্রীষ্মের এই ফুলটির প্রতি ভালোবাসা জানিয়ে প্রকৃতির সাথে থাকি। শিশুদের নিয়ে গাছগাছালি দেখা, ফুল লতা পাতা চেনাসহ-... ...বাকিটুকু পড়ুন

সকাতরে ঐ কাঁদিছে সকলে

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৩:২৯

সকাতরে ওই কাঁদিছে সকলে, শোনো শোনো পিতা।

কহো কানে কানে, শুনাও প্রাণে প্রাণে মঙ্গলবারতা।।

ক্ষুদ্র আশা নিয়ে রয়েছে বাঁচিয়ে, সদাই ভাবনা।

যা-কিছু পায় হারায়ে যায়,... ...বাকিটুকু পড়ুন

বসন্ত বিলাসিতা! ফুল বিলাসিতা! ঘ্রাণ বিলাসিতা!

লিখেছেন নাজনীন১, ১৯ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৪:০৯


যদিও আমাদের দেশে বসন্ত এর বর্ণ হলুদ! হলুদ গাঁদা দেখেই পহেলা ফাল্গুন পালন করা হয়।

কিন্তু প্রকৃতিতে বসন্ত আসে আরো পরে! রাধাচূড়া, কৃষ্ণচূড়া এদের হাত ধরে রক্তিম বসন্ত এই বাংলার!

ঠান্ডার দেশগুলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

×